মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গণমানুষের আবেগের ফসল
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এ কে এম জাকারিয়া
প্রথম আলো : আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, ডিসেম্বর মাস আপনার কাছে বিশেষ কী নিয়ে হাজির হয়?
আসাদুজ্জামান নূর : ডিসেম্বর তো অবশ্যই বিশেষ। আসলে আমার কাছে শুরুটা তো বেশ আগে থেকেই। সেই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ঘূর্ণিঝড়, ত্রাণ নিয়ে যাওয়া, সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়া। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ৮ মার্চ আমার নিজের এলাকায় ফিরে আসা, এরপর মুক্তিযুদ্ধের শুরু—এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্য দিয়েই একাত্তরের ডিসেম্বর এসেছে আমাদের জীবনে। এখনো ডিসেম্বর আসে এগুলো নিয়েই। কোনোটিই বাদ দিতে পারি না।
প্রথম আলো : আপনারা কী বিবেচনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর : আসলে প্রথমে আমাদের ভাবনা ছিল বধ্যভূমিগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়। এই চিন্তা থেকে আমরা কুল্লাপাথার বধ্যভূমি পরিদর্শনে যাই। তারপর খুলনার চুকনগরসহ আরও কিছু বধ্যভূমিতে যাই। সেসব দেখার পর আমাদের মনে হয়েছে কাজটি সরকার বা সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। তখন আমরা অন্যভাবে চিন্তাভাবনা করা শুরু করি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখার মতো কোনো উদ্যোগ তখনো ছিল না, অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে ও হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। তখন একটা জাদুঘর গড়ে তোলার ভাবনা নিয়ে আমরা এগোই। আটজনের একটি ট্রাস্টি গঠন করা হয়। আমরা প্রত্যেকে ২৫ হাজার করে টাকা দিই। সেগুনবাগিচার বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়। এটি আক্কু চৌধুরীর বোনের শ্বশুরবাড়ি। সেই পরিবারের লোকজনও আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তাঁরা অনেক কম ভাড়াতেই বাড়িটি আমাদের দিয়েছেন।
প্রথম আলো : আপনাদের এই উদ্যোগের প্রতি সমাজের সাড়া কেমন ছিল?
আসাদুজ্জামান নূর : উদ্যোগ সফল করতে আমরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। সব মহল থেকেই ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব দলের নেতা-কর্মীরা সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। সবাই টাকা দিয়ে সহায়তা করতে পেরেছেন এমন নয়, কিন্তু আমাদের উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যুদ্ধের স্মারক উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রেও আমরা সব পর্যায়ে সহযোগিতা পেতে শুরু করি।
প্রথম আলো : আনুষ্ঠানিক যাত্রা কবে?
আসাদুজ্জামান নূর : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্বোধন হয় ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ। সেগুনবাগিচায় আমরা জাদুঘরের সামনে প্যান্ডেলসহ একটি মঞ্চ করেছিলাম। সেদিন এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল যে আমরা আর সেখানে অনুষ্ঠান করতে পারিনি। জাদুঘরের ভেতরের প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে ভিজতে হয়েছে। পরে যখন সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া শুরু হলো, তখন আমাদের অনেকেরই চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছিল। দর্শক-শ্রোতাদেরও অনেকেই আবেগ সামলাতে পারেননি। এই জাদুঘরের সঙ্গে আমাদের সবার একটি আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। অনেক দেশেই হয়তো ওয়ার মিউজিয়াম আছে, কিন্তু এ ধরনের একটি উদ্যোগ বা জাদুঘর খুব কমই আছে। এ জাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য একটি মন্তব্য খাতা রয়েছে। সেখানে লেখা বিভিন্ন দর্শনার্থীর মন্তব্য পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন এই জাদুঘরকে ঘিরে মানুষের কত গভীর আবেগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কতটা সংরক্ষণ করতে পেরেছি তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে আবেগ রয়েছে, তা এই জাদুঘরের মাধ্যমে ধারণ করা গেছে।
প্রথম আলো : ১৯৭৫ সালের পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার বিষয়টি দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। বরং এসব বিষয় চেপে রাখার উদ্যোগই লক্ষণীয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সূচনা পর্বের যে আবেগের কথা আপনি বললেন, দীর্ঘ সময়ের সেই বদ্ধ পরিস্থিতিই কি মানুষকে এত আবেগাক্রান্ত করেছিল?
আসাদুজ্জামান নূর : বলতে পারেন দীর্ঘ সময় একটি পাথর চাপা দেওয়া ছিল। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার উদ্যোগ নিই, তখন এটা যেন ছিল ঝরনার মুখ থেকে পাথর সরিয়ে দেওয়ার মতো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ সময় আমরা কোনো কথা বলতে পারিনি। টেলিভিশনে একধরনের বিধিনিষেধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক ও অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাধা ছিল। বঙ্গবন্ধু তো তখন বাংলাদেশ টিভিতে কার্যত নিষিদ্ধ। পত্রপত্রিকায়ও বঙ্গবন্ধুর ছবি তেমন ছাপা হতো না। একটা দীর্ঘ সময় আমরা একটি দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি।
প্রথম আলো : আপনারা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ও কাজ শুরু করেছিলেন, তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন কি?
আসাদুজ্জামান নূর : তারা এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায়নি, তবে বাধাও দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ১৯৯৬ সালের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়েছে আর সে বছরই ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু স্মারক জাদুঘরে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগ এবং আজ এ পর্যায়ে আসার পেছনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বড় অবদান রয়েছে। বর্তমানে আমরা সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত অনুদান পাই। এর বাইরেও বিশেষ অনুদান পেয়ে থাকি।
প্রথম আলো : আগারগাঁওয়ে বর্তমানে বৃহত্তর পরিসরে ও নিজস্ব জায়গায় যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির কাজ চলছে, তার শুরুটা কীভাবে? আর বর্তমান অবস্থা কী?
আসাদুজ্জামান নূর : বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা জমির জন্য আবেদন করেছিলাম। নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে জমিটি পেয়েছি। নামমাত্র দামে সরকার আমাদের জমিটি দিয়েছে। এই জাদুঘর বানানোর উদ্যোগের জন্য বড় তহবিলের প্রয়োজন ছিল। জনগণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আমরা কাজটি এগিয়ে নিয়েছি। সাধারণ মানুষ অর্থ জুগিয়েছেন। ধনী ব্যক্তিরা ও বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ভবনের জন্য আমরা নকশা আহ্বান করেছিলাম। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ও একটি কমিটির মাধ্যমে সেই নকশা চূড়ান্ত করা হয়। আগারগাঁওয়ে সেই জাদুঘর তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পথে। এখন গ্যালারি সাজানোর কাজ চলছে। দুজন মার্কিন কিউরেটর কাজ করছেন। আগামী মার্চে উদ্বোধন করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা উদ্বোধনের জন্য তারিখ চেয়েছি।
প্রথম আলো : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি—এসব পরিচয়ের বাইরে আপনি এখন বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী। সেদিন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে আপনি দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সাংস্কৃতিক চর্চার গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো আপনার।
আসাদুজ্জামান নূর : আসলে সংস্কৃতিচর্চা শুরু হয় প্রথমে বাড়ি থেকে, তারপর স্কুল থেকে। এখন আমরা দুই ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আয়-রোজগারের দিকটিই এখন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আমরা অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। শিক্ষার সবকিছু পাঠ্যপুস্তকনির্ভর হয়ে পড়েছে। শিক্ষার মান কমেছে। গ্রামের অনেক স্কুলে শিক্ষকদের মান ভালো নয়। আগে একজন শিক্ষক যে দায়িত্ব নিয়ে একজন ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা ও বিকাশে ভূমিকা রাখতেন, সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। পরিবেশটাই বেশ বদলে গেছে। সংস্কৃতির চর্চা মানে তো শুধু নিজে গান গাওয়া বা অভিনয় করা নয়। গান শোনা বা নাটক দেখাও সংস্কৃতিচর্চার অংশ। স্কুল পর্যায়েই কাজটি করতে হয়। তবে মন্ত্রণালয় হিসেবে সংস্কৃতিচর্চা বাড়াতে নানা পর্যায়ে আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সাংস্কৃতিক অবকাঠামো যথেষ্ট আছে। উপজেলা পর্যায়েও আমরা মুক্তমঞ্চ বা গণগ্রন্থাগার গড়ে তুলছি। ফলে সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে আমাদের নানা উদ্যোগ অব্যাহত আছে।
প্রথম আলো : আপনি পরিবার ও স্কুল পর্যায়ে সমস্যার কথা বললেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতিচর্চা নিশ্চিত করার দায়িত্বটা তো সরকারের।
আসাদুজ্জামান নূর : আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে সংস্কৃতিচর্চা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গান শেখানোর কর্মসূচি বর্তমানে চালু আছে। তা ছাড়া ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যায়ে যাঁরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, আমরা তাঁদের সহায়তা করার চেষ্টা করছি। সরকারের কাঠামোর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা নানাভাবে সম্পৃক্ত করছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই আমরা কাজ করছি। ঢাকায় দেখবেন কত অনুষ্ঠান হচ্ছে। হল খালি পাওয়া যায় না। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে আমরা উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার উদ্যোগ হোক বা জঙ্গিবাদ মোকাবিলার চেষ্টা হোক, সংস্কৃতির চর্চা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রথম আলো : সরকার কি এই দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে? সরকারের নীতির ক্ষেত্রে কি এর প্রতিফলন রয়েছে?
আসাদুজ্জামান নূর : সংস্কৃতিচর্চা বাড়ানোর বিষয়টি সরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এই খাতে বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। নিয়মিত বাজেটের বাইরেও আমরা বরাদ্দ পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর এসব ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ আছে। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবেও খোঁজখবর রাখেন। সংস্কৃতির চর্চা যে বাড়ানো দরকার, তা এখন নতুন করে বেশ আলোচনায় এসেছে। আমার মনে হয়, পাঠ্যক্রমের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আমরা সম্ভবত স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি। ছাত্রছাত্রীরা সময় পাচ্ছে না। তারা যে মনের আনন্দে একটু খেলাধুলা করবে, ছবি আঁকবে, সেই সুযোগগুলো তাদের দিচ্ছি না। পরীক্ষা আর ফলাফলের চাপ তাদের সব সময় কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের সময়ে মনে আছে পরীক্ষার ফলাফলে ভূমিকা না থাকলেও খেলাধুলার ক্লাস হতো, দ্রুত পঠনের ক্লাস হতো। এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
আসাদুজ্জামান নূর : ধন্যবাদ।
প্রথম আলো : আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, ডিসেম্বর মাস আপনার কাছে বিশেষ কী নিয়ে হাজির হয়?
আসাদুজ্জামান নূর : ডিসেম্বর তো অবশ্যই বিশেষ। আসলে আমার কাছে শুরুটা তো বেশ আগে থেকেই। সেই ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, ঘূর্ণিঝড়, ত্রাণ নিয়ে যাওয়া, সংসদ অধিবেশন বাতিল হওয়া। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ৮ মার্চ আমার নিজের এলাকায় ফিরে আসা, এরপর মুক্তিযুদ্ধের শুরু—এসব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার মধ্য দিয়েই একাত্তরের ডিসেম্বর এসেছে আমাদের জীবনে। এখনো ডিসেম্বর আসে এগুলো নিয়েই। কোনোটিই বাদ দিতে পারি না।
প্রথম আলো : আপনারা কী বিবেচনা থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছিলেন?
আসাদুজ্জামান নূর : আসলে প্রথমে আমাদের ভাবনা ছিল বধ্যভূমিগুলো কীভাবে সংরক্ষণ করা যায়। এই চিন্তা থেকে আমরা কুল্লাপাথার বধ্যভূমি পরিদর্শনে যাই। তারপর খুলনার চুকনগরসহ আরও কিছু বধ্যভূমিতে যাই। সেসব দেখার পর আমাদের মনে হয়েছে কাজটি সরকার বা সরকারি উদ্যোগ ছাড়া সম্ভব নয়। তখন আমরা অন্যভাবে চিন্তাভাবনা করা শুরু করি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখার মতো কোনো উদ্যোগ তখনো ছিল না, অনেক কিছু নষ্ট হয়ে গেছে ও হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে। তখন একটা জাদুঘর গড়ে তোলার ভাবনা নিয়ে আমরা এগোই। আটজনের একটি ট্রাস্টি গঠন করা হয়। আমরা প্রত্যেকে ২৫ হাজার করে টাকা দিই। সেগুনবাগিচার বাড়িটি ভাড়া নেওয়া হয়। এটি আক্কু চৌধুরীর বোনের শ্বশুরবাড়ি। সেই পরিবারের লোকজনও আমাদের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। তাঁরা অনেক কম ভাড়াতেই বাড়িটি আমাদের দিয়েছেন।
প্রথম আলো : আপনাদের এই উদ্যোগের প্রতি সমাজের সাড়া কেমন ছিল?
আসাদুজ্জামান নূর : উদ্যোগ সফল করতে আমরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছি। সব মহল থেকেই ব্যাপক সাড়া পেয়েছি। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সব দলের নেতা-কর্মীরা সহায়তা করার চেষ্টা করেছেন। সবাই টাকা দিয়ে সহায়তা করতে পেরেছেন এমন নয়, কিন্তু আমাদের উদ্যোগের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যুদ্ধের স্মারক উপাদান সংগ্রহের ক্ষেত্রেও আমরা সব পর্যায়ে সহযোগিতা পেতে শুরু করি।
প্রথম আলো : আনুষ্ঠানিক যাত্রা কবে?
আসাদুজ্জামান নূর : মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্বোধন হয় ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ। সেগুনবাগিচায় আমরা জাদুঘরের সামনে প্যান্ডেলসহ একটি মঞ্চ করেছিলাম। সেদিন এমন বৃষ্টি শুরু হয়েছিল যে আমরা আর সেখানে অনুষ্ঠান করতে পারিনি। জাদুঘরের ভেতরের প্রাঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে সবাইকে ভিজতে হয়েছে। পরে যখন সন্জীদা খাতুনের নেতৃত্বে আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ গাওয়া শুরু হলো, তখন আমাদের অনেকেরই চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছিল। দর্শক-শ্রোতাদেরও অনেকেই আবেগ সামলাতে পারেননি। এই জাদুঘরের সঙ্গে আমাদের সবার একটি আবেগের সম্পর্ক রয়েছে। অনেক দেশেই হয়তো ওয়ার মিউজিয়াম আছে, কিন্তু এ ধরনের একটি উদ্যোগ বা জাদুঘর খুব কমই আছে। এ জাদুঘরে দর্শনার্থীদের জন্য একটি মন্তব্য খাতা রয়েছে। সেখানে লেখা বিভিন্ন দর্শনার্থীর মন্তব্য পড়লে আপনি বুঝতে পারবেন এই জাদুঘরকে ঘিরে মানুষের কত গভীর আবেগ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মাধ্যমে আমরা আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কতটা সংরক্ষণ করতে পেরেছি তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে যে আবেগ রয়েছে, তা এই জাদুঘরের মাধ্যমে ধারণ করা গেছে।
প্রথম আলো : ১৯৭৫ সালের পর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা বা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসচর্চার বিষয়টি দীর্ঘ সময় রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। বরং এসব বিষয় চেপে রাখার উদ্যোগই লক্ষণীয় ছিল। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সূচনা পর্বের যে আবেগের কথা আপনি বললেন, দীর্ঘ সময়ের সেই বদ্ধ পরিস্থিতিই কি মানুষকে এত আবেগাক্রান্ত করেছিল?
আসাদুজ্জামান নূর : বলতে পারেন দীর্ঘ সময় একটি পাথর চাপা দেওয়া ছিল। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর করার উদ্যোগ নিই, তখন এটা যেন ছিল ঝরনার মুখ থেকে পাথর সরিয়ে দেওয়ার মতো। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে দীর্ঘ সময় আমরা কোনো কথা বলতে পারিনি। টেলিভিশনে একধরনের বিধিনিষেধ ছিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নাটক ও অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাধা ছিল। বঙ্গবন্ধু তো তখন বাংলাদেশ টিভিতে কার্যত নিষিদ্ধ। পত্রপত্রিকায়ও বঙ্গবন্ধুর ছবি তেমন ছাপা হতো না। একটা দীর্ঘ সময় আমরা একটি দমবন্ধ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছি।
প্রথম আলো : আপনারা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগ নিয়েছিলেন ও কাজ শুরু করেছিলেন, তখন ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। তখন সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন কি?
আসাদুজ্জামান নূর : তারা এ ব্যাপারে কোনো উৎসাহ দেখায়নি, তবে বাধাও দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ১৯৯৬ সালের মার্চে আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়েছে আর সে বছরই ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সে সময়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বেশ কিছু স্মারক জাদুঘরে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের উদ্যোগ এবং আজ এ পর্যায়ে আসার পেছনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর বড় অবদান রয়েছে। বর্তমানে আমরা সরকারের কাছ থেকে নিয়মিত অনুদান পাই। এর বাইরেও বিশেষ অনুদান পেয়ে থাকি।
প্রথম আলো : আগারগাঁওয়ে বর্তমানে বৃহত্তর পরিসরে ও নিজস্ব জায়গায় যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তৈরির কাজ চলছে, তার শুরুটা কীভাবে? আর বর্তমান অবস্থা কী?
আসাদুজ্জামান নূর : বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা জমির জন্য আবেদন করেছিলাম। নানা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারের আমলে জমিটি পেয়েছি। নামমাত্র দামে সরকার আমাদের জমিটি দিয়েছে। এই জাদুঘর বানানোর উদ্যোগের জন্য বড় তহবিলের প্রয়োজন ছিল। জনগণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় আমরা কাজটি এগিয়ে নিয়েছি। সাধারণ মানুষ অর্থ জুগিয়েছেন। ধনী ব্যক্তিরা ও বিভিন্ন বড় বড় প্রতিষ্ঠান আর্থিক সহায়তা দিয়েছে। ভবনের জন্য আমরা নকশা আহ্বান করেছিলাম। প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ও একটি কমিটির মাধ্যমে সেই নকশা চূড়ান্ত করা হয়। আগারগাঁওয়ে সেই জাদুঘর তৈরির কাজ শেষ হওয়ার পথে। এখন গ্যালারি সাজানোর কাজ চলছে। দুজন মার্কিন কিউরেটর কাজ করছেন। আগামী মার্চে উদ্বোধন করার চিন্তাভাবনা রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমরা উদ্বোধনের জন্য তারিখ চেয়েছি।
প্রথম আলো : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি—এসব পরিচয়ের বাইরে আপনি এখন বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী। সেদিন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে আপনি দেশে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা জঙ্গিবাদ মোকাবিলায় সাংস্কৃতিক চর্চার গুরুত্বের কথা বলেছিলেন। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো আপনার।
আসাদুজ্জামান নূর : আসলে সংস্কৃতিচর্চা শুরু হয় প্রথমে বাড়ি থেকে, তারপর স্কুল থেকে। এখন আমরা দুই ক্ষেত্রেই সমস্যা দেখতে পাচ্ছি। সামগ্রিকভাবে মূল্যবোধের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আয়-রোজগারের দিকটিই এখন বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। আমরা অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছি। শিক্ষার সবকিছু পাঠ্যপুস্তকনির্ভর হয়ে পড়েছে। শিক্ষার মান কমেছে। গ্রামের অনেক স্কুলে শিক্ষকদের মান ভালো নয়। আগে একজন শিক্ষক যে দায়িত্ব নিয়ে একজন ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনা ও বিকাশে ভূমিকা রাখতেন, সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। পরিবেশটাই বেশ বদলে গেছে। সংস্কৃতির চর্চা মানে তো শুধু নিজে গান গাওয়া বা অভিনয় করা নয়। গান শোনা বা নাটক দেখাও সংস্কৃতিচর্চার অংশ। স্কুল পর্যায়েই কাজটি করতে হয়। তবে মন্ত্রণালয় হিসেবে সংস্কৃতিচর্চা বাড়াতে নানা পর্যায়ে আমরা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। সাংস্কৃতিক অবকাঠামো যথেষ্ট আছে। উপজেলা পর্যায়েও আমরা মুক্তমঞ্চ বা গণগ্রন্থাগার গড়ে তুলছি। ফলে সংস্কৃতির চর্চা বাড়াতে আমাদের নানা উদ্যোগ অব্যাহত আছে।
প্রথম আলো : আপনি পরিবার ও স্কুল পর্যায়ে সমস্যার কথা বললেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্কৃতিচর্চা নিশ্চিত করার দায়িত্বটা তো সরকারের।
আসাদুজ্জামান নূর : আমরা বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রাথমিক শিক্ষা পর্যায়ে সংস্কৃতিচর্চা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিয়ে চিন্তাভাবনা চলছে। শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গান শেখানোর কর্মসূচি বর্তমানে চালু আছে। তা ছাড়া ব্যক্তি ও সংগঠন পর্যায়ে যাঁরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত, আমরা তাঁদের সহায়তা করার চেষ্টা করছি। সরকারের কাঠামোর বাইরেও অনেক প্রতিষ্ঠানকে আমরা নানাভাবে সম্পৃক্ত করছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, এ ধরনের অনেক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই আমরা কাজ করছি। ঢাকায় দেখবেন কত অনুষ্ঠান হচ্ছে। হল খালি পাওয়া যায় না। ঢাকার বাইরে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে আমরা উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে রাখার উদ্যোগ হোক বা জঙ্গিবাদ মোকাবিলার চেষ্টা হোক, সংস্কৃতির চর্চা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
প্রথম আলো : সরকার কি এই দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে? সরকারের নীতির ক্ষেত্রে কি এর প্রতিফলন রয়েছে?
আসাদুজ্জামান নূর : সংস্কৃতিচর্চা বাড়ানোর বিষয়টি সরকার খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। এই খাতে বাজেট বাড়ানো হচ্ছে। নিয়মিত বাজেটের বাইরেও আমরা বরাদ্দ পাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর এসব ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ আছে। তাঁরা ব্যক্তিগতভাবেও খোঁজখবর রাখেন। সংস্কৃতির চর্চা যে বাড়ানো দরকার, তা এখন নতুন করে বেশ আলোচনায় এসেছে। আমার মনে হয়, পাঠ্যক্রমের দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আমরা সম্ভবত স্কুল পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেশি বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছি। ছাত্রছাত্রীরা সময় পাচ্ছে না। তারা যে মনের আনন্দে একটু খেলাধুলা করবে, ছবি আঁকবে, সেই সুযোগগুলো তাদের দিচ্ছি না। পরীক্ষা আর ফলাফলের চাপ তাদের সব সময় কেড়ে নিচ্ছে। আমাদের সময়ে মনে আছে পরীক্ষার ফলাফলে ভূমিকা না থাকলেও খেলাধুলার ক্লাস হতো, দ্রুত পঠনের ক্লাস হতো। এসব নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে।
প্রথম আলো : আপনাকে ধন্যবাদ।
আসাদুজ্জামান নূর : ধন্যবাদ।
No comments