দুই স্বাধীনতা—একটা তুলনামূলক বিচার
১৯৭১ সালের ২৪ বছর আগে ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের কলোনি ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যায়। একই সঙ্গে দেশটিকে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দুই ভাগ করে দিয়ে যায়। দুটি দেশ হলো ভারত ও পাকিস্তান। আমরা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলাম। তখনো বুঝিনি যে আমরা নতুন করে আবার পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলাম। আমাদের নতুন শোষকেরা তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত, যারা তখনকার পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানকে কলোনির মতো মনে করেছিল।
অল্প সময়ের মধ্যেই আমাদের উপলব্ধি হলো এবং শুরু হলো পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম। নানা পর্যায় অতিক্রম করে ১৯৭১ সালে মহান সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছিলাম সেই স্বাধীনতা। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে সেই বিজয় অর্জিত হয়েছিল। অন্যদিকে ভারতের স্বাধীনতা এসেছিল ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের মধ্যরজনীতে। যদিও একই সঙ্গে দেশটি আর অখণ্ড থাকেনি। ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট (ভারতের স্বাধীনতা দিবস) এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর (বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের বিজয় দিবস)—এ দুই দিনের মধ্যকার পার্থক্যটি কেমন ছিল, তা আলোচনার দাবি রাখে। ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে এক চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন তদানীন্তন বোম্বে ক্রনিক্যাল-এর সম্পাদক ও বিখ্যাত লেখক ডি এফ কারাকার তাঁর একটি বইয়ে। বইটি ইংরেজিতে লেখা। বইয়ের শিরোনাম দ্য বিট্রেয়াল অব ইন্ডিয়া। ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্টের মধ্যরজনীতে তিনি ছিলেন বোম্বে শহরে। উৎসবমুখর বোম্বে শহর। ২০০ বছর পর দেশটি স্বাধীন হচ্ছে। আনন্দ, উচ্ছ্বাস ও উৎসব তো থাকবেই। কারাকার ছিলেন বোম্বের এক অভিজাত হোটেলে। সেখানে প্রচুর খানাপিনা ও উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল। সেই আয়োজনের মধ্যে ছিলেন বোম্বের ইংরেজ শাসক শ্বেতাঙ্গ গভর্নর। আরও ছিলেন স্থানীয় কংগ্রেস নেতারা এবং কালো চামড়ার গণ্যমান্য ভারতীয়রা।
তাঁদের মধ্যে জওহরলাল নেহরুর বোন কৃষ্ণা হাতিসিংহও ছিলেন। ঠিক মধ্যরজনীতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা নামল এবং বিপুল করতালির মধ্যে ভারতের তিন রঙের পতাকা উত্তোলিত হলো। উপস্থিত সাদা ও কালো-বাদামি চামড়ার মানুষেরা পরস্পরকে অভিনন্দিত করল। আলিঙ্গন করল। ডি এফ কারাকার লিখেছেন, ‘দুই শ বর্ষের ইতিহাস কি আমরা এভাবে ভুলে যাব? শাসক-শাসিতের সম্পর্কের, প্রভু-দাসের সম্পর্কের সত্যিই অবসান হলো মাত্র এক রাতের মধ্যে?’ তুলনা করুন ১৯৪৭ সালের মধ্য আগস্টের বোম্বের সঙ্গে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের ঢাকার। ঢাকায় আমরা সেদিন শত্রুর সঙ্গে আলিঙ্গন তো দূরের কথা, হাত পর্যন্ত মিলাইনি। আগের দিন পর্যন্ত আমরা পরস্পরের দিকে বন্দুক তাক করে ছিলাম। এমনকি ১৬ ডিসেম্বরের সকালেও ঢাকায় পাকিস্তানি দস্যুদের গুলিতে মানুষ মারা গেছে। এ রকম একটি জানা ঘটনার কথা আমি বিবৃত করতে চাই। ঘটনাটি ঘটেছিল আমারই পরিবারে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভয়াবহ গণহত্যার পর ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে আমি, আমার ছোট ভাই হায়দার আনোয়ার খান জুনো, কাজী জাফর আহমদ, রাশেদ খান মেনন প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক ও লেখক জহির রায়হানের দেওয়া গাড়িতে করে ঢাকা ত্যাগ করি। জহির রায়হান তাঁর গাড়িটি আমাদের দিয়েছিলেন, যদি তা যুদ্ধের জন্য কোনো কাজে লাগে।
আমরা গিয়েছিলাম নরসিংদী জেলার শিবপুরে। সেখানে পরবর্তী সময়ে মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে বিশাল গেরিলা ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল। কদিন পর আমার মা–বাবাও শিবপুরে চলে আসেন। ডিসেম্বর মাসের দিকে মা-বাবা ও আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী ঢাকায় ফিরে আসেন। আমার খালাতো বোন ড. আয়েশা চৌধুরী ডোরা ঢাকায় ছিলেন নয় মাস, কিন্তু গোপনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করতেন। ১৬ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পেয়ে ডা. ডোরা গাড়িতে করে বেরিয়ে পড়েন। তাঁর গাড়িতে করে আমার মা-বাবা ও আমার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী চপলও রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। ডোরার কণ্ঠে ছিল ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি। সেই সময় বঙ্গবন্ধুর পরিবার (বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, ড. ওয়াজেদ) ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডে একটা একতলা বাসায় পাকিস্তানি বাহিনীর পাহারাধীনে বন্দী ছিল। শুনেছি একাত্তরের নয় মাসে কেউ ওই রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করত না। কারণ বাড়ির ছাদে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর বাংকার। পাকিস্তানি বাহিনীর একটা ইউনিটও ছিল। আমার মা-বাবা ও বোন ডা. ডোরা ভেবেছিলেন, দেশ তো এখন স্বাধীন, এখন নিশ্চয়ই ওই রাস্তায় যাওয়া যায়। সম্ভবত তাঁরা বঙ্গবন্ধুর পরিবার কেমন আছে, সেটা জানতে আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর অন্যরা সারেন্ডার করলেও ধানমন্ডির ১৮ নম্বর রোডের ওই বাড়িটিতে অবস্থিত ইউনিটটি আত্মসমর্পণ করেছিল এক দিন পরে। মা-বাবা ও বোনের গাড়িটি বাড়িটির সামনে যেতেই পাকিস্তানি ইউনিট গুলি করে।
একটি গুলিতে তৎক্ষণাৎ মারা যান আমার বোন ডা. আয়েশা চৌধুরী ডোরা। আরেকটি গুলিতে মারা যান গাড়ির ড্রাইভার। একটি গুলি আমার ছোট ভাই জুনোর স্ত্রী মাহবুবা রশিদা চপলের মাথা ছুঁয়ে আমার মায়ের হাতের মধ্য দিয়ে ডা. ডোরাকে আঘাত করেছিল। মা ও চপলের রক্তক্ষরণ হলেও তাঁরা মারা যাননি। পরে শুনেছি, শেখ হাসিনা ও তাঁর মহীয়সী মা দুজনেই গুলিবিদ্ধ গাড়ির আরোহীদের উদ্ধারের চেষ্টা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের দিকে রাইফেল উঁচিয়ে ধরেছিল। সেদিন ঢাকার রাস্তায় আরও অনেকে হতাহত হয়েছেন। ঘটনাটির একটু বিস্তারিত বর্ণনা দিলাম এটা বলার জন্য যে আমরা শত্রুর সঙ্গে করমর্দন করে স্বাধীনতা পাইনি। হ্যাঁ, ভারতের স্বাধীনতাও এসেছিল বহু লোকের শহীদ হওয়ার মধ্য দিয়ে। কিন্তু শেষ পর্যায়ে স্বাধীনতাটা এসেছিল আপসের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে। তার সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের ঘটনাটি একেবারেই ভিন্ন। আবার ফিরে যাই কারাকারের বইটিতে। তিনি বলছেন, ভোর চারটার দিকে তিনি হোটেল থেকে বের হয়ে বোম্বের পথে নামলেন। পথের দুই ধারে ভিক্ষুকেরা দল বেঁধে বসে আছে। কারাকার লিখছেন, ২০০ বছর পর এই স্বাধীনতার তাৎপর্য কী ওই ভিক্ষুকদের কাছে? তারপর তিনিই উত্তর দিচ্ছেন, ভিক্ষুকেরা জানে যে আজকে এমন এক উৎসবের দিন, যেদিন বেশি ভিক্ষা পাওয়া যাবে। অর্থাৎ, লেখক বলতে চেয়েছেন,
ভিক্ষুক বা নিম্ন শ্রেণির মানুষের কাছে স্বাধীনতা এর চেয়ে বেশি অর্থবহ হয়ে আসেনি। কিন্তু ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় ভিক্ষুকসহ সব মানুষ জানত এই স্বাধীনতার মানে কী? প্রথমত, অবরুদ্ধ জীবনের অবসান এবং মুক্ত বাতাসে নিশ্বাস নেওয়ার স্বাদ। আরও বেশি। রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, তা সব মানুষের জন্য সত্যিই অর্থবহ হয়ে উঠবে, এমন ধারণা করেছিল দেশের সব মানুষ। সশস্ত্র সংগ্রামের উত্তাপ থাকতে থাকতেই যে সংবিধান রচিত হলো, তাতে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে ঘোষিত হলো সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা। আজ সাড়ে চার দশক পর যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন একটা বড় দীর্ঘশ্বাস পড়ে। লাখ লাখ মানুষ শহীদ হয়েছেন যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে, সেই আকাঙ্ক্ষা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং সশস্ত্র যুদ্ধের যে অঙ্গীকার ছিল, তা আমরা ভুলে গেছি। গণতন্ত্র নির্বাসিত। সমাজতন্ত্রের বদলে চলছে নিকৃষ্ট ধরনের লুটেরা পুঁজিবাদ, যে কেবল ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য বাড়াচ্ছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে বাণিজ্যিক উপাদানে পরিণত করা হয়েছে। আর ধর্মনিরপেক্ষতা? জিয়াউর রহমান ওই শব্দটাকে ছেঁটে ফেলে দিলেও পরবর্তী সময়ে তা সংবিধানে সংযোজিত হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম রেখে দিলে ধর্মনিরপেক্ষতার কতটুকু অবশিষ্ট থাকে? উপরন্তু মৌলবাদের উৎপাত, পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের ঘোরাফেরা এবং ধর্মীয় ও জাতীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকে কি আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা বলতে পারি না? ডি এফ কারাকার লিখেছিলেন বিট্রেয়াল অব ইন্ডিয়া—ভারতের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিবৃত্ত। আমাদের কেউ কি লিখবেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস—কেন, কীভাবে, কে, কবে এই বিশ্বাসঘাতকতা করল, যা এখনো অব্যাহত আছে?
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments