টেকসই উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে হবে
বিনিয়োগের নিম্ন হার এখন পৃথিবীর অর্থনীতিতে বড় হতাশার কারণ। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের আগের বছরগুলোতে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে গৃহায়ণ ও ব্যক্তিগত ভোগ ব্যয়। কিন্তু সংকট শুরু হওয়ার পর এই দুই ধরনের ব্যয়ই কমে যায়। এটা বাড়ানোর জন্য যে বিনিয়োগ করা দরকার ছিল, তা কখনোই হয়নি। এই অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে। সংকটের পর দেখা গেল, বিশ্বের প্রধান কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো সুদের হার কমিয়ে দিয়ে ব্যয় ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর চেষ্টা করল। এই কৌশল কিছুমাত্রায় কাজও করেছে। তখন নীতিপ্রণেতারা পুঁজিবাজারে প্রচুর তারল্য সরবরাহ করে ও সুদের হার কমিয়ে রেখে বিনিয়োগকারীদের উৎসাহ দেন, যাতে তাঁরা স্টক ও বন্ডের মূল্য বাড়িয়ে দেন। এতে বিনিয়োগ থেকে কিছু মুনাফা হয়, যার কারণে আর্থিক সম্পদ সৃষ্টি হয়। বাজারে আইপিও ছাড়া হয়। এতে বিনিয়োগও কিছুটা বাড়ে।
কোম্পানির ঋণ-ইক্যুইটির অনুপাত বেড়ে গেছে। আবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ঋণের রাশ টেনে ধরবে, তখন সম্পদের মূল্য ব্যাপক হারে কমে যাবে। মুদ্রানীতি দিয়ে অনেক কিছু করার চেষ্টা করা হয়েছে। ব্যাপরাটা এমন হয়েছে যে অধিক ব্যবহারের কারণে এটা অনেকটা তেতো হয়ে গেছে। কিন্তু উচ্চগতির রেল, সড়ক, নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী জ্বালানি, নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ হয়নি। বাজেটের কৃচ্ছ্রসাধনের কারণে সরকারি বিনিয়োগ কমেছে। অন্যদিকে সরকারি নীতি ও আন্তর্জাতিক রাজস্ব সংগ্রহের ব্যাপারে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা থাকায় উচ্চ আয়ের দেশগুলোতে এসব খাতের ব্যয় কমেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উচ্চগতির রেল ও অন্যান্য আধুনিক অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলেও তাঁর আট বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রে এক কিলোমিটারও লাইন নির্মাণ হয়নি। সময় এসেছে, এখন কথাকে কাজে পরিণত করতে হবে, শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, সব জায়গাতেই। আমাদের এখন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। এটা করতে গেলে তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে: সঠিক প্রকল্প চিহ্নিত করা; উন্নত পরিকল্পনা প্রণয়ন, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতই যুক্ত থাকবে (কখনো একাধিক দেশ) ও অর্থায়নের কাঠামো প্রণয়ন। সফল হতে হলে সরকারকে কার্যকরভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে, একই সঙ্গে ঠিকঠাক বাজেট প্রণয়ন ও প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। গত ২০ বছরে চীন এই সক্ষমতা দেখিয়েছে, যদিও সে বড় রকমের পরিবেশ দূষণ করেছে। কিন্তু ইউরোপ ও আমেরিকা থমকে গেছে। কথা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দরিদ্র দেশগুলোকে বলেছে,
তারা যেন এই চেষ্টাও না করে। তবে এখন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজি) ও প্যারিস ক্লাইমেট অ্যাগ্রিমেন্ট হওয়ার কারণে সরকারগুলোর সুবিধা হয়েছে। এতে তাদের পক্ষে সঠিক প্রকল্প প্রণয়ন করা সহজ হবে। পৃথিবীতে এখন নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী জ্বালানিব্যবস্থায় প্রচুর বিনিয়োগ করা দরকার। একই সঙ্গে তাকে নতুন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বন্ধ করতে হবে। ইলেকট্রিক যানবাহন তৈরিতে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। আর অভ্যন্তরীণ দহন হয়, এমন ইঞ্জিন উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। ওদিকে উন্নয়নশীল পৃথিবীর যেসব শহরে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে, সেখানে পানি ও স্যানিটেশন খাতে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। নিম্ন আয়ের দেশগুলোকে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে নজর দিতে হবে। এশিয়াকে ইউরোপের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য চীন যে ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড প্রকল্প হাতে নিয়েছে, তাতে উল্লিখিত লক্ষ্যগুলো অর্জন করা সহজ হবে। ধারণা করা যায়, নিম্ন কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্য নিয়েই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এই উদ্যোগের কারণে ভূমিবেষ্টিত ইউরেশিয়ার দেশগুলোতে কর্মসংস্থান বাড়বে, সঙ্গে বাড়বে ব্যয় ও প্রবৃদ্ধি। এর ফলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া ও চীনের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যুক্ত হবে। আফ্রিকাতেও জরুরি ভিত্তিতে এমন একটি কর্মসূচি দরকার। যদিও আফ্রিকার দেশগুলো বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ খাতে অগ্রাধিকার দিচ্ছে, নতুন বিনিয়োগ না হলে অগ্রগতির হার কমে যাবে। আফ্রিকার দেশগুলোর বার্ষিক সম্মিলিত শিক্ষা ব্যয় কয়েক শ কোটি ডলার বাড়ানো উচিত। এর সঙ্গে তাদের সম্মিলিত অবকাঠামো ব্যয় বছরে অন্তত ১০ হাজার কোটি ডলার বাড়াতে হবে। চীন, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে দীর্ঘ মেয়াদে নিম্ন সুদের ঋণ নিয়ে এসব করতে হবে। এর সঙ্গে তাদের দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় থেকে টাকা নিতে হবে, যেমন তারা পেনশন–ব্যবস্থা চালু করতে পারে। ওদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের নতুন অবকাঠামো নির্মাণে বড় বিনিয়োগ করতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সর্বশেষ বড় অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে সেই ১৯৭০-এর দশকে,
ন্যাশনাল হাইওয়ে সিস্টেম। তাদের উচিত হবে, নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী শক্তি, উচ্চগতির রেল ও ইলেকট্রিক যানবাহনে বিনিয়োগ করা। এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করার জন্য বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের বড় তহবিল করা উচিত, যাতে তারা বিদ্যমান নিম্ন সুদের হারে ঋণ দিতে পারে। অন্যদিকে বিভিন্ন দেশের সরকারকে কার্বন কর বাড়াতে হবে। এই টাকা দিয়ে তার উচিত হবে, নিম্ন কার্বন নিঃসরণকারী বিদ্যুৎ–ব্যবস্থা গড়ে তোলা। বৈশ্বিক করব্যবস্থার ফাঁকফোকরগুলো ভরাট করতে হবে। এর মাধ্যমে বছরে বৈশ্বিক রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি ডলার বাড়াতে হবে। দরিদ্রতম দেশগুলোতে এই বিনিয়োগ আসবে সরকারের উন্নয়ন বাজেট থেকে। ফলে তাদের সামরিক ব্যয় কমানো উচিত। একই সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ এবং নতুন পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। দেশে দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘাঁটি বন্ধ করতে হবে। সহযোগিতা ও কূটনীতির মাধ্যমে মার্কিন-চীন অস্ত্র প্রতিযোগিতার রাশ টানতে হবে। এতে যে টাকাটা বাঁচবে, সেটা স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও যুদ্ধবিধ্বস্ত দরিদ্র দেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করা যায়। কথা হচ্ছে, টেকসই উন্নয়ন স্রেফ ইচ্ছা বা স্লোগান নয়। বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ও উচ্চ কর্মসংস্থানের জন্য এটাই একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ। সময় হয়েছে, এতে মনোযোগ দিতে হবে, বিনিয়োগ করতে হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জেফরি ডি স্যাক্স: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জেফরি ডি স্যাক্স: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।
No comments