সর্বজনীন নাগরিক পেনশন
দেশে মৌসুমি বাজেট আলোচনা শেষ হলো। সাধারণ মানুষের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাজেটে করহার বৃদ্ধির যে প্রস্তাব পাস হলো তা নিয়ে মূলত বেশি মাত্রায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বর্তমান আলোচনার বিষয় একটু ভিন্ন। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি ভিন্নভাবে উল্লিখিত হলেও এটি নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। কিন্তু জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের আলোকে বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমে একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে—এ দেশে যে ১০-১২ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে আয়কর দিয়ে থাকেন, সেই আয়কর দেওয়ার পেছনে তাঁদের ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রণোদনা কী? যদি শুধু নিবর্তনমূলক একটি ব্যবস্থার মাধ্যমে বাধ্যবাধকতাই কর আদায়ের মূল ভিত্তি হয়, তাহলে করদাতার সংখ্যা বৃদ্ধি ও করের পরিমাণ বৃদ্ধি একটা জায়গায় চিরদিনই আটকে থাকবে। করদাতাদের করের বিনিময়ে রাষ্ট্র কী সেবা-সহায়তা নিশ্চিত করছে বা করদাতার কর দেওয়ার পেছনে অন্য কোনো প্রণোদনা সৃষ্টি করা যায় কি না, রাষ্ট্রকে তা ভাবতে হবে। সে বিষয়ে সামান্য আলোকপাত এই নিবন্ধের অবতারণা।
করদাতাদের কাছে তাঁর কর দেওয়ার সুফল অনুভব করার কিছু বিষয় মূর্তমান বা দৃশ্যমান করতে হবে। সাধারণ করদাতাকে রাষ্ট্র স্বাভাবিক নিয়মে চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা এবং কর্ম শেষে পেনশনের ব্যবস্থা করতে পারে। একজন করদাতা ও তাঁর পরিবারের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিয়মমাফিক চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে। প্রত্যেক করদাতাকে বিশেষ একটি স্বাস্থ্যকার্ড দিয়ে, বিশেষ কোনো সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে এবং অনুরূপভাবে করদাতাদের সন্তানদের জন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির অগ্রাধিকার থাকতে পারে। অবশ্যই ন্যূনতম যোগ্যতা ব্যতিরেকে নয়। ন্যূনতম যোগ্যতার নিরিখে তা নির্ধারিত হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বাইরে তৃতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা ও মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার বর্তমান মাহেন্দ্রক্ষণে যা বিচার্য, তা হচ্ছে করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন–ব্যবস্থার একটি উত্তম সংযোগ সাধন। কারণ সরকারি চাকরির বাইরে যাঁরা অন্য কোনো জীবিকায় নিয়োজিত এবং নিয়মিত আয়কর দিয়ে থাকেন, তাঁরা তাঁদের ষাটোর্ধ্ব বয়সে জীবনের বাকি দিনগুলোর জন্য কার ওপর নির্ভর করবেন, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল-২০১৬তে বিষয়টি নিয়ে কিছু চিন্তা–ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কখন, কীভাবে জীবন চক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তায় সর্বজনীন নাগরিক পেনশন অন্তর্ভুক্ত হবে, সে বিষয়টি স্বচ্ছ করা হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে, তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই।
সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালু করতে হলে অনেক রকমের প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। একদিকে ব্যবস্থাপনা, অপর দিকে অর্থসংস্থান। এখন শুধু সরকারি কর্মচারীদের পেনশন দেওয়া হয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ৩০ লাখ দরিদ্র বয়স্ক পুরুষ-নারীকে ৫০০ টাকা হারে আমৃত্যু বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদির দায়দায়িত্ব তাঁদের নিয়োগদাতাদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত বিমার কথাও ভাবা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের ফলে বিষয়টি একীভূত ও সর্বজনীন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না। বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র হওয়ার পর প্রত্যেক নাগরিক এখন একটি বিশেষ নম্বর পাচ্ছেন। একইভাবে ১৮ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সের প্রত্যেক নাগরিক একটি সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মনিবন্ধন নম্বর লাভ করবেন। তিনি আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বা স্বনিয়োজিত যা-ই হোন না কেন, তাঁর আয় অনুযায়ী কর আওতার অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাঁর প্রদত্ত করের একটি অংশ ১, ২ বা ৩ শতাংশ তাঁর পেনশনের প্রিমিয়াম হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে এবং নির্দিষ্ট বয়সের পর ওই নিবন্ধিত ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় পেনশন পাবেন। এভাবে রাষ্ট্রের নিজস্ব পেনশন তহবিল গড়ে উঠবে। রাষ্ট্র সেটি বিনিয়োগ করতে পারবে। প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য যে ঋণ করা হয় তার প্রয়োজন হবে না।
করদাতাদের কাছে তাঁর কর দেওয়ার সুফল অনুভব করার কিছু বিষয় মূর্তমান বা দৃশ্যমান করতে হবে। সাধারণ করদাতাকে রাষ্ট্র স্বাভাবিক নিয়মে চিকিৎসা, সন্তানের শিক্ষা এবং কর্ম শেষে পেনশনের ব্যবস্থা করতে পারে। একজন করদাতা ও তাঁর পরিবারের জন্য সরকারি হাসপাতালগুলোতে নিয়মমাফিক চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেওয়া যেতে পারে। প্রত্যেক করদাতাকে বিশেষ একটি স্বাস্থ্যকার্ড দিয়ে, বিশেষ কোনো সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া যেতে পারে এবং অনুরূপভাবে করদাতাদের সন্তানদের জন্য সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির অগ্রাধিকার থাকতে পারে। অবশ্যই ন্যূনতম যোগ্যতা ব্যতিরেকে নয়। ন্যূনতম যোগ্যতার নিরিখে তা নির্ধারিত হবে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বাইরে তৃতীয় যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তা ও মধ্যম আয়ের দেশের পর্যায়ে উন্নীত হওয়ার বর্তমান মাহেন্দ্রক্ষণে যা বিচার্য, তা হচ্ছে করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন–ব্যবস্থার একটি উত্তম সংযোগ সাধন। কারণ সরকারি চাকরির বাইরে যাঁরা অন্য কোনো জীবিকায় নিয়োজিত এবং নিয়মিত আয়কর দিয়ে থাকেন, তাঁরা তাঁদের ষাটোর্ধ্ব বয়সে জীবনের বাকি দিনগুলোর জন্য কার ওপর নির্ভর করবেন, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল-২০১৬তে বিষয়টি নিয়ে কিছু চিন্তা–ভাবনা রয়েছে। কিন্তু কখন, কীভাবে জীবন চক্রভিত্তিক সামাজিক নিরাপত্তায় সর্বজনীন নাগরিক পেনশন অন্তর্ভুক্ত হবে, সে বিষয়টি স্বচ্ছ করা হয়নি। বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে, তবে বিস্তারিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই।
সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালু করতে হলে অনেক রকমের প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে। একদিকে ব্যবস্থাপনা, অপর দিকে অর্থসংস্থান। এখন শুধু সরকারি কর্মচারীদের পেনশন দেওয়া হয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রমের আওতায় প্রায় ৩০ লাখ দরিদ্র বয়স্ক পুরুষ-নারীকে ৫০০ টাকা হারে আমৃত্যু বয়স্ক ভাতা দেওয়া হচ্ছে। বেসরকারি চাকরিজীবীদের পেনশন, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদির দায়দায়িত্ব তাঁদের নিয়োগদাতাদের ওপরই চাপিয়ে দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা চলছে। এ ক্ষেত্রে বেসরকারি চাকরিজীবীদের জন্য বিশেষ রাষ্ট্রীয় গ্যারান্টিযুক্ত বিমার কথাও ভাবা হচ্ছে। এসব পদক্ষেপের ফলে বিষয়টি একীভূত ও সর্বজনীন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাবে না। বাংলাদেশে জাতীয় পরিচয়পত্র হওয়ার পর প্রত্যেক নাগরিক এখন একটি বিশেষ নম্বর পাচ্ছেন। একইভাবে ১৮ বছরের ঊর্ধ্ব বয়সের প্রত্যেক নাগরিক একটি সামাজিক নিরাপত্তা ও কর্মনিবন্ধন নম্বর লাভ করবেন। তিনি আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বা স্বনিয়োজিত যা-ই হোন না কেন, তাঁর আয় অনুযায়ী কর আওতার অন্তর্ভুক্ত হবেন। তাঁর প্রদত্ত করের একটি অংশ ১, ২ বা ৩ শতাংশ তাঁর পেনশনের প্রিমিয়াম হিসেবে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জমা হবে এবং নির্দিষ্ট বয়সের পর ওই নিবন্ধিত ব্যক্তি রাষ্ট্রীয় পেনশন পাবেন। এভাবে রাষ্ট্রের নিজস্ব পেনশন তহবিল গড়ে উঠবে। রাষ্ট্র সেটি বিনিয়োগ করতে পারবে। প্রতিবছর বাজেট ঘাটতি মেটানোর জন্য যে ঋণ করা হয় তার প্রয়োজন হবে না।
আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, পেনশন সবই সাধারণ করদাতার অর্থে সংস্থান করা হয়। এ বিষয়ে তাই ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন এবং দেশের সরকারি-বেসরকারি সব কর্মজীবীরই পেনশনের অধিকার রয়েছে। এই অধিকার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া এখনই শুরু করা প্রয়োজন এবং প্রয়োজন সার্বিক পেনশনব্যবস্থা সুষমকরণ। এমন অনেক বেসরকারি চাকরিজীবী বা স্বনিয়োজিত কিংবা উদ্যোক্তা রয়েছেন, যিনি ৩০-৩৫ বছর কর দিয়েছেন কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে তাঁর নিজের চিকিৎসাসহ দৈনন্দিন জীবনযাপন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করলে বর্তমানে প্রদত্ত করব্যবস্থার সঙ্গে তাঁদের পেনশনব্যবস্থার সংযোগ স্থাপন করে এ অনিশ্চয়তার অবসান ঘটানো সম্ভব। করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন ও স্বাস্থ্য বা চিকিৎসার একটি কার্যকর সংযোগ স্থাপন সম্ভব হলে দেশে করদাতার সংখ্যা বহুগুণে বৃদ্ধি পাবে। অন্তত এ রকম একটি পদক্ষেপের কথা ভাবা যেতে পারে। যাঁরা ২০১৮ সালের আগের ১০ বছর নিয়মিতভাবে আয়কর দিয়েছেন এবং ২০১৮ সালে ৬০ বছর বয়স অতিক্রম করেছেন, তাঁদের প্রদত্ত করের আনুপাতিক হারে বাকি জীবনের জন্য অবসরভাতা দেওয়া যেতে পারে। চালু করা যেতে পারে করদাতা সিনিয়র সিটিজেনদের জন্য বিশেষ স্বাস্থ্য কার্ড, যা তাঁদের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে অগ্রাধিকারভিত্তিক চিকিৎসার সুযোগ প্রদান করবে এবং বেসরকারি হাসপাতালে বিশেষ কিছু মূল্যছাড় দেবে। এটি একটি নাগরিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি কর্মে নিয়োজিত যেকোনো একজন নাগরিক যিনি সমাজ ও রাষ্ট্র তাঁর কর্মক্ষম থাকাকালে যথাযথ অবদান রাখবেন, বৃদ্ধ বয়সে কর্মক্ষমতা হারিয়ে জরা ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ার পর রাষ্ট্র তাঁকে অরক্ষিত অবস্থায় ছেড়ে দিতে পারে না। তাই কর্মক্ষম থাকার সময় থেকেই তাঁরই করের অর্থে তাঁর দেখভালের দায়িত্ব রাষ্ট্রকে গ্রহণ করার জন্য অবসর ভাতা ও চিকিৎসার নিশ্চয়তা দেওয়ার একটি বাস্তব চিন্তা–ভাবনা রাষ্ট্রকে করতে আহ্বান জানাই। এটি রাষ্ট্রকে মানবিক করবে এবং কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের দিকে দীর্ঘ পথযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে গণ্য হবে।
ড. তোফায়েল আহমেদ: সহ-আহ্বায়ক, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা ফোরাম ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
ড. তোফায়েল আহমেদ: সহ-আহ্বায়ক, জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা ফোরাম ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।
No comments