ছেঁড়া তার, অপঘাত, দালান-রহস্য
ঈদের কয়েক দিন আগের ঘটনা। তখন ঈদ উপলক্ষে বাজার রমরমা। রংবেরঙের বাতি জ্বলছে। অসংখ্য যুবক-যুবতী, শিশু, বৃদ্ধ এস্কেলেটরে উঠছে-নামছে। এর মধ্যেই বিকট একটা শব্দ। সেই সঙ্গে আলো নিভে গেল, কাচগুলো ভেঙে পড়ছে। অন্ধকারে আত্মরক্ষার জন্য ছোটাছুটি, সুপারমার্কেট থেকে বেরোনোর জন্য আকুতি। মানুষের আর্তনাদ, চিৎকার। এস্কেলেটরগুলো বন্ধ। আলো নেই। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো মার্কেট। জানা গেল লিফট ছিঁড়ে ইতিমধ্যেই ছয়জন নিহত, আহত বেশুমার। এসব নতুন কিছু নয়। প্রতিনিয়তই চলছে আমাদের দেশে। প্রাণের মূল্য এ দেশে সবচেয়ে কম। বিদেশি লিফটে একটা সার্টিফিকেট টাঙানো থাকে: লিফটটিতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন আছে অত তারিখ পর্যন্ত। বাড়ির মালিককে সেই তারিখের আগেই অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। এখানে সেসবের বালাই নেই। আগে লিফটগুলোতে একজন করে লিফটম্যান থাকত, এখন অধিকাংশ লিফট স্বয়ংক্রিয়।যেখানে বেশি লোক ওঠানামা করে সেখানকার লিফটের কর্মক্ষমতাও দেখা প্রয়োজন।
যেকোনো পশ্চিমা দেশে বা প্রাচ্যের উন্নত দেশগুলোতে দালান পরিদর্শকের একটি মূল্যবান পদ থাকে। এই পদে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা কাজ করেন। এই দালান পরিদর্শকের ক্ষমতা অনেক। পরীক্ষা করে যদি তিনি কোনো দালানে লিফট, পয়োনিষ্কাশন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বা আপত্কালীন বেরোনোর পথে কোথাও কোনো ঝামেলা দেখেন, তাহলে অবিলম্বে দালানটি বাসের অযোগ্য বলে নোটিশ দিয়ে বসবাসকারীদের জানিয়ে দেবেন। তারপর দ্রুত দালানটিতে সিলগালা লাগিয়ে দেবেন। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা নিলে কত যে সিলগালা লাগত, তার হিসাব নেই। এ দায়িত্ব কি রাজউকের, সে সংস্থা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে? নাকি সিটি করপোরেশনের? জানি না এ কার দায়িত্বে পড়বে! এই যে কত মানবসন্তানের অপঘাতে মৃত্যু হচ্ছে শুধু কিছু মানুষের অবহেলায়, তার দায় কে নেবে? এই সংগত প্রশ্নের জবাবই বা কে দেবে? যে সুপারমার্কেটে লিফট ছেঁড়ার ঘটনা ঘটেছে সেখানে আগেও লিফটে ঝামেলা হয়েছে। কে মালিক এত বড় শপিং কমপ্লেক্সের?
যেকোনো পশ্চিমা দেশে বা প্রাচ্যের উন্নত দেশগুলোতে দালান পরিদর্শকের একটি মূল্যবান পদ থাকে। এই পদে অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা কাজ করেন। এই দালান পরিদর্শকের ক্ষমতা অনেক। পরীক্ষা করে যদি তিনি কোনো দালানে লিফট, পয়োনিষ্কাশন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বা আপত্কালীন বেরোনোর পথে কোথাও কোনো ঝামেলা দেখেন, তাহলে অবিলম্বে দালানটি বাসের অযোগ্য বলে নোটিশ দিয়ে বসবাসকারীদের জানিয়ে দেবেন। তারপর দ্রুত দালানটিতে সিলগালা লাগিয়ে দেবেন। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা নিলে কত যে সিলগালা লাগত, তার হিসাব নেই। এ দায়িত্ব কি রাজউকের, সে সংস্থা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছে? নাকি সিটি করপোরেশনের? জানি না এ কার দায়িত্বে পড়বে! এই যে কত মানবসন্তানের অপঘাতে মৃত্যু হচ্ছে শুধু কিছু মানুষের অবহেলায়, তার দায় কে নেবে? এই সংগত প্রশ্নের জবাবই বা কে দেবে? যে সুপারমার্কেটে লিফট ছেঁড়ার ঘটনা ঘটেছে সেখানে আগেও লিফটে ঝামেলা হয়েছে। কে মালিক এত বড় শপিং কমপ্লেক্সের?
তাঁর বিরুদ্ধে সরকার কী ব্যবস্থা নিল, তাও আমরা জানি না। দালান-ঝুঁকিতে রয়েছে লাখ মানুষ। মাঝারি ভূকম্পনেই ঝুরঝুর করে পড়বে ওই সব স্থাপনা। সাম্প্রতিক এক ভূমিকম্পে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান দালান সচিবালয়ের কর্মকর্তারা ভয়াবহ বর্ণনা দিয়েছেন তাঁদের অভিজ্ঞতার। কিন্তু ওই সব ক্ষমতাধর ব্যক্তি এসব অপঘাতে মৃত্যুর বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিচ্ছেন? জবাব মেলে না। ফিরে আসি লিফট দুর্ঘটনার কথায়। লিফটের প্রযুক্তিগত দিকগুলো এখনো আমাদের প্রকৌশলীদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে কি? লিফটের সবকিছুই বিদেশ থেকে আনা। হাজার হাজার লিফট প্রতিদিন ব্যবহৃত হচ্ছে। দুর্ঘটনায় নিরাপত্তাব্যবস্থা লিফটে নিশ্চয়ই থাকে। সেই ব্যবস্থাটি কি লিফট রপ্তানিকারক কোম্পানির কাছ থেকে আমদানিকারক সঠিকভাবে বুঝে নেয়? লিফট ছেঁড়ার দৃশ্যত কোনো কারণ নেই। তবু ছিঁড়ে যায়, মানুষ মারা যায়। তবে কি গোড়ায় কোনো গলদ আছে? উন্নত দেশগুলোতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ লিফট লাগানোর পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে থাকে এবং বছর বছর পরীক্ষা করে নিরীক্ষাপত্র দিয়ে থাকে। কোনো কোনো লিফট বিকল হয় এবং দুর্ঘটনার বড় কারণ অতি ব্যবহার ও অতিরিক্ত যাত্রীধারণ। বিদ্যুতের ঘাটতি থাকাতে প্রায়ই লিফট আটকে যায়।
আজকাল কিছু কিছু জায়গায় জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে বটে। কখনো দেখেছি জেনারেটরে তেমন কেউ নেই অথবা জেনারেটর চালানোর লোকটি কোথাও গেছে। সেদিন একটি দালানের সাততলায় উঠেছি, বিদ্যুৎ চলে গেল। জেনারেটর নেই। কেউ কেউ হেঁটেই নিচে নামলাম, কিন্তু লিফটে আটকে থাকা লোকগুলোর কী হবে? অত্যন্ত আদিম উপায়ে তাদের নামানো হবে। অর্ধেক তলায় লিফট আটকে গেছে, দরজা খুলে লাফিয়ে নিচে নামবে যাত্রীরা। যদি তার মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা থাকেন তাহলে কী হবে? জেনারেটর ছাড়া যে লিফট ব্যবহার করা যাবে না, এই বিধান কি কোথাও আছে? যদি থাকে তাহলে তার প্রয়োগের প্রক্রিয়া কী? সেখানেও অদ্ভুত আঁধার! যেসব লিফটে একজন করে লিফটম্যান আছেন, তাঁরাও কতটা প্রশিক্ষিত? দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করার কৌশল কি তাঁদের জানা আছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে আনকোরা অদক্ষ লোকেরাই এখানে কাজ করে থাকে। কিন্তু কন্ট্রোলে যাঁরা আছেন তাঁরাই–বা কতটা জানেন? এর আগেও শুনেছি লিফট কাত হয়ে গেছে, সবাই হয়তো মারা যাননি, যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা হয়তো জীবনে লিফট ব্যবহার করবেন না।
দিন দিন আকাশচুম্বী অট্টালিকার সংখ্যা বাড়ছে। আবাসিক দালানগুলোও তিরিশ-পঁয়ত্রিশ তলা হতে শুরু করেছে। সেখানে লিফট ব্যবহার অত্যাবশ্যক। এসব জায়গায় লিফট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাসিন্দাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দালানটি কতটুকু বাসযোগ্য, কোথাও ফাটল ধরছে না, এসব দিকেও সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন। কাত হওয়া দালানেও দেখা যায় মানুষ বসবাস করে চলেছে। বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। আগামী এক যুগ পরে দিগন্তরেখায় নীল-সবুজ দেখা যাবে কি না সন্দেহ। হাট-বাজার, দালানকোঠায় ভরে যাচ্ছে শ্যামল বাংলাদেশ। ঢাকা শহরেও এখন দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দালান। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটেও শুরু হয়েছে প্রবলভাবে। যা হচ্ছে তা অপ্রতিরোধ্য কিন্তু দালান নির্মাণের আইনকানুনের প্রয়োগ দেখা যায় না। দুর্নীতির সুযোগ থাকায় কোনো আইনি বাধ্যবাধকতাও কাজ করে না। শহরে উল্টো দিক থেকে গাড়ি চালালেও তার শাস্তি হয় না। নাগরিক সচেতনতা এ ক্ষেত্রে এত কম যে কেউ বাধাও দিচ্ছে না। উত্তরায় লিফটে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা জানানোর সবচেয়ে বড় উপায় সমাজে সর্বোচ্চ সচেতনতা সৃষ্টি করা, আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
আজকাল কিছু কিছু জায়গায় জেনারেটরের ব্যবস্থা আছে বটে। কখনো দেখেছি জেনারেটরে তেমন কেউ নেই অথবা জেনারেটর চালানোর লোকটি কোথাও গেছে। সেদিন একটি দালানের সাততলায় উঠেছি, বিদ্যুৎ চলে গেল। জেনারেটর নেই। কেউ কেউ হেঁটেই নিচে নামলাম, কিন্তু লিফটে আটকে থাকা লোকগুলোর কী হবে? অত্যন্ত আদিম উপায়ে তাদের নামানো হবে। অর্ধেক তলায় লিফট আটকে গেছে, দরজা খুলে লাফিয়ে নিচে নামবে যাত্রীরা। যদি তার মধ্যে শিশু, বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধা থাকেন তাহলে কী হবে? জেনারেটর ছাড়া যে লিফট ব্যবহার করা যাবে না, এই বিধান কি কোথাও আছে? যদি থাকে তাহলে তার প্রয়োগের প্রক্রিয়া কী? সেখানেও অদ্ভুত আঁধার! যেসব লিফটে একজন করে লিফটম্যান আছেন, তাঁরাও কতটা প্রশিক্ষিত? দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা করার কৌশল কি তাঁদের জানা আছে? অধিকাংশ ক্ষেত্রে আনকোরা অদক্ষ লোকেরাই এখানে কাজ করে থাকে। কিন্তু কন্ট্রোলে যাঁরা আছেন তাঁরাই–বা কতটা জানেন? এর আগেও শুনেছি লিফট কাত হয়ে গেছে, সবাই হয়তো মারা যাননি, যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁরা হয়তো জীবনে লিফট ব্যবহার করবেন না।
দিন দিন আকাশচুম্বী অট্টালিকার সংখ্যা বাড়ছে। আবাসিক দালানগুলোও তিরিশ-পঁয়ত্রিশ তলা হতে শুরু করেছে। সেখানে লিফট ব্যবহার অত্যাবশ্যক। এসব জায়গায় লিফট ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাসিন্দাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে দালানটি কতটুকু বাসযোগ্য, কোথাও ফাটল ধরছে না, এসব দিকেও সার্বক্ষণিক নজরদারি প্রয়োজন। কাত হওয়া দালানেও দেখা যায় মানুষ বসবাস করে চলেছে। বাংলাদেশে দ্রুত নগরায়ণ হচ্ছে। আগামী এক যুগ পরে দিগন্তরেখায় নীল-সবুজ দেখা যাবে কি না সন্দেহ। হাট-বাজার, দালানকোঠায় ভরে যাচ্ছে শ্যামল বাংলাদেশ। ঢাকা শহরেও এখন দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দালান। চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেটেও শুরু হয়েছে প্রবলভাবে। যা হচ্ছে তা অপ্রতিরোধ্য কিন্তু দালান নির্মাণের আইনকানুনের প্রয়োগ দেখা যায় না। দুর্নীতির সুযোগ থাকায় কোনো আইনি বাধ্যবাধকতাও কাজ করে না। শহরে উল্টো দিক থেকে গাড়ি চালালেও তার শাস্তি হয় না। নাগরিক সচেতনতা এ ক্ষেত্রে এত কম যে কেউ বাধাও দিচ্ছে না। উত্তরায় লিফটে নিহত ব্যক্তিদের প্রতি শ্রদ্ধা ও আহত ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা জানানোর সবচেয়ে বড় উপায় সমাজে সর্বোচ্চ সচেতনতা সৃষ্টি করা, আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ করা।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব।
No comments