বাংলাদেশে সন্ত্রাসের প্রকৃত উৎস by উইলিয়াম বি. মাইলাম
গত
সপ্তাহে বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে একজন বৌদ্ধ ভিক্ষু খুন হয়েছেন, সম্ভবত
চাপাতির আঘাতে। এর আগের সপ্তাহে উত্তরাঞ্চলে খুন হয়েছেন একজন সুফি মুসলিম
নেতা। দুই সপ্তাহের কম সময় আগে খুন হয়েছেন একজন এলজিবিটি কর্মী। তার মাত্র
একদিন আগে খুনের শিকার হন ইংরেজি বিষয়ের একজন অধ্যাপক। এসব হামলার বেশ
কয়েকটির দায় এখনও কেউ স্বীকার করেনি। তবে হত্যার ধরন বীভৎস। ২০১৫ সালের
ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে অন্তত ২৫টি সহিংস হত্যাকান্ড
ঘটেছে। এসব হত্যাকা- অনেক সময়ই ঘটেছে জনসম্মুখে। এর শিকার ধর্মীয়
সংখ্যালঘু, ধর্মনিরপেক্ষ ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার স্বপক্ষের মানুষ। আরো
কয়েকজনের ওপর একই কায়দায় হামলা চালানো হয়েছে এবং তারা বেঁচে গিয়েছেন। এসব
হামলার মধ্যে ২০টিরও বেশির দায় স্বীকার করেছে আইএস। গোটা ছয়েকের দায়
স্বীকার করেছে আল কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা। একটি করে হামলার দায়
স্বীকার করেছে বাংলাদেশের স্থানীয় চরমপন্থি দল জেএমবি ও আনসার আল ইসলাম।
বাংলাদেশের এসব হামলা বৃদ্ধি পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তারা আশঙ্কা করছে যে, স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হয়তো এখন আন্তর্জাতিক জিহাদি নেটওয়ার্কের মনোযোগ আকর্ষণ করতে অথবা তারা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে এটা দেখাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে এর জবাব দিয়েছে। জাপান আকাশপথের নিরাপত্তা দিচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থাকে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহায়তা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন প্রতিক্রিয়া হবে এটা আগেই অনুমানযোগ্য। কিন্তু এটি ভুলপথে পরিচালিত হয়েছে এবং এটা বিপজ্জনক। এর মূলে হলো, কারণ নির্ধারণ করা হয়েছে ভুলভাবে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এসব হত্যাকা-ের ঘটনা যতটা না সন্ত্রাসী ইস্যু, তারচেয়ে বেশি সুশাসন বিষয়ক। সেটা হলোÑ ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে প্রচ- আক্রমণ শুরু করেছে, সেটাই বাংলাদেশে চরমপন্থাকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৯১ সালে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসানের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাজ করছে জিরো-সাম মানসিকতা। তখন থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রতিটি ক্ষমতার মেয়াদে ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। প্রতিবার যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের মনোযোগ ছিল নিজেদের সমৃদ্ধ করা এবং বিরোধীদের দুর্বল করার দিকে। এতে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সামাজিক সেবা, যেগুলো সরকার দেয়নি, তা দিয়েছে এনজিওগুলো। এক হিসাবে সরকারের নিজের কিছু কাজে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা দেশটির জন্য অনেকাংশে ভালোই হয়েছে। গত দুই দশক ধরে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে গড়ে বছরে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্রম-অবনতি ঘটেছে।
২০০৬ সালের শেষের দিকে তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি ২০০৭ সালের নির্বাচন নিয়ে কারসাজি করার চেষ্টা করলে বড় ধরনের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সময়ের জন্য সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে নির্বাচনে ভোট পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ এবং ২০১১ সালের তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারা সংবিধান থেকে অপসারণ করে। অনেকটা ওই সংশোধনীর প্রতিবাদেই বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে এবং তখন থেকেই একদলীয় ও নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি পরিণত হয়েছে সরকারের তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল, প্রকৃতপক্ষে একমাত্র টার্গেট। আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সুশীল সমাজে এই দলটির সঙ্গে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিচার বিভাগ ও পুলিশকে ব্যবহার করে আসছে। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ীÑ সরকার গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-কে ব্যবহার করে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে আসছে। যেসব সাংবাদিক এগুলোর যেকোনো একটি নিয়েও কাজ করার সাহস দেখিয়েছেন, তাদের মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অবিরাম প্রচারণায় সব ধরনের সহিংস কট্টরপন্থিরা শিথিল পরিবেশ পেয়েছে। বিএনপি ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে সীমিত বিচারিক ও পুলিশি শক্তি ব্যবহারের দিকে রাষ্ট্রের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়েছে। যে সম্পদ বা রিসোর্স দিয়ে সন্ত্রাস ও অপরাধ প্রতিরোধ করা যেতো এতে তা খর্ব হচ্ছে। বিরোধীদের দমনে যে অবৈধ পন্থা ব্যবহার করা হচ্ছে তা আইনের শাসনকে খর্ব করছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে দায়মুক্তির একটি পরিবেশ, যা সন্ত্রাসকেই উৎসাহিত করে।
চাপাতির কোপে প্রথম নিহত হন একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার। এটা ঘটে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের আগে। যেমনটা আপনি একটি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করেন আওয়ামী লীগ তেমনই প্রতিক্রিয়া দেখায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অফিস থেকে বেরিয়ে নিহতের পরিবারের কাছে গিয়ে শোক প্রকাশ করেন। অপরাধীদের ধরার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। কিন্তু দলটি আবার নির্বাচিত হওয়ার পর একই ধরনের অন্য হামলাগুলোর বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া হলো কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া।
নিহতের পরিবারের প্রতি আওয়ামী লীগের নেতারা সম্মান জানিয়েছেন কিনা তা পরিষ্কার নয়। একই সময়ে আল কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট অথবা ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশে উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেছেন এ দলের নেতারা। বিএনপি ও তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর অবশিষ্ট যা আছে, তারা বাংলাদেশে সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করছেন তারা। এলজিবিটি অধিকারকর্মী ও মার্কিন দূতাবাসের কর্মী জুলহাজ মান্নানকে হত্যার পর, কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অভিযোগ আবারও উত্থাপন করেছেন।
সরকারের আরো ক্ষতিকর দিক হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় অটল না থাকা। সেপ্টেম্বরে হিন্দুদের এক উৎসবের প্রাক্কালে শেখ হাসিনা হিন্দু নেতাদের একটি গ্রুপকে বলেছেন, যার যার নিজস্ব ধর্ম চর্চার অধিকার আছে। তবে অন্যের ধর্মী অনুভূতিতে আঘাত করার অধিকার নেই। বাংলা নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে তিনি আবারও ইসলামের সমালোচনাকারী ব্লগারদের লেখাকে অকথ্য শব্দ বলে আখ্যায়িত করেন। এ সময় তিনি প্রশ্ন রাখেন যদি এসব লেখার কারণে কোনো অঘটন ঘটে তাহলে কেন এর দায় সরকারের নেয়া উচিত। এর ফলে যারা ইসলামের শত্রু বলে বিবেচিত তাদের ওপর হামলার জন্য উগ্রপন্থিরা একে একটি ‘ফ্রি পাস’ হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে কট্টরপন্থি গ্রুপগুলোর একটি ইতিহাস আছে। এর মধ্যে অনেকে রয়েছে আফগান যুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে, যেখানে কিছু বাংলাদেশি যুদ্ধ করেছে। আর কিছু হচ্ছে ওহাবী প্রভাবের উৎপাদ। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে কাজ শেষে ফেরার সময় তারা এই প্রভাব বহন করে এনেছেন দেশে। কিন্তু গত বছর ধারাবাহিক হামলা শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশে সর্বশেষ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে ২০০৫ সালে। সেই হামলা চালিয়েছে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে এখন যে ধরনের সন্ত্রাসী হুমকি বিরাজ করছে, বিশেষ করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলোর মধ্যে যে যোগসূত্র, তার সঙ্গে আগের ওই হামলার ব্যবধান রয়েছে। যেমনভাবেই এটা করা হোক, মূলধারার ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সরকারের দমনপীড়নের ফলেই এর বেশির ভাগ ঘটছে। নীতিগতভাবে এটা সুশাসনের সমস্যার চেয়ে নীতিগতভাবে একটি নিরাপত্তার ইস্যু। এসব হামলার এই প্রতিক্রিয়ায় ঘটনা ক্রমশ খারাপের দিকে যাবে।
(উইলিয়াম বি. মাইলাম। ওয়াশিংটনে উডরো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র পলিসি বিষয়ক স্কলার। তিনি এর আগে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
১৯শে মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘দ্য রিয়েল সোর্স অব টেরর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ)
বাংলাদেশের এসব হামলা বৃদ্ধি পশ্চিমা বিশ্বের সরকারগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলছে। তারা আশঙ্কা করছে যে, স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হয়তো এখন আন্তর্জাতিক জিহাদি নেটওয়ার্কের মনোযোগ আকর্ষণ করতে অথবা তারা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করছে এটা দেখাতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। বেশ কয়েকটি পশ্চিমা দেশ সন্ত্রাসবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে এর জবাব দিয়েছে। জাপান আকাশপথের নিরাপত্তা দিচ্ছে, সন্ত্রাসবাদ ও সহিংস চরমপন্থাকে মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সহায়তা জোরদারের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এমন প্রতিক্রিয়া হবে এটা আগেই অনুমানযোগ্য। কিন্তু এটি ভুলপথে পরিচালিত হয়েছে এবং এটা বিপজ্জনক। এর মূলে হলো, কারণ নির্ধারণ করা হয়েছে ভুলভাবে। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক এসব হত্যাকা-ের ঘটনা যতটা না সন্ত্রাসী ইস্যু, তারচেয়ে বেশি সুশাসন বিষয়ক। সেটা হলোÑ ২০১৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনের পর ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যে প্রচ- আক্রমণ শুরু করেছে, সেটাই বাংলাদেশে চরমপন্থাকে ছড়িয়ে দিয়েছে।
১৯৯১ সালে সামরিক স্বৈরতন্ত্রের অবসানের পর থেকেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিরাজ করছে জিরো-সাম মানসিকতা। তখন থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি ও আওয়ামী লীগ প্রতিটি ক্ষমতার মেয়াদে ক্ষমতা প্রদর্শন করেছে। প্রতিবার যারাই ক্ষমতায় এসেছে, তাদের মনোযোগ ছিল নিজেদের সমৃদ্ধ করা এবং বিরোধীদের দুর্বল করার দিকে। এতে অর্থনৈতিক সম্প্রসারণের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সামাজিক সেবা, যেগুলো সরকার দেয়নি, তা দিয়েছে এনজিওগুলো। এক হিসাবে সরকারের নিজের কিছু কাজে দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা দেশটির জন্য অনেকাংশে ভালোই হয়েছে। গত দুই দশক ধরে দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বেড়ে গড়ে বছরে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হয়েছে। স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষার মতো সামাজিক উন্নয়ন সূচকে ভারত ও পাকিস্তানকে পিছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ক্রম-অবনতি ঘটেছে।
২০০৬ সালের শেষের দিকে তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি ২০০৭ সালের নির্বাচন নিয়ে কারসাজি করার চেষ্টা করলে বড় ধরনের বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কিছু সময়ের জন্য সামরিক বাহিনী ক্ষমতা নিয়ে নেয়। ২০০৯ সালে নির্বাচনে ভোট পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে আওয়ামী লীগ এবং ২০১১ সালের তাদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ব্যবহার করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ধারা সংবিধান থেকে অপসারণ করে। অনেকটা ওই সংশোধনীর প্রতিবাদেই বিএনপি ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করে এবং তখন থেকেই একদলীয় ও নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিএনপি পরিণত হয়েছে সরকারের তথাকথিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মূল, প্রকৃতপক্ষে একমাত্র টার্গেট। আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সুশীল সমাজে এই দলটির সঙ্গে ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত বিচার বিভাগ ও পুলিশকে ব্যবহার করে আসছে। বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে সন্দেহজনক দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্য অনুযায়ীÑ সরকার গুম, নির্যাতন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-কে ব্যবহার করে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে আসছে। যেসব সাংবাদিক এগুলোর যেকোনো একটি নিয়েও কাজ করার সাহস দেখিয়েছেন, তাদের মানহানি ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অবিরাম প্রচারণায় সব ধরনের সহিংস কট্টরপন্থিরা শিথিল পরিবেশ পেয়েছে। বিএনপি ও তার সমর্থকদের বিরুদ্ধে সীমিত বিচারিক ও পুলিশি শক্তি ব্যবহারের দিকে রাষ্ট্রের মনোযোগ নিবদ্ধ হয়েছে। যে সম্পদ বা রিসোর্স দিয়ে সন্ত্রাস ও অপরাধ প্রতিরোধ করা যেতো এতে তা খর্ব হচ্ছে। বিরোধীদের দমনে যে অবৈধ পন্থা ব্যবহার করা হচ্ছে তা আইনের শাসনকে খর্ব করছে। এতে সৃষ্টি হচ্ছে দায়মুক্তির একটি পরিবেশ, যা সন্ত্রাসকেই উৎসাহিত করে।
চাপাতির কোপে প্রথম নিহত হন একজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার। এটা ঘটে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের আগে। যেমনটা আপনি একটি ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে প্রত্যাশা করেন আওয়ামী লীগ তেমনই প্রতিক্রিয়া দেখায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার অফিস থেকে বেরিয়ে নিহতের পরিবারের কাছে গিয়ে শোক প্রকাশ করেন। অপরাধীদের ধরার প্রত্যয় ঘোষণা করেন। কিন্তু দলটি আবার নির্বাচিত হওয়ার পর একই ধরনের অন্য হামলাগুলোর বিষয়ে তাদের প্রতিক্রিয়া হলো কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া।
নিহতের পরিবারের প্রতি আওয়ামী লীগের নেতারা সম্মান জানিয়েছেন কিনা তা পরিষ্কার নয়। একই সময়ে আল কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাব কন্টিনেন্ট অথবা ইসলামিক স্টেটের বাংলাদেশে উপস্থিতির কথা অস্বীকার করেছেন এ দলের নেতারা। বিএনপি ও তার সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর অবশিষ্ট যা আছে, তারা বাংলাদেশে সরকারকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করছেন তারা। এলজিবিটি অধিকারকর্মী ও মার্কিন দূতাবাসের কর্মী জুলহাজ মান্নানকে হত্যার পর, কয়েক সপ্তাহ আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই অভিযোগ আবারও উত্থাপন করেছেন।
সরকারের আরো ক্ষতিকর দিক হলো মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় অটল না থাকা। সেপ্টেম্বরে হিন্দুদের এক উৎসবের প্রাক্কালে শেখ হাসিনা হিন্দু নেতাদের একটি গ্রুপকে বলেছেন, যার যার নিজস্ব ধর্ম চর্চার অধিকার আছে। তবে অন্যের ধর্মী অনুভূতিতে আঘাত করার অধিকার নেই। বাংলা নববর্ষের এক অনুষ্ঠানে তিনি আবারও ইসলামের সমালোচনাকারী ব্লগারদের লেখাকে অকথ্য শব্দ বলে আখ্যায়িত করেন। এ সময় তিনি প্রশ্ন রাখেন যদি এসব লেখার কারণে কোনো অঘটন ঘটে তাহলে কেন এর দায় সরকারের নেয়া উচিত। এর ফলে যারা ইসলামের শত্রু বলে বিবেচিত তাদের ওপর হামলার জন্য উগ্রপন্থিরা একে একটি ‘ফ্রি পাস’ হিসেবে ব্যবহার করছে।
বাংলাদেশে কট্টরপন্থি গ্রুপগুলোর একটি ইতিহাস আছে। এর মধ্যে অনেকে রয়েছে আফগান যুদ্ধের উত্তরাধিকারী হিসেবে, যেখানে কিছু বাংলাদেশি যুদ্ধ করেছে। আর কিছু হচ্ছে ওহাবী প্রভাবের উৎপাদ। পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে কাজ শেষে ফেরার সময় তারা এই প্রভাব বহন করে এনেছেন দেশে। কিন্তু গত বছর ধারাবাহিক হামলা শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশে সর্বশেষ সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে ২০০৫ সালে। সেই হামলা চালিয়েছে জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ।
বাংলাদেশে এখন যে ধরনের সন্ত্রাসী হুমকি বিরাজ করছে, বিশেষ করে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক গ্রুপগুলোর মধ্যে যে যোগসূত্র, তার সঙ্গে আগের ওই হামলার ব্যবধান রয়েছে। যেমনভাবেই এটা করা হোক, মূলধারার ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে সরকারের দমনপীড়নের ফলেই এর বেশির ভাগ ঘটছে। নীতিগতভাবে এটা সুশাসনের সমস্যার চেয়ে নীতিগতভাবে একটি নিরাপত্তার ইস্যু। এসব হামলার এই প্রতিক্রিয়ায় ঘটনা ক্রমশ খারাপের দিকে যাবে।
(উইলিয়াম বি. মাইলাম। ওয়াশিংটনে উডরো উইলসন সেন্টারের সিনিয়র পলিসি বিষয়ক স্কলার। তিনি এর আগে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
১৯শে মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘দ্য রিয়েল সোর্স অব টেরর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক লেখার অনুবাদ)
No comments