আমি কান পেতে রই by মতিন রহমান
‘যদি
ঈশ্বর আমাকে আর একটু জীবন কৃপা করেন, আমি সাধারণ পোশাক পরব, সূর্যের
সম্মুখে নিজেকে মেলে ধরব আমি, আমার দেহ।’ গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
জীবনের অপরাহ্নে এমনটিই প্রার্থনা করেছিলেন। মোটর নিউরন দুরারোগ্য
ব্যাধিতে আক্রান্ত শহীদুল ইসলাম খোকনের আকাঙ্ক্ষায় তেমনটি ছিল। অথচ
খোকনকে ৪ এপ্রিল হারিয়ে যেতে হলো। খোকন হারিয়ে যেতে চায়নি। ঘন শূন্যতার
মাঝেও বাক্শূন্য খোকন পৃথিবীর শরীরের স্পর্শ পেতে চেয়েছে। জীবন থেকে
নিজেকে প্রত্যাহার করে নিতে ওর বড় কষ্ট হয়েছে। আর তাই হয়তো শেষ কটি দিনে
খোকন খুবই স্মৃতি ভারাতুর ছিল। বেদনার কথা, বিচ্ছেদের কথা ডায়েরির পৃষ্ঠায়
লিখে রাখত। এই নিত্যদিনের পৃথিবী থেকে তরতাজা যুবক খোকন বিচ্ছিন্ন হয়ে
যাবে এটা চলচ্চিত্র জগতের কেউ চায়নি। তবুও খোকনকে অন্য পৃথিবীর দূর
অঞ্চলের যাত্রী হতে হলো। খোকনের অকাল প্রস্থানে চলচ্চিত্র পরিবার দারুণ
বেদনা অনুভব করেছে। পৃথিবীতে একটা নতুন ভোর দেখার জন্য যেমন সারা রাত
অন্ধকারে চোখ মেলে থাকতে হয়। শহীদুল ইসলাম খোকনও সর্বদাই চলচ্চিত্রের
জন্য সংরক্ষিত স্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকত। ২০০১ সালে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা
নির্মূল আন্দোলনে বীর সাহসী খোকনের ভূমিকা তার জেগে থাকার প্রমাণ মেলে।
অসুস্থ খোকনকে নিয়ে আমিই লিখেছিলাম, সবকিছু ঠিক আছে। আসলে তো সবকিছু ঠিক
আছে। সুরে তাল আছে। চলচ্চিত্র দৃশ্যে ধারাবাহিকতা আছে। সৌরমণ্ডলে গতির
ঐকতান আছে। এসব ঠিক থাকার পরও আমরা শহীদুল ইসলাম খোকনকে হারিয়ে ফেললাম।
কখনো মৃত্যু আসে অজান্তে, বিনা নোটিশে। কোনো মৃত্যু আসে আগাম জানান
দিয়ে। আগাম নোটিশ পাওয়া ছিল খোকনের মৃত্যু। তাই হয়তো আমরা সরে যেতে
পারছি। পরিচালক, প্রযোজক ও নায়ক মাসুদ পারভেজ (সোহেল রানা) খোকনকে
চলচ্চিত্রে দাঁড়াতে শিখিয়েছেন। সেই খোকনের মুক্ত চিন্তায় কঠোর পরিশ্রমে
নায়ক রুবেলের অ্যাকশন হিরো হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া। ড্যানি সিডাক, সিরাজ
পান্না অথবা ইলিয়াস কোবরা চিরদিনই খোকনকে চলচ্চিত্রের শিক্ষক হিসেবে
স্মরণ রাখবে। ম্যাডাম ফুলীখ্যাত অভিনেত্রী সিমলার স্মৃতিতেও খোকন বেঁচে
থাকবে। চলচ্চিত্র অঙ্গনের সবাই সমস্বরে বলবে, একমাত্র খোকনই পেরেছে
হুমায়ুন ফরীদিকে চলচ্চিত্র পর্দায় ঔদ্ধত্যে চমকিত করতে। চলচ্চিত্রের প্রতি
অভিমান করা সুবর্ণাকেও অপহরণ চলচ্চিত্রে পুনঃ ফ্রেমবন্দী করতে পেরেছে
খোকন। খোকন সব সময় মনে করত মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। মানুষ সব পারে।
খোকনের চিন্তাগুরু ছিলেন আহমদ ছফা, আরজ আলী মাতুব্বর। খোকন স্বশিক্ষায়
শিক্ষিত একজন চলচ্চিত্রকার। তার ছিল বহুমাত্রিক প্রতিভা। চলচ্চিত্র
পরিচালনার পাশাপাশি প্রযোজনা, চিত্রনাট্য-সংলাপ রচনা করেছে। কখনো
ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে নায়কের ভূমিকায় সংলাপ উচ্চারণ করেছে। তার নির্মিত
দুই ডজন চলচ্চিত্রের কাহিনি বৈচিত্র্য ও বিষয়বস্তু দর্শকদের অজানা
উপলব্ধির খোরাক জুগিয়েছে। খোকন জাতির পিতাকে রূপক অর্থে সেলুলয়েডে বন্দী
করেছে। হত্যা, গুম হওয়ার হুমকি তোয়াক্কা না করে রাক্ষস ও ঘাতক ছবিতে
স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তির মুখোশ উন্মোচন করেছে। এই ধরনের দৃঢ় প্রত্যয়
চলচ্চিত্রকার শহীদুল ইসলাম খোকনের জন্য বাঙলা নির্ধারিত ছিল। লাল সবুজ
চলচ্চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ফুটিয়ে তুলতে এবং মুক্তিযুদ্ধের এক
সেক্টর কমান্ডারের বিপ্লবী চিন্তা রূপক অর্থে চলচ্চিত্রে ধারণ করতে অসীম
সাহস দেখিয়েছেন খোকন। জীবনের মন্থর দিনগুলোতে খোকনের সঙ্গী ছিল লাল
মলাটের ডায়েরি। কাঁপা হাতে অস্পষ্ট অক্ষরে খোকন সংক্ষেপে লিখে গেছে, ‘আমার
এখনো অনেক কাজ বাকি। আমি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে চাই।’ শহীদুল ইসলাম খোকন
জীবন সায়াহ্নে উপলব্ধি করেছে আয়না তার বড় শিক্ষক। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে
খোকন নিজেকে জানতে চেয়েছে—খোকন কে, কোথা থেকে এসেছে। খোকন গতকাল কী
করেছে। খোকনের এই জীবনোপলব্ধি প্রায় সে গল্পচ্ছলে প্রকাশ করত। জীবনকে
বুঝতে এই ক্ষুদ্র দর্শনই খোকনকে আমাদের থেকে আলাদা করতে পেরেছে। চলচ্চিত্র
নির্মাণকালে খোকন কখনোই শিল্পীদের প্রভুত্ব স্বীকার করেনি। ‘ডিরেক্টর ইজ
এ সুপারস্টার’ এই সত্য প্রতিষ্ঠা করতে খোকনই পেরেছিল পরিচালক হিসেবে
সর্বাধিক সম্মানী আদায় করতে। খোকনের জীবনে কোনো বিরক্তি বিষয় ছিল না।
যতক্ষণ প্রাণ ছিল, জ্ঞান ছিল ততক্ষণই খোকন প্রাণতম ছিল। দেখা হলেই দরাজ
কণ্ঠে বলত ‘বড় ভাই কেমন আছেন।’ এমন মধুর সম্ভাবনা খোকনের কণ্ঠে শোভা
পেত। খোকন আমাদের মাঝে নেই। আমরা আছি। ওর ঘর-সংসারে জয়, হৃদয়, শৈলী ও শীষ
আছে এবং থাকবে। হয়তো আমরাও থাকব। আমাদের সবার বেঁচে থাকার প্রার্থনায় আমি
কান পেতে রইলাম। যদি কখনো অদৃশ্য বাতাসে খোকনের কণ্ঠে ভেসে আসে ‘বড় ভাই,
কেমন আছেন?’ তখন আমি খোকনেরই কথা ফিরিয়ে দিয়ে বলব, ‘সবকিছু ঠিক আছে।’
No comments