প্রেয়সীর তিলটির জন্য ঢাকা চিটাগাং রাজশাহী খুলনা by মিনার রশীদ
ইরানের কবি হাফিজ তার প্রেয়সীর গালের এক তিলের জন্য সমরখন্দ ও বোখারা বিলিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।
কবির সেই কবিতার বাণী সেখানকার শাসকের কানে পৌঁছলে তিনি রীতিমতো আঁৎকে উঠলেন। কবিকে তলব করে জিজ্ঞেস করেন, ও হতভাগা কবি! সমরখন্দ ও বোখারা আমার। আর কোথাকার কোন হতভাগিনীর জন্য তুমি কিনা আমার সাম্রাজ্য বিলিয়ে দিতে চাচ্ছ?
সমরখন্দ ও বোখারা বিলিয়ে দেয়ার কথা শুনে অন্ততপক্ষে সেখানকার শাসক নড়েচড়ে বসেছিলেন। কিন্তু প্রেমাস্পদের গালের তিল বা শরীরের অন্য কিছুর জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বিলিয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও কারো কোনো নড়ন চড়ন নজরে পড়বে বলে মনে হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মহান ভাষা দিবস অনুষ্ঠানে তার আবেগপূর্ণ বক্তব্যে দুই বাংলার মধ্যে কেন পাসপোর্ট থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এই কথাটি ইন্ডিয়ার কোনো খাদ্যমন্ত্রীর না হয়ে আরেকটু পশ্চিমের কোনো অ-খাদ্যমন্ত্রীর হলে এত দিনে কত ধানে কত চাল তা টের পাওয়া যেত। কোনো কোনো চ্যানেলের লোকজন পারলে ষোলো কোটি মানুষের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া নিয়ে এসে তাদের টিভিতে প্রচার করতেন।
অথচ মল্লিক বাবুর এই আবেগপূর্ণ বক্তব্য দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটির জন্য মারাত্মক ইঙ্গিত বহন করে। মল্লিকের এই মনোবাঞ্ছা সম্ভাব্য দু’টি উপায়ের মধ্যে একটির মাধ্যমে পূর্ণ হতে পারে। হয় পশ্চিম বাংলাকে ভারত থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাথে যোগ দিতে হবে। নতুবা বাংলাদেশকে সিকিমের মতো তার সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে প্রতিবেশীর একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যেতে হবে।
যে রাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে ওই মস্ত্রী এই আবেগটি দেখিয়েছিলেন সেই রাষ্ট্র এটাকে ক্ষতিকর গণ্য করেনি। রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য তিনি এখনো অভিযুক্ত হননি। কাজেই বিয়োগ অঙ্কটি টানলে কলিজার মধ্যে কোথাও যেন, কেমন যেন একটি টান পড়ে। জাতে যা-ই হোন, মল্লিক বাবু তালে একদম ঠিক।
অনেক দেশের নাগরিকদের পরস্পরের দেশে যাতায়াতের জন্য কোনো ভিসার দরকার পড়ে না। কিন্তু তেমন সৌহার্দ্যরে নিদর্শনস্বরূপ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এই ভিসা তুলে দেয়ার কথা বলেননি। তিনি পাসপোর্ট তুলে দেয়ার কথা বলেছেন! তিনি বুঝে শুনেই কথাটি বলেছেন বলে ধরে নিতে হয়।
এই সিকোয়েন্সটি বোঝাতে হলে বেশ কিছু দিন আগের এক খাজা বাবার কথা স্মরণ করতে হয়। সেই বাবা আবার অনেক আধুনিক, মুক্তমনা ও মডার্ন ছিলেন। অনেকটা উন্মুক্ত যৌনতার প্রচারক আমেরিকান গুরু রজনীশের মতো। নারী-পুরুষ, বিশেষ করে উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীরা বেশি করে তার মুরিদ হয়েছিল। তার আসরে মদ-গাঁজাসহ সব উত্তেজক ড্রাগের ব্যবহার হতো। আসরের শুরুতে ছেলেমেয়েদের মাঝে একটা কাপড়ের পর্দা টানানো থাকত। রাত একটু গভীর হলে আসরের মেজাজ বুঝে একসময় ‘খাজা বাবা’ গেয়ে উঠতেন, মনের মধ্যে পর্দা থাকলে বাইরের পর্দার দরকার নেই। সাথে সাথেই তুমুল চিৎকারের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যকার পর্দা সরিয়ে দেয়া হতো। কিছুক্ষণ ধ্যান করে সেই বাবা আবার বলতেন, মনের মধ্যে আলো থাকলে বাইরের আলোর দরকার নেই। তারপর আলোও নিভিয়ে দেয়া হতো। আলো নিভিয়ে ও পর্দা সরিয়ে বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করে সবাই একত্র হয়ে কী ধরনের প্রার্থনা করত তা সহজেই অনুমেয়।
মল্লিক বাবুরা এই চেতনার অনেকটা কাছাকাছি আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন বলে অনেকে আশঙ্কা করছে। মনে হচ্ছে, জাতি আজ বেহুঁশ হয়ে পড়েছে। এসব কথা শুনে আগে যা-ও দু-একজন উসখুস করতেন, এখন তা-ও বন্ধ। ভূ-রাজনৈতিক সচেতনতার বাতিটি অনেক আগেই নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন ‘মনের মধ্যে পাসপোর্ট থাকলে বাইরের পাসপোর্টের দরকার নেই’ বলে ধুয়া তোলা সম্ভব বলে কেউ কেউ মনে করেন।
শুধু এই মল্লিক মন্ত্রীই নন, গত বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা দিদির সফরসঙ্গী চলচ্চিত্র নায়ক ও ভারতের লোকসভার সদস্য দেব দুই বাংলাকে এক করে দেয়ার জন্য দুই দেশের সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন।
এই দেব ও জ্যোতিপ্রিয়দের আগের পুরুষ ১৯০৫ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে বাংলাকে ভাগ করা হলে বাংলা মায়ের জন্য একই ধরনের মাতম তুলেছিলেন। তাদের সে দিন সে কী কান্না! সেই কান্নায় পুরোপুরি ভিজে গিয়ে ব্রিটিশরাজ ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত করেন। তখন খুব খুশি হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্রাট পঞ্চম জর্জকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি গান লিখেছিলেন। সে গানটিই পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। ওই কবি তখন এসব ব্যাপারে গোষ্ঠীগত ও নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থভিত্তিক ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গ রহিত করার পরে মুসলিম সমাজকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। তিনি বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তখনো তার ভয় ছিল সেই একটাই। পূর্ব বাংলার চাষাভুষার ছেলেরা শিক্ষিত হয়ে গেলে অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়বে। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতারাই হয়ে পড়েছেন অনেকটা ভিলেনের মতো। একশ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক বরকন্দাজ সৃষ্টি করে তাদের দিয়ে এসব করা হচ্ছে।
প্রশাসনিক সুবিধার্থে ব্রিটিশরাজ বাংলাকে ভাগ করে পূর্ব ও পশ্চিম নামে দু’টি প্রদেশ করেছিল। আসাম ও পূর্ব বাংলাকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা হয়েছিল, যার রাজধানী হয়েছিল ঢাকা। তাতে পূর্ব বাংলার জনগণ যারপরনাই খুশি হয়েছিল। কারণ নতুন এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়।
পূর্ব বাংলায় ছিল মূলত নিন্ম জাতের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস। এই দু’টি সম্প্রদায়কে লুণ্ঠন করে কলকাতা মহানগরীকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছিল উঁচু জাতের হিন্দু ও জমিদার সম্প্রদায়। বঙ্গভঙ্গ তাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত হানে। কাজেই তাদের পক্ষে এই বিভক্তি মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলা মায়ের আবেগ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং নিজেদের সম্মিলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে বঙ্গভঙ্গ রহিত করতে তারা সমর্থ হয়।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে এই ‘বাংলাপ্রেমিক’দের আসল চেহারাটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালে যারা বাংলা মাকে ভাগ করার জন্য রোদন শুরু করেছিলেন, ১৯৪৭ সালে সেই একই গোষ্ঠী ‘বাংলা মা’কে দ্বিখণ্ডিত করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, শরৎ বসু (সুভাষ বসুর ভাই) প্রমুখ স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করলেও তাদের পক্ষে এই বিশুদ্ধ বাংলাপ্রেমিকদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তারা বরং বাংলাকে ভাগ করে কোনো মতে দিল্লির কোলে আশ্রয় নেয়াকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। একই আবেশে অন্য গ্রুপ পিন্ডির পূর্বসূরি করাচির সাথে জড়িয়ে পড়ে। তখন আর বাংলা মায়ের কথা কারো খেয়াল থাকেনি।
এটা সত্য, তখন ধর্মীয় উন্মাদনা বা আবেশ হিন্দু মুসলিম উভয় বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যেই কাজ করেছিল। কিছু দিনের মধ্যেই সেই উন্মাদনা অপসারিত হলে আমরা পিন্ডির খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু একই ধরনের চিন্তাভাবনার কথা দাদারা কল্পনাতেও আনতে পারে না। তারা আবেগে মাঝে মাঝে (আমাদের চেয়েও) বেশি ‘মাতাল’ হলেও দিল্লির ‘তাল’টি কখনোই ছাড়েন না। কোনো দিন হয়তো ছাড়বেনও না।
এ দিকে আমরা ছুটেছি ভিন্ন পথে। ১৯৪৭ সালের আগে সবাই এক থাকলেও এখন অনেক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। স্বার্থের ভাগ, আবেগের ভাগ, অনুভবের ভাগ আমাদের নিঃশেষ করে দিয়েছে। ক্ষমতার লোভ আমাদের বেহুঁশ করে ফেলেছে।
আমাদের ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান ও বোধ শূন্যের কোঠায়। আজব এক ভয় যেন সবাইকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমার এই বিলাপ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য আমারই অন্য ভাই ওঁৎ পেতে আছে, আমাকে কায়দা মতো ধরার জন্য। আমরা এতটুকু হীনম্মন্য হয়ে পড়েছি যে, দালালদের কাছ থেকে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকি। এগুলো নিয়ে দু-একজন নূরে আলম সিদ্দিকী আহাজারি করলেও মনে হয় আমরা বড্ড দেরি করে ফেলেছি। জীবনের প্রতি মায়া আমাদের অনেক বেশি। অথচ এই জীবনের ফয়সালা মাটিতে হয় না; তা হয় আসমানে।
কবির সেই কবিতার বাণী সেখানকার শাসকের কানে পৌঁছলে তিনি রীতিমতো আঁৎকে উঠলেন। কবিকে তলব করে জিজ্ঞেস করেন, ও হতভাগা কবি! সমরখন্দ ও বোখারা আমার। আর কোথাকার কোন হতভাগিনীর জন্য তুমি কিনা আমার সাম্রাজ্য বিলিয়ে দিতে চাচ্ছ?
সমরখন্দ ও বোখারা বিলিয়ে দেয়ার কথা শুনে অন্ততপক্ষে সেখানকার শাসক নড়েচড়ে বসেছিলেন। কিন্তু প্রেমাস্পদের গালের তিল বা শরীরের অন্য কিছুর জন্য ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা বিলিয়ে দেয়ার কথা বলা হলেও কারো কোনো নড়ন চড়ন নজরে পড়বে বলে মনে হয় না।
পশ্চিমবঙ্গের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মহান ভাষা দিবস অনুষ্ঠানে তার আবেগপূর্ণ বক্তব্যে দুই বাংলার মধ্যে কেন পাসপোর্ট থাকবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।
এই কথাটি ইন্ডিয়ার কোনো খাদ্যমন্ত্রীর না হয়ে আরেকটু পশ্চিমের কোনো অ-খাদ্যমন্ত্রীর হলে এত দিনে কত ধানে কত চাল তা টের পাওয়া যেত। কোনো কোনো চ্যানেলের লোকজন পারলে ষোলো কোটি মানুষের কাছ থেকে প্রতিক্রিয়া নিয়ে এসে তাদের টিভিতে প্রচার করতেন।
অথচ মল্লিক বাবুর এই আবেগপূর্ণ বক্তব্য দু’টি রাষ্ট্রের মধ্যে একটির জন্য মারাত্মক ইঙ্গিত বহন করে। মল্লিকের এই মনোবাঞ্ছা সম্ভাব্য দু’টি উপায়ের মধ্যে একটির মাধ্যমে পূর্ণ হতে পারে। হয় পশ্চিম বাংলাকে ভারত থেকে পৃথক হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সাথে যোগ দিতে হবে। নতুবা বাংলাদেশকে সিকিমের মতো তার সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়ে প্রতিবেশীর একটি অঙ্গরাজ্য হয়ে যেতে হবে।
যে রাষ্ট্রের মাটিতে দাঁড়িয়ে ওই মস্ত্রী এই আবেগটি দেখিয়েছিলেন সেই রাষ্ট্র এটাকে ক্ষতিকর গণ্য করেনি। রাষ্ট্রদ্রোহিতার জন্য তিনি এখনো অভিযুক্ত হননি। কাজেই বিয়োগ অঙ্কটি টানলে কলিজার মধ্যে কোথাও যেন, কেমন যেন একটি টান পড়ে। জাতে যা-ই হোন, মল্লিক বাবু তালে একদম ঠিক।
অনেক দেশের নাগরিকদের পরস্পরের দেশে যাতায়াতের জন্য কোনো ভিসার দরকার পড়ে না। কিন্তু তেমন সৌহার্দ্যরে নিদর্শনস্বরূপ জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক এই ভিসা তুলে দেয়ার কথা বলেননি। তিনি পাসপোর্ট তুলে দেয়ার কথা বলেছেন! তিনি বুঝে শুনেই কথাটি বলেছেন বলে ধরে নিতে হয়।
এই সিকোয়েন্সটি বোঝাতে হলে বেশ কিছু দিন আগের এক খাজা বাবার কথা স্মরণ করতে হয়। সেই বাবা আবার অনেক আধুনিক, মুক্তমনা ও মডার্ন ছিলেন। অনেকটা উন্মুক্ত যৌনতার প্রচারক আমেরিকান গুরু রজনীশের মতো। নারী-পুরুষ, বিশেষ করে উঠতি বয়সের যুবক-যুবতীরা বেশি করে তার মুরিদ হয়েছিল। তার আসরে মদ-গাঁজাসহ সব উত্তেজক ড্রাগের ব্যবহার হতো। আসরের শুরুতে ছেলেমেয়েদের মাঝে একটা কাপড়ের পর্দা টানানো থাকত। রাত একটু গভীর হলে আসরের মেজাজ বুঝে একসময় ‘খাজা বাবা’ গেয়ে উঠতেন, মনের মধ্যে পর্দা থাকলে বাইরের পর্দার দরকার নেই। সাথে সাথেই তুমুল চিৎকারের মধ্য দিয়ে ছেলেমেয়েদের মধ্যকার পর্দা সরিয়ে দেয়া হতো। কিছুক্ষণ ধ্যান করে সেই বাবা আবার বলতেন, মনের মধ্যে আলো থাকলে বাইরের আলোর দরকার নেই। তারপর আলোও নিভিয়ে দেয়া হতো। আলো নিভিয়ে ও পর্দা সরিয়ে বিশেষ পরিবেশ সৃষ্টি করে সবাই একত্র হয়ে কী ধরনের প্রার্থনা করত তা সহজেই অনুমেয়।
মল্লিক বাবুরা এই চেতনার অনেকটা কাছাকাছি আমাদের পৌঁছে দিয়েছেন বলে অনেকে আশঙ্কা করছে। মনে হচ্ছে, জাতি আজ বেহুঁশ হয়ে পড়েছে। এসব কথা শুনে আগে যা-ও দু-একজন উসখুস করতেন, এখন তা-ও বন্ধ। ভূ-রাজনৈতিক সচেতনতার বাতিটি অনেক আগেই নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন ‘মনের মধ্যে পাসপোর্ট থাকলে বাইরের পাসপোর্টের দরকার নেই’ বলে ধুয়া তোলা সম্ভব বলে কেউ কেউ মনে করেন।
শুধু এই মল্লিক মন্ত্রীই নন, গত বছর ১৯ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা দিদির সফরসঙ্গী চলচ্চিত্র নায়ক ও ভারতের লোকসভার সদস্য দেব দুই বাংলাকে এক করে দেয়ার জন্য দুই দেশের সরকারের কাছে অনুরোধ করেছেন।
এই দেব ও জ্যোতিপ্রিয়দের আগের পুরুষ ১৯০৫ সালে প্রশাসনিক সুবিধার্থে বাংলাকে ভাগ করা হলে বাংলা মায়ের জন্য একই ধরনের মাতম তুলেছিলেন। তাদের সে দিন সে কী কান্না! সেই কান্নায় পুরোপুরি ভিজে গিয়ে ব্রিটিশরাজ ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রহিত করেন। তখন খুব খুশি হয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ সম্রাট পঞ্চম জর্জকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি গান লিখেছিলেন। সে গানটিই পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। ওই কবি তখন এসব ব্যাপারে গোষ্ঠীগত ও নিজ সম্প্রদায়ের স্বার্থভিত্তিক ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠতে পারেননি। বঙ্গভঙ্গ রহিত করার পরে মুসলিম সমাজকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। তিনি বিরোধিতায় নেমেছিলেন। তখনো তার ভয় ছিল সেই একটাই। পূর্ব বাংলার চাষাভুষার ছেলেরা শিক্ষিত হয়ে গেলে অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়বে। অথচ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতারাই হয়ে পড়েছেন অনেকটা ভিলেনের মতো। একশ্রেণীর বুদ্ধিবৃত্তিক বরকন্দাজ সৃষ্টি করে তাদের দিয়ে এসব করা হচ্ছে।
প্রশাসনিক সুবিধার্থে ব্রিটিশরাজ বাংলাকে ভাগ করে পূর্ব ও পশ্চিম নামে দু’টি প্রদেশ করেছিল। আসাম ও পূর্ব বাংলাকে নিয়ে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ গঠন করা হয়েছিল, যার রাজধানী হয়েছিল ঢাকা। তাতে পূর্ব বাংলার জনগণ যারপরনাই খুশি হয়েছিল। কারণ নতুন এই প্রশাসনিক ব্যবস্থা তাদের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়।
পূর্ব বাংলায় ছিল মূলত নিন্ম জাতের হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের বাস। এই দু’টি সম্প্রদায়কে লুণ্ঠন করে কলকাতা মহানগরীকে সমৃদ্ধ করে যাচ্ছিল উঁচু জাতের হিন্দু ও জমিদার সম্প্রদায়। বঙ্গভঙ্গ তাদের কায়েমি স্বার্থে আঘাত হানে। কাজেই তাদের পক্ষে এই বিভক্তি মেনে নেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বাংলা মায়ের আবেগ নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়ে এবং নিজেদের সম্মিলিত রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব কাজে লাগিয়ে বঙ্গভঙ্গ রহিত করতে তারা সমর্থ হয়।
কিন্তু ১৯৪৭ সালে এই ‘বাংলাপ্রেমিক’দের আসল চেহারাটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। ১৯০৫ সালে যারা বাংলা মাকে ভাগ করার জন্য রোদন শুরু করেছিলেন, ১৯৪৭ সালে সেই একই গোষ্ঠী ‘বাংলা মা’কে দ্বিখণ্ডিত করতে উদগ্রীব হয়ে পড়েন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম, শরৎ বসু (সুভাষ বসুর ভাই) প্রমুখ স্বাধীন যুক্ত বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য চেষ্টা করলেও তাদের পক্ষে এই বিশুদ্ধ বাংলাপ্রেমিকদের কাউকে পাওয়া যায়নি। তারা বরং বাংলাকে ভাগ করে কোনো মতে দিল্লির কোলে আশ্রয় নেয়াকেই শ্রেয় মনে করেছিলেন। একই আবেশে অন্য গ্রুপ পিন্ডির পূর্বসূরি করাচির সাথে জড়িয়ে পড়ে। তখন আর বাংলা মায়ের কথা কারো খেয়াল থাকেনি।
এটা সত্য, তখন ধর্মীয় উন্মাদনা বা আবেশ হিন্দু মুসলিম উভয় বাঙালি সম্প্রদায়ের মধ্যেই কাজ করেছিল। কিছু দিনের মধ্যেই সেই উন্মাদনা অপসারিত হলে আমরা পিন্ডির খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসি। কিন্তু একই ধরনের চিন্তাভাবনার কথা দাদারা কল্পনাতেও আনতে পারে না। তারা আবেগে মাঝে মাঝে (আমাদের চেয়েও) বেশি ‘মাতাল’ হলেও দিল্লির ‘তাল’টি কখনোই ছাড়েন না। কোনো দিন হয়তো ছাড়বেনও না।
এ দিকে আমরা ছুটেছি ভিন্ন পথে। ১৯৪৭ সালের আগে সবাই এক থাকলেও এখন অনেক ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। স্বার্থের ভাগ, আবেগের ভাগ, অনুভবের ভাগ আমাদের নিঃশেষ করে দিয়েছে। ক্ষমতার লোভ আমাদের বেহুঁশ করে ফেলেছে।
আমাদের ভূ-রাজনৈতিক জ্ঞান ও বোধ শূন্যের কোঠায়। আজব এক ভয় যেন সবাইকে গ্রাস করে ফেলেছে। আমার এই বিলাপ স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য আমারই অন্য ভাই ওঁৎ পেতে আছে, আমাকে কায়দা মতো ধরার জন্য। আমরা এতটুকু হীনম্মন্য হয়ে পড়েছি যে, দালালদের কাছ থেকে দেশপ্রেমের সার্টিফিকেট নেয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে থাকি। এগুলো নিয়ে দু-একজন নূরে আলম সিদ্দিকী আহাজারি করলেও মনে হয় আমরা বড্ড দেরি করে ফেলেছি। জীবনের প্রতি মায়া আমাদের অনেক বেশি। অথচ এই জীবনের ফয়সালা মাটিতে হয় না; তা হয় আসমানে।
No comments