‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত’ হওয়ার গণতন্ত্র! by সোহরাব হাসান

৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় দলীয় সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কাউন্সিলের আগে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘নাটকটা ভালোই করেছে। নির্বাচিত দুজনই আসামি।’ বিএনপির চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি যে নিছক লোক দেখানো ছিল, সেটাই ইঙ্গিত করেছেন প্রধানমন্ত্রী।
বিএনপির চেয়ারপারসন ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে সাবেক স্পিকার জমির উদ্দিন সরকারের নেতৃত্বে একটি নির্বাচন কমিশন করে প্রার্থিতা আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু চেয়ারপারসন পদে খালেদা জিয়া এবং সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান পদে বর্তমানে লন্ডনে বসবাসকারী তারেক রহমান ছাড়া কেউ মনোনয়নপত্র জমা দেননি। ফলে ১৯ মার্চ নির্ধারিত কাউন্সিলের আগেই তাঁরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলের দুই শীর্ষ পদে নির্বাচিত হয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী এটাকেই নাটক বলেছেন।
দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচন নিয়ে এ ধরনের নাটক কেবল বিএনপিতে মঞ্চস্থ হলে দেশের মানুষ এটুকু আশ্বস্ত হতে পারত যে একটি দলে গণতন্ত্রচর্চা না হলে কি, অন্যান্য দলে তো সুষ্ঠু গণতন্ত্রচর্চা হচ্ছে এবং তারা দেশ ও রাজনীতিকে সঠিক ধারায় নিয়ে যাবে। কিন্তু দলে গণতন্ত্রচর্চার সমস্যা কেবল বিএনপির নয়; ক্ষমতাসীন কিংবা বিরোধী নির্বিশেষে প্রায় সব দলেই প্রকট। এসব দলের নেতারা শীর্ষ নেতা বা নেত্রীর কথাকেই বেদবাক্য মনে করেন, তাঁদের কাছে যুক্তি-তর্ক পেশ করাকেও বেয়াদবি ভাবেন। দলের বাইরে সবাই গণতন্ত্রী কিন্তু কমিটিতে বসলে ভিজে বিড়াল। রাজনৈতিক দলগুলোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেতৃত্ব নির্বাচনও এসেছে এই অনুগত মানসিকতা থেকে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতারা নিজেদের কলহ মেটাতে না পেরেই দুই নেত্রীকে ডেকে এনে তাঁদের হাতে দলের নেতৃত্ব অর্পণ করেছিলেন। তাঁরা কেউ সোৎসাহে রাজনীতিতে আসেননি।
প্রশ্ন হলো, নেতৃত্ব নির্বাচনে বিএনপি যে নাটক করেছে, আওয়ামী লীগ সেই নাটক করবে না, সেই আশা কি আমরা করতে পারি? পারি না। সেখানেও প্রায় ৩৫ বছর ধরে সভানেত্রী পদে দ্বিতীয় কেউ প্রার্থিতা ঘোষণা করেননি। প্রকৃত নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, সেটি আওয়ামী লীগেও হবে না। যদিও দুই দলের গঠনতন্ত্রে ঢের ফারাক আছে।
যেকোনো নির্বাচনে দুই বা তার অধিক প্রার্থী থাকেন। কিন্তু জয়ী হবেন একজন। এরপর বিজিতকে নিয়ে বিজয়ীর কিংবা বিজয়ীর অধীনে বিজিতের কাজ করার মানসিকতা থাকতে হয়, যা আমাদের দলগুলোর মধ্যে প্রায় দুর্লভ। রাজনৈতিক দলগুলোর ভাঙনের পেছনে আদর্শের চেয়েও ব্যক্তিত্বের সংঘাতই বেশি সক্রিয় বরাবর। আগে এই বৈরিতা বা বিভক্তি বামপন্থীদের একচ্ছত্র ছিল। এখন সর্বত্র তার সংক্রমণ ঘটছে। বলা হয়, বড় দলগুলোতে গণতন্ত্র নেই। কিন্তু ছোট দলগুলোর অবস্থা কী? সেখানেও এক দল এক নেতা। দুই নেতা হলেই বিভক্তি।
বিএনপি কাউন্সিলের আগে যে এক ব্যক্তি এক পদ নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, সেটি বাস্তবায়ন হলে দলের চাঁই বিপদে পড়বেন। তাঁরা কেবল একাধিক পদ আঁকড়ে থাকেননি, অন্যদের আসার সুযোগও বন্ধ করে দিয়েছেন। এ কারণেই রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব হয়ে পড়েছে বন্ধকি সম্পত্তি। বছরের পর বছর চলে গেলেও মেয়াদ শেষ হয় না।
রাজনীতিতে একেক সময় একেকটি মৌসুম চলে। কখনো হরতালের মৌসুম, কখনো অবরোধ বা জ্বালাও-পোড়াও মৌসুম। এখন চলছে কাউন্সিলের মৌসুম। চলতি বছরে অনেক দলের কাউন্সিল হবে। কাউন্সিল মানে নতুন নেতৃত্ব। দলের নতুন কর্মসূচি, নতুন পরিকল্পনা। গতকাল শুক্রবার ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল—জাসদের কাউন্সিল শুরু হয়েছে। ১৯ মার্চ হবে বিএনপির কাউন্সিল। এই কাউন্সিলের স্থান নিয়ে প্রথমে অনিশ্চয়তা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সরকার অনুমতি দিয়েছে।
তবে কাউন্সিল নিয়ে বেশি রহস্য সৃষ্টি করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। দলটি প্রথমে ঘোষণা দিয়েছিল ডিসেম্বরে কাউন্সিল হবে। কিন্তু দলের একাংশ পৌর নির্বাচনের দোহাই দিয়ে সেই কাউন্সিল পিছিয়ে দেয়। পরে নতুন তারিখ নির্ধারিত হয় ২৮ মার্চ। এখন শোনা যাচ্ছে কাউন্সিল আরেক দফা পেছাবে। কিন্তু কাউন্সিল যখনই হোক না কেন, দলই তার পূর্বশর্ত অনুযায়ী জেলা-উপজেলাগুলোর সম্মেলন শেষ করেনি। বিএনপি রাজনৈতিক প্রতিকূলতার অজুহাত দেখাতে পারে। তারা বলতে পারে, সরকারের জেল-জুলুম ও হামলা-মামলার কারণে সব জেলায় কমিটি করা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু আওয়ামী লীগ কী বলবে? কাউন্সিলের আগে জেলা-উপজেলার কাউন্সিল করে নেতৃত্ব নির্বাচন করার কথা, তাও শেষ হয়নি। দুই দলের কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্ন স্থানে গিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে এসেছেন। সেটিও যেখানে সম্ভব হয়নি সেখান থেকে আগের কমিটিই প্রতিনিধিত্ব করবে। কয়েক দিন আগে কুমিল্লায় গিয়েছিলাম সেখানকার রাজনৈতিক হালচাল জানতে। বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে মনে হয়েছে, ইউপি নির্বাচন বা দলীয় কাউন্সিল! কোনো ব্যাপারেই তাঁদের তেমন উৎসাহী নেই। তাঁরা মনে করেন, বর্তমান মেরুদণ্ডহীন নির্বাচন কমিশন কোনো ভালো নির্বাচন করতে পারবে না। আর দলীয় কাউন্সিলে কাউন্সিলরদের ভোটে নেতৃত্ব নির্বাচনেরও কোনো সম্ভাবনা নেই। ঢাকা দেশের রাজধানী। এই নগরে প্রায় দেড় কোটি লোকের বাস। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় দলেও এখানে পূর্ণাঙ্গ কমিটি নেই। বিএনপি মির্জা আব্বাসের নেতৃত্ব যে আহ্বায়ক কমিটি করেছিল, তা নিষ্ক্রিয়। মোহাম্মদ হানিফ মারা যাওয়ার পর থেকে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ খালি। এখন উত্তরে ও দক্ষিণে দুটি কমিটি করার কথা বলা হলেও সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক কারা হবেন ঠিক হয়নি। এই হলো প্রধান দুই দলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কাউন্সিল যখনই হোক না নেতৃত্ব নির্বাচনের সনাতনি ধারা বদলাবে না। কাউন্সিলে আগত কাউন্সিলররা শীর্ষ পদে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন না। যিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হবেন, তাঁর পক্ষেই তাঁকে তাঁদের জয়ধ্বনি দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় বিএনপি নেতৃত্ব নির্বাচনে একটি ‘নাটক’ করেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মঞ্চায়ন তার চেয়ে উন্নত মানের হবে, সেটি জোর দিয়ে বলা যায় না।
রাজনৈতিক দলগুলোতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কিংবা হাত তোলা পদ্ধতিতে নেতৃত্ব নির্বাচিত হওয়ার রেওয়াজ চলে আসছে সম্ভবত এ দেশে দলীয় রাজনীতি শুরুর পর থেকেই। কিন্তু সেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনের বিষয়টি জাতীয় সংসদ থেকে ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত সংক্রমিত হবে, সে কথা কেউ ভাবতে পারেননি। কেননা, বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দলীয় নেতৃত্ব নির্বাচিত হলে দলের নেতা-কর্মীরা ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। আর রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন স্তরে যেসব নির্বাচন হয়, সেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন হলে ১০ কোটি ভোটার ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হন। এই আলোকেই ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ১৫৪ জন সাংসদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার ব্যাপক সমালোচনা হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট এলাকার ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি। সেবার ক্ষমতাসীনদের পেক্ষ বলা হয়েছিল, বিরোধী জোট নির্বাচন বর্জন করেছে বলে এমনটি হয়েছে। তাদের কী করার আছে? কিন্তু চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অর্ধশতাধিক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়াকে তাঁরা কী বলবেন? যে দেশে গ্রামের ক্লাব কিংবা স্কুল কমিটির নির্বাচন নিয়ে তুলকালাম ঘটে, সেই দেশে প্রার্থী না পাওয়া অস্বাভাবিক বললেও কম বলা হবে। এ কথা স্বীকার করতে হবে যে বাংলাদেশে আরও অনেক খারাপ রীতির মতো নির্বাচনব্যবস্থার বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রথা চালু করার কৃতিত্ব সামরিক শাসকদেরই। কথিত গণভোটে একজনই প্রার্থী থাকেন। ফলে সেখানে ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়। দীর্ঘ আন্দোলন–সংগ্রাম এবং বহু মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা সেই সামরিক শাসকদের তাড়ালেও তাঁদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ভূত রয়ে গেছে।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের প্রথম দফার ৭৩৮টি ইউপির মধ্যে অর্ধশতাধিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়া কেবল বাংলাদেশের নির্বাচন ইতিহাসের, বিশ্ব ইতিহাসেও নজিরবিহীন। ফলে অদূর ভবিষ্যতে এই নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত কাজী রকিবউদ্দীনের কমিশন গিনেজ বুক অব রেকর্ডসে নাম লেখাতে পারবে আশা করি।
আওয়ামী লীগের কোনো কোনো নেতা বলার চেষ্টা করছেন, বিএনপি এতই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে যে প্রার্থী দেওয়ার লোক পাচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ তাঁদের প্রার্থী ধার দিতে পারত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগই যোগ্য প্রার্থী না পেয়ে বিএনপি ও জামায়াত থেকে প্রার্থী ধার করেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে হাঙ্গামাও হয়েছে। দ্বিতীয়ত, প্রার্থী দেওয়ার মতো লোক যদি বিএনপিতে না-ই থাকবে, তাহলে তাদের মনোনয়নপত্র ছিঁড়ে ফেলা কিংবা প্রার্থীকে আটকে রাখার ঘটনা কেন ঘটল? সামরিক শাসনামলেও নির্বাচনের প্রতি মানুষের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। তাঁরা এই ভোটকেই তাঁদের অধিকার প্রয়োগের একমাত্র হাতিয়ার মনে করেন। সেই হাতিয়ারটি কেড়ে নিলে নির্বাচন হওয়া না-হওয়ার মধ্যে কোনো ফারাক থাকে না। সিইসি বন্দুকের শেষ গুলিটি পর্যন্ত ব্যবহার করার কথা বললেও নির্বাচনের প্রথম শর্ত অর্থাৎ সবার প্রার্থিতা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। এই নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন দিতে পারবে, সে কথা কেউ বিশ্বাস করে না। কিন্তু তারা প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুযোগটুকুও দেবে না, এটি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না।
নির্বাচন কমিশন এবং ক্ষমতাসীনেরা মিলে যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার এই মহড়াটি এভাবে চালাতে থাকে, তাহলে ভবিষ্যতে দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা বলে কিছু থাকবে না। তখন দারিদ্র্যকে জাদুঘরে পাঠানোর আগেই নির্বাচনব্যবস্থা জাদুঘরে ঠাঁই নেবে। সেটি দেশ, রাজনীতি ও রাজনীতিকদের জন্য সুখকর হবে বলে মনে হয় না।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.