আমরা পতাকাটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাই by কামরুল আলম খান খসরু
একটি
জাতীয় পতাকা মানে একটি জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদ্বয়, একটি জাতির স্বীকৃতি।
একটি জাতীয় পতাকা মানে একটি জাতির আবেগ, অনুভূতি, ভালোবাসা, ভাষা, সংস্কৃতি
তথা তার সাংস্কৃতিক পরিচয়। জাতীয় পতাকা সার্বভৌমত্বের প্রতীক আর জাতীয়
সংগীত সংস্কৃতির প্রতীক। জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সংগীত নিয়েই রাষ্ট্রস্থিতি
লাভ করে এগিয়ে যায়। বাঙালি জাতি তার প্রাণপ্রিয় পতাকা অর্জনে অবর্ণনীয়
অকল্পনীয় দুঃখ-যন্ত্রণা ভোগ করেছে। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে। জাতীয়
পতাকা অর্জনে বাঙালি জাতির বীরত্বগাথা ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে।
বাংলাদেশের পতাকা তৈরির পর্বটি খুবই আকর্ষণীয় এবং উত্তেজনাময়। এটি একটি টিম স্পিরিটের ফলাফল। এ পতাকাটি তৎকালীন ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের উর্বর মস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ। এ পতাকা তৈরিতে আমি সেদিন আদ্যোপান্ত জড়িত ছিলাম। তাই আমার স্মৃতিতে যতটুকু মনে আছে তা জাতির সামনে তুলে ধরছি।
পতাকার ভাবনাটি হঠাৎ করে কারও মাথায় উদয় হয়নি। এটি অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘সিচুয়েশন ডিমান্ডস’। অর্থাৎ একটি পতাকা অতি জরুরি হয়ে পড়েছিল পরিস্থিতির কারণে। আর এটি তৈরি হয়েছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে এক কর্মদিবসের প্রচেষ্টায়। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ এই পতাকাটি প্রথমবারের মতো উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে। সেদিন উত্তোলন অনুষ্ঠানে আগত ছাত্র-জনতার মধ্যে বাঁধভাঙা জোয়ার বয়ে যায়।
১৯৬২ সালে আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হই। তখন আমি কলেজছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ছিল তখন ভয়াবহ। সামরিক সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফ্রন্ট (এনএসএফ)-র দৌরাত্ম্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তখন মিছিল করার সাহস পাচ্ছিল না। ছাত্রলীগের বহু ত্যাগী নেতা প্রকাশ্যে এনএসএফের ক্যাডারদের হাতে নিয়মিত প্রহৃত হচ্ছিলেন। এরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠান বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানকে। তিনি সিরাজ ভাইকে সারা দেশ চষে কিছু অকুতোভয় তরুণ সংগ্রহ করে দিতে বলেন। সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুর কথামতো ৮-১০ জন তরুণ সংগ্রহ করে একদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিয়ে যান। আমি ছিলাম এ দলের অন্যতম সদস্য। বঙ্গবন্ধু আমাদের উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ এক বক্তৃতা করেন। আমরা তার চেহারা, ব্যক্তিত্ব, সাহস, বাচনভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হয় যাই। পরে সিরাজ ভাই আমাদের কানে কানে বীজমন্ত্র দেন। এরপর থেকে আমরা নিয়মিত ইকবাল হলে থাকা শুরু করি। ক্রমে এ হলকে ছাত্রলীগের ঘাঁটিতে পরিণত করি। পরিকল্পনা মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে এনএসএফকে উৎখাত করে আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখি।
১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতে এবং সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে গঠিত হয় নিউক্লিয়াস বা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। এর সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, শেখ মণি এবং আমি। ১৯৬৪ সালে গঠিত হয় বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হন কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টকে পুনর্বিন্যাস করে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’। সিরাজুল আলম খানের পাশাপাশি এ পর্যায়ে নেতৃত্বে আসেন কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব, শেখ ফজলুল হক মণি, মার্শাল মণি প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতা। ১৯৭০ সালে গঠিত হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। আমি ছিলাম এর ডেপুটি কমান্ডার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত হয় মুজিব বাহিনী যার ঢাকা সিটি গেরিলা কমান্ডার ছিলাম আমি। মোস্তফা মোহসীন মন্টু ছিল ঢাকা জেলা কমান্ডার। শেখ মণি ছিলেন আমাদের সুপ্রিম কামান্ডার।
সেদিন ৭০-র ৬ই জুন। সন্ধ্যা হওয়ার পরপরই ইকবাল হলের ১১৬ নং কক্ষে বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাদের ভিড় লেগে যায়। সে সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, মার্শাল মণি প্রমুখ। রুমের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন চিশতি হেলালুর রহমান, ইকরামুল হক, নজরুল, শিব নারায়ণ দাস, রেজা শাহজাহান প্রমুখ ছাত্রনেতা। প্রথমে একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। উপস্থিত সভার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, পতাকার জমিন হবে বাংলার চিরচেনা সবুজ রঙের। তার মাঝখানে থাকবে বৃত্তকার লাল রঙের সূর্যের প্রতীক। এ প্রতীকের মাঝখানে থাকবে সোনালি রঙের বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ছবি। বিষয়টির ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই এর ট্রেসিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্রলীগকর্মী শিব নারায়ণ দাসকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই ট্রেসিংয়ের উপর ড্রয়িং করে তা আরও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য শিব নারায়ণ দাসকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানে বুয়েটে) শেরেবাংলা হলের ৪১০ নম্বর কক্ষে পাঠানো হয়। সেখানে থাকতেন ছাত্রলীগ নেতা হাসানুল হক ইনু (তথ্যমন্ত্রী) এবং সালাউদ্দিন আহম্মেদ। ইনু ভাই এবং শাজাহান ভাই ট্রেসিংটি দেখে একটি সাদা কাগজের উপর চমৎকারভাবে পতাকাটির ড্রয়িং করে দেন। শিব নারায়ণ দাস অতি বিশ্বস্তার সঙ্গে ড্রইংটি মধ্যরাতে এনে সিরাজ ভাইয়ের হাতে পৌঁছে দেন। এখন প্রয়োজন পড়ে দর্জি এবং কাপড়ের। পতাকাটি তৈরি করে এনে দেয়ার জন্য দরকার পড়ে অত্যন্ত সাহসী, দক্ষ এবং বিচক্ষণ এক কর্মীর। ছাত্রলীগের মধ্যে এমন কোন কর্মী আছে, এ গুরু দায়িত্ব সুচারুরূপে বিশ্বস্ততা ও সাহসের সঙ্গে পালন করতে পারবে।
সেদিন মধ্যরাতে আমাকে ডেকে আনা হয় ইকবাল হলের ১১৬নং কক্ষে। আমি ও মোস্তফা মোহসীন মন্টু তখন অপেক্ষা করছিলাম ১৫১নং কক্ষে। তখন রাত আনুমানিক ২টা। সিরাজ ভাই আমাকে কাপড় সংগ্রহ করে দর্জি দিয়ে সেলাই করে ড্রইং মতো পতাকা তৈরি করার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন। আমি তখন মার্শাল কোর্ট কর্তৃক ১৪ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে খুবই সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরা করছি। বঙ্গবন্ধু বহু চেষ্টা করেও আমাদের (আমি, মন্টু ও সেলিম) দণ্ডাদেশ বাতিল করতে পারছিলেন না। এখানে বলে রাখি ১৯৬৯ সালে নেতৃত্বের ইঙ্গিতে আমি, মন্টু ও সেলিম নিউ মার্কেটের ভেতর ৪ পাকিস্তানি সৈন্যকে ঘায়েল করি। আমাদের অনুপস্থিতিতে মার্শাল কোর্ট ১৪ বছর কারাদণ্ড দেয়। এ ১৪ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে স্বাধীনতা পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাই। স্বাধীনতার পর এই দণ্ডাদেশ মওকুফ হয়। যাক সে কথা সিরাজ ভাই আমাকে বলেন, যেখান থেকে পারিস এ ড্রইং অনুযায়ী একটি পতাকা তৈরি করে নিয়ে আয় রাত ফুরাবার পূর্বেই। আমার বিশ্বাস আছে এই কাজটি একমাত্র তুই পারবি।’
সিরাজ ভাই থেকে আমি পতাকা তৈরির দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মনে মনে ছক কষি। কাকে দিয়ে কোথায় গিয়ে এই পতাকা তৈরি করতে হবে তা নিশ্চিত করি। তারপর ড্রাইং হাতে নিয়ে আমার স্কেপ রুট দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হই। প্রথমে নীলক্ষেত বস্তি সংলগ্ন রেললাইন পার হয়ে হোম ইকোনমিক্স কলেজ, আজিমপুর কলোনি এবং আজিমপুর কবরস্থানের প্রাচীর টপকে নিউ মার্কেটের উত্তর পাশ দিয়ে কাঁচাবাজারে চলে আসি। তখন নিউ মার্কেটের ভেতরে ছিল একটি মসজিদ এবং কাঁচা বাজারের পাশেও ছিল একটি টিনের তৈরি মসজিদ। এখন সেখানে নিউ সুপার মার্কেট। এ মসজিদের পাশে ছিল কয়েকটি দোকান ঘর যার একটির মালিক ছিল এক অবাঙালি ব্যক্তি। সে দর্জির কাজ করতো এবং রাতে দোকানেই ঘুমাতো।
আমি সেখানে গিয়ে তার ঘরের দরজা নক করি। সে চিৎকার দিয়ে বলে এতো রাত্রে কে, আমি তখন নিজ পরিচয় দিয়ে বলি, ‘মুঝে এক ঝান্ডা (পতাকা) বানানা হায়, দরওজা খোলো (আমার একটি পতাকা তৈরি করতে হবে, দরজা খোলো)।’ দর্জি ভেতর থেকে বলে, ‘ঝান্ডা তো গুলিস্তান মে মিলতা হ্যায়, উদার যাইয়ে (পতাকা তো গুলিস্তানে পাওয়া যায় সেখানে যান)’। আমি বলি, ‘মুঝে আলাগ এক ঝান্ডা চাইয়ে, দরওজা খোলো’ (আমার একটি ভিন্ন পতাকা দরকার) দরজা খোলো। এই পর্যায়ে আমি দ্রুত দরজা খুলতে বলি। না খুলতে তার পরিণতির কথা বলি। সে দরজা খুলে আমাকে দেখে বলে, খসরু ভাই ‘আপ বহুত তাকলিফ মে হ্যায়’ (আপনি বড় বিচলিত আছেন)।’ আমি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বলি, জ্যায়সা জ্যায়সা ম্যায় চাহুঙ্গা ওয়াসা ওয়াসা ক্যারো।
আমি তখন উত্তেজিত ও ঘর্মাক্ত। সামান্য সময় নষ্ট করার কোন সুযোগ নেই। আমি তাকে ড্রইংটি বের করে খুলে দেখিয়ে বলি, মুঝে এয়স্রা ঝান্ডা বানানা হায়, আভি চাইয়ে’ (আমার এমন একটি পতাকা তৈরি করে দিতে হবে, তাড়াতাড়ি চাই)। আমি তার দোকানে রাখা লাল সবুজ রঙের কাপড়ের বান্ডিল খুঁজতে থাকি। কিন্তু লাল সবুজ রঙের কাপড় খুঁজে পেলাম না। অবাঙালি দর্জি বলে, এই রঙের কাপড় পাওয়া যেতে পারে খালেক দর্জির দোকানে। খালেক দর্জির দোকানটি আবার বলাকা ভবনের তিন তলায় ছাত্রলীগের অফিসের পাশে অবস্থিত। সে দোকানের নাম ‘পাক ফ্যাশান টেইলার্স’। খালেকও দোকানেই রাতযাপন করতো। আমি অবাঙালি দর্জিকে খালেকের দোকানে গিয়ে আমার কথা বলে ড্রইং মতো পতাকা তৈরি করে আনতে বলি। দর্জি শার্টার টেনে সেখানে রওনা হয়। আমি তার দোকানের সামনে একটি টুলে বসে অপেক্ষা করার ভান করি।
অবাঙালি দর্জি রওনা হওয়ার সামান্য পরই আমি চোখের নিমিশে নিউ মার্কেটের ছাদে উঠে মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে অদূরে বলাকা ভবনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। আমি ভাবছিলাম ড্রইং হাতে নিয়ে দর্জি গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের আবার ডেকে না আনে। কারণ তখনকার পরিস্থিতি এমন ছিল, কাউকে বিশ্বাস করা যেত না। সর্বত্রই পাকিস্তানিদের চর অবস্থান করছিল। একটু পরই তার প্রমাণ পাই।
আমি নিউ মার্কেটের ছাদে উঠে উপুড় হয়ে বসে দেখি পাক ফ্যাশন টেইলার্সের দোকানের লাইট জ্বলেছে। এর কয়েক মিনিট পর মেশিনে কাপড় সেলাই করার আওয়াজ ভেসে আসে। এরপর মেশিনের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়, লাইট নিভে যায়। আমি দ্রুত আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে এসে পতাকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দর্জি এসে বলে ‘লিজিয়ে খসরু ভাই, খালেক কা পাছ কাপড়া মিলা, ওহী বানাকে দিয়া’ (নেন খসরু ভাই খালেকের কাছে কাপড় ছিল ও বানিয়েও দিল)।
আমি পতাকাটি খুলে এক ঝলক দেখে তা ভাঁজ করে গেঞ্জির মধ্যে ঢুকিয়ে গন্তব্যে রওনা হই। আমি নিউ মার্কেটের পশ্চিম পাশ দিয়ে এসে আজিমপুর কবরস্থানের প্রাচীরের কাছাকাছি চলে আসি। দেখি নীলক্ষেত-নিউ মার্কেটের মোড় থেকে কয়েকটি গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে ইপিআর গেটের দিকে আসছে। প্রথমে গাড়িগুলোকে ইপিআরের ভেবেছিলাম। আমি টুক করে কবরস্থানের প্রাচীর টপকে ওপারে গিয়ে মাথা উঁচু করে দেখি, গাড়ি থেকে নেমে পাকিস্তানি সৈন্যরা দ্রুত এলাকাটি ঘিরে ফেলেছে। আমি বুঝতে পারি তারা কোথাও থেকে ইনফরমেশন পেয়েছে। এভাবে দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে অসংখ্যবার প্রায় ধরা পড়তে বেঁচে গেছি। ১১ বার নিশ্চিত মৃত্যুর থেকে রক্ষা পেয়েছি। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এ বিষয় নিয়ে লিখব।
আমি শৈশবে বড় হয়েছি আজিমপুর নিউ পল্টন লাইন এলাকায়। সমস্ত এলাকাটি আমার নখ দর্পণে। তখন আজিমপুর কবরস্থান ছিল জঙ্গলে ভর্তি। সন্ধ্যা হলে সেখানে শেয়াল ডাকত। মানুষ দিনের বেলায়ও এ কবরস্থানের ভেতরে যেতে ভয় পেত। আমি দ্রুত গন্তব্যে রওনা হই। কবরস্থানের প্রাচীর টপকে চলে আসি আজিমপুর কলোনির ভিতর। এরপর ওই কলোনির প্রাচীর টপকে বানরের মতো দৌড়ে দৌড়ে চলে আসি হোম ইকোনমিক্স কলেজের প্রাচীরের কাছে। প্রাচীর টপকে চলে আসি কলেজের ভেতরে। তারপর আবার হোম ইকোনমিক্স কলেজের প্রাচীর টপকে চলে আসি নীলক্ষেত বস্তিতে। রেললাইন এবং হলের প্রাচীর টপকে পৌঁছাই ইকবাল হলের পশ্চিম দিকের গেটের কাছে (এখন সেখানে এক্সটেনশন বিল্ডিং)। ওই গেটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকতো আমার কাছে। আমি চাবি বের করে তালা খুলে হলে প্রবেশ করি। উল্লেখ্য, ইকবাল হল থেকে নিরাপদে বের হতে (এক্সিট) এবং নিরাপদে প্রবেশ করতে (ইন্টার) আমি বিশেষ বিশেষ সময় বিশেষ বিশেষ রুট ব্যবহার করতাম যা কেউ জানতো না।
রাত তখন শেষ প্রহর। আমি হলে প্রবেশ করে সিরাজ ভাইয়ের কাছে আসি। দেখি, ছাত্রলীগ নেতারা জড়ো হয়ে বসে ঊর্ধ্বশ্বাসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সিরাজ ভাইয়ের হাতে পতাকাটি তুলে দিলে তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমি জানি তুই পারবি। তখন সবাই বলল খসরুর নামও ইতিহাসে লেখা থাকবে। আমি এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। এরপর ছাত্রলীগ নেতারা পতাকাটি কবে কখন ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় বসেন।
তার কিছুদিন পর সিরাজ ভাই বলেন, পতাকাটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আয়। আমরা (আমি, হোসেন, মুরাদ, রুমি, নাজিম, ভলকু প্রমুখ) একটি জিপে চড়ে পতাকাটি সংগোপনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে উপস্থিত হই। বঙ্গবন্ধুকে আমরা স্বপ্নের সেই পতাকাটি দেখাই। পতাকাটি দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। তার চোখে মুখে যেন আনন্দ ধরে না। বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়ানো ছিলেন সিরাজ ভাই, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারা করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবে কখন প্রকাশ্যে পতাকাটি উড়াবি আমি বলে দিব এখন তা খুব গোপনে রেখে দে’। আমরা পতাকাটি নিয়ে আবার হলে ফিরে আসি।
’৭১-র ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলে ঢাকায় সর্বস্তরের জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন বিকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলা ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত মতে পরদিন ২র মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। ওই দিন বিকালে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের এক প্রতিবাদ সভা কলাভবনের সামনে বটতলায় অনুষ্ঠিত হয়। সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতা শেখ মো. জাহিদ হোসেন ওই পতাকাটি একটি বাঁশের আগায় বেঁধে ইকবাল হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে বটতলায় জড়ো হয়। জয় বাংলা বাহিনীর এ পতাকাটি হাতে নিয়ে রব ভাই তা কলাভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদে ওঠে উত্তোলন করেন এবং ডানে বাঁয়ে বারবার নেড়ে সেখানে বেঁধে দেন। উপস্থিত বিপুল সংখ্যক ছাত্রজনতা করতালি দিয়ে পতাকাটিকে শুভেচ্ছা জানায়। তৈরি হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে প্রথম মাইলফলক। এভাবে আমরা একটির পর একটি মাইলফলক নির্মাণ করে এগিয়ে গেছি চূড়ান্ত বিজয়ের পথে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল আলম খান খসরু
(মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা সিটি গেরিলা কামান্ডার এবং বিএলএফের অন্যতম সদস্য)
বাংলাদেশের পতাকা তৈরির পর্বটি খুবই আকর্ষণীয় এবং উত্তেজনাময়। এটি একটি টিম স্পিরিটের ফলাফল। এ পতাকাটি তৎকালীন ছাত্রলীগের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের উর্বর মস্তিষ্কের বহিঃপ্রকাশ। এ পতাকা তৈরিতে আমি সেদিন আদ্যোপান্ত জড়িত ছিলাম। তাই আমার স্মৃতিতে যতটুকু মনে আছে তা জাতির সামনে তুলে ধরছি।
পতাকার ভাবনাটি হঠাৎ করে কারও মাথায় উদয় হয়নি। এটি অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছিল। ইংরেজিতে একটি কথা আছে, ‘সিচুয়েশন ডিমান্ডস’। অর্থাৎ একটি পতাকা অতি জরুরি হয়ে পড়েছিল পরিস্থিতির কারণে। আর এটি তৈরি হয়েছিল এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশে এক কর্মদিবসের প্রচেষ্টায়। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ এই পতাকাটি প্রথমবারের মতো উত্তোলন করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন প্রাঙ্গণে। সেদিন উত্তোলন অনুষ্ঠানে আগত ছাত্র-জনতার মধ্যে বাঁধভাঙা জোয়ার বয়ে যায়।
১৯৬২ সালে আমি ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত হই। তখন আমি কলেজছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি ছিল তখন ভয়াবহ। সামরিক সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফ্রন্ট (এনএসএফ)-র দৌরাত্ম্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা তখন মিছিল করার সাহস পাচ্ছিল না। ছাত্রলীগের বহু ত্যাগী নেতা প্রকাশ্যে এনএসএফের ক্যাডারদের হাতে নিয়মিত প্রহৃত হচ্ছিলেন। এরকম পরিস্থিতি থেকে উত্তোরণের জন্য বঙ্গবন্ধু ডেকে পাঠান বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা সিরাজুল আলম খানকে। তিনি সিরাজ ভাইকে সারা দেশ চষে কিছু অকুতোভয় তরুণ সংগ্রহ করে দিতে বলেন। সিরাজ ভাই বঙ্গবন্ধুর কথামতো ৮-১০ জন তরুণ সংগ্রহ করে একদিন বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিয়ে যান। আমি ছিলাম এ দলের অন্যতম সদস্য। বঙ্গবন্ধু আমাদের উদ্দেশে নাতিদীর্ঘ এক বক্তৃতা করেন। আমরা তার চেহারা, ব্যক্তিত্ব, সাহস, বাচনভঙ্গি দেখে মুগ্ধ হয় যাই। পরে সিরাজ ভাই আমাদের কানে কানে বীজমন্ত্র দেন। এরপর থেকে আমরা নিয়মিত ইকবাল হলে থাকা শুরু করি। ক্রমে এ হলকে ছাত্রলীগের ঘাঁটিতে পরিণত করি। পরিকল্পনা মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে এনএসএফকে উৎখাত করে আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখি।
১৯৬২ সালে বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতে এবং সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে সশস্ত্র সংগ্রামের লক্ষ্যে গঠিত হয় নিউক্লিয়াস বা স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ। এর সঙ্গে প্রথম থেকে যুক্ত ছিলেন বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতা কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, শেখ মণি এবং আমি। ১৯৬৪ সালে গঠিত হয় বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট। এর সঙ্গে যুক্ত হন কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব প্রমুখ। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধুর অভিপ্রায় অনুযায়ী বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্টকে পুনর্বিন্যাস করে গঠন করা হয় ‘বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স’। সিরাজুল আলম খানের পাশাপাশি এ পর্যায়ে নেতৃত্বে আসেন কাজী আরেফ আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক, আ স ম আবদুর রব, শেখ ফজলুল হক মণি, মার্শাল মণি প্রমুখ ছাত্রলীগ নেতা। ১৯৭০ সালে গঠিত হয় ‘জয় বাংলা বাহিনী’। আমি ছিলাম এর ডেপুটি কমান্ডার। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় গঠিত হয় মুজিব বাহিনী যার ঢাকা সিটি গেরিলা কমান্ডার ছিলাম আমি। মোস্তফা মোহসীন মন্টু ছিল ঢাকা জেলা কমান্ডার। শেখ মণি ছিলেন আমাদের সুপ্রিম কামান্ডার।
সেদিন ৭০-র ৬ই জুন। সন্ধ্যা হওয়ার পরপরই ইকবাল হলের ১১৬ নং কক্ষে বিশিষ্ট ছাত্রলীগ নেতাদের ভিড় লেগে যায়। সে সময়ে সেখানে উপস্থিত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, মার্শাল মণি প্রমুখ। রুমের বাইরে অপেক্ষা করছিলেন চিশতি হেলালুর রহমান, ইকরামুল হক, নজরুল, শিব নারায়ণ দাস, রেজা শাহজাহান প্রমুখ ছাত্রনেতা। প্রথমে একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। উপস্থিত সভার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, পতাকার জমিন হবে বাংলার চিরচেনা সবুজ রঙের। তার মাঝখানে থাকবে বৃত্তকার লাল রঙের সূর্যের প্রতীক। এ প্রতীকের মাঝখানে থাকবে সোনালি রঙের বাংলাদেশের ভূখণ্ডের ছবি। বিষয়টির ওপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার পরপরই এর ট্রেসিংয়ের দায়িত্ব দেয়া হয় ছাত্রলীগকর্মী শিব নারায়ণ দাসকে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওই ট্রেসিংয়ের উপর ড্রয়িং করে তা আরও নিখুঁতভাবে সম্পন্ন করার জন্য শিব নারায়ণ দাসকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমানে বুয়েটে) শেরেবাংলা হলের ৪১০ নম্বর কক্ষে পাঠানো হয়। সেখানে থাকতেন ছাত্রলীগ নেতা হাসানুল হক ইনু (তথ্যমন্ত্রী) এবং সালাউদ্দিন আহম্মেদ। ইনু ভাই এবং শাজাহান ভাই ট্রেসিংটি দেখে একটি সাদা কাগজের উপর চমৎকারভাবে পতাকাটির ড্রয়িং করে দেন। শিব নারায়ণ দাস অতি বিশ্বস্তার সঙ্গে ড্রইংটি মধ্যরাতে এনে সিরাজ ভাইয়ের হাতে পৌঁছে দেন। এখন প্রয়োজন পড়ে দর্জি এবং কাপড়ের। পতাকাটি তৈরি করে এনে দেয়ার জন্য দরকার পড়ে অত্যন্ত সাহসী, দক্ষ এবং বিচক্ষণ এক কর্মীর। ছাত্রলীগের মধ্যে এমন কোন কর্মী আছে, এ গুরু দায়িত্ব সুচারুরূপে বিশ্বস্ততা ও সাহসের সঙ্গে পালন করতে পারবে।
সেদিন মধ্যরাতে আমাকে ডেকে আনা হয় ইকবাল হলের ১১৬নং কক্ষে। আমি ও মোস্তফা মোহসীন মন্টু তখন অপেক্ষা করছিলাম ১৫১নং কক্ষে। তখন রাত আনুমানিক ২টা। সিরাজ ভাই আমাকে কাপড় সংগ্রহ করে দর্জি দিয়ে সেলাই করে ড্রইং মতো পতাকা তৈরি করার গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন। আমি তখন মার্শাল কোর্ট কর্তৃক ১৪ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে খুবই সাবধানতার সঙ্গে চলাফেরা করছি। বঙ্গবন্ধু বহু চেষ্টা করেও আমাদের (আমি, মন্টু ও সেলিম) দণ্ডাদেশ বাতিল করতে পারছিলেন না। এখানে বলে রাখি ১৯৬৯ সালে নেতৃত্বের ইঙ্গিতে আমি, মন্টু ও সেলিম নিউ মার্কেটের ভেতর ৪ পাকিস্তানি সৈন্যকে ঘায়েল করি। আমাদের অনুপস্থিতিতে মার্শাল কোর্ট ১৪ বছর কারাদণ্ড দেয়। এ ১৪ বছরের দণ্ডাদেশ মাথায় নিয়ে স্বাধীনতা পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাই। স্বাধীনতার পর এই দণ্ডাদেশ মওকুফ হয়। যাক সে কথা সিরাজ ভাই আমাকে বলেন, যেখান থেকে পারিস এ ড্রইং অনুযায়ী একটি পতাকা তৈরি করে নিয়ে আয় রাত ফুরাবার পূর্বেই। আমার বিশ্বাস আছে এই কাজটি একমাত্র তুই পারবি।’
সিরাজ ভাই থেকে আমি পতাকা তৈরির দায়িত্ব পাওয়ার পরপরই মনে মনে ছক কষি। কাকে দিয়ে কোথায় গিয়ে এই পতাকা তৈরি করতে হবে তা নিশ্চিত করি। তারপর ড্রাইং হাতে নিয়ে আমার স্কেপ রুট দিয়ে দ্রুত অগ্রসর হই। প্রথমে নীলক্ষেত বস্তি সংলগ্ন রেললাইন পার হয়ে হোম ইকোনমিক্স কলেজ, আজিমপুর কলোনি এবং আজিমপুর কবরস্থানের প্রাচীর টপকে নিউ মার্কেটের উত্তর পাশ দিয়ে কাঁচাবাজারে চলে আসি। তখন নিউ মার্কেটের ভেতরে ছিল একটি মসজিদ এবং কাঁচা বাজারের পাশেও ছিল একটি টিনের তৈরি মসজিদ। এখন সেখানে নিউ সুপার মার্কেট। এ মসজিদের পাশে ছিল কয়েকটি দোকান ঘর যার একটির মালিক ছিল এক অবাঙালি ব্যক্তি। সে দর্জির কাজ করতো এবং রাতে দোকানেই ঘুমাতো।
আমি সেখানে গিয়ে তার ঘরের দরজা নক করি। সে চিৎকার দিয়ে বলে এতো রাত্রে কে, আমি তখন নিজ পরিচয় দিয়ে বলি, ‘মুঝে এক ঝান্ডা (পতাকা) বানানা হায়, দরওজা খোলো (আমার একটি পতাকা তৈরি করতে হবে, দরজা খোলো)।’ দর্জি ভেতর থেকে বলে, ‘ঝান্ডা তো গুলিস্তান মে মিলতা হ্যায়, উদার যাইয়ে (পতাকা তো গুলিস্তানে পাওয়া যায় সেখানে যান)’। আমি বলি, ‘মুঝে আলাগ এক ঝান্ডা চাইয়ে, দরওজা খোলো’ (আমার একটি ভিন্ন পতাকা দরকার) দরজা খোলো। এই পর্যায়ে আমি দ্রুত দরজা খুলতে বলি। না খুলতে তার পরিণতির কথা বলি। সে দরজা খুলে আমাকে দেখে বলে, খসরু ভাই ‘আপ বহুত তাকলিফ মে হ্যায়’ (আপনি বড় বিচলিত আছেন)।’ আমি অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বলি, জ্যায়সা জ্যায়সা ম্যায় চাহুঙ্গা ওয়াসা ওয়াসা ক্যারো।
আমি তখন উত্তেজিত ও ঘর্মাক্ত। সামান্য সময় নষ্ট করার কোন সুযোগ নেই। আমি তাকে ড্রইংটি বের করে খুলে দেখিয়ে বলি, মুঝে এয়স্রা ঝান্ডা বানানা হায়, আভি চাইয়ে’ (আমার এমন একটি পতাকা তৈরি করে দিতে হবে, তাড়াতাড়ি চাই)। আমি তার দোকানে রাখা লাল সবুজ রঙের কাপড়ের বান্ডিল খুঁজতে থাকি। কিন্তু লাল সবুজ রঙের কাপড় খুঁজে পেলাম না। অবাঙালি দর্জি বলে, এই রঙের কাপড় পাওয়া যেতে পারে খালেক দর্জির দোকানে। খালেক দর্জির দোকানটি আবার বলাকা ভবনের তিন তলায় ছাত্রলীগের অফিসের পাশে অবস্থিত। সে দোকানের নাম ‘পাক ফ্যাশান টেইলার্স’। খালেকও দোকানেই রাতযাপন করতো। আমি অবাঙালি দর্জিকে খালেকের দোকানে গিয়ে আমার কথা বলে ড্রইং মতো পতাকা তৈরি করে আনতে বলি। দর্জি শার্টার টেনে সেখানে রওনা হয়। আমি তার দোকানের সামনে একটি টুলে বসে অপেক্ষা করার ভান করি।
অবাঙালি দর্জি রওনা হওয়ার সামান্য পরই আমি চোখের নিমিশে নিউ মার্কেটের ছাদে উঠে মাথা নিচু করে দৌড়ে এসে অদূরে বলাকা ভবনের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। আমি ভাবছিলাম ড্রইং হাতে নিয়ে দর্জি গিয়ে পাকিস্তানি আর্মিদের আবার ডেকে না আনে। কারণ তখনকার পরিস্থিতি এমন ছিল, কাউকে বিশ্বাস করা যেত না। সর্বত্রই পাকিস্তানিদের চর অবস্থান করছিল। একটু পরই তার প্রমাণ পাই।
আমি নিউ মার্কেটের ছাদে উঠে উপুড় হয়ে বসে দেখি পাক ফ্যাশন টেইলার্সের দোকানের লাইট জ্বলেছে। এর কয়েক মিনিট পর মেশিনে কাপড় সেলাই করার আওয়াজ ভেসে আসে। এরপর মেশিনের আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়, লাইট নিভে যায়। আমি দ্রুত আবার পূর্বের জায়গায় ফিরে এসে পতাকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকি। দর্জি এসে বলে ‘লিজিয়ে খসরু ভাই, খালেক কা পাছ কাপড়া মিলা, ওহী বানাকে দিয়া’ (নেন খসরু ভাই খালেকের কাছে কাপড় ছিল ও বানিয়েও দিল)।
আমি পতাকাটি খুলে এক ঝলক দেখে তা ভাঁজ করে গেঞ্জির মধ্যে ঢুকিয়ে গন্তব্যে রওনা হই। আমি নিউ মার্কেটের পশ্চিম পাশ দিয়ে এসে আজিমপুর কবরস্থানের প্রাচীরের কাছাকাছি চলে আসি। দেখি নীলক্ষেত-নিউ মার্কেটের মোড় থেকে কয়েকটি গাড়ি হেডলাইট জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে ইপিআর গেটের দিকে আসছে। প্রথমে গাড়িগুলোকে ইপিআরের ভেবেছিলাম। আমি টুক করে কবরস্থানের প্রাচীর টপকে ওপারে গিয়ে মাথা উঁচু করে দেখি, গাড়ি থেকে নেমে পাকিস্তানি সৈন্যরা দ্রুত এলাকাটি ঘিরে ফেলেছে। আমি বুঝতে পারি তারা কোথাও থেকে ইনফরমেশন পেয়েছে। এভাবে দেশের জন্য কাজ করতে গিয়ে অসংখ্যবার প্রায় ধরা পড়তে বেঁচে গেছি। ১১ বার নিশ্চিত মৃত্যুর থেকে রক্ষা পেয়েছি। ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে এ বিষয় নিয়ে লিখব।
আমি শৈশবে বড় হয়েছি আজিমপুর নিউ পল্টন লাইন এলাকায়। সমস্ত এলাকাটি আমার নখ দর্পণে। তখন আজিমপুর কবরস্থান ছিল জঙ্গলে ভর্তি। সন্ধ্যা হলে সেখানে শেয়াল ডাকত। মানুষ দিনের বেলায়ও এ কবরস্থানের ভেতরে যেতে ভয় পেত। আমি দ্রুত গন্তব্যে রওনা হই। কবরস্থানের প্রাচীর টপকে চলে আসি আজিমপুর কলোনির ভিতর। এরপর ওই কলোনির প্রাচীর টপকে বানরের মতো দৌড়ে দৌড়ে চলে আসি হোম ইকোনমিক্স কলেজের প্রাচীরের কাছে। প্রাচীর টপকে চলে আসি কলেজের ভেতরে। তারপর আবার হোম ইকোনমিক্স কলেজের প্রাচীর টপকে চলে আসি নীলক্ষেত বস্তিতে। রেললাইন এবং হলের প্রাচীর টপকে পৌঁছাই ইকবাল হলের পশ্চিম দিকের গেটের কাছে (এখন সেখানে এক্সটেনশন বিল্ডিং)। ওই গেটের ডুপ্লিকেট চাবি থাকতো আমার কাছে। আমি চাবি বের করে তালা খুলে হলে প্রবেশ করি। উল্লেখ্য, ইকবাল হল থেকে নিরাপদে বের হতে (এক্সিট) এবং নিরাপদে প্রবেশ করতে (ইন্টার) আমি বিশেষ বিশেষ সময় বিশেষ বিশেষ রুট ব্যবহার করতাম যা কেউ জানতো না।
রাত তখন শেষ প্রহর। আমি হলে প্রবেশ করে সিরাজ ভাইয়ের কাছে আসি। দেখি, ছাত্রলীগ নেতারা জড়ো হয়ে বসে ঊর্ধ্বশ্বাসে আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। সিরাজ ভাইয়ের হাতে পতাকাটি তুলে দিলে তিনি আমায় জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘আমি জানি তুই পারবি। তখন সবাই বলল খসরুর নামও ইতিহাসে লেখা থাকবে। আমি এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি। এরপর ছাত্রলীগ নেতারা পতাকাটি কবে কখন ব্যবহার করা যায় তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় বসেন।
তার কিছুদিন পর সিরাজ ভাই বলেন, পতাকাটি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে আয়। আমরা (আমি, হোসেন, মুরাদ, রুমি, নাজিম, ভলকু প্রমুখ) একটি জিপে চড়ে পতাকাটি সংগোপনে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে উপস্থিত হই। বঙ্গবন্ধুকে আমরা স্বপ্নের সেই পতাকাটি দেখাই। পতাকাটি দেখে তিনি উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেন। তার চোখে মুখে যেন আনন্দ ধরে না। বঙ্গবন্ধুর পেছনে দাঁড়ানো ছিলেন সিরাজ ভাই, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। তারা করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘কবে কখন প্রকাশ্যে পতাকাটি উড়াবি আমি বলে দিব এখন তা খুব গোপনে রেখে দে’। আমরা পতাকাটি নিয়ে আবার হলে ফিরে আসি।
’৭১-র ১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দিলে ঢাকায় সর্বস্তরের জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সেদিন বিকালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীন বাংলা ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্ত মতে পরদিন ২র মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। ওই দিন বিকালে স্বাধীন বাংলা সংগ্রাম পরিষদের এক প্রতিবাদ সভা কলাভবনের সামনে বটতলায় অনুষ্ঠিত হয়। সিরাজ ভাইয়ের নির্দেশে ছাত্রলীগ নেতা শেখ মো. জাহিদ হোসেন ওই পতাকাটি একটি বাঁশের আগায় বেঁধে ইকবাল হল থেকে মিছিল নিয়ে এসে বটতলায় জড়ো হয়। জয় বাংলা বাহিনীর এ পতাকাটি হাতে নিয়ে রব ভাই তা কলাভবনের গাড়ি বারান্দার ছাদে ওঠে উত্তোলন করেন এবং ডানে বাঁয়ে বারবার নেড়ে সেখানে বেঁধে দেন। উপস্থিত বিপুল সংখ্যক ছাত্রজনতা করতালি দিয়ে পতাকাটিকে শুভেচ্ছা জানায়। তৈরি হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পথে প্রথম মাইলফলক। এভাবে আমরা একটির পর একটি মাইলফলক নির্মাণ করে এগিয়ে গেছি চূড়ান্ত বিজয়ের পথে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা কামরুল আলম খান খসরু
(মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা সিটি গেরিলা কামান্ডার এবং বিএলএফের অন্যতম সদস্য)
No comments