আমরা অনড় নই , সুষ্ঠু নির্বাচনের গ্যারান্টি চাই -একান্ত সাক্ষাৎকারে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
নয়া দিগন্ত : দীর্ঘ দিন পর ৫ জানুয়ারির বর্ষপূর্তিতে আপনারা শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করলেন। এর মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক অচলাবস্থার কি অবসান ঘটতে যাচ্ছে?
মির্জা ফখরুল : এটা বলা খুব মুশকিল। কারণ বর্তমান সরকারের আচরণ কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যায় না। এ কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কখনো তারা গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে কিছুটা ছাড় দেয় আবার কখনো শক্ত অবস্থানে থাকে। একদমই কোনো সুযোগ থাকে না। কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমাদের ঘরোয়া কর্মসূচি পালন করতে পারতাম না। এখন পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর থেকে এই সুযোগ কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। তাও এটি কতদিন থাকবে তা আমরা জানি না।
নয়া দিগন্ত : পৌরসভা নির্বাচন থেকে তাহলে বিএনপির কী অর্জন হলো?
মির্জা ফখরুল : পৌরসভা নির্বাচন থেকে আমাদের অর্জন হলো, আমরা জনগণের কাছে যেতে পারছি। কিছুটা সুযোগ পাচ্ছি। যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল আমরা কোথাও যেতে পারছিলাম না, আমাদের নেতাকর্মীরা বেরুতে পারছিল না, সে জায়গায় এরা প্রকাশ্য এসে রাজনীতির কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : সরকার তো বলছে পৌরসভা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলকও হয়েছে।
মির্জা ফখরুল : সরকারের কথায় তো আমরা সঠিক বিচার করতে পারব না। কারণ, এই সরকারের চরিত্র আমরা জানি। এটি পুরোপুরিভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার এবং যে নির্বাচনের মাধ্যমে এরা ক্ষমতায় আছে সে নির্বাচনের কোনো নৈতিক বৈধতা নেই। এ কারণে এরা সবসময় অস্থিরতায় থাকে এবং আস্থাহীনতায় ভোগে। যে কারণে বিরোধী দলের ওপর তারা বেশি করে চড়াও হয়। সে কারণে এরা বলে নির্বাচন ভালো হয়েছে। পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু সুন্দর হবে এটা আমরা আশা করিনি। আমরা বলেছিলাম, নির্বাচনে যাচ্ছি আন্দোলনের অংশ হিসেবে। অর্থাৎ এটাকে নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাবো এবং তাদের সামনে আমাদের কথাগুলো বলব। সে ক্ষেত্রে আরেকবার আমাদের লাভ হয়েছে, আমরা বাইরে আসতে পেরেছি, আবারো জনগণের সামনে প্রমাণ করতে পেরেছি এদের সময় নির্বাচন কিভাবে হচ্ছে। আমাদের যে দাবি নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার দরকার, তা আবারো প্রতিষ্ঠিত হলো। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দরকার। আমাদের তো ইংল্যান্ড আমেরিকা দিয়ে চিন্তা করলে চলবে না। এমনকি ভারত দিয়ে তুলনা করলে চলবে না। এই নির্বাচনে প্রমাণ হলো নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হবে না।
নয়া দিগন্ত : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের তো মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে কী আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না?
মির্জা ফখরুল : বিষয়টাকে আমরা অনড়ভাবে দেখতে চাই না। আমরা বলছি নির্বাচনের সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকতে হবে। অর্থাৎ সেই সরকার সরাসরি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। নির্বাচন কমিশন কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তাদের বাজেট, অর্থ সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু তাদের লোকবল কম, তাদের প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। যখন একটি সরকার থাকে তখন প্রশাসন সে সরকারের অনুগত থাকে। এটাই প্রশাসনের চরিত্র। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দলীয় সরকারের অধীনে যেহেতু প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকতে পারে না, সে কারণে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা এসেছে।
নয়া দিগন্ত : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাহলে কী আপনার এখনো অনড়?
মির্জা ফখরুল : না, কথাগুলো এভাবে বললে হবে না। প্রথমে বলেছি আমরা অনড় নই। ধরে নিই, যদি এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, সরকার নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য। এক্ষেত্রে আলোচনা, সমঝোতা এবং সংবিধানের ব্যাপার রয়েছে। এ কারণে আমরা বলছি, এ নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে আমরা একটা জায়গায় আসতে পারি কি না, যেখান থেকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আমরা পাবো। মূল কথা হলো নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সেই সংলাপের সম্ভাবনা কতটুকু?
মির্জা ফখরুল : আমরা তো বারবার বলছি। সরকারপক্ষ তো সারা দিচ্ছে না। কত ধরনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এসব শর্ত দিয়ে তো সংলাপ হবে না। সংলাপ করতে হলে খোলামনে আসতে হবে।
নয়া দিগন্ত : যদি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব আসে, সে ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী হবে।
মির্জা ফখরুল : যদির ভিত্তিতে কোনো রাজনীতিবিদ বক্তব্য দিতে পারে না। কারণ এতে অনেক ভুল বোঝাবুঝি বা সমস্যা হতে পারে। আমরা বলতে চাই, নির্বাচনের জন্য যদি একটি অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে, তাহলে আমরা যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে রাজি আছি। শর্ত হচ্ছে নিরপেক্ষ এবং যেকোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত পরিবেশে নির্বাচন হতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সংলাপও হচ্ছে না আবার কিছুটা পরিবেশ ফিরে পাচ্ছেন, এখন কি বিএনপি দল পুনর্গঠনের দিকে যাবে?
মির্জা ফখরুল : দল পুনর্গঠনের চিন্তাভাবনা আমরা প্রথম থেকেই করছি, কিন্তু সরকারের আচরণের কারণে তা আমরা ফলপ্রসূ করতে পারিনি। ভয়ভীতি, দমন, পীড়নের কারণে সভা সমাবেশ আমরা করতে পারিনি। এখন আমরা সাংগঠনিক কাজ শুরু করেছি। দ্রুত এসব প্রক্রিয়া শেষ করে কাউন্সিল করতে চাই।
নয়া দিগন্ত : সাংগঠনিক কার্যক্রমের অভাবে তৃণমূলে এক ধরনের হতাশা আছে বলে মনে করা হয়।
মির্জা ফখরুল : দেখুন, আমি খোলামেলাভাবে বলতে চাই সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের আচরণের ওপর। আজকে যদি আমার থানার প্রেসিডেন্ট বা জেলার প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি জেলে থাকেন তাহলে তো সাংগঠনিক কার্যক্রম থমকে যাবে। আমরা কর্মসূচি দেয়ার পর দফায় দফায় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনো বহু নেতাকর্মী জেলে রয়েছে। প্রায় ছয় হাজারের মতো নেতাকর্মী জেলে রয়েছে। এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। মুক্ত পরিবেশ ছাড়া আমরা কোনোভাবেই সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারব না।
নয়া দিগন্ত : জোটের মধ্যে কিন্তু বিরোধ দেখা যাচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ জোট থেকে বের হয়ে গেছে।
মির্জা ফখরুল : দেখুন, বাংলাদেশে এ ধরনের রাজনীতি নতুন নয়। বহু আগে থেকেই এমন জোট গঠন হয়, জোট ভাঙে। জোট থেকে বেরিয়ে যায়, আবার জোটে আসে। সংসদীয় গণতন্ত্র আছে এমন রাজনীতিতে এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ভারতে রাজ্য সরকারে যে জোট থাকে, জাতীয় নির্বাচনে আবার সে জোট থাকছে না, ভেঙে যাচ্ছে। এটা হতেই পারে। জোট গঠন বা ভেঙে যাওয়া সংসদীয় রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্য।
নয়া দিগন্ত : ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন বিএনপি ভাঙনের দিকে যেতে পারে। সেরকম শঙ্কা আছে কি?
মির্জা ফখরুল : এগুলো কথার কথা। আমরা যারা রাজনীতি করি তারা বহু কথা বলি, যা আমরা নিজেরাও মনে করি না। যার পেছনে কোনো অর্থ থাকে না। রাজনীতির কারণে বলতে হয়, তাই বলা। এ ছাড়া বিএনপি ভাঙার চেষ্টা সবসময় হয়ে এসেছে। আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকার খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এমনকি জোট ভাঙার জন্য চেষ্টা করে তারা সফল হয়নি। আমরা ক্ষমতা থেকে প্রায় আট বছর বাইরে। বিএনপির প্রথমসারির বা পরিচিত মুখ কাউকে দল থেকে বের করতে পারেনি। আবার ২০ দলের যারা প্রধান শক্তি তাদেরও জোট থেকে বের করতে পারেনি। আবার যারা বেরিয়ে গেছে তাদের একটা গ্রুপ কিন্তু জোটে থেকে যাচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : জোটের প্রসঙ্গে আরেকটি দিক সামনে চলে এসেছে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে সরকার নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কী।
মির্জা ফখরুল : যদি রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করি তাহলে আমি মনে করি, জামায়াত নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগের জন্য লাভ হবে না। এ কারণে লাভ হবে না, জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করা রাজনৈতিক দল। দলটি পাকিস্তান আমল থেকে রাজনীতি করে আসছে। দলটি সাংবিধানিক রাজনীতি করে। এই দলকে যদি আপনি নিষিদ্ধ করে দেন; এই দলের আদর্শভিত্তিক একটি বড় কর্মীবাহিনী আছে। এই কর্মীবাহিনী কোথায় যাবে? এই কর্মীবাহিনী হয় আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাবে অথবা তারা অন্য দলের সাথে যুক্ত হবে। তাতে তো আওয়ামী লীগের লাভ হবে না। কারণ আওয়ামী লীগের রাজনীতি আর জামায়াতের রাজনীতি এক নয়। এমনকি কাছাকাছিও নয়। সুতরাং এতে আওয়ামী লীগের লাভ হবে বলে মনে হয় না। যে কারণে আমার মনে হয় মুখে তারা যাই বলুক নিষিদ্ধ করব; আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে বলে আমার মনে হয় না। সংসদীয় রাজনীতিতে অনেক যোগ বিয়োগ আছে। কোন দল থাকলে লাভ হবে কোন দল থাকলে হবে না। আসলে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিএনপি -জামায়াতের জোটকে ভেঙে ফেলা। এই জোট ভোটের রাজনীতির যোগ বিয়োগে তাদের জন্য ক্ষতিকর। এটাই তাদের আসল সমস্যা। এ কারণে তারা চায় এই জোট ভাঙতে।
নয়া দিগন্ত : বিএনপি জাতীয়তাবাদী ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসের রাজনীতি করছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রবাহে বিএনপি কি নতুন বিন্যাসের চিন্তা করছে?
মির্জা ফখরুল : বিএনপির নতুন বিন্যাসের প্রয়োজন নেই। আপনি যদি বিএনপির ঘোষণাপত্র, মেনিফেস্টো দেখেন- বিএনপির খুব স্পষ্ট কথাবার্তা বলা আছে। বিএনপি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসের রাজনীতি করে, ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসে রাজনীতি করে, উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে। এই দিকটি খুব স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে কোনো অস্পষ্টতা নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনীতিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতি থাকে।
নয়া দিগন্ত : আপনি নিজেও বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তনের কথা বলেছেন সেটি কেমন?
মির্জা ফখরুল : আমি পরিবর্তনের কথা বলেছি রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে। আমরা যে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিই এবং যেভাবে প্রচার করি, তা এখন প্রযুক্তিনির্ভর হওয়া উচিত। কারণ দুনিয়া বদলে গেছে। প্রযুক্তি এমন জায়গায় গেছে, এখন আর জনসভা করার দরকার হয় না। ধরুন ম্যাডামের বক্তব্যের জন্য টেলিভিশনে যদি আমরা আধা ঘণ্টার সময় পাই। সবগুলো চ্যানেলে তার বক্তব্য প্রচার করা হয়, তাহলে তো জনসভার কাজ হয়ে যায়। তাহলে তো লোক জরো করে এনে বক্তব্য দেয়ার দরকার হয় না। এই দিকগুলোর কথা আমি বলছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এখন পুরনো চিন্তার মধ্যে আছি। এখন যদি ম্যাডামের টুইটার বা ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আমরা প্রচার চালাতে পারি। এখন তো গ্রামের নারীদের হাতে টেলিফোন আছে। এ ধরনের প্রচারণায় সুবিধা হবে বেশি ফল পাওয়া যাবে, খরচ কম হবে। বেশি লোকের কাছে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু এসব জায়গায় এখন পর্যন্ত আমরা যেতে পারছি না। আবার নানারকম আইনি বিধি-নিষেধও আছে, সেগুলোয় মাথায় রাখতে হচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় জঙ্গিবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিএনপি পৃষ্ঠপোষকতা করে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী।
মির্জা ফখরুল : এই ইস্যুটাই একটি নোংরা রাজনীতি। বিএনপি কোনো মতেই, কোনো দিনেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে ছিল না এবং বিশ্বাসও করে না। বিএনপি একটি সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এ দলের তো কোনো গুপ্তহত্যায় জড়ানোর প্রয়োজন নেই। এটাই হচ্ছে মূল কথা। এসব হচ্ছে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ। যারা করছে তারা বাংলাদেশে উগ্রবাদ তৈরি হচ্ছে, জঙ্গিবাদ তৈরি হচ্ছে- এ ধরনের কথাবার্তা বলে। এখানে আইএস আছে, জঙ্গিবাদ আছে- এসব বলে লাভ কার ক্ষতি কার? সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের। যদি সত্যিই এ ধরনের জঙ্গিবাদ এ দেশে আনা হয়, তাহলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে বাংলাদেশের মানুষের।
বাংলাদেশ একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের মানুষ শান্তিতে সবাইকে নিয়ে বাস করতে চায়। এখানে সব ধর্মের মানুষ এক সাথে থাকে। এখানে যেমন ব্লগাররা আছে, তেমনি কট্টর ধর্মবিশ্বাসী লোকজনও আছে। আগে তো কখনো শুনিনি এদের মারামারি করতে হবে। কিছু স্বার্থান্বেষী লোক এগুলো করাচ্ছে, বাংলাদেশকে উগ্রবাদী ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করার জন্য। আমরা কখনো এমন পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। আমরা বারবার বলেছি, যখন গণতন্ত্রকে সঙ্কোচন করবেন, মুখ বন্ধ করবেন তার সুযোগ উগ্রবাদীরা নেবে।
নয়া দিগন্ত : জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে বিএনপি কী ভুমিকা রাখতে চায়?
মির্জা ফখরুল : বিএনপি একটি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা প্রতিরোধ করতে একটি জাতীয় ঐকমত্য দরকার। সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বসতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে হবে। এ দেশে আলেম-ওলামাদের সমাজে বড় ধরনের ভূমিকা আছে। তাদের সাথে বসেন, কথা বলেন। মানুষের কাছে কথা চলে যাক সন্ত্রাসের এই পথ সঠিক পথ নয়। এই পথ ইসলামের নয়। যারা ইসলামের কথা বলে ভুল দিকে পরিচালিত করতে চায় তাদের পথ ইসলামের পথ নয়। এই কথাটা সবাইকে একসাথে বলতে হবে। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে এই প্রবণতাকে বন্ধ করা যেতে পারে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে কেন তরুণেরা আইএসে যোগ দিচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ তাদের সামনে বিকল্প কোনো দর্শন নেই। বিকল্প রাজনীতি নেই। তারা ও দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এত অন্যায় অবিচার দেখে তারা হতাশা থেকে ওদিকে ঝুঁকছে। আপনি যদি গণতন্ত্রকে সামনে আনতে পারেন, তাহলে কোনো দিন এরা ও দিকে যাবে না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ দিন। কথা বলতে দিন। মতামতকে গুরুত্ব দিন। সুন্দর নির্বাচন দিন। যদি কেউ জানে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তার পক্ষে এনে সরকার গঠন করতে পারব, তখন কেন সে অন্য দিকে যাবে।
নয়া দিগন্ত : আপনি জাতীয় ঐক্যের কথা বললেন। কিন্তু ক্ষমাতসীন দলের নেতারা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে বিএনপির বর্তমান অবস্থান জাতীয় ঐক্যের পথে অন্তরায়- আপনার বক্তব্য কী?
মির্জা ফখরুল : ওরা এ কথা আজীবন বলে আসছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশে আর কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। ওরা ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি? আসলে এটা তাদের মাইন্ডসেট। মনের মধ্যে ঢুকে আছে। ওরাই প্রভু, ওরাই জমিদার, ওরাই তালুকদার, ওরাই সব। বাকি আর কেউ কিছু না। আমি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। আমি বিএনপি করি কেন? জিয়াউর রহমান কী ছিলেন? রণাঙ্গনে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা বিএনপিতে বেশি আছে। তারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। এ ধরনের কথা বলার অর্থ হচ্ছে মূল ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয়া।
নয়া দিগন্ত : মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের কথা বললেন কিন্তু তাকে তো পাকিস্তানের গুপ্তচর বলা হচ্ছে। এমনকি তার কবর সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানা যাচ্ছে। বিষয়টি কিভাবে দেখেন?
মির্জা ফখরুল : সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত হবে আত্মহত্যার শামিল। আমি মনে করি, তাদের যদি এ ধরনের দুরভিসন্ধি থাকে, বাংলাদেশের মানুষ কখনো এটা মেনে নেবে না।
নয়া দিগন্ত : আমরা দেখছি সরকার উন্নয়নের কথা বলছে। এমনও বলা হচ্ছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আরো কয়েক টার্ম সরকারের ক্ষমতায় থাকা দরকার।
মির্জা ফখরুল : আসলে সরকার তাদের পুরনো আশা দেখছে। ১৯৭৫ সালে যখন তারা একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করে, তখন তাদের কথা এরকমই ছিল। তারা গণতন্ত্রের বদলে একটি রেজিমেন্টেড পলিটিকস দরকার বলে মনে করেছিল। গণতন্ত্র নয় উন্নয়ন দিয়ে জনগণের সমস্যা সমাধান করতে চায়। বাস্তবতা হচ্ছে, যে রাজনৈতিক দর্শন এখন পৃথিবী থেকে বাদ হয়ে গেছে সমাজতন্ত্র বা একদলীয় শাসন, আওয়ামী লীগ সেটি ধরে রাখতে চায়। আমাদের দেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে গণতন্ত্রমনা। এমন দেশে এ ধরনের রাজনীতি হবে আত্মহত্যার রাজনীতি। এগুলো বলে সরকার আরো জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। যদি সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে তা প্রমাণ হবে।
আর উন্নয়ন তো গণতন্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। সরকারের মধ্যে যদি জনগণের মতের প্রতিফলন না থাকে তা হলে তো উন্নয়ন হবে না। এখন যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে তা কোন ধরনের উন্নয়ন। আমরা দেখছি ঢাকা শহরের মধ্যে দৃশ্যমান কয়েকটি ওভারব্রিজ , মেট্রোরেলের কাজ শুরু করা হচ্ছে। এগুলোর সাথে সাধারণ জনগণের সম্পর্ক খুব কম। গোটা বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা কিন্তু ঢাকায় একটি ফ্লাইওভার হলে কি উন্নয়ন হবে? রেলওয়ে একেবারে ডুবতে বসেছে। শিক্ষা এখন সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে গেছে। সাধারণ মানুষ কোনো স্বাস্থ্যসেবা পায় না। তা হলে কোথায় উন্নয়ন হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিদেশীরা চলে যাচ্ছে। দেশী বিনিয়োগকারীরা অন্য দেশে বিনিয়োগ করছে । এমন হাজার দিক আছে। সিপিডি কয়েক দিন আগে বলেছে, বাংলাদেশ শান্ত অবস্থায় থাকলেও অর্থনীতির গতি নেই। শুধু কথা বলে বা নানা ধরনের তথ্য দিয়ে উন্নয়ন হয় না।
নয়া দিগন্ত : প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিএনপি কি কোনো মূল্যায়ন করছে?
মির্জা ফখরুল : আমাদের কাছে মনে হয় শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা পৃথিবীতে ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। সে পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি আরব সম্প্রতি একটি জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর লক্ষ্য স্পষ্ট নয়। ইরান ও ইয়েমেনে দেশটির সাথে বিরোধ চলছে। সিরিয়া নিয়ে নানা স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য অস্থির। একইভাবে বাংলাদেশে ভূ-রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। চীন ও ভারত এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আবার রাশিয়ার তৎপরতা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্র্যাগমেটিক চিন্তাভাবনা খুব জরুরি। সেদিক থেকে বিএনপি চিন্তা করছে। আপনি তুরস্কের কথা বলতে পারেন। তুরস্ক কিন্তু আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। কারণ তুরস্কে গণতন্ত্র আছে। নিয়মিত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হচ্ছে। আবার ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলো পারমাণবিক চুক্তি করেছে, যা এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। আবার পাকিস্তান পশ্চিম এবং চীনের সাথে এমনকি ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আঞ্চলিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দিকে এখন আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। পররাষ্ট্রনীতিতে নিজ দেশের স্বার্থ বড় কথা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিজের স্বার্থ দেখা হচ্ছে ভালো রাজনীতি। আমরা সে চেষ্টা করছি।
নয়া দিগন্ত : বিএনপি চেয়ারপারসন সম্প্রতি জনসভায় সুশাসন নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের কারোর ওপর কোনো ক্ষোভ নেই। এর মাধ্যমে তিনি কী বার্তা দিতে চান?
মির্জা ফখরুল : তিনি সঠিক কথাই বলেছেন। তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দেয়ার কথা বলেছেন। দেশ আজ নানাভাবে বিভক্ত। মানুষের মধ্যে বিভেদ বিভাজন থাকলে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। এই বিভক্তি মানুষের কর্মস্পৃহা নষ্ট করেছে। এ কারণে তিনি রিকনসিলিয়েশেনের কথা বলছেন। বিএনপি উদারপন্থী গণতান্ত্রিক দল। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনে বিশ্বাসী দল। কোনো বিপ্লবী দল নয়।
মির্জা ফখরুল : এটা বলা খুব মুশকিল। কারণ বর্তমান সরকারের আচরণ কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক বলা যায় না। এ কারণে রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাদের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। কখনো তারা গণতান্ত্রিক কার্যক্রমে কিছুটা ছাড় দেয় আবার কখনো শক্ত অবস্থানে থাকে। একদমই কোনো সুযোগ থাকে না। কিছু দিন আগে পর্যন্ত আমাদের ঘরোয়া কর্মসূচি পালন করতে পারতাম না। এখন পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নেয়ার পর থেকে এই সুযোগ কিছুটা পাওয়া যাচ্ছে। তাও এটি কতদিন থাকবে তা আমরা জানি না।
নয়া দিগন্ত : পৌরসভা নির্বাচন থেকে তাহলে বিএনপির কী অর্জন হলো?
মির্জা ফখরুল : পৌরসভা নির্বাচন থেকে আমাদের অর্জন হলো, আমরা জনগণের কাছে যেতে পারছি। কিছুটা সুযোগ পাচ্ছি। যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল আমরা কোথাও যেতে পারছিলাম না, আমাদের নেতাকর্মীরা বেরুতে পারছিল না, সে জায়গায় এরা প্রকাশ্য এসে রাজনীতির কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : সরকার তো বলছে পৌরসভা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলকও হয়েছে।
মির্জা ফখরুল : সরকারের কথায় তো আমরা সঠিক বিচার করতে পারব না। কারণ, এই সরকারের চরিত্র আমরা জানি। এটি পুরোপুরিভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার এবং যে নির্বাচনের মাধ্যমে এরা ক্ষমতায় আছে সে নির্বাচনের কোনো নৈতিক বৈধতা নেই। এ কারণে এরা সবসময় অস্থিরতায় থাকে এবং আস্থাহীনতায় ভোগে। যে কারণে বিরোধী দলের ওপর তারা বেশি করে চড়াও হয়। সে কারণে এরা বলে নির্বাচন ভালো হয়েছে। পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু সুন্দর হবে এটা আমরা আশা করিনি। আমরা বলেছিলাম, নির্বাচনে যাচ্ছি আন্দোলনের অংশ হিসেবে। অর্থাৎ এটাকে নিয়ে আমরা জনগণের কাছে যাবো এবং তাদের সামনে আমাদের কথাগুলো বলব। সে ক্ষেত্রে আরেকবার আমাদের লাভ হয়েছে, আমরা বাইরে আসতে পেরেছি, আবারো জনগণের সামনে প্রমাণ করতে পেরেছি এদের সময় নির্বাচন কিভাবে হচ্ছে। আমাদের যে দাবি নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকার দরকার, তা আবারো প্রতিষ্ঠিত হলো। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার দরকার। আমাদের তো ইংল্যান্ড আমেরিকা দিয়ে চিন্তা করলে চলবে না। এমনকি ভারত দিয়ে তুলনা করলে চলবে না। এই নির্বাচনে প্রমাণ হলো নিরপেক্ষ সরকার না থাকলে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হবে না।
নয়া দিগন্ত : বর্তমান নির্বাচন কমিশনের তো মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে। শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে কী আগামীতে সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না?
মির্জা ফখরুল : বিষয়টাকে আমরা অনড়ভাবে দেখতে চাই না। আমরা বলছি নির্বাচনের সময়ে একটি নিরপেক্ষ সরকার থাকতে হবে। অর্থাৎ সেই সরকার সরাসরি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা নির্বাচন কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করবে না। নির্বাচন কমিশন কিন্তু এখন পর্যন্ত পুরোপুরিভাবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর নির্ভরশীল। ফলে তাদের বাজেট, অর্থ সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওপর নির্ভর করে। যেহেতু তাদের লোকবল কম, তাদের প্রশাসনের ওপর নির্ভর করতে হয়। যখন একটি সরকার থাকে তখন প্রশাসন সে সরকারের অনুগত থাকে। এটাই প্রশাসনের চরিত্র। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দলীয় সরকারের অধীনে যেহেতু প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকতে পারে না, সে কারণে কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণা এসেছে।
নয়া দিগন্ত : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাহলে কী আপনার এখনো অনড়?
মির্জা ফখরুল : না, কথাগুলো এভাবে বললে হবে না। প্রথমে বলেছি আমরা অনড় নই। ধরে নিই, যদি এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, সরকার নিরপেক্ষ থাকতে বাধ্য। এক্ষেত্রে আলোচনা, সমঝোতা এবং সংবিধানের ব্যাপার রয়েছে। এ কারণে আমরা বলছি, এ নিয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। সব রাজনৈতিক দলের সাথে আলাপ-আলোচনা করে আমরা একটা জায়গায় আসতে পারি কি না, যেখান থেকে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন আমরা পাবো। মূল কথা হলো নিরপেক্ষ নির্বাচনের গ্যারান্টি নিশ্চিত করতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সেই সংলাপের সম্ভাবনা কতটুকু?
মির্জা ফখরুল : আমরা তো বারবার বলছি। সরকারপক্ষ তো সারা দিচ্ছে না। কত ধরনের শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এসব শর্ত দিয়ে তো সংলাপ হবে না। সংলাপ করতে হলে খোলামনে আসতে হবে।
নয়া দিগন্ত : যদি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচনের প্রস্তাব আসে, সে ক্ষেত্রে আপনাদের অবস্থান কী হবে।
মির্জা ফখরুল : যদির ভিত্তিতে কোনো রাজনীতিবিদ বক্তব্য দিতে পারে না। কারণ এতে অনেক ভুল বোঝাবুঝি বা সমস্যা হতে পারে। আমরা বলতে চাই, নির্বাচনের জন্য যদি একটি অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যেখানে নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে, তাহলে আমরা যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে রাজি আছি। শর্ত হচ্ছে নিরপেক্ষ এবং যেকোনো ধরনের প্রভাবমুক্ত পরিবেশে নির্বাচন হতে হবে।
নয়া দিগন্ত : সংলাপও হচ্ছে না আবার কিছুটা পরিবেশ ফিরে পাচ্ছেন, এখন কি বিএনপি দল পুনর্গঠনের দিকে যাবে?
মির্জা ফখরুল : দল পুনর্গঠনের চিন্তাভাবনা আমরা প্রথম থেকেই করছি, কিন্তু সরকারের আচরণের কারণে তা আমরা ফলপ্রসূ করতে পারিনি। ভয়ভীতি, দমন, পীড়নের কারণে সভা সমাবেশ আমরা করতে পারিনি। এখন আমরা সাংগঠনিক কাজ শুরু করেছি। দ্রুত এসব প্রক্রিয়া শেষ করে কাউন্সিল করতে চাই।
নয়া দিগন্ত : সাংগঠনিক কার্যক্রমের অভাবে তৃণমূলে এক ধরনের হতাশা আছে বলে মনে করা হয়।
মির্জা ফখরুল : দেখুন, আমি খোলামেলাভাবে বলতে চাই সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের আচরণের ওপর। আজকে যদি আমার থানার প্রেসিডেন্ট বা জেলার প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি জেলে থাকেন তাহলে তো সাংগঠনিক কার্যক্রম থমকে যাবে। আমরা কর্মসূচি দেয়ার পর দফায় দফায় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনো বহু নেতাকর্মী জেলে রয়েছে। প্রায় ছয় হাজারের মতো নেতাকর্মী জেলে রয়েছে। এটা স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। মুক্ত পরিবেশ ছাড়া আমরা কোনোভাবেই সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে পারব না।
নয়া দিগন্ত : জোটের মধ্যে কিন্তু বিরোধ দেখা যাচ্ছে। ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশ জোট থেকে বের হয়ে গেছে।
মির্জা ফখরুল : দেখুন, বাংলাদেশে এ ধরনের রাজনীতি নতুন নয়। বহু আগে থেকেই এমন জোট গঠন হয়, জোট ভাঙে। জোট থেকে বেরিয়ে যায়, আবার জোটে আসে। সংসদীয় গণতন্ত্র আছে এমন রাজনীতিতে এটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। ভারতে রাজ্য সরকারে যে জোট থাকে, জাতীয় নির্বাচনে আবার সে জোট থাকছে না, ভেঙে যাচ্ছে। এটা হতেই পারে। জোট গঠন বা ভেঙে যাওয়া সংসদীয় রাজনীতির একটা বৈশিষ্ট্য।
নয়া দিগন্ত : ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলছেন বিএনপি ভাঙনের দিকে যেতে পারে। সেরকম শঙ্কা আছে কি?
মির্জা ফখরুল : এগুলো কথার কথা। আমরা যারা রাজনীতি করি তারা বহু কথা বলি, যা আমরা নিজেরাও মনে করি না। যার পেছনে কোনো অর্থ থাকে না। রাজনীতির কারণে বলতে হয়, তাই বলা। এ ছাড়া বিএনপি ভাঙার চেষ্টা সবসময় হয়ে এসেছে। আগেও হয়েছে এখনো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকার খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। এমনকি জোট ভাঙার জন্য চেষ্টা করে তারা সফল হয়নি। আমরা ক্ষমতা থেকে প্রায় আট বছর বাইরে। বিএনপির প্রথমসারির বা পরিচিত মুখ কাউকে দল থেকে বের করতে পারেনি। আবার ২০ দলের যারা প্রধান শক্তি তাদেরও জোট থেকে বের করতে পারেনি। আবার যারা বেরিয়ে গেছে তাদের একটা গ্রুপ কিন্তু জোটে থেকে যাচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : জোটের প্রসঙ্গে আরেকটি দিক সামনে চলে এসেছে জোটের শরিক জামায়াতে ইসলামীকে সরকার নিষিদ্ধ করতে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে বিএনপির অবস্থান কী।
মির্জা ফখরুল : যদি রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করি তাহলে আমি মনে করি, জামায়াত নিষিদ্ধ করা আওয়ামী লীগের জন্য লাভ হবে না। এ কারণে লাভ হবে না, জামায়াত নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাস করা রাজনৈতিক দল। দলটি পাকিস্তান আমল থেকে রাজনীতি করে আসছে। দলটি সাংবিধানিক রাজনীতি করে। এই দলকে যদি আপনি নিষিদ্ধ করে দেন; এই দলের আদর্শভিত্তিক একটি বড় কর্মীবাহিনী আছে। এই কর্মীবাহিনী কোথায় যাবে? এই কর্মীবাহিনী হয় আন্ডার গ্রাউন্ডে চলে যাবে অথবা তারা অন্য দলের সাথে যুক্ত হবে। তাতে তো আওয়ামী লীগের লাভ হবে না। কারণ আওয়ামী লীগের রাজনীতি আর জামায়াতের রাজনীতি এক নয়। এমনকি কাছাকাছিও নয়। সুতরাং এতে আওয়ামী লীগের লাভ হবে বলে মনে হয় না। যে কারণে আমার মনে হয় মুখে তারা যাই বলুক নিষিদ্ধ করব; আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত জামায়াতকে নিষিদ্ধ করবে বলে আমার মনে হয় না। সংসদীয় রাজনীতিতে অনেক যোগ বিয়োগ আছে। কোন দল থাকলে লাভ হবে কোন দল থাকলে হবে না। আসলে মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিএনপি -জামায়াতের জোটকে ভেঙে ফেলা। এই জোট ভোটের রাজনীতির যোগ বিয়োগে তাদের জন্য ক্ষতিকর। এটাই তাদের আসল সমস্যা। এ কারণে তারা চায় এই জোট ভাঙতে।
নয়া দিগন্ত : বিএনপি জাতীয়তাবাদী ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসের রাজনীতি করছে। বর্তমান আন্তর্জাতিক রাজনীতির গতিপ্রবাহে বিএনপি কি নতুন বিন্যাসের চিন্তা করছে?
মির্জা ফখরুল : বিএনপির নতুন বিন্যাসের প্রয়োজন নেই। আপনি যদি বিএনপির ঘোষণাপত্র, মেনিফেস্টো দেখেন- বিএনপির খুব স্পষ্ট কথাবার্তা বলা আছে। বিএনপি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসের রাজনীতি করে, ধর্মীয় স্বাধীনতায় বিশ্বাসে রাজনীতি করে, উদার গণতান্ত্রিক রাজনীতি করে। এই দিকটি খুব স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে কোনো অস্পষ্টতা নেই। এ ক্ষেত্রে বিএনপির রাজনীতিতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয় যদি গণতান্ত্রিক রাজনীতি থাকে।
নয়া দিগন্ত : আপনি নিজেও বিএনপির রাজনীতিতে পরিবর্তনের কথা বলেছেন সেটি কেমন?
মির্জা ফখরুল : আমি পরিবর্তনের কথা বলেছি রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে। আমরা যে রাজনৈতিক কর্মসূচি নিই এবং যেভাবে প্রচার করি, তা এখন প্রযুক্তিনির্ভর হওয়া উচিত। কারণ দুনিয়া বদলে গেছে। প্রযুক্তি এমন জায়গায় গেছে, এখন আর জনসভা করার দরকার হয় না। ধরুন ম্যাডামের বক্তব্যের জন্য টেলিভিশনে যদি আমরা আধা ঘণ্টার সময় পাই। সবগুলো চ্যানেলে তার বক্তব্য প্রচার করা হয়, তাহলে তো জনসভার কাজ হয়ে যায়। তাহলে তো লোক জরো করে এনে বক্তব্য দেয়ার দরকার হয় না। এই দিকগুলোর কথা আমি বলছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা এখন পুরনো চিন্তার মধ্যে আছি। এখন যদি ম্যাডামের টুইটার বা ফেসবুক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আমরা প্রচার চালাতে পারি। এখন তো গ্রামের নারীদের হাতে টেলিফোন আছে। এ ধরনের প্রচারণায় সুবিধা হবে বেশি ফল পাওয়া যাবে, খরচ কম হবে। বেশি লোকের কাছে পৌঁছানো যাবে। কিন্তু এসব জায়গায় এখন পর্যন্ত আমরা যেতে পারছি না। আবার নানারকম আইনি বিধি-নিষেধও আছে, সেগুলোয় মাথায় রাখতে হচ্ছে।
নয়া দিগন্ত : সরকারের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয় জঙ্গিবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিএনপি পৃষ্ঠপোষকতা করে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী।
মির্জা ফখরুল : এই ইস্যুটাই একটি নোংরা রাজনীতি। বিএনপি কোনো মতেই, কোনো দিনেই এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে ছিল না এবং বিশ্বাসও করে না। বিএনপি একটি সাংবিধানিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। এ দলের তো কোনো গুপ্তহত্যায় জড়ানোর প্রয়োজন নেই। এটাই হচ্ছে মূল কথা। এসব হচ্ছে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের অংশ। যারা করছে তারা বাংলাদেশে উগ্রবাদ তৈরি হচ্ছে, জঙ্গিবাদ তৈরি হচ্ছে- এ ধরনের কথাবার্তা বলে। এখানে আইএস আছে, জঙ্গিবাদ আছে- এসব বলে লাভ কার ক্ষতি কার? সবচেয়ে ক্ষতি হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষের। যদি সত্যিই এ ধরনের জঙ্গিবাদ এ দেশে আনা হয়, তাহলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে বাংলাদেশের মানুষের।
বাংলাদেশ একটি উদার গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশের মানুষ শান্তিতে সবাইকে নিয়ে বাস করতে চায়। এখানে সব ধর্মের মানুষ এক সাথে থাকে। এখানে যেমন ব্লগাররা আছে, তেমনি কট্টর ধর্মবিশ্বাসী লোকজনও আছে। আগে তো কখনো শুনিনি এদের মারামারি করতে হবে। কিছু স্বার্থান্বেষী লোক এগুলো করাচ্ছে, বাংলাদেশকে উগ্রবাদী ব্যর্থ রাষ্ট্র প্রমাণ করার জন্য। আমরা কখনো এমন পরিস্থিতি মেনে নিতে পারি না। আমরা বারবার বলেছি, যখন গণতন্ত্রকে সঙ্কোচন করবেন, মুখ বন্ধ করবেন তার সুযোগ উগ্রবাদীরা নেবে।
নয়া দিগন্ত : জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে বিএনপি কী ভুমিকা রাখতে চায়?
মির্জা ফখরুল : বিএনপি একটি জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছে। এ ধরনের প্রবণতা প্রতিরোধ করতে একটি জাতীয় ঐকমত্য দরকার। সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে বসতে হবে। বাংলাদেশের বাস্তবতা বুঝতে হবে। এ দেশে আলেম-ওলামাদের সমাজে বড় ধরনের ভূমিকা আছে। তাদের সাথে বসেন, কথা বলেন। মানুষের কাছে কথা চলে যাক সন্ত্রাসের এই পথ সঠিক পথ নয়। এই পথ ইসলামের নয়। যারা ইসলামের কথা বলে ভুল দিকে পরিচালিত করতে চায় তাদের পথ ইসলামের পথ নয়। এই কথাটা সবাইকে একসাথে বলতে হবে। জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করার মধ্য দিয়ে এই প্রবণতাকে বন্ধ করা যেতে পারে। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে কেন তরুণেরা আইএসে যোগ দিচ্ছে তা ভেবে দেখা দরকার। কারণ তাদের সামনে বিকল্প কোনো দর্শন নেই। বিকল্প রাজনীতি নেই। তারা ও দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এত অন্যায় অবিচার দেখে তারা হতাশা থেকে ওদিকে ঝুঁকছে। আপনি যদি গণতন্ত্রকে সামনে আনতে পারেন, তাহলে কোনো দিন এরা ও দিকে যাবে না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ দিন। কথা বলতে দিন। মতামতকে গুরুত্ব দিন। সুন্দর নির্বাচন দিন। যদি কেউ জানে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তার পক্ষে এনে সরকার গঠন করতে পারব, তখন কেন সে অন্য দিকে যাবে।
নয়া দিগন্ত : আপনি জাতীয় ঐক্যের কথা বললেন। কিন্তু ক্ষমাতসীন দলের নেতারা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে বিএনপির বর্তমান অবস্থান জাতীয় ঐক্যের পথে অন্তরায়- আপনার বক্তব্য কী?
মির্জা ফখরুল : ওরা এ কথা আজীবন বলে আসছে। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশে আর কেউ মুক্তিযুদ্ধ করেনি। ওরা ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশের স্বাধীনতা চায়নি? আসলে এটা তাদের মাইন্ডসেট। মনের মধ্যে ঢুকে আছে। ওরাই প্রভু, ওরাই জমিদার, ওরাই তালুকদার, ওরাই সব। বাকি আর কেউ কিছু না। আমি একজন রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধা। আমি বিএনপি করি কেন? জিয়াউর রহমান কী ছিলেন? রণাঙ্গনে লড়াই করা মুক্তিযোদ্ধা বিএনপিতে বেশি আছে। তারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। এ ধরনের কথা বলার অর্থ হচ্ছে মূল ইস্যু থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয়া।
নয়া দিগন্ত : মুক্তিযুদ্ধে জিয়াউর রহমানের কথা বললেন কিন্তু তাকে তো পাকিস্তানের গুপ্তচর বলা হচ্ছে। এমনকি তার কবর সরিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানা যাচ্ছে। বিষয়টি কিভাবে দেখেন?
মির্জা ফখরুল : সরকারের এ ধরনের সিদ্ধান্ত হবে আত্মহত্যার শামিল। আমি মনে করি, তাদের যদি এ ধরনের দুরভিসন্ধি থাকে, বাংলাদেশের মানুষ কখনো এটা মেনে নেবে না।
নয়া দিগন্ত : আমরা দেখছি সরকার উন্নয়নের কথা বলছে। এমনও বলা হচ্ছে, উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে আরো কয়েক টার্ম সরকারের ক্ষমতায় থাকা দরকার।
মির্জা ফখরুল : আসলে সরকার তাদের পুরনো আশা দেখছে। ১৯৭৫ সালে যখন তারা একদলীয় শাসন বাকশাল কায়েম করে, তখন তাদের কথা এরকমই ছিল। তারা গণতন্ত্রের বদলে একটি রেজিমেন্টেড পলিটিকস দরকার বলে মনে করেছিল। গণতন্ত্র নয় উন্নয়ন দিয়ে জনগণের সমস্যা সমাধান করতে চায়। বাস্তবতা হচ্ছে, যে রাজনৈতিক দর্শন এখন পৃথিবী থেকে বাদ হয়ে গেছে সমাজতন্ত্র বা একদলীয় শাসন, আওয়ামী লীগ সেটি ধরে রাখতে চায়। আমাদের দেশের মানুষ ঐতিহ্যগতভাবে গণতন্ত্রমনা। এমন দেশে এ ধরনের রাজনীতি হবে আত্মহত্যার রাজনীতি। এগুলো বলে সরকার আরো জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে। যদি সত্যিকার অর্থে সুষ্ঠু নির্বাচন হয় তাহলে তা প্রমাণ হবে।
আর উন্নয়ন তো গণতন্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। সরকারের মধ্যে যদি জনগণের মতের প্রতিফলন না থাকে তা হলে তো উন্নয়ন হবে না। এখন যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে তা কোন ধরনের উন্নয়ন। আমরা দেখছি ঢাকা শহরের মধ্যে দৃশ্যমান কয়েকটি ওভারব্রিজ , মেট্রোরেলের কাজ শুরু করা হচ্ছে। এগুলোর সাথে সাধারণ জনগণের সম্পর্ক খুব কম। গোটা বাংলাদেশের রাস্তাঘাটের বেহাল দশা কিন্তু ঢাকায় একটি ফ্লাইওভার হলে কি উন্নয়ন হবে? রেলওয়ে একেবারে ডুবতে বসেছে। শিক্ষা এখন সবচেয়ে খারাপ পর্যায়ে গেছে। সাধারণ মানুষ কোনো স্বাস্থ্যসেবা পায় না। তা হলে কোথায় উন্নয়ন হচ্ছে। দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না। বিদেশীরা চলে যাচ্ছে। দেশী বিনিয়োগকারীরা অন্য দেশে বিনিয়োগ করছে । এমন হাজার দিক আছে। সিপিডি কয়েক দিন আগে বলেছে, বাংলাদেশ শান্ত অবস্থায় থাকলেও অর্থনীতির গতি নেই। শুধু কথা বলে বা নানা ধরনের তথ্য দিয়ে উন্নয়ন হয় না।
নয়া দিগন্ত : প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিএনপি কি কোনো মূল্যায়ন করছে?
মির্জা ফখরুল : আমাদের কাছে মনে হয় শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা পৃথিবীতে ভূ-রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিবর্তন এসেছে। সে পরিবর্তনের কারণে নানা ধরনের আঞ্চলিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে। সৌদি আরব সম্প্রতি একটি জোট গঠনের ঘোষণা দিয়েছে। এর লক্ষ্য স্পষ্ট নয়। ইরান ও ইয়েমেনে দেশটির সাথে বিরোধ চলছে। সিরিয়া নিয়ে নানা স্বার্থের দ্বন্দ্ব আছে। পুরো মধ্যপ্রাচ্য অস্থির। একইভাবে বাংলাদেশে ভূ-রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। চীন ও ভারত এখন গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আবার রাশিয়ার তৎপরতা বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে প্র্যাগমেটিক চিন্তাভাবনা খুব জরুরি। সেদিক থেকে বিএনপি চিন্তা করছে। আপনি তুরস্কের কথা বলতে পারেন। তুরস্ক কিন্তু আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান নিয়েছে। কারণ তুরস্কে গণতন্ত্র আছে। নিয়মিত সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হচ্ছে। আবার ইরানের সাথে পশ্চিমা দেশগুলো পারমাণবিক চুক্তি করেছে, যা এ অঞ্চলের ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব ফেলছে। আবার পাকিস্তান পশ্চিম এবং চীনের সাথে এমনকি ভারতের সাথে ভালো সম্পর্ক সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আঞ্চলিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দিকে এখন আমাদের দৃষ্টি দেয়া দরকার। পররাষ্ট্রনীতিতে নিজ দেশের স্বার্থ বড় কথা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিজের স্বার্থ দেখা হচ্ছে ভালো রাজনীতি। আমরা সে চেষ্টা করছি।
নয়া দিগন্ত : বিএনপি চেয়ারপারসন সম্প্রতি জনসভায় সুশাসন নিশ্চিত করার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের কারোর ওপর কোনো ক্ষোভ নেই। এর মাধ্যমে তিনি কী বার্তা দিতে চান?
মির্জা ফখরুল : তিনি সঠিক কথাই বলেছেন। তিনি প্রতিহিংসার রাজনীতি বাদ দেয়ার কথা বলেছেন। দেশ আজ নানাভাবে বিভক্ত। মানুষের মধ্যে বিভেদ বিভাজন থাকলে কোনো দেশ এগিয়ে যেতে পারে না। এই বিভক্তি মানুষের কর্মস্পৃহা নষ্ট করেছে। এ কারণে তিনি রিকনসিলিয়েশেনের কথা বলছেন। বিএনপি উদারপন্থী গণতান্ত্রিক দল। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা পরিবর্তনে বিশ্বাসী দল। কোনো বিপ্লবী দল নয়।
No comments