চীনা উদ্যোগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ by মিংকাং লিউ ও ওয়েনঝি লু
চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন ২০১৩ সালে ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তখনই সেটা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এটা সেই প্রাচীন সমুদ্র ও সড়কপথের সিল্ক রোড পুনরুদ্ধারের প্রয়াস, যে রাস্তা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করেছিল। প্রায় ৬০টি দেশ ও বেশ কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে, ফলে সংগত কারণেই এই প্রকল্প অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করবে, একই সঙ্গে তা চ্যালেঞ্জেরও বটে।
মূল সিল্ক রোডের অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে, এটা ছিল বাণিজ্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিনিময় হয়েছে। চীনের নতুন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ ও ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোডও’ একই কাজ করবে। নতুন নতুন ও উন্নততর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রসার হবে, ফলে সবারই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।
চীনের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে এই কৌশল গ্রহণের যুক্তিটা খুব পরিষ্কার। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বাড়ার হার ও সুযোগ কমে যাওয়ায় চীনকে এখন নিজের অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এই বাজার খুলে দেওয়ার মধ্যে আছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করা, যার মধ্য দিয়ে উভয়েরই লাভ হবে। চীনের প্রতিবেশী দেশগুলো তার নিম্নহারের মূল্য সংযোজনকারী কাজগুলোর ঠিকাদারি পেয়ে লাভবান হতে পারে। এতে করে সেই দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে, তেমনি চীনও মূল্য শৃঙ্খলে আরেকটু ওপরে উঠতে পারবে, যেখানে উৎপাদনশীলতা ও মজুরি উভয়ই বেশি—এ দুটোই কিন্তু ভোগের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
চীন এই সম্পর্ক স্থাপনের মূল কাজ ইতিমধ্যে করে ফেলেছে, তারা এই ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডের’ আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে তারা বিনিয়োগে সহায়তা দেওয়ার জন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যেমন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক।
বিশ্বের আর্থিক খাতের একটি কেন্দ্র হচ্ছে হংকং, আবার সাংহাইও আর্থিক খাতের আরেকটি আঞ্চলিক কেন্দ্র। ফলে চীন একটা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেয়ে যাওয়ায় তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকা আরও শক্তিশালী হয়েছে। তার সঙ্গে আছে দ্রুত বর্ধনশীল ও উদ্ভাবনমুখী কোম্পানি যেমন হুয়াওয়ে, আলিবাবা ও ওয়ান্দা। ফলে, শি জিনপিং নিজের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো জায়গায় আছেন।
কিন্তু তাঁর যাত্রাটা খুব মসৃণ হবে না। যেকোনো আন্তর্জাতিক প্রকল্পের মতো ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞ কূটনীতির প্রয়োজন হবে, কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তার জন্য সতর্ক পরিকল্পনাও প্রয়োজন।
এই ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডের’ আশপাশের দেশগুলো ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের এক বিরল যুগলবন্দীর সম্মুখীন হয়েছে। এই ঝুঁকির মধ্যে যেমন সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যাপার আছে, তেমনি ব্যাষ্টিক অর্থনীতিরও ব্যাপার আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বিনিময় মূল্যের ওঠানামা, বড় ঋণের ভার, বৈচিত্র্যহীন ও ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামো, আর ব্যাষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি হচ্ছে দুর্বল ব্যাংকিং খাত।
‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা জন্য যা যা দরকার, চীনের কাছে তার সবই আছে। এখন কথা হচ্ছে, চীন যত দিন তা স্বচ্ছ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যবহার করবে, তত দিন চীন ও তার প্রতিবেশীরা লাভবান হবে।
সুশাসনের অভাবও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার মধ্যে আছে দুর্নীতি থেকে সংস্কার প্রক্রিয়ার অদক্ষ বাস্তবায়ন। একই ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনাও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ (কোথাও কোথাও তো সন্ত্রাসবাদের হুমকিও আছে)। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকির কথাও তো ভুলে যাওয়া যায় না, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
এরপর আছে বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক হরেক রকম আইন। যদিও চীনা উদ্যোক্তাদের পক্ষে কোনো দেশে ঢোকার আগে এটা বোঝা সম্ভব নয়, সে দেশের আইন কেমন। কিন্তু এই আইন লঙ্ঘন করা হলে একটি কোম্পানির কার্যক্রম ও বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতে পারে।
এখন কথা হচ্ছে, চ্যালেঞ্জ অনেক জটিল হলেও তা দূর করার তরিকা কিন্তু বেশ সহজ-সরল। প্রথম ও প্রধান কথা হচ্ছে, দুর্নীতি পরিহার করতে হবে। কারণ, দুর্নীতি থাকলে শুধু ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগ ব্যাহতই হবে না, ভবিষ্যতে চীনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগও হুমকির মুখে পড়বে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আর্থিক প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে এর ব্যয়, সুবিধা, বাস্তুতান্ত্রিক প্রভাব যেমন বায়ুদূষণ, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের আশঙ্কা খতিয়ে দেখতে হবে।
এই মনোভঙ্গিটি আরও দৃঢ় করতে হলে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের অর্থায়নের ব্যাপারটাকে বাজারের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। অধিকাংশ বিনিয়োগের পরিধি ও অর্থায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই কার্যকর হবে, ঠিক যেমন ঝুঁকি ভাগাভাগির প্রক্রিয়াও হিতকর প্রমাণিত হবে। এই অর্থায়নের ভিত্তি হচ্ছে সম্ভাব্য ক্যাশ ফ্লো, স্পনসরদের ব্যালান্স শিট নয়।
তা ছাড়া, বিনিয়োগকারীদের স্রেফ প্রকল্পের নির্মাণের দিকেই নজর দিলে চলবে না, তাদের আরও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের দিকে নজর দিতে হবে, যেমন মুনাফা নিশ্চিত করা, স্থানীয় লোকালয় ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলা প্রভৃতি। পরামর্শক, আইনজীবী, নিরীক্ষক, এনজিওসহ অন্যান্য সংস্থাকে এসব কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
আরও কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। যেমন বলা যায় নতুন ও অপরিচিত পরিবেশে কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনেক সমস্যায় পড়তে হতে পারে, ফলে কোনো দেশে যাওয়ার আগে তাঁরা আগেভাগেই সেখানকার স্থানীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আর ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগের নেতা হিসেবে চীনকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল আচরণ করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ হবে, প্রাদেশিক সরকারকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, আবার তাকে বাজারের গঠনমূলক ও ন্যায্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে চীনকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করতে হবে, যাতে সরকারের সব স্তরের কর্মী ও উদ্যোক্তারা বাইরে কাজ করার মৌলিক তথ্যগুলো জানতে পারে। আর এই উদ্যোগে হংকংকে যুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে, কাজটা চীনকেই করতে হবে। কারণ অর্থায়ন, রসদ সরবরাহ, তথ্যপ্রাপ্তি, মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া, আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা—এসব কাজে হংকংয়ের অভিজ্ঞতা অনেক। আর কথাটা শেষে বললেও তা মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, কথাটা হলো সংকট ব্যবস্থাপনা আরও সংহত করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্যোগ এবং বের হয়ে আসার কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
এই ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করাটা খুব সুখকর হবে না। কিন্তু সফল হওয়ার জন্য যা যা দরকার, চীনের কাছে তার সবই আছে। এখন কথা হচ্ছে, চীন যত দিন তা স্বচ্ছ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যবহার করবে, তত দিন চীন ও তার প্রতিবেশীরা ব্যাপক লাভবান হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
মিংকাং লিউ: চায়না ব্যাংকিং রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান।
ওয়েনঝি লু: হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষণা ফেলো।
মূল সিল্ক রোডের অস্তিত্ব ছিল আজ থেকে প্রায় দুই হাজার বছর আগে, এটা ছিল বাণিজ্যের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ। এর মধ্য দিয়ে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিনিময় হয়েছে। চীনের নতুন ‘সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’ ও ‘টোয়েন্টি ফার্স্ট সেঞ্চুরি মেরিটাইম সিল্ক রোডও’ একই কাজ করবে। নতুন নতুন ও উন্নততর অবকাঠামো নির্মাণের মধ্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সংস্কৃতি ও চিন্তার প্রসার হবে, ফলে সবারই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে।
চীনের পরিপ্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে এই কৌশল গ্রহণের যুক্তিটা খুব পরিষ্কার। দেশটির মোট দেশজ উৎপাদন বাড়ার হার ও সুযোগ কমে যাওয়ায় চীনকে এখন নিজের অর্থনীতি উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এই বাজার খুলে দেওয়ার মধ্যে আছে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করা, যার মধ্য দিয়ে উভয়েরই লাভ হবে। চীনের প্রতিবেশী দেশগুলো তার নিম্নহারের মূল্য সংযোজনকারী কাজগুলোর ঠিকাদারি পেয়ে লাভবান হতে পারে। এতে করে সেই দেশগুলোর প্রবৃদ্ধি যেমন বাড়বে, তেমনি চীনও মূল্য শৃঙ্খলে আরেকটু ওপরে উঠতে পারবে, যেখানে উৎপাদনশীলতা ও মজুরি উভয়ই বেশি—এ দুটোই কিন্তু ভোগের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
চীন এই সম্পর্ক স্থাপনের মূল কাজ ইতিমধ্যে করে ফেলেছে, তারা এই ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডের’ আশপাশের দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়িয়েছে। একই সঙ্গে তারা বিনিয়োগে সহায়তা দেওয়ার জন্য বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যেমন এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক।
বিশ্বের আর্থিক খাতের একটি কেন্দ্র হচ্ছে হংকং, আবার সাংহাইও আর্থিক খাতের আরেকটি আঞ্চলিক কেন্দ্র। ফলে চীন একটা প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা পেয়ে যাওয়ায় তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকা আরও শক্তিশালী হয়েছে। তার সঙ্গে আছে দ্রুত বর্ধনশীল ও উদ্ভাবনমুখী কোম্পানি যেমন হুয়াওয়ে, আলিবাবা ও ওয়ান্দা। ফলে, শি জিনপিং নিজের উচ্চাভিলাষী প্রকল্প বাস্তবায়ন করার মতো জায়গায় আছেন।
কিন্তু তাঁর যাত্রাটা খুব মসৃণ হবে না। যেকোনো আন্তর্জাতিক প্রকল্পের মতো ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রেও বিজ্ঞ কূটনীতির প্রয়োজন হবে, কারণ এই প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। তার জন্য সতর্ক পরিকল্পনাও প্রয়োজন।
এই ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডের’ আশপাশের দেশগুলো ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জের এক বিরল যুগলবন্দীর সম্মুখীন হয়েছে। এই ঝুঁকির মধ্যে যেমন সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যাপার আছে, তেমনি ব্যাষ্টিক অর্থনীতিরও ব্যাপার আছে। সামষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকির ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে বিনিময় মূল্যের ওঠানামা, বড় ঋণের ভার, বৈচিত্র্যহীন ও ভঙ্গুর অর্থনৈতিক কাঠামো, আর ব্যাষ্টিক অর্থনীতির ঝুঁকি হচ্ছে দুর্বল ব্যাংকিং খাত।
‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা জন্য যা যা দরকার, চীনের কাছে তার সবই আছে। এখন কথা হচ্ছে, চীন যত দিন তা স্বচ্ছ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যবহার করবে, তত দিন চীন ও তার প্রতিবেশীরা লাভবান হবে।
সুশাসনের অভাবও বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যার মধ্যে আছে দুর্নীতি থেকে সংস্কার প্রক্রিয়ার অদক্ষ বাস্তবায়ন। একই ভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনাও আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ (কোথাও কোথাও তো সন্ত্রাসবাদের হুমকিও আছে)। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ঝুঁকির কথাও তো ভুলে যাওয়া যায় না, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
এরপর আছে বিভিন্ন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যবিষয়ক হরেক রকম আইন। যদিও চীনা উদ্যোক্তাদের পক্ষে কোনো দেশে ঢোকার আগে এটা বোঝা সম্ভব নয়, সে দেশের আইন কেমন। কিন্তু এই আইন লঙ্ঘন করা হলে একটি কোম্পানির কার্যক্রম ও বিনিয়োগ ঝুঁকির মুখে পড়ে যেতে পারে।
এখন কথা হচ্ছে, চ্যালেঞ্জ অনেক জটিল হলেও তা দূর করার তরিকা কিন্তু বেশ সহজ-সরল। প্রথম ও প্রধান কথা হচ্ছে, দুর্নীতি পরিহার করতে হবে। কারণ, দুর্নীতি থাকলে শুধু ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগ ব্যাহতই হবে না, ভবিষ্যতে চীনের আন্তর্জাতিক উদ্যোগও হুমকির মুখে পড়বে। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আর্থিক প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে এর ব্যয়, সুবিধা, বাস্তুতান্ত্রিক প্রভাব যেমন বায়ুদূষণ, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসের আশঙ্কা খতিয়ে দেখতে হবে।
এই মনোভঙ্গিটি আরও দৃঢ় করতে হলে ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের অর্থায়নের ব্যাপারটাকে বাজারের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে। অধিকাংশ বিনিয়োগের পরিধি ও অর্থায়নের পরিপ্রেক্ষিতে এটা খুবই কার্যকর হবে, ঠিক যেমন ঝুঁকি ভাগাভাগির প্রক্রিয়াও হিতকর প্রমাণিত হবে। এই অর্থায়নের ভিত্তি হচ্ছে সম্ভাব্য ক্যাশ ফ্লো, স্পনসরদের ব্যালান্স শিট নয়।
তা ছাড়া, বিনিয়োগকারীদের স্রেফ প্রকল্পের নির্মাণের দিকেই নজর দিলে চলবে না, তাদের আরও দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্যের দিকে নজর দিতে হবে, যেমন মুনাফা নিশ্চিত করা, স্থানীয় লোকালয় ও পরিবেশের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলা প্রভৃতি। পরামর্শক, আইনজীবী, নিরীক্ষক, এনজিওসহ অন্যান্য সংস্থাকে এসব কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
আরও কিছু ব্যবহারিক পদক্ষেপ নেওয়া হলে কয়েকটি সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব। যেমন বলা যায় নতুন ও অপরিচিত পরিবেশে কাজ করার ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের অনেক সমস্যায় পড়তে হতে পারে, ফলে কোনো দেশে যাওয়ার আগে তাঁরা আগেভাগেই সেখানকার স্থানীয় সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। আর ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগের নেতা হিসেবে চীনকে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো দায়িত্বশীল আচরণ করবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ হবে, প্রাদেশিক সরকারকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণ করা, আবার তাকে বাজারের গঠনমূলক ও ন্যায্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে চীনকে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ কর্মসূচি আয়োজন করতে হবে, যাতে সরকারের সব স্তরের কর্মী ও উদ্যোক্তারা বাইরে কাজ করার মৌলিক তথ্যগুলো জানতে পারে। আর এই উদ্যোগে হংকংকে যুক্ত করার উদ্যোগ নিতে হবে, কাজটা চীনকেই করতে হবে। কারণ অর্থায়ন, রসদ সরবরাহ, তথ্যপ্রাপ্তি, মেধাবীদের নিয়োগ দেওয়া, আইনের শাসন বাস্তবায়ন করা—এসব কাজে হংকংয়ের অভিজ্ঞতা অনেক। আর কথাটা শেষে বললেও তা মোটেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, কথাটা হলো সংকট ব্যবস্থাপনা আরও সংহত করতে কেন্দ্রীয় সরকারকে উদ্যোগ এবং বের হয়ে আসার কৌশল প্রণয়ন করতে হবে।
এই ‘ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড’ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করাটা খুব সুখকর হবে না। কিন্তু সফল হওয়ার জন্য যা যা দরকার, চীনের কাছে তার সবই আছে। এখন কথা হচ্ছে, চীন যত দিন তা স্বচ্ছ ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে ব্যবহার করবে, তত দিন চীন ও তার প্রতিবেশীরা ব্যাপক লাভবান হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
মিংকাং লিউ: চায়না ব্যাংকিং রেগুলেটরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান।
ওয়েনঝি লু: হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষণা ফেলো।
No comments