আরব বসন্তের ৫ বছর- তুলনামূলক সফল তিউনিসিয়া by সুমাইয়া ঘানুশি
পিতা রশিদ ঘানুশির সাথে সুমাইয়া |
আরব
বসন্ত একেবারে ব্যর্থ হয়েছে, এমনটি বলার সময় এখনো আসেনি। বরং আরব বসন্তের
সূচনাক্ষেত্রটির দিকে আমরা যদি তাকাই দেখতে পাব স্বল্প হলেও ফুল ফুটেছে।
মধ্য তিউনিসিয়ার ধূলিধূসর শহর সিদি বৌজিদে যে বিদ্রোহের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে
উঠেছিল সেটাই ছড়িয়ে পড়ে একের পর এক আরব দেশে। ধারণা তৈরি হয়, আরবরা হয়তো
শেষ পর্যন্ত দীর্ঘ অন্ধকার এক টানেল থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজে পেয়েছে।
মুক্তি, উন্নতি আর আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন নিয়েই এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। আরবদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছিল মুক্তির। কিন্তু তার পরিবর্তে এই আন্দোলন তাদের দিয়েছে নৈরাজ্য, গৃহযুদ্ধ আর আরো নৃশংস সামরিক স্বৈরাচার। আন্দোলন শুরুর পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ‘আরব বসন্তের’ অর্থ কী?
মিসরে দেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে সেনাপ্রধান শক্তহাতে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। তাদের পাশের বাড়ি লিবিয়ায় একই সাথে দু’টি সরকার দেশ চালাচ্ছে। একটি ত্রিপোলিতে আরেকটি তবরুকে। পুরো রাষ্ট্র কাঠামোই ভেঙে পড়ার জোগাড়!
সিরিয়ায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। বিদেশী হস্তক্ষেপ, জাতিগোষ্ঠীগত সঙ্কট কী নেই সেখানে? ইয়েমেনের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। সেখানে আলি আবদুল্লাহ সালেহর হুথি গ্রুপ এবং সৌদি আরব সমর্থিত হাদি সরকারের মধ্যে সঙ্ঘাত চলছে।
আরব বসন্তের ক্ষীণ আলো এখনো জ্বলছে শুধু তিউনিসিয়াতেই। তারা ইতোমধ্যে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রগতিশীল সংবিধান তৈরি করেছে। ২০১৪ সালে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতেও সক্ষম হয়েছে তারা। বর্তমানে চার দলের জোট সরকার তিউনিসিয়া চালাচ্ছে। তবে এরপরও তিউনিসিয়াকে পুরোপুরি সফল বলার অবকাশ খুব বেশি নেই। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী লিবিয়ার সঙ্কট তিউনিসিয়াকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অতীতের প্রশাসনের পক্ষে বর্তমান নিডা টোনস নামে পরিচিত বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতেও সঙ্কটে পড়ছে। বর্তমানের জোট সরকারে সাবেক স্বৈরশাসক বেন আলির লোকজনও রয়েছে।
বহু বিপ্লবী গ্রুপ এই সমঝোতাকে পছন্দ না করলেও রাজনৈতিক মানচিত্রে এর কারণেই তিউনিসিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। তারপরও এই দেশটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবের সময় মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উচ্চাশা জেগেছিল তার সাথেও বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সমন্বয় নেই। পাশাপাশি সন্ত্রাসী হামলার হুমকি তো রয়েছেই।
আরব বসন্তের চাপে তৈরি নৈরাজ্যের মধ্যেও তিউনিসিয়া দেশটিকে মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রধান কারণ তাদের সমন্বিত সমাজ। এখানে ধর্মীয়, জাতিগত বা বর্ণ-গোষ্ঠী অথবা রাজনৈতিক ও আদর্শগত মতপার্থক্য নেই। যেমনটি ইরাক, সিরিয়া বা লেবাননে দেখা যায়। দেশটির রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাসও নেই। তিউনিসিয়ার স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হাবিব বরগৌবা সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। মিসরে গামাল আবদেল নাসের এবং সিরিয়া ও ইরাকে বাথ পার্টির নেতৃত্বে দফায় দফায় অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে।
তবে তিউনিসীয় সেনাবাহিনী বরাবরই দেশের রাজনীতিতে অংশ নেয়ার চেয়ে সীমান্ত সুরক্ষার ব্যাপারেই অধিক মনোযোগী। বরগৌবার কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন সেনাবাহিনীকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়নি। একই কথা বেন আলির শাসনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বেন আলির তিউনিসিয়াকে অবশ্য পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করাই বেশি সহজ।
তবে এর মধ্যে দেশটি মূলত রাজনীতিকদের হাতেই ছিল। সেখানে সামরিক উপস্থিতি দেখা যায়নি। সামরিক বাহিনীর ছায়া ছাড়াই বিপ্লব-পরবর্তী অনিশ্চিত সময়ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিস্তৃত হয়েছে। শক্তিশালী সুশীলসমাজের ছত্রছায়ায় দেশটির বৈরী রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মধ্যকার বিভেদ দূরে ঠেলে গণতন্ত্রের সুরক্ষায় সক্ষম হয়েছে।
তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ সম্ভবত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। তারা রাজনীতিকে ঠেলে এর চরম সীমাবদ্ধতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বাস্তবমুখী যৌক্তিকতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। দুই স্বনামধন্য রাজনীতিকের হত্যাকাণ্ডের পর সঙ্কটে পড়ে ক্ষমতাসীন আন নাহদা পার্টি। তবে পরিস্থিতি সাফল্যের সাথে সামাল দেয় তারা। আরব রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়ে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও জোট করে তারা। ফলে কয়েক মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটে। তাদের সংবিধান প্রণয়নের পথও সহজ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের এই ছাড় দেয়ার মানসিকতাই দেশটিকে ব্যর্থ হওয়ার থেকে বাঁচিয়ে দেয়। প্রতিবেশী লিবিয়া বা সিরিয়ার মতো তারা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। মিসরের মতো কর্তৃত্বপরায়ণদের হাতে পড়েনি।
এই প্রক্রিয়ার অন্যতম সুবিধা হলো সাবেক আমলের রাজনীতিবিদেরাও এর মধ্যে দিয়ে আবারো রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পান। আন নাহদা পার্টি ক্ষমতায় গিয়ে বিতর্কিত ‘বিপ্লব সুরক্ষা’ আইনও বাতিল করে দেয়। এই আইনের কারণেই সাবেক ক্ষমতাসীন দল আরসিডির রাজনীতি করার অধিকার রদ করা হয়েছিল। এ ধরনের আইন অবশ্য এখনো ইরাক বা লিবিয়ায় প্রচলিত রয়েছে। এই রাজনৈতিক হিসাবের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, আজকের তিউনিসিয়ায় ক্ষমতার একটা ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। অতীত বা বর্তমানে ক্ষমতাসীনেরা কেউ কাউকে নাকচ করে দিতে পারছে না। অতীতের ক্ষমতাসীনেরা এখনো দেশটির প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ প্রশাসন, অর্থ, গণমাধ্যমে প্রাধান্য বিস্তার করছে। আর বিপ্লবের পর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা অনেক বেশি শক্তিশালী।
নানা কারণেই প্রথম দফার আরব বসন্ত ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে নতুন শক্তিগুলোর ব্যর্থতাও আছে। যেমন মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড। তারা তরুণদের সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর জোট গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের জোট তৈরি করতে পারলে তা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারত। সবচেয়ে জঘন্য ভূমিকা পালন করেছে উপসাগরীয় দেশগুলোর ক্ষমতাসীনেরা। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরব জনগণের যতই সদিচ্ছা থাকুক না কেন পাশের দেশগুলোর সরকারপ্রধানেরাও এ ব্যাপারে আগ্রহী নন।
কাজেই আজ ‘আরব বসন্তের’ অর্থ কী? বাস্তবতা হলো এর যেটুকু সাফল্য তা শুধু তিউনিসিয়াতেই দেখা যায়। তবে দৃশ্যমান সাফল্য বাদ দিলে আরব বসন্তকে একেবারে বাতিল করে দেয়া যায়Ñ বিষয়টি এমনও নয়। এর প্রথম ঢেউটি হয়তো ব্যর্থ হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে মুক্তি, সম্মান, ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা নিয়ে প্রথম ঢেউটি আরব অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল তেমন বহু ঢেউ আবারো একই অঞ্চলে আছড়ে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
[সুমাইয়া ঘানুশি ব্রিটিশ-তিউনিসীয় লেখক এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিউনিসিয়ার আন নাহদা প্রধান ড. রশিদ ঘানুশির মেয়ে। মিডল ইস্ট আই-এ থেকে এই নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন তানজিলা কাওকাব]
মুক্তি, উন্নতি আর আত্মনির্ভরতার স্বপ্ন নিয়েই এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। আরবদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছিল মুক্তির। কিন্তু তার পরিবর্তে এই আন্দোলন তাদের দিয়েছে নৈরাজ্য, গৃহযুদ্ধ আর আরো নৃশংস সামরিক স্বৈরাচার। আন্দোলন শুরুর পাঁচ বছর পার হয়ে গেছে। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে ‘আরব বসন্তের’ অর্থ কী?
মিসরে দেশের প্রথম গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে সরিয়ে সেনাপ্রধান শক্তহাতে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে। তাদের পাশের বাড়ি লিবিয়ায় একই সাথে দু’টি সরকার দেশ চালাচ্ছে। একটি ত্রিপোলিতে আরেকটি তবরুকে। পুরো রাষ্ট্র কাঠামোই ভেঙে পড়ার জোগাড়!
সিরিয়ায় ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ চলছে। বিদেশী হস্তক্ষেপ, জাতিগোষ্ঠীগত সঙ্কট কী নেই সেখানে? ইয়েমেনের পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। সেখানে আলি আবদুল্লাহ সালেহর হুথি গ্রুপ এবং সৌদি আরব সমর্থিত হাদি সরকারের মধ্যে সঙ্ঘাত চলছে।
আরব বসন্তের ক্ষীণ আলো এখনো জ্বলছে শুধু তিউনিসিয়াতেই। তারা ইতোমধ্যে ওই অঞ্চলের সবচেয়ে প্রগতিশীল সংবিধান তৈরি করেছে। ২০১৪ সালে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের আয়োজন করতেও সক্ষম হয়েছে তারা। বর্তমানে চার দলের জোট সরকার তিউনিসিয়া চালাচ্ছে। তবে এরপরও তিউনিসিয়াকে পুরোপুরি সফল বলার অবকাশ খুব বেশি নেই। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী লিবিয়ার সঙ্কট তিউনিসিয়াকেও ছুঁয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া অতীতের প্রশাসনের পক্ষে বর্তমান নিডা টোনস নামে পরিচিত বহুদলীয় সরকার ব্যবস্থার সাথে খাপ খাইয়ে নিতেও সঙ্কটে পড়ছে। বর্তমানের জোট সরকারে সাবেক স্বৈরশাসক বেন আলির লোকজনও রয়েছে।
বহু বিপ্লবী গ্রুপ এই সমঝোতাকে পছন্দ না করলেও রাজনৈতিক মানচিত্রে এর কারণেই তিউনিসিয়া সোজা হয়ে দাঁড়াতে পেরেছে। তারপরও এই দেশটি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। ভঙ্গুর অর্থনীতি নিয়ে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বিপ্লবের সময় মানুষের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে যে উচ্চাশা জেগেছিল তার সাথেও বর্তমান পরিস্থিতির কোনো সমন্বয় নেই। পাশাপাশি সন্ত্রাসী হামলার হুমকি তো রয়েছেই।
আরব বসন্তের চাপে তৈরি নৈরাজ্যের মধ্যেও তিউনিসিয়া দেশটিকে মোটামুটি স্থিতিশীল রাখতে সক্ষম হয়েছে। এর প্রধান কারণ তাদের সমন্বিত সমাজ। এখানে ধর্মীয়, জাতিগত বা বর্ণ-গোষ্ঠী অথবা রাজনৈতিক ও আদর্শগত মতপার্থক্য নেই। যেমনটি ইরাক, সিরিয়া বা লেবাননে দেখা যায়। দেশটির রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপের ইতিহাসও নেই। তিউনিসিয়ার স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হাবিব বরগৌবা সামরিক অভ্যুত্থান নিয়ে শঙ্কিত ছিলেন। মিসরে গামাল আবদেল নাসের এবং সিরিয়া ও ইরাকে বাথ পার্টির নেতৃত্বে দফায় দফায় অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটে।
তবে তিউনিসীয় সেনাবাহিনী বরাবরই দেশের রাজনীতিতে অংশ নেয়ার চেয়ে সীমান্ত সুরক্ষার ব্যাপারেই অধিক মনোযোগী। বরগৌবার কর্তৃত্বপূর্ণ শাসন সেনাবাহিনীকে এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেয়নি। একই কথা বেন আলির শাসনের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বেন আলির তিউনিসিয়াকে অবশ্য পুলিশি রাষ্ট্র হিসেবে সংজ্ঞায়িত করাই বেশি সহজ।
তবে এর মধ্যে দেশটি মূলত রাজনীতিকদের হাতেই ছিল। সেখানে সামরিক উপস্থিতি দেখা যায়নি। সামরিক বাহিনীর ছায়া ছাড়াই বিপ্লব-পরবর্তী অনিশ্চিত সময়ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিস্তৃত হয়েছে। শক্তিশালী সুশীলসমাজের ছত্রছায়ায় দেশটির বৈরী রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের মধ্যকার বিভেদ দূরে ঠেলে গণতন্ত্রের সুরক্ষায় সক্ষম হয়েছে।
তিউনিসিয়ায় গণতন্ত্র টিকে থাকার অন্যতম কারণ সম্ভবত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। তারা রাজনীতিকে ঠেলে এর চরম সীমাবদ্ধতার দিকে নিয়ে যাওয়ার চেয়ে বাস্তবমুখী যৌক্তিকতাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। দুই স্বনামধন্য রাজনীতিকের হত্যাকাণ্ডের পর সঙ্কটে পড়ে ক্ষমতাসীন আন নাহদা পার্টি। তবে পরিস্থিতি সাফল্যের সাথে সামাল দেয় তারা। আরব রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনার জন্ম দিয়ে নিজেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও জোট করে তারা। ফলে কয়েক মাস ধরে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার অবসান ঘটে। তাদের সংবিধান প্রণয়নের পথও সহজ হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন দলের এই ছাড় দেয়ার মানসিকতাই দেশটিকে ব্যর্থ হওয়ার থেকে বাঁচিয়ে দেয়। প্রতিবেশী লিবিয়া বা সিরিয়ার মতো তারা গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েনি। মিসরের মতো কর্তৃত্বপরায়ণদের হাতে পড়েনি।
এই প্রক্রিয়ার অন্যতম সুবিধা হলো সাবেক আমলের রাজনীতিবিদেরাও এর মধ্যে দিয়ে আবারো রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ পান। আন নাহদা পার্টি ক্ষমতায় গিয়ে বিতর্কিত ‘বিপ্লব সুরক্ষা’ আইনও বাতিল করে দেয়। এই আইনের কারণেই সাবেক ক্ষমতাসীন দল আরসিডির রাজনীতি করার অধিকার রদ করা হয়েছিল। এ ধরনের আইন অবশ্য এখনো ইরাক বা লিবিয়ায় প্রচলিত রয়েছে। এই রাজনৈতিক হিসাবের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা হলো, আজকের তিউনিসিয়ায় ক্ষমতার একটা ভারসাম্য তৈরি হয়েছে। অতীত বা বর্তমানে ক্ষমতাসীনেরা কেউ কাউকে নাকচ করে দিতে পারছে না। অতীতের ক্ষমতাসীনেরা এখনো দেশটির প্রধান প্রধান প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ প্রশাসন, অর্থ, গণমাধ্যমে প্রাধান্য বিস্তার করছে। আর বিপ্লবের পর বর্তমান ক্ষমতাসীনেরা অনেক বেশি শক্তিশালী।
নানা কারণেই প্রথম দফার আরব বসন্ত ব্যর্থ হয়েছে। এর মধ্যে নতুন শক্তিগুলোর ব্যর্থতাও আছে। যেমন মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড। তারা তরুণদের সম্পৃক্ত করে বৃহত্তর জোট গঠনে ব্যর্থ হয়েছে। এ ধরনের জোট তৈরি করতে পারলে তা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে শক্তিশালী অবস্থান নিতে পারত। সবচেয়ে জঘন্য ভূমিকা পালন করেছে উপসাগরীয় দেশগুলোর ক্ষমতাসীনেরা। স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে আরব জনগণের যতই সদিচ্ছা থাকুক না কেন পাশের দেশগুলোর সরকারপ্রধানেরাও এ ব্যাপারে আগ্রহী নন।
কাজেই আজ ‘আরব বসন্তের’ অর্থ কী? বাস্তবতা হলো এর যেটুকু সাফল্য তা শুধু তিউনিসিয়াতেই দেখা যায়। তবে দৃশ্যমান সাফল্য বাদ দিলে আরব বসন্তকে একেবারে বাতিল করে দেয়া যায়Ñ বিষয়টি এমনও নয়। এর প্রথম ঢেউটি হয়তো ব্যর্থ হয়েছে। তবে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে মুক্তি, সম্মান, ন্যায়বিচারের আকাক্সক্ষা নিয়ে প্রথম ঢেউটি আরব অঞ্চলে আছড়ে পড়েছিল তেমন বহু ঢেউ আবারো একই অঞ্চলে আছড়ে পড়ার অপেক্ষায় প্রহর গুনছে।
[সুমাইয়া ঘানুশি ব্রিটিশ-তিউনিসীয় লেখক এবং মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিউনিসিয়ার আন নাহদা প্রধান ড. রশিদ ঘানুশির মেয়ে। মিডল ইস্ট আই-এ থেকে এই নিবন্ধটি অনুবাদ করেছেন তানজিলা কাওকাব]
No comments