ফের এরশাদের ‘ঘর’ ভাঙছে? by সোহরাব হাসান

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কতটা গণতন্ত্রী, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন দলটির সদ্য পদচ্যুত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। দলের চেয়ারম্যান গতকাল মঙ্গলবার তাঁর বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে মহাসচিব পদ থেকে পত্রপাঠ বিদায় করে দিয়েছেন। এত দিন সভা-সেমিনার, টক শোতে জিয়াউদ্দিন তাঁর নেতা কতটা ‘গণতন্ত্রী’ তা প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন।
এর আগে এরশাদ সাহেব মাহবুবুর রহমান, খালেদুর রহমান টিটো, আবদুল মতিন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু ও নাজিউর রহমানকেও একই কায়দায় বিদায় দিয়েছেন। এমনকি ২০১৪ সালের এপ্রিলে তিনি যখন রুহুল আমিন হাওলাদারকে সরিয়ে জিয়াউদ্দিন বাবলুকে মহাসচিব করেন, তখনো একই স্বেচ্ছাচারিতার আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেবার এরশাদ রুহুল আমিনের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ এনেছিলেন, এবার জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনলেন। সেই সঙ্গে শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়েও তাঁকে অভিযুক্ত করলেন। কিন্তু তিনি যে দলের কারও সঙ্গে আলাপ না করে একা এত বড় একটি সিদ্ধান্ত নিলেন, তাতে কি শৃঙ্খলা ভঙ্গ হয়নি? কেবল এরশাদ নন, বাংলাদেশে সব দলের প্রধানের জন্য সাত খুন মাফ। তিনি যা করবেন, সেটাই আইন, তিনি যা বলবেন, সেটাই গঠনতন্ত্র। জিয়াউদ্দিনকে সরানোর সময় এরশাদও গঠনতন্ত্রের দোহাই দিয়েছেন।
জাতীয় পার্টিকে ঘিরে গত ৭২ ঘণ্টায় অনেক ‘নাটক’ মঞ্চস্থ হয়েছে ঢাকা ও রংপুরে। তবে শেষ দৃশ্যের ছবিটা কেমন হবে, এখনই তা বলা যাচ্ছে না। কেননা, রাজনৈতিক মহলে এরশাদ বরাবরই ‘আনপ্রেডিকটেবল’ বলে পরিচিত। গত রোববার তিনি রংপুরে সংবাদ সম্মেলন করে প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করেন। একই সঙ্গে তাঁর অবর্তমানে জি এম কাদেরই দল চালাবেন বলে জানিয়ে দেন এরশাদ। এটি অনেকটা উত্তরাধিকার নির্বাচনের মতো। জাতীয় পার্টির গঠনতন্ত্রে কো-চেয়ারম্যান বলে কোনো পদ নেই। এরশাদ বলেছেন, আগামী কাউন্সিলে সেই পদ সৃষ্টি করা হবে। উত্তরাধিকারের রাজনীতি কেবল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতেই ভর করেনি, এরশাদের জাতীয় পার্টিও এই রোগে আক্রান্ত হলো।
এরশাদ যখন দলের কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির সদস্যসচিব পদে রুহুল আমিন হাওলাদারকে নিয়ে আসেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে জিয়াউদ্দিনের কপাল পুড়ল। গতকাল এরশাদ সে কথাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়ে দিলেন মাত্র। রাজনীতিকদের শরমটরম কম বলেই তাঁরা যে অন্যায়ই করুন না কেন, গঠনতন্ত্রের দোহাই দেন। আর সামরিক শাসকেরা ক্ষমতায় এসে যেসব দল করেন, তার গঠনতন্ত্র এমনভাবে তৈরি যে দলীয় চেয়ারম্যানই সবকিছুর নিয়ন্তা। কথাটি বিশ্বাস না হলে জাতীয় পার্টি ও বিএনপির গঠনতন্ত্র দুটি পড়ে দেখুন। দলের বা সহযোগী যেকোনো সংগঠনের যেকোনো পদে যে কাউকে তিনি যেমন পদায়িত করতে পারেন, তেমনি পরিত্যাজ্যও ঘোষণাও করতে পারেন। এবং দলীয় প্রধান যাঁকে খুশি ওপরে তোলেন, যাঁকে খুশি নিচে নামান। কারও কিছু বলার নেই।
যেকোনো গণতান্ত্রিক দল পরিচালিত হয় নীতি, আদর্শ ও গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে। কিন্তু সেই নীতি ও আদর্শকে পাশ কাটিয়ে যখন দলটি সুবিধাবাদের চোরাগলিতে ঢুকে পড়ে, তখন তা থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন। এরশাদের জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ সরকারের কাছ থেকে তিনটি মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী কিংবা বিশেষ দূতের পদই ভাগিয়ে নেয়নি, বেসরকারি ব্যাংক-বিশ্ববিদ্যালয়ও হাতিয়ে নিয়েছে।
জাতীয় পার্টির বর্তমান সংকটের মূলে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। সেই নির্বাচনে যাঁরা এরশাদের হুকুম মেনে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেছিলেন, তাঁরা সংসদে যাওয়ার অধিকার হারিয়েছেন। আর যাঁরা তাঁর নির্দেশ না মেনে মনোনয়নপত্র বহাল রেখেছিলেন, তাঁরাই মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন। সেই সময় সাবেক মন্ত্রী জি এম কাদেরও এরশাদের কথামতো মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন। অর্থাৎ তিনি নিজের ভাইসহ অনেককে পথে বসিয়েছেন। দুই বছর ধরেই জাতীয় পার্টিতে যে চাপান–উতর চলছিল, তার বিস্ফোরণ দেখা গেল চলতি সপ্তাহে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যত রকম কৌতুক আছে, সবচেয়ে বড় কৌতুকের নাম এরশাদ। তিনি সকালে এক কথা বলেন, বিকেলে সেটি অবলীলায় উল্টে দেন। ক্ষমতায় থাকতে তাঁর এসব কাণ্ডকারখানা দেখে দুর্জনেরা সিএমএলএকে (চিফ মার্শল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর) ঠাট্টা করে বলতেন, ‘ক্যানসেল মাই লাস্ট অ্যানাউন্সমেন্ট।’ আমরা এখনো জানি না, গতকাল এরশাদ সাহেব যেসব ঘোষণা দিয়েছেন, সেগুলো ভবিষ্যতে বাতিল করবেন কি না।
অনেকের মতে, এরশাদ এসব করছেন সরকারকে এই বার্তা দিতে যে তিনিই জাতীয় পার্টি। অন্য সব ফক্কিকার। এখনো এরশাদের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা আছে। সেই মামলাগুলো প্রত্যাহারের জন্য মাঝেমধ্যেই তিনি গর্জন করে ওঠেন। এবারের নাটকও সেই গর্জনের অংশ কি না, তা কে বলতে পারে?
এরশাদের তুঘলকি আচরণ গত ২৫ বছরে এতটুকু বদলেছে বলে মনে হয় না। নাহলে দলের কারও সঙ্গে কথা না বলে তিনি রংপুরে গিয়ে তাঁর ছোট ভাই জি এম কাদেরকে কেন দলের কো-চেয়ারম্যান করবেন? দলের চেয়ারম্যান হিসেবে সবার সঙ্গে আলোচনা করেই তিনি এ সিদ্ধান্ত নিতে পারতেন। এরশাদ আজ যেভাবে জি এম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান করলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একই কায়দায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করেছিলেন। কিন্তু তাতে দলীয় কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন আসেনি। কেননা, তিনি চেয়ারম্যানের পদটি ছাড়েনইনি, তাহলে ভারপ্রাপ্তের প্রশ্ন আসবে কীভাবে? দেখা যাক, এবার কী করেন।
জাতীয় পার্টিতে যে নাটক চলছে, সেটি অভিনব নয়। এ ধরনের নাটক দলটির শুরু থেকে মঞ্চস্থ হয়ে আসছে, যার সাক্ষী অনেক প্রয়াত ও জীবিত নেতা। তিনি কনিষ্ঠকে উচ্চ পদে বসিয়ে জ্যেষ্ঠকে কীভাবে অপমান করতেন, তার কিছু বিবরণ পাওয়া যায় তাঁরই সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী আতাউর রহমান খান ও মিজানুর রহমান চৌধুরীর বইয়ে।
বর্তমানে জাতীয় পার্টি বা এরশাদের অবস্থান কী, সেটা তিনি কখনোই পরিষ্কার করেননি। তিনি দলের মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বলেন, কিন্তু মন্ত্রীর পদমর্যাদায় নিজে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে বহাল আছেন। কথায় বলে আপনি আচরি ধর্ম। দলের নেতাদের মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বলার আগে তাঁর উচিত ছিল বিশেষ দূতের পদটি ছাড়া।
এবার জাতীয় পার্টিতে যে ঘূর্ণিঝড় দেখা গেল, তা শিগগির বন্ধ হবে, না ক্ষমতার রাজনীতিতে ওলটপালট ঘটাবে, সেটি দেখার জন্য আমাদের অারও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এরশাদ দলের ভেতরের বিদ্রোহ অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছেন।
ক্ষমতায় থাকতে এরশাদ সারাক্ষণ চেষ্টা করেছেন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করতে এবং তিনি কিছুটা সফলও হয়েছিলেন। কিন্তু যখন দল দুটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করল, তখনই তিনি পদত্যাগে বাধ্য হলেন। ক্ষমতা ত্যাগের পরও এরশাদ এই চাণক্য নীতি বর্জন না করে দলের ভেতরে একে অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছেন। এ পর্যন্ত যতবার জাতীয় পার্টি ভেঙেছে, ক্ষমতার হিস্যা কিংবা ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণেই। এরশাদ কারারুদ্ধ থাকতে ১৯৯১ সালে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করেন দ্বাদশ সংশোধনী পাসের সময়। এরপর দলের ভাঙন দেখা দেয় ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের সরকারে যোগদান প্রশ্নে। তখনো এরশাদ দুদিকে খেলতে ছিলেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাঁর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে চাইছিল। কিন্তু এরশাদ বিএনপিকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। কেননা, বিএনপির শাসনামলে পুরো সময়টাই তাঁকে কারাভোগ করতে হয়। তিনি আওয়ামী লীগের প্রস্তাবে সাড়া দেন এবং তাঁর সমর্থন নিয়েই আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রী হন। এতে দলের বিএনপিপন্থী অংশ ক্ষুব্ধ হয়। আওয়ামী লীগ আমলেই ১৯৯৯ সালে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে এরশাদ শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে চারদলীয় জোট করে মাঠ গরম করেন। জেলের ভয়ে আবার সেই জোট থেকে একসময় বেরিয়েও আসেন। কিন্তু তাঁর এককালীন ঘনিষ্ঠ সহযোগী মতিন ও নাজিউর থেকে যান চারদলেই। ফলে ২০০১ সালে জাতীয় পার্টিকে এককভাবে নির্বাচন করে ১৪টি আসন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়।
আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির কেউ টুঁ শব্দ করলেই তার ভেতর ষড়যন্ত্র খোঁজেন। কিন্তু পৌর নির্বাচনের আগে ও পরে এরশাদের মন্তব্যগুলো তাঁরা একবার মিলিয়ে নিতে পারেন। ২০১৫ সালের অক্টোবরে দলীয় অফিসের সামনে এক সমাবেশে এই স্বৈরশাসক বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র এখন কবরে। নির্বাচন কমিশনেরও কবর হয়ে গেছে (যুগান্তর, ২৪ অক্টোবর ২০১৫)।’ সেই কবর হওয়া গণতন্ত্রেই এরশাদ সাংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত পদে বহাল আছেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পটভূমিতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের পুতুল সরকারের একজন প্রতিনিধি যুদ্ধে উত্তর ভিয়েতনামের কাছে হেরে যাওয়ার পর বলেছিলেন, আমেরিকা যার বন্ধু তার আর শত্রুর দরকার হয় না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলে থাকেন, এরশাদ যার বন্ধু তার আর শত্রুর প্রয়োজন হবে না।
এবার জাতীয় পার্টিতে যে ঘূর্ণিঝড় দেখা গেল, তা শিগগির বন্ধ হবে, না ক্ষমতার রাজনীতিতে ওলটপালট ঘটাবে, সেটি দেখার জন্য আমাদের অারও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এরশাদ দলের ভেতরের বিদ্রোহ অনেকটাই সামাল দিতে পেরেছেন। ‘বিদ্রোহী’রা প্রথমে তাঁর সিদ্ধান্ত ‘মানি না’ ‘মানব না’ বলে আওয়াজ তুললেও পরে সুর নরম করেছেন। কিন্তু তিনি শেষ পর্যন্ত ‘ঘর’ টিকিয়ে রাখতে পারবেন কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। বিদ্রোহীরা মহাসচিব পদে রদবদল কিংবা জি এম কাদেরকে কো–চেয়ারম্যান মেনে নিলেও মন্ত্রিত্ব যে ছাড়বেন না, তা তাঁদের হাবভাবেই স্পষ্ট। এরশাদ জানেন যে জাতীয় পার্টিতে তাঁর প্রতিপক্ষ গ্রুপ যতই লম্ফঝম্ফ করুক না কেন, কেউ তাঁর অবাধ্য হতে পারবেন না। ‘অনুগত বিরোধী দলটির’ নেতা তাঁর দলের সবাইকে অনুগতই রাখতেই পছন্দ করেন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.