শহীদ আসাদের অমরতা by হায়দার আকবর খান রনো
আজ
থেকে ৪৭ বছর আগে এমনই একদিনে ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র আসাদুজ্জামান আসাদ আইয়ুব সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। এ
ঘটনা দাবানলের সৃষ্টি করেছিল, যার পরিণতিতে ঘটে গেল ঐতিহাসিক
গণ-অভ্যুত্থান, আইয়ুব খানের পতন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও
বঙ্গবন্ধুসহ অন্য আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তিলাভ। এই অভ্যুত্থান শ্রমিক ও
কৃষকের মধ্যেও বিপুলভাবে জাগরণ সৃষ্টি করেছিল। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের
ধারাবাহিকতাতেই এসেছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের
অভ্যুদয়। তাই আসাদের শাহাদতবরণ ইতিহাসের কালপঞ্জিতে এক বিশেষ ঘটনা।
রক্তাক্ষরে লেখা এক বিশেষ দিন ২০ জানুয়ারি।
১৯৬৮ সালের শেষ দিক থেকেই অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি পর্ব চলছিল। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টনে জনসভা শেষে মাওলানা ভাসানী গভর্নর ভবন ঘেরাও করেন। বর্তমানে যেটা বঙ্গভবন, তখন সেটাই ছিল গভর্নর মোনায়েম খানের সরকারি বাসভবন। ঘেরাও শেষে তিনি পরদিন হরতালের ডাক দেন। অভূতপূর্বভাবে হরতাল সফল হয়েছিল। জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ চলেছিল। তার পরদিন ৮ ডিসেম্বর আবারও হরতাল। মাওলানা ভাসানী এবার হুমকি দিলেন ‘শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে বাস্তিল দুর্গের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে মুজিবকে মুক্ত করব।’ একই সঙ্গে তিনি গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হাট হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর বিভিন্ন জায়গায় হাট হরতাল হয়েছিল। নড়াইলে এবং নরসিংদীর মনোহরদী থানার হাতিরদিয়া বাজারে পুলিশ গুলি করে মানুষ হত্যা করেছিল।
ছাত্রনেতা আসাদ একই সঙ্গে কৃষক আন্দোলনও করতেন। হাতিরদিয়া বাজারে হাট হরতাল করতে গিয়ে তিনি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন। মাথা ফেটে গিয়েছিল। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল না। গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে ফোনেরও যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু হাতিরদিয়ায় পুলিশের গুলি এবং কয়েকজনের শহীদ হওয়ার খবরটি দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানো দরকার। আসাদ আহতাবস্থায় মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধেই কিছুটা সাইকেলে করে, পরে ট্রেনে করে ঢাকায় পৌঁছান হাতিরদিয়ার গুলির খবর দিতে। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় নিজে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিলেন। তার মাত্র কয়েক দিন পর যখন আসাদ নিজেই ঢাকার রাস্তায় শহীদ হলেন, তখন দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘সেদিন আসাদ এসেছিল খবর দিতে, আজ এল খবর হয়ে।’
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে দুই ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ ও এনএসএফ-এর একাংশ নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সেই ১১ দফা সারা দেশে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিল। এই কর্মসূচিকে ব্যাপক প্রচারে নেওয়ার জন্য ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশ এবং ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হয়েছিল। ১৮ তারিখ পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছিল। ১৯ তারিখ গুলি করেছিল পুলিশ। সেদিন আসাদুল হক নামে একজন (তিনি শহীদ আসাদ নন) গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে মিছিলটি বের হয়েছিল, তার প্রথম সারিতে ছিলেন আসাদুজ্জামান আসাদ। চানখাঁরপুল মোড় থেকে পুলিশের জিপ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আসাদের রক্তমাখা প্রাণহীন দেহ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
আসাদের মৃত্যুতে সারা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। আসাদ সাধারণ পথচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সচেতন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) অন্যতম নেতা ছিলেন। একই সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সংগঠক (প্রধানত শিবপুর এলাকায়) এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
আসাদের মৃত্যুর পর সারা দেশে স্লোগান উঠেছিল ‘আসাদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না’।
বৃথা যায়নি। আসাদের রক্ত বেয়ে এবং তার সঙ্গে লাখ লাখ শহীদের রক্ত যুক্ত হয়ে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আসাদ, তোমাকে বাংলাদেশ কোনো দিন ভুলবে না। তোমার মৃত্যু মৃত্যুকেই অস্বীকার করে তোমাকেই অমর করে রেখেছে ইতিহাসের পাতায়।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
১৯৬৮ সালের শেষ দিক থেকেই অভ্যুত্থানের প্রস্তুতি পর্ব চলছিল। ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর পল্টনে জনসভা শেষে মাওলানা ভাসানী গভর্নর ভবন ঘেরাও করেন। বর্তমানে যেটা বঙ্গভবন, তখন সেটাই ছিল গভর্নর মোনায়েম খানের সরকারি বাসভবন। ঘেরাও শেষে তিনি পরদিন হরতালের ডাক দেন। অভূতপূর্বভাবে হরতাল সফল হয়েছিল। জনতা-পুলিশ সংঘর্ষ চলেছিল। তার পরদিন ৮ ডিসেম্বর আবারও হরতাল। মাওলানা ভাসানী এবার হুমকি দিলেন ‘শেখ মুজিবকে মুক্তি না দিলে বাস্তিল দুর্গের মতো ক্যান্টনমেন্ট ভেঙে মুজিবকে মুক্ত করব।’ একই সঙ্গে তিনি গ্রামাঞ্চলে আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হাট হরতালের ডাক দিয়েছিলেন। ২৯ ডিসেম্বর বিভিন্ন জায়গায় হাট হরতাল হয়েছিল। নড়াইলে এবং নরসিংদীর মনোহরদী থানার হাতিরদিয়া বাজারে পুলিশ গুলি করে মানুষ হত্যা করেছিল।
ছাত্রনেতা আসাদ একই সঙ্গে কৃষক আন্দোলনও করতেন। হাতিরদিয়া বাজারে হাট হরতাল করতে গিয়ে তিনি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হয়েছিলেন। মাথা ফেটে গিয়েছিল। তখনকার দিনে মোবাইল ফোন ছিল না। গ্রামাঞ্চলের সঙ্গে ফোনেরও যোগাযোগব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু হাতিরদিয়ায় পুলিশের গুলি এবং কয়েকজনের শহীদ হওয়ার খবরটি দ্রুত ঢাকায় পৌঁছানো দরকার। আসাদ আহতাবস্থায় মাথায় ব্যান্ডেজ বেঁধেই কিছুটা সাইকেলে করে, পরে ট্রেনে করে ঢাকায় পৌঁছান হাতিরদিয়ার গুলির খবর দিতে। তিনি বিভিন্ন পত্রিকায় নিজে গিয়ে খবর দিয়ে এসেছিলেন। তার মাত্র কয়েক দিন পর যখন আসাদ নিজেই ঢাকার রাস্তায় শহীদ হলেন, তখন দৈনিক পাকিস্তান-এ কর্মরত সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ নির্মল সেন লিখেছিলেন, ‘সেদিন আসাদ এসেছিল খবর দিতে, আজ এল খবর হয়ে।’
১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে দুই ছাত্র ইউনিয়ন ছাত্রলীগ ও এনএসএফ-এর একাংশ নিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন এবং ১৪ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে ১১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। সেই ১১ দফা সারা দেশে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছিল। এই কর্মসূচিকে ব্যাপক প্রচারে নেওয়ার জন্য ১৭ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সমাবেশ এবং ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করা হয়েছিল। ১৮ তারিখ পুলিশ টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করেছিল। ১৯ তারিখ গুলি করেছিল পুলিশ। সেদিন আসাদুল হক নামে একজন (তিনি শহীদ আসাদ নন) গুলিবিদ্ধ হন। পরদিন ২০ জানুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে যে মিছিলটি বের হয়েছিল, তার প্রথম সারিতে ছিলেন আসাদুজ্জামান আসাদ। চানখাঁরপুল মোড় থেকে পুলিশের জিপ থেকে আসাদকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলি ছোড়ে। সঙ্গে সঙ্গে আসাদের রক্তমাখা প্রাণহীন দেহ রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে।
আসাদের মৃত্যুতে সারা দেশ ক্ষোভে ফেটে পড়ল। আসাদ সাধারণ পথচারী ছিলেন না। তিনি ছিলেন সচেতন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী। তিনি ছাত্র ইউনিয়নের (মেনন গ্রুপ) অন্যতম নেতা ছিলেন। একই সঙ্গে কৃষক আন্দোলনের সংগঠক (প্রধানত শিবপুর এলাকায়) এবং গোপন কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।
আসাদের মৃত্যুর পর সারা দেশে স্লোগান উঠেছিল ‘আসাদের মৃত্যু বৃথা যেতে দেব না’।
বৃথা যায়নি। আসাদের রক্ত বেয়ে এবং তার সঙ্গে লাখ লাখ শহীদের রক্ত যুক্ত হয়ে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
আসাদ, তোমাকে বাংলাদেশ কোনো দিন ভুলবে না। তোমার মৃত্যু মৃত্যুকেই অস্বীকার করে তোমাকেই অমর করে রেখেছে ইতিহাসের পাতায়।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments