একমাত্র প্যাপিরাসগাছের মৃত্যু by মোকারম হোসেন
ঢাকায় বলধা গার্ডেনের বিরল সংগ্রহ একমাত্র প্যাপিরাসগাছটি এখন আর নেই। দুর্লভ এই গাছটি দীর্ঘদিন ধরে বলধা গার্ডেনের সাইকিতে সংরক্ষিত ছিল। এ বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে কনকসুধার ছবি তুলতে গিয়ে জানতে পারি প্যাপিরাসগাছটি নেই। সাইকিতে ঢোকার পর ডান দিকে রোজক্যাকটাসের পাশে টবের ভেতরেই ছিল গাছটি। জানামতে, দেশে আর কোনো প্যাপিরাসগাছ নেই। আমাদের অবহেলায় একটি উদ্ভিদ প্রজাতি বিলুপ্ত হলো। কারণ জানতে চাইলে বাগানের কর্মীরা জানান, এ বছর অতিবৃষ্টিতে বাগানের ভেতর জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। বৃষ্টির পানির সঙ্গে পয়োনিষ্কাশন নালার ময়লা গাছের গোড়ায় জমে থাকায় গাছটির মৃত্যু হয়েছে। ধারণা করা হয়, বাগান তৈরির সূচনা পর্বেই বৃক্ষপ্রেমিক জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ রায় প্যাপিরাসগাছটি এখানে নিয়ে আসেন।
দেশের প্রকৃতিপ্রেমিক লেখক ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে বলধা গার্ডেন সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিল। গুরুত্বপূর্ণ এই বাগানের চারপাশে অনেক সুউচ্চ স্থাপনা তৈরি হওয়ায় সেখানকার উদ্ভিদবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি বর্ষায় নিয়মিত জলাবদ্ধতার কারণেও প্রতিবছর অনেক গাছপালার মৃত্যু হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে এখানকার বিলুপ্ত গাছের তালিকা প্রতিনিয়তই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অচিরেই এই বাগান ধ্বংস হবে। দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও নিসর্গীদের মতে, মূল গাছগুলো অক্ষত রেখে চারা–কলমের মাধ্যমে বাগানের গাছগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বলধা গার্ডেনের আদলে আরেকটি বাগান তৈরি করা উচিত। তাহলে বাগানটি নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। হারিয়ে যাবে না প্যাপিরাসের মতো দুষ্প্রাপ্য গাছগুলো। শুধু উল্লিখিত গাছটিই নয়, বাগানে এমন আরও অনেক গাছ রয়েছে, যার দ্বিতীয়টি কোথাও সংরক্ষিত নেই। এ ধরনের কোনো একটি গাছ বাগান থেকে হারিয়ে যাওয়া মানে সারা দেশ থেকেই চিরতরে হারিয়ে যাওয়া।
এখানকার বিলুপ্ত গাছের তালিকা প্রতিনিয়তই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অচিরেই এই বাগান ধ্বংস হবে প্যাপিরাস (Cyperus papyrus) মূলত প্রাচীন লেখার উপকরণ। প্যাপিরাসের বাকলে লেখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। তবে প্রাচীন লেখার আরেক উপকরণ ভূর্জপত্রের গাছটি এখনো বাগানের সাইকি অংশে বেঁচে আছে। প্রাচীন মিসরীয়রা প্যাপিরাসের কাণ্ড থেকে একধরনের কাগজ তৈরি করত। একাধিক গাছের সংগৃহীত বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে একটি পরিপূর্ণ লেখার উপকরণ বানানো হতো। প্যাপিরাসগাছ এক থেকে চার মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কাণ্ড খুব নরম এবং গোড়ার দিকে মানুষের হাতের কবজির মতো মোটা। মোথা বেশ শক্ত। মোথা থেকে গজানো নতুন চারা লালচে বাদামি রঙের আবরণে ঢাকা থাকে। মাথার দিকে পাতার ভারে কাণ্ড অনেকটা নুয়ে পড়ে। গাছের পাতা দেখতে কোঁকড়ানো খসখসে চুলের মতো। পাতা ছোট, মূল শক্ত। মিসরীয়রা প্যাপিরাসগাছের সরু লম্বা ডাঁটি দিয়ে মাদুর ও নৌকার পাল তৈরি করত। কাণ্ডের ভেতরের মজ্জা শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত। ইথিওপিয়া ও নীল নদের উজানে এখনো প্যাপিরাসগাছ দেখা যায়। সাধারণত ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ গাছ ভালো থাকে। গ্রীষ্মের শেষ ভাগে ফুল ফোটে। জলার ধার অথবা অল্প পানির জলাভূমি পছন্দ। বীজ ও মোথাকন্দ থেকে বংশবৃদ্ধি।
বলধা গার্ডেনের হতশ্রী রূপ দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে বাগানটি লোকবল ও অর্থ–সংকটে ভুগছে। বাগানের সর্বত্র অযত্নের ছাপ। সংরক্ষিত সাইকি অংশের পরিস্থিতিও বেশ নাজুক। স্বল্পসংখ্যক মালি নিয়ে শুধু গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। চারপাশের উঁচু দালানে প্রায় ঢাকা পড়েছে বাগানটি। দিনের আলোয়ও পেছনের দিকটা বেশ অন্ধকার। সিবিলি অংশে সারা দিনই দর্শনার্থীদের ভিড়। এই দর্শনার্থীরা মূলত অন্য মতলবে এখানে আসেন। প্রশ্ন হলো, বলধা গার্ডেনের মতো এমন স্পর্শকাতর একটি স্থাপনা কেন টিকিটের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হলো! তবু যাঁরা এখানে বেড়াতে আসেন, তাঁরা যদি সত্যিকার অর্থে বৃক্ষের সমঝদার হতেন, তাহলে কোনো প্রশ্ন ছিল না। উপরন্তু, নিত্যদিনের এই অনিয়ন্ত্রিত জনস্রোত উদ্যানের বিপন্ন গাছগুলোর মৃত্যুকেই শুধু ত্বরান্বিত করছে। এই বাগানের অর্জিত অর্থ ছাড়া কি বন বিভাগের চলছিল না? আবার এখানকার অর্জিত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হলেও বাগান রক্ষণাবেক্ষণে তার সিকি ভাগও ব্যয় হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, অচিরেই এসব আত্মঘাতী কাজের সমাপ্তি ঘটবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাগানটি বাঁচিয়ে রাখতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক: তরুপল্লব
tarupallab@gmail. com
দেশের প্রকৃতিপ্রেমিক লেখক ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে বলধা গার্ডেন সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছিল। গুরুত্বপূর্ণ এই বাগানের চারপাশে অনেক সুউচ্চ স্থাপনা তৈরি হওয়ায় সেখানকার উদ্ভিদবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি বর্ষায় নিয়মিত জলাবদ্ধতার কারণেও প্রতিবছর অনেক গাছপালার মৃত্যু হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে এখানকার বিলুপ্ত গাছের তালিকা প্রতিনিয়তই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অচিরেই এই বাগান ধ্বংস হবে। দেশের উদ্ভিদবিজ্ঞানী ও নিসর্গীদের মতে, মূল গাছগুলো অক্ষত রেখে চারা–কলমের মাধ্যমে বাগানের গাছগুলো অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে বলধা গার্ডেনের আদলে আরেকটি বাগান তৈরি করা উচিত। তাহলে বাগানটি নিশ্চিত বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে। হারিয়ে যাবে না প্যাপিরাসের মতো দুষ্প্রাপ্য গাছগুলো। শুধু উল্লিখিত গাছটিই নয়, বাগানে এমন আরও অনেক গাছ রয়েছে, যার দ্বিতীয়টি কোথাও সংরক্ষিত নেই। এ ধরনের কোনো একটি গাছ বাগান থেকে হারিয়ে যাওয়া মানে সারা দেশ থেকেই চিরতরে হারিয়ে যাওয়া।
এখানকার বিলুপ্ত গাছের তালিকা প্রতিনিয়তই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অচিরেই এই বাগান ধ্বংস হবে প্যাপিরাস (Cyperus papyrus) মূলত প্রাচীন লেখার উপকরণ। প্যাপিরাসের বাকলে লেখা অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রাচীন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। তবে প্রাচীন লেখার আরেক উপকরণ ভূর্জপত্রের গাছটি এখনো বাগানের সাইকি অংশে বেঁচে আছে। প্রাচীন মিসরীয়রা প্যাপিরাসের কাণ্ড থেকে একধরনের কাগজ তৈরি করত। একাধিক গাছের সংগৃহীত বিভিন্ন অংশ জোড়া দিয়ে একটি পরিপূর্ণ লেখার উপকরণ বানানো হতো। প্যাপিরাসগাছ এক থেকে চার মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। কাণ্ড খুব নরম এবং গোড়ার দিকে মানুষের হাতের কবজির মতো মোটা। মোথা বেশ শক্ত। মোথা থেকে গজানো নতুন চারা লালচে বাদামি রঙের আবরণে ঢাকা থাকে। মাথার দিকে পাতার ভারে কাণ্ড অনেকটা নুয়ে পড়ে। গাছের পাতা দেখতে কোঁকড়ানো খসখসে চুলের মতো। পাতা ছোট, মূল শক্ত। মিসরীয়রা প্যাপিরাসগাছের সরু লম্বা ডাঁটি দিয়ে মাদুর ও নৌকার পাল তৈরি করত। কাণ্ডের ভেতরের মজ্জা শুকিয়ে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করত। ইথিওপিয়া ও নীল নদের উজানে এখনো প্যাপিরাসগাছ দেখা যায়। সাধারণত ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ গাছ ভালো থাকে। গ্রীষ্মের শেষ ভাগে ফুল ফোটে। জলার ধার অথবা অল্প পানির জলাভূমি পছন্দ। বীজ ও মোথাকন্দ থেকে বংশবৃদ্ধি।
বলধা গার্ডেনের হতশ্রী রূপ দেখে খুব সহজেই অনুমান করা যায় যে বাগানটি লোকবল ও অর্থ–সংকটে ভুগছে। বাগানের সর্বত্র অযত্নের ছাপ। সংরক্ষিত সাইকি অংশের পরিস্থিতিও বেশ নাজুক। স্বল্পসংখ্যক মালি নিয়ে শুধু গাছগুলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে। চারপাশের উঁচু দালানে প্রায় ঢাকা পড়েছে বাগানটি। দিনের আলোয়ও পেছনের দিকটা বেশ অন্ধকার। সিবিলি অংশে সারা দিনই দর্শনার্থীদের ভিড়। এই দর্শনার্থীরা মূলত অন্য মতলবে এখানে আসেন। প্রশ্ন হলো, বলধা গার্ডেনের মতো এমন স্পর্শকাতর একটি স্থাপনা কেন টিকিটের বিনিময়ে সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত করা হলো! তবু যাঁরা এখানে বেড়াতে আসেন, তাঁরা যদি সত্যিকার অর্থে বৃক্ষের সমঝদার হতেন, তাহলে কোনো প্রশ্ন ছিল না। উপরন্তু, নিত্যদিনের এই অনিয়ন্ত্রিত জনস্রোত উদ্যানের বিপন্ন গাছগুলোর মৃত্যুকেই শুধু ত্বরান্বিত করছে। এই বাগানের অর্জিত অর্থ ছাড়া কি বন বিভাগের চলছিল না? আবার এখানকার অর্জিত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হলেও বাগান রক্ষণাবেক্ষণে তার সিকি ভাগও ব্যয় হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে। আমাদের প্রত্যাশা, অচিরেই এসব আত্মঘাতী কাজের সমাপ্তি ঘটবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বাগানটি বাঁচিয়ে রাখতে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে।
মোকারম হোসেন: প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক। সাধারণ সম্পাদক: তরুপল্লব
tarupallab@gmail. com
No comments