ভারতে বিচারপতি বাছাইয়ে পর্দা উন্মোচন by মিজানুর রহমান খান
স্বচ্ছতা
ও জনগণের জানার অধিকারের জয় হয়েছে। ৬৬ বছর ধরে অনুসৃত গোপনীয়তার প্রথা
ভেঙে বেরিয়ে এসেছেন ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট। গত ১৬ অক্টোবর বিচারক নিয়োগ
কমিশন গঠনসংক্রান্ত ভারতের সংবিধান সংশোধনী বিল বাতিল করেছিলেন তাঁরা। সেই
রায়ের ৬০ দিনের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর বিচারক নিয়োগ ও বাছাইয়ে নতুন ফর্মুলা
দিয়েছেন আদালত। তবে এই বিতর্ক সহজে থামছে না। কারণ, বিচারক বাছাই ও
নিয়োগের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আদালতের কাছেই ন্যস্ত রাখতে সরকার ও আইনসভা
রাজি থাকে কি না, সেটা দেখার বিষয়। আবার আদালত বলেছেন, প্রধান বিচারপতি ও
অপর চার জ্যেষ্ঠ বিচারকের সর্বসম্মতিতে নিয়োগ পাকা হবে। কিন্তু সব সময়
সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না-ও হতে পারে। তা ছাড়া বিচারক বাদে অন্য
কাউকেই কলিজিয়ামে ঢুকতে দেওয়া যাবে না, সেই যুক্তি সবাই না–ও মানতে পারেন।
তবে বিচারপতি বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বলতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কী বোঝেন, সেটা এখন থেকে জনগণও বুঝতে পারবে। কী কী বিবেচনায় বিচারকের মতো এতটা বিশাল মাপের গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য লোককে বাছাই করা হয়, সেটা এতকাল শুধু প্রধান বিচারপতি ও পাঁচ জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কলিজিয়ামের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল। সত্যি একটা কালো পর্দাঘেরা ব্যাপার ছিল। এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রথমবারের মতো স্বীকার করলেন যে বিচারপতি বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সরাসরি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। এমনকি কোনো বিচারক প্রার্থীর ব্যাপারে জনগণ অভিযোগ করতে পারবেন এবং কলিজিয়াম ও সরকারকে তা বিবেচনায় নিতে হবে।
আসলে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কিংবা নির্বাহী বিভাগ, কেউ এটা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মানবেন। কিন্তু তা-ই সত্য হলো। সরকার নয়, ভারতের সুপ্রিম কোর্টই এগিয়ে এলেন। তাঁরাই জাতির সামনে, বিশ্বসভ্যতার সামনে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করলেন যে বিচারপতি বাছাই করার প্রক্রিয়াটায় আমজনতার ন্যায্য হিস্যা আছে। বিচারক বাছাইয়ে মানুষের জানার অধিকারের বিষয়টি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, এটা পরিপন্থী নয়।
অথচ এতকাল রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপন জারি করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সরকারি তরফে বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু জানানোটা রীতিমতো নিষিদ্ধ ব্যাপার ছিল। বিচারকের শপথ নেওয়ার তারিখটা দ্রুততার সঙ্গে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো। আর তখন নবনিযুক্ত বিচারকের বিষয়ে উচ্চবাচ্য করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
আর এখন বিচারক পদে কারও চূড়ান্ত নিয়োগের সরকারি প্রজ্ঞাপন ঘাড়ের ওপর চেপে বসার অনেক আগেই মানুষ জানবে যে কাদের ভেতর থেকে বিচারক বাছাই করা হচ্ছে। কিসের ভিত্তিতে প্রাথমিক তালিকাটা তৈরি হলো। কারণ, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের একটি সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ বুধবার বলেছেন, ‘বাছাই ও নিয়োগের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নিয়োগের কার্যপ্রণালিতে তার প্রতিফলন থাকতে হবে এবং নিয়োগ সম্পর্কিত প্রতিটি স্তরের বিষয় আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রিম কোর্টের (ক্ষেত্রমতে হাইকোর্টের) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।’ এ ছাড়া বিচারক বাছাই-সংক্রান্ত পুরো আলোচনা ও পরামর্শ প্রক্রিয়ার লিখিত রেকর্ড থাকতে হবে, এমনকি কারও ভিন্নমতও লিখে রাখতে হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেসব রাষ্ট্র বিচারক বাছাইয়ে কঠিন পর্দাপ্রথা চালু রেখেছে, তাদের তা থেকে বেরিয়ে আসতে উৎসাহিত করতে হবে।
অতীতে আমরা দেখেছি, বিচারক নিয়োগের কোনো মামলায় আদালত তলব করেও সরকার বা আদালত প্রশাসনের কাছ থেকে উপযুক্ত রেকর্ডের হদিস পাননি। প্রধান বিচারপতি এককভাবে কাউকে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করেছিলেন, কেবল এতটুকু অনুমান বা কল্পনার ভিত্তিতে পাকাপাকি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এটা এখন বলা যায়, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বিশ্বের অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো ভারতীয় উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রগুলোও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ও শুনানিনির্ভর বাছাইয়ের প্রক্রিয়া মেনে নেবে। ভারতে এখন যদি সম্ভাব্য বিচারক প্রার্থীর বিষয় আগেভাগে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, তাহলে সেখানে একধরনের প্রকাশ্য আলাপ-আলোচনার একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পরোক্ষভাবে গণশুনানি চালু হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করতে হয় যে কোনো কোনো দেশের আদালত ‘স্বচ্ছতা’ শব্দটি ব্যবহারিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে কেবল কাগজে-কলমেই আটকে রেখেছেন। বাস্তবে কোনো ‘স্বচ্ছতা’র নীতি অনুসরণ করা হয় বলে আদৌ প্রতীয়মান হয় না। অবশ্য জোর গলায় সংশ্লিষ্ট সচেতন মহলের কাউকে এ বিষয়ে দাবিও করতে দেখা যায় না। উপরন্তু এ বিষয়ে একধরনের আশ্চর্য দায়মুক্তি দেখা যায়। বিচারক পদপ্রার্থী বাছাইয়ের পরে আসে নিয়োগের প্রশ্ন। কিন্তু কী করে বাছাই করা হয়, এমনকি কারা, কীভাবে, কোন বিবেচনায়, কী কারণে বিচারকের শূন্য পদে প্রার্থী কিংবা বিশিষ্ট আইনবিদ হিসেবে বিচারালয়ের পবিত্র আসনে বসার জন্য আমন্ত্রিত হন, তা বাছাই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। অথচ এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্ট বা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থাই ছিল না।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায় এই অচলায়তন ভেঙে দেবে, সেই আশায় আমরা দিন গুনব। ভাবতে ভালো লাগছে যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কিংবা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে সচিব অথবা মন্ত্রীকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করবেন। তাঁরা শুধাবেন, মাননীয় মন্ত্রী, এখন কতগুলো শূন্য পদ আছে? প্রাথমিক তালিকায় যেসব নাম আপনারা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছেন, সেটা কিসের ভিত্তিতে, কীভাবে তৈরি হলো? মি. অমুকের বিষয়ে আমাদের কাছে এই তথ্য-প্রমাণ আছে। তাহলে তাঁর নাম কী করে এল? এভাবে কলিজিয়াম তার জবাবদিহি মেনে নিয়েছে।
১৯৪৯ সাল থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও তাদের সরকারগুলো দাবি করে আসছে, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তবেই তারা বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিয়ে চলে। কিন্তু সেটা জনগণের জানা-বোঝার একেবারে বাইরে ছিল। জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ তাতে ছিল না। এমনকি সেই অধিকার যে আছে, সেটাই কেউ স্বীকার করতেন না। ভরতের সরকার যে কমিশন করেছিল, তাতেও জনতার জানার অধিকার এভাবে স্বীকৃত হয়নি।
বিচারক পদে কাউকে নিয়োগের সরকারি প্রজ্ঞাপনের আগে গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমজনতা কিছুই জানতে পারত না। ১৯৯৩ সালে পাঁচ বিচারকের সমন্বয়ে কলিজিয়াম প্রথা যখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট চালু করলেন, তখন সরকার ও সংসদ এর বিরোধিতা করেনি, বরং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা নিয়ে কথা উঠল। আকার-ইঙ্গিতে অভিযোগ উঠল যে ভারত তার সর্বোচ্চ আদালতে সব থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের বসাতে পারছে না। নানা ধরনের কোটারি ও সংকীর্ণ স্বার্থ ভর করেছে। দীর্ঘ তর্ক–বিতর্কের পরে কংগ্রেস ও বিজেপি অবশেষে এক বিরল সমঝোতায় পৌঁছাল। তারা বিচারপতি নিয়োগের বিধানসংবলিত সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী পাস করল। আর সেটা বাতিল হলে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকা মোদি সরকারের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখা হতো। বিজেপির অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ‘অনির্বাচিতদের স্বৈরশাসন’ বলে আদালতের যে সমালোচনা করেছিলেন, এখন তার ধার কমে যাবে। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট সরকারের নিবেদন কিছুটা কবুল করেছেন। সরকার বলেছে, বিচারক নিয়োগে একটি এমওপি লাগবেই। এমওপি মানে মেমোরেন্ডাম অব প্রসিডিউর। আর এটা নির্বাহী বিভাগের কাজ, আদালতের এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। আদালত বলেছেন, আমরা তা মেনে নিলাম। তবে এমওপির লক্ষ্য হবে কলিজিয়াম-ব্যবস্থাকে উন্নত করা। এমওপিতে অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে। এসব বিষয়ে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নিতে হবে।
আসলে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের অক্টোবর ও ডিসেম্বরের দুটি রায়ের আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করাই স্থায়ী সমাধান। প্রস্তাবিত এমওপিকে কমিশনে ঢোকাতে হবে। ভারতকে আরেকটি সংবিধান সংশোধনীতে যেতে হবে। কারণ, আদালত তৈরি আইন সংবিধানের বিকল্প হতে পারে না। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যখন কমিশন-সংক্রান্ত পুরো আইনটিই বাতিল করলেন, তখন তা ছিল খুবই হতাশার। গত অক্টোবরে এই কলামে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। আদালত বলেছেন, সরকারকে বিচারক নিয়োগের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে নিয়োগ সচিবালয় গঠন করতে হবে।
ভারতের মিডিয়া ও সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১৬ ডিসেম্বর তাই একটি শুভ দিন। বাংলাদেশের বিজয় দিবসে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় জনগণের জানার অধিকারের বিজয় ঘোষণা করেছেন। কারণ, এ দিনটিতে বাক্স্বাধীনতার নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। ভারতের মিডিয়া বিচারক বাছাইয়ের প্রক্রিয়ার গোড়া থেকেই এখন সংগত ও গঠনমূলক প্রশ্ন তুলতে পারবেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এই নবতর উপলব্ধিকে সাধুবাদ জানাই। এটা বিশ্বাস করতে ভালো লাগছে যে জগদ্দল পাথরকে টলানো সম্ভব।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
তবে বিচারপতি বাছাইয়ের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বলতে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কী বোঝেন, সেটা এখন থেকে জনগণও বুঝতে পারবে। কী কী বিবেচনায় বিচারকের মতো এতটা বিশাল মাপের গুরুত্বপূর্ণ পদে যোগ্য লোককে বাছাই করা হয়, সেটা এতকাল শুধু প্রধান বিচারপতি ও পাঁচ জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে নিয়ে গঠিত কলিজিয়ামের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল। সত্যি একটা কালো পর্দাঘেরা ব্যাপার ছিল। এখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রথমবারের মতো স্বীকার করলেন যে বিচারপতি বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে সরাসরি জানার অধিকার জনগণের রয়েছে। এমনকি কোনো বিচারক প্রার্থীর ব্যাপারে জনগণ অভিযোগ করতে পারবেন এবং কলিজিয়াম ও সরকারকে তা বিবেচনায় নিতে হবে।
আসলে বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কিংবা নির্বাহী বিভাগ, কেউ এটা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে মানবেন। কিন্তু তা-ই সত্য হলো। সরকার নয়, ভারতের সুপ্রিম কোর্টই এগিয়ে এলেন। তাঁরাই জাতির সামনে, বিশ্বসভ্যতার সামনে দ্বিধাহীন চিত্তে স্বীকার করলেন যে বিচারপতি বাছাই করার প্রক্রিয়াটায় আমজনতার ন্যায্য হিস্যা আছে। বিচারক বাছাইয়ে মানুষের জানার অধিকারের বিষয়টি বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ধারণার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ, এটা পরিপন্থী নয়।
অথচ এতকাল রাষ্ট্রপতি প্রজ্ঞাপন জারি করার আগমুহূর্ত পর্যন্ত সরকারি তরফে বাছাইয়ের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছু জানানোটা রীতিমতো নিষিদ্ধ ব্যাপার ছিল। বিচারকের শপথ নেওয়ার তারিখটা দ্রুততার সঙ্গে জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হতো। আর তখন নবনিযুক্ত বিচারকের বিষয়ে উচ্চবাচ্য করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত।
আর এখন বিচারক পদে কারও চূড়ান্ত নিয়োগের সরকারি প্রজ্ঞাপন ঘাড়ের ওপর চেপে বসার অনেক আগেই মানুষ জানবে যে কাদের ভেতর থেকে বিচারক বাছাই করা হচ্ছে। কিসের ভিত্তিতে প্রাথমিক তালিকাটা তৈরি হলো। কারণ, প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের একটি সুপ্রিম কোর্ট বেঞ্চ বুধবার বলেছেন, ‘বাছাই ও নিয়োগের প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই নিয়োগের কার্যপ্রণালিতে তার প্রতিফলন থাকতে হবে এবং নিয়োগ সম্পর্কিত প্রতিটি স্তরের বিষয় আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় এবং সুপ্রিম কোর্টের (ক্ষেত্রমতে হাইকোর্টের) ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।’ এ ছাড়া বিচারক বাছাই-সংক্রান্ত পুরো আলোচনা ও পরামর্শ প্রক্রিয়ার লিখিত রেকর্ড থাকতে হবে, এমনকি কারও ভিন্নমতও লিখে রাখতে হবে বলে সুপ্রিম কোর্ট নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। যেসব রাষ্ট্র বিচারক বাছাইয়ে কঠিন পর্দাপ্রথা চালু রেখেছে, তাদের তা থেকে বেরিয়ে আসতে উৎসাহিত করতে হবে।
অতীতে আমরা দেখেছি, বিচারক নিয়োগের কোনো মামলায় আদালত তলব করেও সরকার বা আদালত প্রশাসনের কাছ থেকে উপযুক্ত রেকর্ডের হদিস পাননি। প্রধান বিচারপতি এককভাবে কাউকে বিচারক নিয়োগে সুপারিশ করেছিলেন, কেবল এতটুকু অনুমান বা কল্পনার ভিত্তিতে পাকাপাকি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
এটা এখন বলা যায়, সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন বিশ্বের অন্যান্য উন্নত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মতো ভারতীয় উপমহাদেশীয় রাষ্ট্রগুলোও উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ও শুনানিনির্ভর বাছাইয়ের প্রক্রিয়া মেনে নেবে। ভারতে এখন যদি সম্ভাব্য বিচারক প্রার্থীর বিষয় আগেভাগে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, তাহলে সেখানে একধরনের প্রকাশ্য আলাপ-আলোচনার একটা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পরোক্ষভাবে গণশুনানি চালু হয়ে যাবে।
এ প্রসঙ্গে দুঃখের সঙ্গে স্মরণ করতে হয় যে কোনো কোনো দেশের আদালত ‘স্বচ্ছতা’ শব্দটি ব্যবহারিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরিয়ে কেবল কাগজে-কলমেই আটকে রেখেছেন। বাস্তবে কোনো ‘স্বচ্ছতা’র নীতি অনুসরণ করা হয় বলে আদৌ প্রতীয়মান হয় না। অবশ্য জোর গলায় সংশ্লিষ্ট সচেতন মহলের কাউকে এ বিষয়ে দাবিও করতে দেখা যায় না। উপরন্তু এ বিষয়ে একধরনের আশ্চর্য দায়মুক্তি দেখা যায়। বিচারক পদপ্রার্থী বাছাইয়ের পরে আসে নিয়োগের প্রশ্ন। কিন্তু কী করে বাছাই করা হয়, এমনকি কারা, কীভাবে, কোন বিবেচনায়, কী কারণে বিচারকের শূন্য পদে প্রার্থী কিংবা বিশিষ্ট আইনবিদ হিসেবে বিচারালয়ের পবিত্র আসনে বসার জন্য আমন্ত্রিত হন, তা বাছাই প্রক্রিয়ার অন্তর্গত। অথচ এ বিষয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বা হাইকোর্ট বা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয় থেকে কোনো তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থাই ছিল না।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ রায় এই অচলায়তন ভেঙে দেবে, সেই আশায় আমরা দিন গুনব। ভাবতে ভালো লাগছে যে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল কিংবা আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হিসেবে সচিব অথবা মন্ত্রীকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করবেন। তাঁরা শুধাবেন, মাননীয় মন্ত্রী, এখন কতগুলো শূন্য পদ আছে? প্রাথমিক তালিকায় যেসব নাম আপনারা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছেন, সেটা কিসের ভিত্তিতে, কীভাবে তৈরি হলো? মি. অমুকের বিষয়ে আমাদের কাছে এই তথ্য-প্রমাণ আছে। তাহলে তাঁর নাম কী করে এল? এভাবে কলিজিয়াম তার জবাবদিহি মেনে নিয়েছে।
১৯৪৯ সাল থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ও তাদের সরকারগুলো দাবি করে আসছে, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা বজায় রেখে তবেই তারা বিচারক নিয়োগে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ দিয়ে চলে। কিন্তু সেটা জনগণের জানা-বোঝার একেবারে বাইরে ছিল। জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ তাতে ছিল না। এমনকি সেই অধিকার যে আছে, সেটাই কেউ স্বীকার করতেন না। ভরতের সরকার যে কমিশন করেছিল, তাতেও জনতার জানার অধিকার এভাবে স্বীকৃত হয়নি।
বিচারক পদে কাউকে নিয়োগের সরকারি প্রজ্ঞাপনের আগে গোটা প্রক্রিয়া সম্পর্কে আমজনতা কিছুই জানতে পারত না। ১৯৯৩ সালে পাঁচ বিচারকের সমন্বয়ে কলিজিয়াম প্রথা যখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট চালু করলেন, তখন সরকার ও সংসদ এর বিরোধিতা করেনি, বরং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে তা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা নিয়ে কথা উঠল। আকার-ইঙ্গিতে অভিযোগ উঠল যে ভারত তার সর্বোচ্চ আদালতে সব থেকে যোগ্য ব্যক্তিদের বসাতে পারছে না। নানা ধরনের কোটারি ও সংকীর্ণ স্বার্থ ভর করেছে। দীর্ঘ তর্ক–বিতর্কের পরে কংগ্রেস ও বিজেপি অবশেষে এক বিরল সমঝোতায় পৌঁছাল। তারা বিচারপতি নিয়োগের বিধানসংবলিত সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী পাস করল। আর সেটা বাতিল হলে জনপ্রিয়তা হারাতে থাকা মোদি সরকারের জন্য পরাজয় হিসেবে দেখা হতো। বিজেপির অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি ‘অনির্বাচিতদের স্বৈরশাসন’ বলে আদালতের যে সমালোচনা করেছিলেন, এখন তার ধার কমে যাবে। কারণ, সুপ্রিম কোর্ট সরকারের নিবেদন কিছুটা কবুল করেছেন। সরকার বলেছে, বিচারক নিয়োগে একটি এমওপি লাগবেই। এমওপি মানে মেমোরেন্ডাম অব প্রসিডিউর। আর এটা নির্বাহী বিভাগের কাজ, আদালতের এতে হস্তক্ষেপ করা উচিত নয়। আদালত বলেছেন, আমরা তা মেনে নিলাম। তবে এমওপির লক্ষ্য হবে কলিজিয়াম-ব্যবস্থাকে উন্নত করা। এমওপিতে অভিযোগ গ্রহণের ব্যবস্থা থাকবে। এসব বিষয়ে প্রধান বিচারপতির পরামর্শ নিতে হবে।
আসলে ভারতের সর্বোচ্চ আদালতের অক্টোবর ও ডিসেম্বরের দুটি রায়ের আলোকে একটি পূর্ণাঙ্গ কমিশন গঠন করাই স্থায়ী সমাধান। প্রস্তাবিত এমওপিকে কমিশনে ঢোকাতে হবে। ভারতকে আরেকটি সংবিধান সংশোধনীতে যেতে হবে। কারণ, আদালত তৈরি আইন সংবিধানের বিকল্প হতে পারে না। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট যখন কমিশন-সংক্রান্ত পুরো আইনটিই বাতিল করলেন, তখন তা ছিল খুবই হতাশার। গত অক্টোবরে এই কলামে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট তাঁর আগের অবস্থান থেকে কিছুটা সরে এসেছেন। আদালত বলেছেন, সরকারকে বিচারক নিয়োগের ন্যূনতম বয়স নির্ধারণ এবং সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টে নিয়োগ সচিবালয় গঠন করতে হবে।
ভারতের মিডিয়া ও সুপ্রিম কোর্ট পর্যবেক্ষণকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ১৬ ডিসেম্বর তাই একটি শুভ দিন। বাংলাদেশের বিজয় দিবসে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ভারতীয় জনগণের জানার অধিকারের বিজয় ঘোষণা করেছেন। কারণ, এ দিনটিতে বাক্স্বাধীনতার নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে। ভারতের মিডিয়া বিচারক বাছাইয়ের প্রক্রিয়ার গোড়া থেকেই এখন সংগত ও গঠনমূলক প্রশ্ন তুলতে পারবেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের এই নবতর উপলব্ধিকে সাধুবাদ জানাই। এটা বিশ্বাস করতে ভালো লাগছে যে জগদ্দল পাথরকে টলানো সম্ভব।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments