নেপালের শিক্ষা! by কামাল আহমেদ
অবরোধ প্রতাহারে নেপালকে শেষ পর্যন্ত ভারতের দাবি মেনে নিতে হয়েছে |
ভারতে
নরেন্দ্র মোদি তাঁর ভূমিধস বিজয়ের পর শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার
প্রতিবেশী দেশগুলোর নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে কথিত ‘প্রতিবেশীদের
অগ্রাধিকার’ দেওয়ার পররাষ্ট্রনীতির সূচনা করেছিলেন। দেশের ভেতরে ‘সবকা সাথ
সমৃদ্ধি’র যে আওয়াজ তুলে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই সমৃদ্ধির ধারায়
প্রতিবেশীদেরও সম্পৃক্ত করার অঙ্গীকার করেছিলেন তিনি। তবে বছর না ঘুরতেই
তাঁর সেই আশ্বাস অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। নেপাল তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
প্রায় চার মাস এক অঘোষিত অবরোধের শিকার নেপাল শেষ পর্যন্ত ২০ ডিসেম্বর রাতে
ভারতের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে। প্রায় সাত বছর ধরে দর-কষাকষি ও
রাজনৈতিক লেনদেনের নানা সমীকরণের মধ্য দিয়ে গৃহীত সংবিধান বৃহৎ প্রতিবেশীর
চাপে আবারও সংশোধনে সম্মত হয়েছে নেপাল সরকার।
নেপালের তেরাই সমতল অঞ্চলের মধেশিদের দাবি অনুযায়ী সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং প্রাদেশিক সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয় বিবেচনায় রাজি হয়েছে মন্ত্রিসভা। তেরাই অঞ্চলের এই মধেশিরা মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং ভারতের বিহার রাজ্যের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার বন্ধন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নেপালের নতুন সংবিধানের যেসব বিষয়কে ঘিরে দেশটিতে বিরোধ ও অস্থিরতা দেখা দেয়, তার মধ্যে সাতটি প্রদেশ সৃষ্টি এবং তার সীমানা চিহ্নিত করা অন্যতম। এ ছাড়া রাজতন্ত্রের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হওয়া হিন্দুরাষ্ট্র পরিচয় পুনরুজ্জীবনের দাবিও উঠেছিল।
গত আগস্ট মাসে দেশটিতে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর দেশের ভেতরে মধেশিরা প্রতিবাদ জানানো শুরু করলে ভারতও প্রকাশ্যে নেপালের সমালোচনা শুরু করে। এমনকি ভারত ওই সংবিধান সংশোধনের কথাও বলে। প্রায় একই সময়ে মধেশিদের আন্দোলনের কারণে নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে ভারতের সীমান্তচৌকিগুলোতে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়, যাকে অঘোষিত অবরোধ হিসেবেই সবাই অভিহিত করতে থাকেন। ভারতে সরকারিভাবে অবরোধের কথা অস্বীকার করা হলেও দেশটির বিরোধী রাজনীতিক এবং সংবাদমাধ্যমেও একে অবরোধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
গত রোববার রাতে (২০ ডিসেম্বর) মধেশি আন্দোলনকারীদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, যে কমিশন এই বিরোধ নিষ্পত্তি ও সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে সুপারিশ পেশ করবে। সমঝোতার পর নেপালের শিল্পমন্ত্রী সোম প্রসাদ পান্ডে সাংবাদিকদের বলেন যে কমিশন গঠিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তার সুপারিশমালা পেশ করবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সেদিন এক বিবৃতিতে চলমান অচলাবস্থা নিরসনের ভিত্তি তৈরি করতে এই সমঝোতা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করে।
নেপালের ওপর ভারতের এই অঘোষিত অবরোধের অবসান যে সবার জন্য সুসংবাদ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আমরা সবাই এখন আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে পারি। কেননা, এই অবরোধের সময় প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে নানা সময়ের সংঘাতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫০ জনের। অবরোধজনিত খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতির কারণে কোনো মৃত্যু ঘটেছে কি না, তার কোনো হিসাব অবশ্য কেউ প্রকাশ করেনি। তবে ৩০ নভেম্বর ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক এক বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন যে অচিরেই এই অবরোধের অবসান না হলে শীত মৌসুমে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তার আগে ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষের প্রতি এই অবরোধ অবসানের আহ্বান জানিয়েছিলেন (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১১ নভেম্বর, ২০১৫)। মি. মুন তাঁর বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন যে অবরোধের কারণে ভয়াবহ ভূমিকম্প–পীড়িত দেশটির প্রত্যন্ত এলাকায় জরুরি মানবিক সাহায্যসামগ্রীর সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর বিবৃতিতে অবরোধের জন্য দায়ী কে, তা উল্লেখ না করলেও বলেছিলেন যে একটি ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলক্ড) দেশ হিসেবে নেপালের ট্রানজিট পাওয়ার অধিকার আছে। উপরন্তু মানবিক সহায়তা পাওয়ার প্রশ্ন তো রয়েছেই। তারও দুই মাস আগে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের র্শীষ বৈঠকের সময় নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে ভারতের এই অবরোধের বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছিল। তবে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা যে কতটা প্রকট, সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা না করলেও চলে। অবশ্য তাদের এসব উদ্বেগের প্রসঙ্গ উত্থাপন এ কারণে জরুরি যে সংকটটি একটি প্রাণঘাতী রূপ নিলেও নিতে পারত। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি বড় ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেল। সম্ভবত বাংলাদেশও একই ধরনের বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পেল। কেননা, জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহে বাংলাদেশের কাছেও নেপাল সহায়তা চেয়েছিল। ভারতের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সেটা কতটা সম্ভব হতো, তা বলা মুশকিল।
এই অর্থনৈতিক অবরোধটির কারণে নেপাল এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো দুর্যোগের কবলে পড়ে। প্রথমটি ঘটেছিল ২৫ এপ্রিলের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে। ওই ভূমিকম্পে দেশটিতে জাতিসংঘের হিসাবে কমপক্ষে ৯ হাজার লোকের মৃত্যু হয় এবং ২৩ হাজারের বেশি লোক আহত হয়। হাজার হাজার লোক আশ্রয়হারা হয় এবং অর্থনীতি চরম সংকটের মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা ধরনের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেও দেশটিতে পুনর্গঠনের কাজ এখনো পুরোদমে শুরু হতে পারেনি।
নেপালের সঙ্গে ভারতের এই বিরোধ বা সংকটের অন্য আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসেরই এক প্রবীণ নেতা মনি শংকর আয়ার। ৭ ডিসেম্বর তিনি এনডিটিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিশেষ নিবন্ধে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন, যাতে দেখা যাচ্ছে নেপালের এই দুর্ভোগের পেছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও অনেকাংশে দায়ী। ‘এ মোদি-মেড ডিজাস্টার হিটস নেপাল হার্ড’ শিরোনামের নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হতে না দেওয়ার প্রতিশোধ নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তিনি আরও লিখেছেন, ২০১৫ সালে বিহারে যে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হয়ে গেল, সেই ভোট সামনে রেখে এক বছর আগে নেপালের জানকিপুরে মি. মোদি একটি জনসভা করতে চেয়েছিলেন। সেখানে তিনি মধেশি মেয়েদের মধ্যে ১০ হাজার বাইসাইকেল বিতরণ করতে চেয়েছিলেন। ওই সব সাইকেল পেলে মধেশি বালিকারা বিহারে বসবাসরত তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে বিজেপির পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করবেন বলে তাঁর আশা ছিল। নেপাল সরকার তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি।
মনি শংকর আয়ার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তাঁর লেখায়। নেপালের যে সংসদে নতুন সংবিধানটি অনুমোদিত হয়েছে, সেই সংসদে তরাই অঞ্চল থেকে জনপ্রতিনিধি আছেন ১১৬ জন এবং তাঁদের মধ্যে ১০৫ জনই সংবিধানটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। মাত্র ১১ জন সাংসদের বিরোধিতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ভারত যে নেপালি সংবিধান আবারও সংশোধনের চাপ দিয়েছে, তিনি তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তাঁর পাঠকদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন যে ভারতের সংবিধানসভা যে সংবিধানটি অনুমোদন করেছিল, নেপাল যদি তা সংশোধনের দাবি জানাত, তাহলে ভারতে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো? এই অঘোষিত অবরোধের পরিণতিতে নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রকে উদ্ধৃত করে কংগ্রেসের এই নেতা আশাবাদ প্রকাশ করে লিখেছেন যে নেপালিরা হয়তো বুঝতে পারবেন, নেপালের ওপর যে অবরোধজনিত দুর্যোগ নেমে এসেছে, তার দায় পুরো ভারতের নয়, শুধু বর্তমান সরকারের। মি. আয়ারের এই লেখা হয়তো রাজনৈতিক কারণেই এতটা কঠোর। কিন্তু ভারতের সংবাদমাধ্যমও বিষয়টিতে কম সোচ্চার নয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গত মাসেই এক সম্পাদকীয়তে মি. মোদির প্রতিবেশী নীতির কড়া সমালোচনা করে লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি (আনইজি নেবারস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৩ নভেম্বর, ২০১৫)।
বিশ্বায়নের কালে জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণায় রূপান্তর ঘটছে—এ কথা আমরা সবাই জানি। ইউরোপে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থার কারণে এক দেশের বাজেটের বিষয়ে অন্য দেশের মতামতের আলাদা গুরুত্ব ইতিমধ্যে স্বীকৃত। এমনকি বৃহত্তর ইউনিয়নকে সন্তুষ্ট করতে গ্রিসকে একাধিকবার নির্বাচনও করতে হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশেই আর সবকিছুই ওই দেশের একার নয়, এতে প্রতিবেশী এবং তার বাইরে পুরো বিশ্ববাসীর স্বার্থ অথবা ভাগ্যের অনেক কিছুই জড়িত আছে। কিন্তু অন্যের নাক গলানোরও তো একটা সীমা আছে। নাকি তা শুধু ছোট দেশগুলোর জন্য সত্য—বড় বাজার অথবা উদীয়মান বিশ্বশক্তির জন্য নয়?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
নেপালের তেরাই সমতল অঞ্চলের মধেশিদের দাবি অনুযায়ী সংসদে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব এবং প্রাদেশিক সীমানা পুনর্নির্ধারণের বিষয় বিবেচনায় রাজি হয়েছে মন্ত্রিসভা। তেরাই অঞ্চলের এই মধেশিরা মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত এবং ভারতের বিহার রাজ্যের সঙ্গে তাদের আত্মীয়তার বন্ধন অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নেপালের নতুন সংবিধানের যেসব বিষয়কে ঘিরে দেশটিতে বিরোধ ও অস্থিরতা দেখা দেয়, তার মধ্যে সাতটি প্রদেশ সৃষ্টি এবং তার সীমানা চিহ্নিত করা অন্যতম। এ ছাড়া রাজতন্ত্রের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হওয়া হিন্দুরাষ্ট্র পরিচয় পুনরুজ্জীবনের দাবিও উঠেছিল।
গত আগস্ট মাসে দেশটিতে নতুন সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর দেশের ভেতরে মধেশিরা প্রতিবাদ জানানো শুরু করলে ভারতও প্রকাশ্যে নেপালের সমালোচনা শুরু করে। এমনকি ভারত ওই সংবিধান সংশোধনের কথাও বলে। প্রায় একই সময়ে মধেশিদের আন্দোলনের কারণে নিরাপত্তাহীনতার দোহাই দিয়ে ভারতের সীমান্তচৌকিগুলোতে সব ধরনের পণ্য পরিবহন বন্ধ হয়ে যায়, যাকে অঘোষিত অবরোধ হিসেবেই সবাই অভিহিত করতে থাকেন। ভারতে সরকারিভাবে অবরোধের কথা অস্বীকার করা হলেও দেশটির বিরোধী রাজনীতিক এবং সংবাদমাধ্যমেও একে অবরোধ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।
গত রোববার রাতে (২০ ডিসেম্বর) মধেশি আন্দোলনকারীদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে একটি কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত হয়, যে কমিশন এই বিরোধ নিষ্পত্তি ও সীমানা নির্ধারণের বিষয়ে সুপারিশ পেশ করবে। সমঝোতার পর নেপালের শিল্পমন্ত্রী সোম প্রসাদ পান্ডে সাংবাদিকদের বলেন যে কমিশন গঠিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তার সুপারিশমালা পেশ করবে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সেদিন এক বিবৃতিতে চলমান অচলাবস্থা নিরসনের ভিত্তি তৈরি করতে এই সমঝোতা ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আশাবাদ প্রকাশ করে।
নেপালের ওপর ভারতের এই অঘোষিত অবরোধের অবসান যে সবার জন্য সুসংবাদ, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে আমরা সবাই এখন আপাতত স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়তে পারি। কেননা, এই অবরোধের সময় প্রতিবাদকারীদের সঙ্গে নানা সময়ের সংঘাতে মৃত্যু হয়েছে অন্তত ৫০ জনের। অবরোধজনিত খাদ্য ও জ্বালানি ঘাটতির কারণে কোনো মৃত্যু ঘটেছে কি না, তার কোনো হিসাব অবশ্য কেউ প্রকাশ করেনি। তবে ৩০ নভেম্বর ইউনিসেফের নির্বাহী পরিচালক অ্যান্থনি লেক এক বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন যে অচিরেই এই অবরোধের অবসান না হলে শীত মৌসুমে শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যাবে। তার আগে ১১ নভেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন এক বিবৃতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সব পক্ষের প্রতি এই অবরোধ অবসানের আহ্বান জানিয়েছিলেন (টাইমস অব ইন্ডিয়া, ১১ নভেম্বর, ২০১৫)। মি. মুন তাঁর বিবৃতিতে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন যে অবরোধের কারণে ভয়াবহ ভূমিকম্প–পীড়িত দেশটির প্রত্যন্ত এলাকায় জরুরি মানবিক সাহায্যসামগ্রীর সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। জাতিসংঘের মহাসচিব তাঁর বিবৃতিতে অবরোধের জন্য দায়ী কে, তা উল্লেখ না করলেও বলেছিলেন যে একটি ভূমিবেষ্টিত (ল্যান্ডলক্ড) দেশ হিসেবে নেপালের ট্রানজিট পাওয়ার অধিকার আছে। উপরন্তু মানবিক সহায়তা পাওয়ার প্রশ্ন তো রয়েছেই। তারও দুই মাস আগে সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের র্শীষ বৈঠকের সময় নেপাল আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘের কাছে ভারতের এই অবরোধের বিষয়ে অভিযোগ জানিয়েছিল। তবে একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের অভিযোগ নিষ্পত্তিতে জাতিসংঘের সীমাবদ্ধতা যে কতটা প্রকট, সে প্রসঙ্গ এখানে আলোচনা না করলেও চলে। অবশ্য তাদের এসব উদ্বেগের প্রসঙ্গ উত্থাপন এ কারণে জরুরি যে সংকটটি একটি প্রাণঘাতী রূপ নিলেও নিতে পারত। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একটি বড় ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেল। সম্ভবত বাংলাদেশও একই ধরনের বিড়ম্বনার হাত থেকে রক্ষা পেল। কেননা, জরুরি ভিত্তিতে জ্বালানি ও খাদ্যসামগ্রী সরবরাহে বাংলাদেশের কাছেও নেপাল সহায়তা চেয়েছিল। ভারতের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কে উত্তরোত্তর ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে সেটা কতটা সম্ভব হতো, তা বলা মুশকিল।
এই অর্থনৈতিক অবরোধটির কারণে নেপাল এ বছর দ্বিতীয়বারের মতো দুর্যোগের কবলে পড়ে। প্রথমটি ঘটেছিল ২৫ এপ্রিলের ভয়াবহ ভূমিকম্পের কারণে। ওই ভূমিকম্পে দেশটিতে জাতিসংঘের হিসাবে কমপক্ষে ৯ হাজার লোকের মৃত্যু হয় এবং ২৩ হাজারের বেশি লোক আহত হয়। হাজার হাজার লোক আশ্রয়হারা হয় এবং অর্থনীতি চরম সংকটের মুখে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নানা ধরনের সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এলেও দেশটিতে পুনর্গঠনের কাজ এখনো পুরোদমে শুরু হতে পারেনি।
নেপালের সঙ্গে ভারতের এই বিরোধ বা সংকটের অন্য আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন ভারতের বিরোধী দল কংগ্রেসেরই এক প্রবীণ নেতা মনি শংকর আয়ার। ৭ ডিসেম্বর তিনি এনডিটিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক বিশেষ নিবন্ধে কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন, যাতে দেখা যাচ্ছে নেপালের এই দুর্ভোগের পেছনে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিও অনেকাংশে দায়ী। ‘এ মোদি-মেড ডিজাস্টার হিটস নেপাল হার্ড’ শিরোনামের নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, নেপালকে হিন্দু রাষ্ট্র হতে না দেওয়ার প্রতিশোধ নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী মোদি। তিনি আরও লিখেছেন, ২০১৫ সালে বিহারে যে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন হয়ে গেল, সেই ভোট সামনে রেখে এক বছর আগে নেপালের জানকিপুরে মি. মোদি একটি জনসভা করতে চেয়েছিলেন। সেখানে তিনি মধেশি মেয়েদের মধ্যে ১০ হাজার বাইসাইকেল বিতরণ করতে চেয়েছিলেন। ওই সব সাইকেল পেলে মধেশি বালিকারা বিহারে বসবাসরত তাঁদের আত্মীয়স্বজনকে বিজেপির পক্ষে ভোট দিতে উদ্বুদ্ধ করবেন বলে তাঁর আশা ছিল। নেপাল সরকার তাঁকে সেই সুযোগ দেয়নি।
মনি শংকর আয়ার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন তাঁর লেখায়। নেপালের যে সংসদে নতুন সংবিধানটি অনুমোদিত হয়েছে, সেই সংসদে তরাই অঞ্চল থেকে জনপ্রতিনিধি আছেন ১১৬ জন এবং তাঁদের মধ্যে ১০৫ জনই সংবিধানটির পক্ষে ভোট দিয়েছেন। মাত্র ১১ জন সাংসদের বিরোধিতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে ভারত যে নেপালি সংবিধান আবারও সংশোধনের চাপ দিয়েছে, তিনি তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি তাঁর পাঠকদের উদ্দেশে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন যে ভারতের সংবিধানসভা যে সংবিধানটি অনুমোদন করেছিল, নেপাল যদি তা সংশোধনের দাবি জানাত, তাহলে ভারতে তার প্রতিক্রিয়া কী হতো? এই অঘোষিত অবরোধের পরিণতিতে নেপালে ভারতবিরোধী মনোভাব জোরদার হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রকে উদ্ধৃত করে কংগ্রেসের এই নেতা আশাবাদ প্রকাশ করে লিখেছেন যে নেপালিরা হয়তো বুঝতে পারবেন, নেপালের ওপর যে অবরোধজনিত দুর্যোগ নেমে এসেছে, তার দায় পুরো ভারতের নয়, শুধু বর্তমান সরকারের। মি. আয়ারের এই লেখা হয়তো রাজনৈতিক কারণেই এতটা কঠোর। কিন্তু ভারতের সংবাদমাধ্যমও বিষয়টিতে কম সোচ্চার নয়। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস গত মাসেই এক সম্পাদকীয়তে মি. মোদির প্রতিবেশী নীতির কড়া সমালোচনা করে লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিবেশীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করতে পারেননি (আনইজি নেবারস, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ৩ নভেম্বর, ২০১৫)।
বিশ্বায়নের কালে জাতিরাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ধারণায় রূপান্তর ঘটছে—এ কথা আমরা সবাই জানি। ইউরোপে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও অভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থার কারণে এক দেশের বাজেটের বিষয়ে অন্য দেশের মতামতের আলাদা গুরুত্ব ইতিমধ্যে স্বীকৃত। এমনকি বৃহত্তর ইউনিয়নকে সন্তুষ্ট করতে গ্রিসকে একাধিকবার নির্বাচনও করতে হয়েছে। বিশ্বের কোনো দেশেই আর সবকিছুই ওই দেশের একার নয়, এতে প্রতিবেশী এবং তার বাইরে পুরো বিশ্ববাসীর স্বার্থ অথবা ভাগ্যের অনেক কিছুই জড়িত আছে। কিন্তু অন্যের নাক গলানোরও তো একটা সীমা আছে। নাকি তা শুধু ছোট দেশগুলোর জন্য সত্য—বড় বাজার অথবা উদীয়মান বিশ্বশক্তির জন্য নয়?
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক।
No comments