নগরকেন্দ্রিক স্থাপনার রূপরেখা by সজল চৌধুরী
একটি অনুমান করা যাক, যদি শুধু
স্থাপনা-অবকাঠামো শিল্প ২০৫০ সালের মধ্যে ৩ গিগাটন বিষাক্ত কার্বন
ডাই-অক্সাইড নির্গমন রোধ করতে পারে, তাহলে সেটি হবে এক বছরে রাস্তা থেকে ৬৩
কোটি গাড়ি তুলে নেওয়ার সমতুল্য। বিষয়টি মোটেও তুচ্ছ নয়। এখন পৃথিবীর
শহরের জনসংখ্যা ৩৫০ কোটি। এর সঙ্গে অতিরিক্ত ২৫০ কোটি নাগরিক নতুন করে
যুক্ত হলে শহরের পরিবেশ, রাস্তাঘাট, যানবাহন, স্বাস্থ্যরক্ষাসহ জলবায়ুর ওপর
কী ধরনের ভয়াবহ প্রভাব পড়তে পারে, তা সহজেই অনুমেয়।
এসব নিয়েই প্যারিসে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের জলবায়ু–বিষয়ক সম্মেলন কপ-২১। যেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য ও স্থাপনাশিল্পের বিষয়টি বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু স্থাপনা কিংবা ভবন খাত থেকেই প্রতিবছর নিঃসরিত সর্বমোট গ্রিনহাউস গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ নির্গত হয়। শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার ও অনিয়ন্ত্রিত পরিচালনাই হচ্ছে এই নির্গমনের কারণ। সেই সঙ্গে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই নির্গমনের পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিন গুণ হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দ্রুত নগরায়ণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আমাদের মতো দেশগুলোর অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ বা অন্যকথায় শোচনীয়। কারণ, আমাদের দেশের শহরগুলোর বিশেষ করে শুধু ঢাকার জনসংখ্যা গত ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে তার সংখ্যা হবে প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। ফলে প্রতিবছরই ঢাকায় বিপুল পরিমাণ স্থাপনা অনিয়ন্ত্রিতভাবে নির্মিত হচ্ছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এর মাশুল হিসেবে নাগরিকদের অধিক মাত্রায় বৈদ্যুতিক বিলসহ অন্যান্য ব্যয়ভার মেটাতে হচ্ছে। একদিকে যেমন শক্তির অপচয় বাড়ছে, তেমনি অন্যদিকে বাড়ছে দূষণের মাত্রা ও কার্বন নিঃসরণের হার।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বিষয়টি সত্য যে ইতিপূর্বে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করলেও স্থাপনাশিল্পে শক্তির ব্যবহার এবং অপচয় রোধকল্পে সঠিক করণীয় নির্ধারণ করতে পারেননি। তবে এবারের কপ-২১ সম্মেলনে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আগে বিষয়টিকে একপ্রকার পাশ কাটিয়ে যাওয়া হলেও বর্তমানে ‘টেকসই উন্নয়ন রূপরেখায়’ এটা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ৪৫টির মতো দেশ তাদের জাতীয় উন্নয়নে ইতিমধ্যে পরিবেশবান্ধব স্থাপনাশিল্পের বিষয়টি আমলে নিয়েছে, বিষয়টি ইঙ্গিতপূর্ণ। অন্যদিকে ‘বিল্ডিং এফিসিয়েন্সি ইন কান্ট্রিস ন্যাশনাল ক্লাইমেট প্ল্যান’-এর তথ্যমতে, বিশ্বের শুধু ৫০টির মতো দেশ তাদের স্থাপনাশিল্পে শক্তির অপচয় রোধ করার জন্য বিশেষভাবে করণীয়র তালিকা প্রণয়ন করেছে। অন্যরা এখনো ওই বিষয়ে সেভাবে পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অতীব জরুরি।
অন্যদিকে, জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক কর্মসূচি ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট বর্তমানে স্থাপনাশিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে এবং উন্নয়নশীল দেশের শহরগুলোতে পরিবেশ খাতে অর্থায়ন বাড়াতে মত দিয়েছে। তারা এ ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড পুনর্নির্ধারণ, স্থাপনাশিল্পে শক্তির ব্যবহার পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনাতে অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। এখন আমাদের দেখতে হবে, এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে আমাদের দেশের শহরকেন্দ্রিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমে কী করা যেতে পারে: স্থানীয় ও নগরকেন্দ্রিক নীতিমালা প্রণয়ন ও আঞ্চলিক সমন্বয়।
তা ছাড়া, আমাদের দেশে বর্তমানে যে বিল্ডিং কোড আছে, সেটিকে অঞ্চলভেদে পরিবেশ ও জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যার ভিত্তি হবে সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা। এ ক্ষেত্রে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ কেন্দ্রীয় হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতা ও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার।
অন্যদিকে দেশের স্থপতি-প্রকৌশলী ইনস্টিটিউট তাদের অভ্যন্তরীণ গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, তাদের সে সক্ষমতা আছে। এ ক্ষেত্রে ডেনিশ ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড যেভাবে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা করছে, আমরা তা অনুসরণ করতে পারি। সেই সঙ্গে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও প্রস্তাবিত ‘বিল্ডিং ডে’ পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাশিল্পের বিষয়ে সচেতন করতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের জ্বালানি ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
ঢাকার মেয়রদের পক্ষ থেকে শহরকে সবুজ করার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে বাড়ির ছাদে গাছ লাগানোর যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয় ও বিজ্ঞানসম্মত। কারণ, গবেষণায় দেখা গেছে, ছাদে সবুজের সমারোহ থাকলে বাড়ির অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো সম্ভব, এতে শক্তির সাশ্রয় হবে। এ ক্ষেত্রে স্থপতিরা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে নগরের পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে পারেন। আর এ কাজ শুরু করতে হবে নিজ আঙিনা থেকেই। আজ যা স্থানীয়, কাল তা সমগ্র বিশ্বের।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে জাপানে গবেষণারত।
এসব নিয়েই প্যারিসে অনুষ্ঠিত হলো বিশ্বের জলবায়ু–বিষয়ক সম্মেলন কপ-২১। যেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে পরিবেশবান্ধব স্থাপত্য ও স্থাপনাশিল্পের বিষয়টি বিশ্বের জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে গবেষণায় দেখা গেছে, শুধু স্থাপনা কিংবা ভবন খাত থেকেই প্রতিবছর নিঃসরিত সর্বমোট গ্রিনহাউস গ্যাসের এক-তৃতীয়াংশ নির্গত হয়। শক্তির যথেচ্ছ ব্যবহার ও অনিয়ন্ত্রিত পরিচালনাই হচ্ছে এই নির্গমনের কারণ। সেই সঙ্গে ধারণা করা হচ্ছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এই নির্গমনের পরিমাণ দ্বিগুণ বা তিন গুণ হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দ্রুত নগরায়ণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
আমাদের মতো দেশগুলোর অবস্থা অত্যন্ত ভয়াবহ বা অন্যকথায় শোচনীয়। কারণ, আমাদের দেশের শহরগুলোর বিশেষ করে শুধু ঢাকার জনসংখ্যা গত ১০ বছরে প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে, আগামী ২০২৫ সালের মধ্যে তার সংখ্যা হবে প্রায় ২ কোটির কাছাকাছি। ফলে প্রতিবছরই ঢাকায় বিপুল পরিমাণ স্থাপনা অনিয়ন্ত্রিতভাবে নির্মিত হচ্ছে, যার সঠিক পরিসংখ্যান সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তোলে। এর মাশুল হিসেবে নাগরিকদের অধিক মাত্রায় বৈদ্যুতিক বিলসহ অন্যান্য ব্যয়ভার মেটাতে হচ্ছে। একদিকে যেমন শক্তির অপচয় বাড়ছে, তেমনি অন্যদিকে বাড়ছে দূষণের মাত্রা ও কার্বন নিঃসরণের হার।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও বিষয়টি সত্য যে ইতিপূর্বে বিশ্বের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করলেও স্থাপনাশিল্পে শক্তির ব্যবহার এবং অপচয় রোধকল্পে সঠিক করণীয় নির্ধারণ করতে পারেননি। তবে এবারের কপ-২১ সম্মেলনে এ বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আগে বিষয়টিকে একপ্রকার পাশ কাটিয়ে যাওয়া হলেও বর্তমানে ‘টেকসই উন্নয়ন রূপরেখায়’ এটা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ৪৫টির মতো দেশ তাদের জাতীয় উন্নয়নে ইতিমধ্যে পরিবেশবান্ধব স্থাপনাশিল্পের বিষয়টি আমলে নিয়েছে, বিষয়টি ইঙ্গিতপূর্ণ। অন্যদিকে ‘বিল্ডিং এফিসিয়েন্সি ইন কান্ট্রিস ন্যাশনাল ক্লাইমেট প্ল্যান’-এর তথ্যমতে, বিশ্বের শুধু ৫০টির মতো দেশ তাদের স্থাপনাশিল্পে শক্তির অপচয় রোধ করার জন্য বিশেষভাবে করণীয়র তালিকা প্রণয়ন করেছে। অন্যরা এখনো ওই বিষয়ে সেভাবে পদক্ষেপ নিতে পারেনি, যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য অতীব জরুরি।
অন্যদিকে, জাতিসংঘের পরিবেশ-বিষয়ক কর্মসূচি ও ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট বর্তমানে স্থাপনাশিল্পকে পরিবেশবান্ধব করতে এবং উন্নয়নশীল দেশের শহরগুলোতে পরিবেশ খাতে অর্থায়ন বাড়াতে মত দিয়েছে। তারা এ ক্ষেত্রে বিল্ডিং কোড পুনর্নির্ধারণ, স্থাপনাশিল্পে শক্তির ব্যবহার পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনাতে অধিক গুরুত্ব আরোপ করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। এখন আমাদের দেখতে হবে, এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলা করতে আমাদের দেশের শহরকেন্দ্রিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রথমে কী করা যেতে পারে: স্থানীয় ও নগরকেন্দ্রিক নীতিমালা প্রণয়ন ও আঞ্চলিক সমন্বয়।
তা ছাড়া, আমাদের দেশে বর্তমানে যে বিল্ডিং কোড আছে, সেটিকে অঞ্চলভেদে পরিবেশ ও জলবায়ুর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে, যার ভিত্তি হবে সুনির্দিষ্ট বিজ্ঞানসম্মত গবেষণা। এ ক্ষেত্রে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সহ কেন্দ্রীয় হাউস বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। শুধু প্রয়োজন আন্তরিকতা ও সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার।
অন্যদিকে দেশের স্থপতি-প্রকৌশলী ইনস্টিটিউট তাদের অভ্যন্তরীণ গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে নগরকেন্দ্রিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে, তাদের সে সক্ষমতা আছে। এ ক্ষেত্রে ডেনিশ ক্লাইমেট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড যেভাবে বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা করছে, আমরা তা অনুসরণ করতে পারি। সেই সঙ্গে বিশ্বের অন্য দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও প্রস্তাবিত ‘বিল্ডিং ডে’ পালনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের পরিবেশবান্ধব স্থাপনাশিল্পের বিষয়ে সচেতন করতে পারে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকল্পের জ্বালানি ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
ঢাকার মেয়রদের পক্ষ থেকে শহরকে সবুজ করার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, বিশেষ করে বাড়ির ছাদে গাছ লাগানোর যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয় ও বিজ্ঞানসম্মত। কারণ, গবেষণায় দেখা গেছে, ছাদে সবুজের সমারোহ থাকলে বাড়ির অভ্যন্তরীণ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় প্রায় ৩-৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো সম্ভব, এতে শক্তির সাশ্রয় হবে। এ ক্ষেত্রে স্থপতিরা সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে নগরের পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় এগিয়ে আসতে পারেন। আর এ কাজ শুরু করতে হবে নিজ আঙিনা থেকেই। আজ যা স্থানীয়, কাল তা সমগ্র বিশ্বের।
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে জাপানে গবেষণারত।
No comments