বিত্ত, দুর্নীতি ও রাজনীতি by হায়দার আকবর খান রনো
প্রথম
আলোর ১৭ ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রথম পৃষ্ঠায় এবারের পৌরসভা নির্বাচনে
প্রার্থীদের হলফনামা পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। তাতে দেখা
যায়, আওয়ামী লীগের ৩৩ জন প্রার্থীর নগদ টাকা আছে কোটি টাকার অনেক বেশি।
প্রতিবেদন বলছে, ‘এর বাইরে কিছু প্রার্থী আছেন, যাঁদের সম্পদ, আয় ও
ব্যাংকঋণের মধ্যে সামঞ্জস্য নেই।’ অন্যদিকে বিএনপি প্রায় এক দশক ক্ষমতার
বাইরে থাকলেও তাদের ৫৬ জন প্রার্থী কোটিপতি। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা
হচ্ছে কোটিপতিদের মধ্যে।
এমন সংবাদ উদ্বেগ খানিকটা বৃদ্ধি করলেও খুব বিস্মিত হইনি। কারণ, রাজনীতি এখন চলে গেছে টাকাওয়ালাদের দখলে। অনেকের জন্য রাজনীতি এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচন এবং এ রকম কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে লাভ উঠে আসে অনেক বেশি পরিমাণে। উপরিউক্ত হলফনামা বিশ্লেষণ থেকে আরও জানা যায় যে আওয়ামী লীগের ১৪০ জন প্রার্থী এবং বিএনপির ১২৬ জন প্রার্থী সরাসরি ব্যবসায়ী।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুটি প্রধান দলে ব্যবসায়ীদের ছড়াছড়ি এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তাঁরাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ করেন। ব্যবসায়ীরা হয়েছেন রাজনীতিবিদ আর রাজনীতিবিদেরা হয়েছেন ব্যবসায়ী। সঠিক পরিসংখ্যান আমার এই মুহূর্তে জানা না থাকলেও এটা নিশ্চিতভাবেই জানি যে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা হচ্ছেন ব্যবসায়ী এবং কোটিপতি, কেউ কেউ অতিকায় ধনী। শুধু এবারের সংসদই নয়, বিগত কয়েকটি সংসদেই একই চিত্র ছিল। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তা কিন্তু ছিল না। পেশাগতভাবে রাজনীতিবিদ যাঁরা, তাঁরাই নির্বাচন করতেন এবং নির্বাচিত হতেন।
বিএনপি কখনোই আদর্শভিত্তিক দল ছিল না। তবু জিয়ার আমলে বেশ কিছু বামপন্থী ও ন্যাপের জেলা পর্যায়ের নেতারা এই দলে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের আদর্শ ধরে রাখতে পারেননি। উপরন্তু দলের মধ্যেও তাঁরা ছিলেন বেশ কোণঠাসা। তবু এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ধুলামাটিতে মাখামাখি করে দলটিকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করেন। কিন্তু তারেক রহমান নেতৃত্বে আসার পর দলটি তেমন ক্রমাগত দক্ষিণে সরে গিয়ে পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান নিয়েছে, তেমনি দলের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেন অতিকায় ধনীরা। যাঁরা দেশ, জনগণ, কর্মসূচি, আদর্শ ইত্যাদি নিয়ে সামান্যতম মাথা ঘামান না।
অন্যদিকে ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তরুণ কর্মীদের মধ্যে একধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শ কাজ করত। তাঁরা জেল-জুলুম খেটেছেন। তাঁরা ছিলেন পেশাগতভাবে রাজনীতিবিদ। তাঁদের সবাই যে দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন, এমন দাবি করা যাবে না। নানা ধরনের সুবিধাবাদও ছিল। তবু একটা ন্যূনতম পর্যায়ে রাজনৈতিক আদর্শবোধ কাজ করত। সেই প্রজন্ম এখন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন এই দলে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য, যাঁদের মুখে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ’ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ইত্যাদি বুলি শোনা গেলেও বাস্তবে তাঁরাও রাজনীতিকে নিয়েছেন ব্যবসা হিসেবে। বড় চমৎকার ব্যবসা। প্রায় বিনা পুঁজিতে বা অতি কম পুঁজিতে বিরাট লাভ। মুনাফার হার খুব বেশি। উৎপাদনের ঝামেলা নেই। ব্যবসায় ঝুঁকিও নেই।
কী ধরনের ধনী ব্যক্তিরা আজ শাসক দলের সাংসদ ও স্থানীয় পর্যায়ে নেতা হয়েছেন, তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। একেবারে সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাংসদ মন্জুরুল ইসলাম লিটন, যিনি কিছুদিন আগে ১২ বছরের বালক সৌরভের পায়ে গুলি করে মিডিয়ায় এসেছিলেন। তিনি গত বিজয় দিবসে সুন্দরগঞ্জে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে এসেছিলেন এবং তা-ও আড়াই ঘণ্টা পর। জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানকেও সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অর্থ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের কী অদ্ভুত মানসিকতা!
গত অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘আজকে রাজনীতির বেশির ভাগ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। এটা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্ক।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি অবৈধভাবে টাকাপয়সার মালিক হতে চান, তাহলে আরও অনেক ব্যবসা আছে। এমন লোকের রাজনীতিতে না আসাই ভালো।’
কিন্তু দুর্ভাগ্য! রাষ্ট্রপতির সদিচ্ছা কার্যকরী হয় না। এমন লোকেরাই রাজনীতি জমিয়ে বসে আছেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছিলেন ষাটের দশকের আওয়ামী লীগের রাজনীতির মানুষ। এই প্রজন্মের আওয়ামী লীগের মধ্যে সেই যুগের বৈশিষ্ট্য খুঁজতে যাওয়া বৃথা।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ক্ষোভ অবৈধ ব্যবসার ব্যাপারে। উপরন্তু রাজনীতির পদ, পরিচয় ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে টাকা উপার্জনের যে পদ্ধতি ও কৌশল, তা অবশ্যই অবৈধ। তা হচ্ছে বড় রকমের দুর্নীতি। এ রকম দুর্নীতি অন্যরা করলে একরকম, যদিও তা খারাপ। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা সেটি করলে দেশের জন্য তা হয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। ভয়াবহ। তা অর্থনীতিকে করে ভঙ্গুর, সমাজকে করে কলুষিত, রাজনীতিকে করে বিকৃত।
আমাদের দেশে করপোরেট হাউসের অধিকাংশ মালিক নিজেরাই সাংসদ বা মন্ত্রী হতে চান। এতে সিস্টেম হিসেবে অর্থব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে হয়ে ওঠে এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় সব পুঁজিবাদী দেশেই দুর্নীতি কম-বেশি আছে। ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির সঙ্গে কমবেশি জড়িত থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিবিদেরা কী রকম দুর্নীতি করেন, তা বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়াইন এক উপন্যাসে (দ্য গোল্ডেন এজ) এক চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে এভাবে প্রকাশ করেছেন। ‘এ কংগ্রেশনাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন কস্টস মানি। জাস্ট রিফ্লেক্ট ফর ইন্সট্যান্স। এ মেজোরিটি অব দ্য হাউস কমিটি, সে ১০,০০০ ডলার এ পিস—৪০,০০০ ডলার; এ মেজোরিটি অব দ্য সিনেট কমিটি, দ্য সেম ইজ—সে ৪০,০০০ ডলার; এ লিটল এক্সট্রা টু ওয়ান অর টু চেয়ারম্যান অব ওয়ান অর টু সাচ কমিটিস, সে ১০,০০০ ডলার ইজ—২০,০০০ অ্যান্ড দেয়ার ইজ ১,০০,০০০ ডলার অব দ্য মানি গন, টু বিগিন উইথ...’
তাহলে উন্নত পুঁজিবাদী দেশেও রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্যটি এখানে লক্ষ করা যেতে পারে। প্রথমত, উন্নত পুঁজিবাদী দেশে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন না। রাজনীতিবিদদের তাঁরা অর্থনৈতিক সহায়তা দান করেন। কিন্তু নিজেরা রাজনৈতিক পদ গ্রহণ করেন না। তাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেম অধিক কার্যকর থাকে। রাজনীতিতে বুর্জোয়ার নিয়ন্ত্রণ হয় অপ্রত্যক্ষ, কিন্তু কার্যকর। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ফ্লেডারিখ অ্যাঙ্গেলস বিষয়টি লক্ষ করে বলেছিলেন, (পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থে), পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ‘সম্পদ জোর খাটায় পরোক্ষভাবে, কিন্তু আরও নিশ্চিতভাবে, একদিকে সরকারি কর্মচারীদের সরাসরি হাত করে, যার বিশুদ্ধ দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমেরিকা, অপরদিকে সরকার ও ফাটকাবাজদের সঙ্গে সহযোগিতা করে...।’
আমাদের দেশে করপোরেট হাউসের অধিকাংশ মালিক নিজেরাই সাংসদ বা মন্ত্রী হতে চান। এতে সিস্টেম হিসেবে অর্থব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে হয়ে ওঠে এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। টেন্ডারবাজি ইত্যাদি তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন অথবা ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের এই পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম হওয়ার পেছনে কিছু ঐতিহাসিক কারণও আছে। এখানে যে ধনিক শ্রেণি বিকাশ লাভ করেছে, তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। ‘বাংলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ ও অভ্যন্তরীণ অসংগতি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালি বুর্জোয়াদের এই স্তরটির তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজেদের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় কৃপার ওপর নির্ভরতা।...(তাদের) উন্নতির পেছনে তাদের নিজস্ব যোগ্যতা বা সামাজিক স্তরগত অবস্থানের সুবিধা—কোনোটাই কাজ করেনি। তাদের উন্নতির কারণ হিসেবে যা প্রতিভাত হয়, তা হলো নেহাত “সৌভাগ্য” অথবা বড়জোর অনুগ্রহ আদায়ের কৌশলে সিদ্ধহস্ততা।’
এই কারণে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই রাজনৈতিক পদ দখল করাকে সুবিধাজনক মনে করেন। অথবা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা নিজেরাই ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। এবং সেই ক্ষেত্রে দুর্নীতির পরিমাণ হয় দেশের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বড় এবং বেপরোয়া লুটপাট রাজনীতির সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়। উল্টোদিকে এত বিরাট ধনসম্পদের মালিক না হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
ক্ষমতাসীনদের সম্পদের স্ফীতি কী হারে হতে পারে তার উদাহরণও আমাদের হাতের কাছে আছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের জন্য সরকারদলীয় যেসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার ও সাংসদেরা (আগের টার্মের অর্থাৎ ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল এই সময়কালে) নির্বাচন কমিশনের কাছে হলফনামা করে সম্পত্তি ও আয়ের যে বিবরণ দিয়েছিলেন, ‘সুজন’ সেই বিবরণ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, আগের পাঁচ বছরে তাঁদের সম্পত্তি ও আয় কী হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ৪৮ প্রার্থীর আয় বেড়েছিল ৫৮২ শতাংশ। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের আয় বেড়েছিল যথাক্রমে ২৪৩ ও ৪৬৪ শতাংশ। এটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। তাহলে পৌরসভা নির্বাচনে ৮৯ কোটিপতি প্রার্থীর খবরে বিস্মিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। কিন্তু উদ্বিগ্ন না হয়েও পারছি না। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে রাজনীতি যে দুষ্টচক্রের মধ্যে আবর্তিত হবে, তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ সহজ হবে না। সেটা শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। আর তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরও বিষময় হতে বাধ্য।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
এমন সংবাদ উদ্বেগ খানিকটা বৃদ্ধি করলেও খুব বিস্মিত হইনি। কারণ, রাজনীতি এখন চলে গেছে টাকাওয়ালাদের দখলে। অনেকের জন্য রাজনীতি এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। নির্বাচন এবং এ রকম কিছু ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করলে লাভ উঠে আসে অনেক বেশি পরিমাণে। উপরিউক্ত হলফনামা বিশ্লেষণ থেকে আরও জানা যায় যে আওয়ামী লীগের ১৪০ জন প্রার্থী এবং বিএনপির ১২৬ জন প্রার্থী সরাসরি ব্যবসায়ী।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুটি প্রধান দলে ব্যবসায়ীদের ছড়াছড়ি এবং চূড়ান্ত বিশ্লেষণে তাঁরাই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণ করেন। ব্যবসায়ীরা হয়েছেন রাজনীতিবিদ আর রাজনীতিবিদেরা হয়েছেন ব্যবসায়ী। সঠিক পরিসংখ্যান আমার এই মুহূর্তে জানা না থাকলেও এটা নিশ্চিতভাবেই জানি যে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা হচ্ছেন ব্যবসায়ী এবং কোটিপতি, কেউ কেউ অতিকায় ধনী। শুধু এবারের সংসদই নয়, বিগত কয়েকটি সংসদেই একই চিত্র ছিল। অথচ স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে তা কিন্তু ছিল না। পেশাগতভাবে রাজনীতিবিদ যাঁরা, তাঁরাই নির্বাচন করতেন এবং নির্বাচিত হতেন।
বিএনপি কখনোই আদর্শভিত্তিক দল ছিল না। তবু জিয়ার আমলে বেশ কিছু বামপন্থী ও ন্যাপের জেলা পর্যায়ের নেতারা এই দলে যোগদান করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা তাঁদের আদর্শ ধরে রাখতে পারেননি। উপরন্তু দলের মধ্যেও তাঁরা ছিলেন বেশ কোণঠাসা। তবু এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির নেতা-কর্মীরা ধুলামাটিতে মাখামাখি করে দলটিকে নতুনভাবে পুনর্গঠিত করেন। কিন্তু তারেক রহমান নেতৃত্বে আসার পর দলটি তেমন ক্রমাগত দক্ষিণে সরে গিয়ে পাকিস্তান আমলের মুসলিম লীগের কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান নিয়েছে, তেমনি দলের মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছেন অতিকায় ধনীরা। যাঁরা দেশ, জনগণ, কর্মসূচি, আদর্শ ইত্যাদি নিয়ে সামান্যতম মাথা ঘামান না।
অন্যদিকে ষাটের দশকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের তরুণ কর্মীদের মধ্যে একধরনের জাতীয়তাবাদী আদর্শ কাজ করত। তাঁরা জেল-জুলুম খেটেছেন। তাঁরা ছিলেন পেশাগতভাবে রাজনীতিবিদ। তাঁদের সবাই যে দুর্নীতিমুক্ত ছিলেন, এমন দাবি করা যাবে না। নানা ধরনের সুবিধাবাদও ছিল। তবু একটা ন্যূনতম পর্যায়ে রাজনৈতিক আদর্শবোধ কাজ করত। সেই প্রজন্ম এখন প্রায় শেষ হয়ে গেছে। এখন এই দলে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য, যাঁদের মুখে ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ’ ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ ইত্যাদি বুলি শোনা গেলেও বাস্তবে তাঁরাও রাজনীতিকে নিয়েছেন ব্যবসা হিসেবে। বড় চমৎকার ব্যবসা। প্রায় বিনা পুঁজিতে বা অতি কম পুঁজিতে বিরাট লাভ। মুনাফার হার খুব বেশি। উৎপাদনের ঝামেলা নেই। ব্যবসায় ঝুঁকিও নেই।
কী ধরনের ধনী ব্যক্তিরা আজ শাসক দলের সাংসদ ও স্থানীয় পর্যায়ে নেতা হয়েছেন, তার অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। একেবারে সাম্প্রতিক একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের সাংসদ মন্জুরুল ইসলাম লিটন, যিনি কিছুদিন আগে ১২ বছরের বালক সৌরভের পায়ে গুলি করে মিডিয়ায় এসেছিলেন। তিনি গত বিজয় দিবসে সুন্দরগঞ্জে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে এসেছিলেন এবং তা-ও আড়াই ঘণ্টা পর। জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানকেও সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। অর্থ ও ক্ষমতা প্রদর্শনের কী অদ্ভুত মানসিকতা!
গত অক্টোবর মাসে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘আজকে রাজনীতির বেশির ভাগ চলে গেছে ব্যবসায়ীদের পকেটে। এটা আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে বড় কলঙ্ক।’ তিনি আরও বলেন, ‘কেউ যদি অবৈধভাবে টাকাপয়সার মালিক হতে চান, তাহলে আরও অনেক ব্যবসা আছে। এমন লোকের রাজনীতিতে না আসাই ভালো।’
কিন্তু দুর্ভাগ্য! রাষ্ট্রপতির সদিচ্ছা কার্যকরী হয় না। এমন লোকেরাই রাজনীতি জমিয়ে বসে আছেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ছিলেন ষাটের দশকের আওয়ামী লীগের রাজনীতির মানুষ। এই প্রজন্মের আওয়ামী লীগের মধ্যে সেই যুগের বৈশিষ্ট্য খুঁজতে যাওয়া বৃথা।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের ক্ষোভ অবৈধ ব্যবসার ব্যাপারে। উপরন্তু রাজনীতির পদ, পরিচয় ও ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে টাকা উপার্জনের যে পদ্ধতি ও কৌশল, তা অবশ্যই অবৈধ। তা হচ্ছে বড় রকমের দুর্নীতি। এ রকম দুর্নীতি অন্যরা করলে একরকম, যদিও তা খারাপ। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষমতাধরেরা সেটি করলে দেশের জন্য তা হয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিকর। ভয়াবহ। তা অর্থনীতিকে করে ভঙ্গুর, সমাজকে করে কলুষিত, রাজনীতিকে করে বিকৃত।
আমাদের দেশে করপোরেট হাউসের অধিকাংশ মালিক নিজেরাই সাংসদ বা মন্ত্রী হতে চান। এতে সিস্টেম হিসেবে অর্থব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে হয়ে ওঠে এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি হয় সব পুঁজিবাদী দেশেই দুর্নীতি কম-বেশি আছে। ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির সঙ্গে কমবেশি জড়িত থাকেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাজনীতিবিদেরা কী রকম দুর্নীতি করেন, তা বিখ্যাত সাহিত্যিক মার্ক টোয়াইন এক উপন্যাসে (দ্য গোল্ডেন এজ) এক চরিত্রের সংলাপের মধ্য দিয়ে এভাবে প্রকাশ করেছেন। ‘এ কংগ্রেশনাল অ্যাপ্রোপ্রিয়েশন কস্টস মানি। জাস্ট রিফ্লেক্ট ফর ইন্সট্যান্স। এ মেজোরিটি অব দ্য হাউস কমিটি, সে ১০,০০০ ডলার এ পিস—৪০,০০০ ডলার; এ মেজোরিটি অব দ্য সিনেট কমিটি, দ্য সেম ইজ—সে ৪০,০০০ ডলার; এ লিটল এক্সট্রা টু ওয়ান অর টু চেয়ারম্যান অব ওয়ান অর টু সাচ কমিটিস, সে ১০,০০০ ডলার ইজ—২০,০০০ অ্যান্ড দেয়ার ইজ ১,০০,০০০ ডলার অব দ্য মানি গন, টু বিগিন উইথ...’
তাহলে উন্নত পুঁজিবাদী দেশেও রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত থাকেন। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে পার্থক্যটি এখানে লক্ষ করা যেতে পারে। প্রথমত, উন্নত পুঁজিবাদী দেশে ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন না। রাজনীতিবিদদের তাঁরা অর্থনৈতিক সহায়তা দান করেন। কিন্তু নিজেরা রাজনৈতিক পদ গ্রহণ করেন না। তাতে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সিস্টেম অধিক কার্যকর থাকে। রাজনীতিতে বুর্জোয়ার নিয়ন্ত্রণ হয় অপ্রত্যক্ষ, কিন্তু কার্যকর। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই ফ্লেডারিখ অ্যাঙ্গেলস বিষয়টি লক্ষ করে বলেছিলেন, (পরিবার ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি গ্রন্থে), পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ‘সম্পদ জোর খাটায় পরোক্ষভাবে, কিন্তু আরও নিশ্চিতভাবে, একদিকে সরকারি কর্মচারীদের সরাসরি হাত করে, যার বিশুদ্ধ দৃষ্টান্ত হচ্ছে আমেরিকা, অপরদিকে সরকার ও ফাটকাবাজদের সঙ্গে সহযোগিতা করে...।’
আমাদের দেশে করপোরেট হাউসের অধিকাংশ মালিক নিজেরাই সাংসদ বা মন্ত্রী হতে চান। এতে সিস্টেম হিসেবে অর্থব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান নড়বড়ে হয়ে ওঠে এবং নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। টেন্ডারবাজি ইত্যাদি তারই বহিঃপ্রকাশ মাত্র। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন অথবা ভারতের সঙ্গে আমাদের দেশের এই পার্থক্যটি গুরুত্বপূর্ণ। এ রকম হওয়ার পেছনে কিছু ঐতিহাসিক কারণও আছে। এখানে যে ধনিক শ্রেণি বিকাশ লাভ করেছে, তার চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য অধ্যাপক রেহমান সোবহান বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছেন। ‘বাংলাদেশে বুর্জোয়া শ্রেণির বিকাশ ও অভ্যন্তরীণ অসংগতি’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘বাঙালি বুর্জোয়াদের এই স্তরটির তাৎপর্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নিজেদের উদ্ভব ও বিকাশের জন্য রাষ্ট্রীয় কৃপার ওপর নির্ভরতা।...(তাদের) উন্নতির পেছনে তাদের নিজস্ব যোগ্যতা বা সামাজিক স্তরগত অবস্থানের সুবিধা—কোনোটাই কাজ করেনি। তাদের উন্নতির কারণ হিসেবে যা প্রতিভাত হয়, তা হলো নেহাত “সৌভাগ্য” অথবা বড়জোর অনুগ্রহ আদায়ের কৌশলে সিদ্ধহস্ততা।’
এই কারণে ব্যবসায়ীরা নিজেরাই রাজনৈতিক পদ দখল করাকে সুবিধাজনক মনে করেন। অথবা ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা নিজেরাই ব্যবসায়ী হয়ে ওঠেন। এবং সেই ক্ষেত্রে দুর্নীতির পরিমাণ হয় দেশের অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে অনেক বড় এবং বেপরোয়া লুটপাট রাজনীতির সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়। উল্টোদিকে এত বিরাট ধনসম্পদের মালিক না হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।
ক্ষমতাসীনদের সম্পদের স্ফীতি কী হারে হতে পারে তার উদাহরণও আমাদের হাতের কাছে আছে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের জন্য সরকারদলীয় যেসব মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার ও সাংসদেরা (আগের টার্মের অর্থাৎ ২০০৮ থেকে ২০১৪ সাল এই সময়কালে) নির্বাচন কমিশনের কাছে হলফনামা করে সম্পত্তি ও আয়ের যে বিবরণ দিয়েছিলেন, ‘সুজন’ সেই বিবরণ বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, আগের পাঁচ বছরে তাঁদের সম্পত্তি ও আয় কী হারে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ৪৮ প্রার্থীর আয় বেড়েছিল ৫৮২ শতাংশ। মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীদের আয় বেড়েছিল যথাক্রমে ২৪৩ ও ৪৬৪ শতাংশ। এটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্য। তাহলে পৌরসভা নির্বাচনে ৮৯ কোটিপতি প্রার্থীর খবরে বিস্মিত হওয়ার তেমন কিছু নেই। কিন্তু উদ্বিগ্ন না হয়েও পারছি না। এই প্রবণতা অব্যাহত থাকলে রাজনীতি যে দুষ্টচক্রের মধ্যে আবর্তিত হবে, তার থেকে বেরিয়ে আসার পথ সহজ হবে না। সেটা শুধু রাজনীতি নয়, অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। আর তার সামাজিক প্রতিক্রিয়া আরও বিষময় হতে বাধ্য।
হায়দার আকবর খান রনো: রাজনৈতিক বিশ্লেষক। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি।
No comments