লজ্জার কথা by হামিদ মীর
এটা
ওই পাকিস্তান নয়, যা ১৯৪৭ সালে মুসলমানেরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এটা ওই
পাকিস্তান, যা ১৯৪৭ সালে হিন্দুরা বানিয়েছে। আপনারা ভাবছেন, হিন্দুরা
পাকিস্তান বানাল কেমন করে? আপনাদের বিস্মিত হওয়া দোষের কিছুই নয়। তবে
বাস্তবতা হলো, ১৯৪৭ সালে হিন্দুরাও একটি পাকিস্তান বানিয়েছিল, যা আজো ভারতে
টিকে রয়েছে। এটি একটি ছোট্ট গ্রাম, যা ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের
সীমান্তে অবস্থিত। ১৯৪৭ সালের আগেও এই গ্রামে অনেক মুসলমান বাস করতেন।
পাকিস্তান যখন সৃষ্টি হলো, তখন এই গ্রামের মুসলমানেরা পাকিস্তানে চলে
যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রামের হিন্দুরা তাদের বেশ বাধা দেয়। এর পরও
মুসলমানেরা পাকিস্তানে থাকতে চায়। এরা নিজেদের স্থাবর সম্পত্তি হিন্দুদের
কাছে সমর্পণ করে পূর্ব পাকিস্তান পাড়ি জমায়। গ্রামের হিন্দুরা ওই
মুসলমানদের স্মরণে তাদের গ্রামের নাম ‘পাকিস্তান’ রেখে দেয়। গ্রামের নাম
পরিবর্তনের জন্য ওই হিন্দুদের ওপর বেশ চাপ সৃষ্টি করা হয়, তা সত্ত্বেও তারা
পাকিস্তান নাম পরিবর্তন করতে অস্বীকৃতি জানায়। এরা পাকিস্তান টিকিয়ে
রেখেছে, তবে গ্রামের মুসলমানেরা যে পাকিস্তানে গিয়েছিল, সে পাকিস্তান টিকে
থাকেনি। তাদের পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে গেছে। ওই মুসলমানেরা নিজেদের পুরনো
গ্রামে ফিরে যেতে পারবে না। বাংলাদেশ তাদের বারবার নাগরিকত্ব পেশ করেছে।
অনেক বিহারি যুবক বাংলাদেশী নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, কিন্তু প্রবীণ
বিহারিদের বড় একটা অংশ আজো নিজেদের পাকিস্তানি বলে পরিচয় দেন। ওই
পাকিস্তানিরা তাদের মূল ভূখণ্ড ইসলামি জমহুরিয়া পাকিস্তান আসতে চায়, কিন্তু
পাকিস্তানের শাসকশ্রেণীর ওই দরিদ্র ও অসহায় পাকিস্তানিদের গ্রহণ করতে
প্রস্তুত নজরে আসে না। এটা ছোট্ট একটি গ্রামের কয়েক শ’ বিহারি মুসলমান নয়,
বরং কমপক্ষে তিন লক্ষাধিক বিহারি মুসলমানদের হৃদয়বিদারক দুঃখগাথা, যারা
কয়েক দশক থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন মুহাজির ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন
করছে। পাকিস্তানের জনগণ ওইসব বিহারিকে নিজেদের আনন্দে শামিল করুক আর না
করুক, তারা কিন্তু ঠিকই পাকিস্তানিদের আনন্দ-খুশিতে আনন্দোৎসব পালন করে এবং
পাকিস্তানিদের দুঃখ-শোককে নিজেদের দুঃখ-শোক মনে করে অশ্রু ঝরায়।
আপনারা ওইসব বিহারিকে ভালো মনে করুন বা খারাপ মনে করুন, বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবনযাপনকারী ওই তিন লাখ মানুষ পাকিস্তানের ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং পাকিস্তান ভূমির জন্য প্রাণ দেয়ার দাবির সামনে এক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি, ওইসব হতদরিদ্র বিহারি পাকিস্তানিদের জন্য সোচ্চার হওয়ার প্রচলন এখন আর নেই। পাকিস্তানি ইসলামি দলগুলোও তাদের নিয়ে আলোচনা ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল এরা মিয়ানমার, কাশ্মির ও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের নামে অর্থ সংগ্রহ করে নিজেদের ঈমান তাজা করছে। বিহারি পাকিস্তানিদের কথা এখন তাদের মনে নেই। যদি বিহারিরা পাকিস্তান চলে আসে, তাহলে তাদের নামে সংগ্রহ করা অর্থ তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে। সুতরাং কোনো দলই এই ঘাটের কারবারে হাত দিতে প্রস্তুত নয়। আমি জানি, আমার এই ঔদ্ধত্যিক মতামত পড়ে অনেক শক্তিশালী ও বদমেজাজি পাকিস্তানি আমাকে ভালোমন্দ বলবেন এবং এ ফতওয়া জারি করতে বিন্দুমাত্র দেরি হবে না যে, হামিদ মীর অসময়ের রাগিণী ছড়িয়ে পাকিস্তানের স্বার্থের ক্ষতি করার নিন্দনীয় চেষ্টা করছেন। ওই ফতোয়া দিয়ে আমার কিছুই আসে-যায় না। আমি একজন গুনাহগার মানুষ। গাদ্দারি আর কুফরের ফতোয়া বিক্রেতাদের কাছে নয়, বরং আমাদের জবাব দিতে হবে আল্লাহর কাছে। আমি যখন কোরবানির ঈদে কোরবানির দর্শনপূর্ণ ভাষণ শুনি, তখন লজ্জা-অনুতাপ আমার অন্তর ও স্নায়ুকে ঘিরে নেয়। আমি ভাবতে থাকি, আমরা কেমন পাকিস্তানি, যারা পাকিস্তানের জন্য মুহাজিরদের ভুলে বসে আছি এবং তাদের জন্য বিন্দুমাত্র কোরবানি দিতে আমাদের মন চায় না।
আপনার অন্তরে যদি সামান্যতম আল্লাহর ভয় থাকে, তাহলে অন্তরে হাত রেখে ভেবে বলুন তো, বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপনকারী তিন লাখ বিহারি পাকিস্তানির আসল অপরাধ কী? এ প্রশ্ন নিয়ে ভাবুন। যদি আপনার ভেতর কিছু মানবতা অবশিষ্ট থাকে, তাহলে আপনি নিজে নিজেই লজ্জা পাবেন। ইতিহাসের সত্যতা হচ্ছে, পাকিস্তান সৃষ্টিকারী দল মুসলিম লীগ আজকের পাকিস্তানে জন্ম নেয়নি, বরং পাকিস্তানের স্রষ্টা মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছে ঢাকায়। মুসলিম লীগ তার প্রথম ক্ষমতা লাভ করেছিল অখণ্ড বাংলায়, পাঞ্জাবে নয়। বিহার, ইউপি, সিপি, গুজরাট ও মাদ্রাজের মুসলমান নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের আন্দোলনে সবার আগে ছিল। আল্লামা ইকবালের এলাহাবাদ ভাষণের পর ওই আন্দোলন সিন্ধু, পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের (খায়বার পাখতুনখাওয়া) দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৪৬ সালে বিহারের মুসলমানদের সংখ্যা প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ ছিল। অথচ প্রাদেশিক নির্বাচনে এরা কংগ্রেসের ১৫২ আসনের বিপরীতে মুসলিম লীগকে ৩৪ আসনের ব্যবস্থা করে দেয়। এরা জানত, বিহার পাকিস্তানের অংশ হবে না। এর পরও এরা পাকিস্তানকে ভোট দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার কারণে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় হাজার হাজার বিহারি মুসলমানদের প্রাণ দিতে হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদবী ও মাওলানা মানাজের আহসান গিলানির মতো বিহারি ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা পাকিস্তানিদের স্মরণে আছে; কিন্তু ওই ওলামায়ে কেরামের খান্দানকে এরা ভুলে গেছে। ওই খান্দানের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছে, আর বেশির ভাগই পাড়ি জমিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। বাঙালিরা পাকিস্তানকে ভালোবাসার পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষাকেও ভালোবাসত। উর্দুকে যখন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ঘোষণা করা হলো এবং প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা উপেক্ষিত হলো, তখন ভাষা আন্দোলন শুরু হলো। ওই আন্দোলন বিহারি পাকিস্তানি আর বাঙালিদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। ১৯৬৪ সালে বাঙালি আর বিহারিরা এক হয়ে জেনারেল আইউব খানের মোকাবেলায় ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষ নেয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রভাব ও ষড়যন্ত্র ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিহারিরা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে জামায়াতে ইসলামী ও কনভেনশন লীগকে সমর্থন করে। আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ও পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহইয়া খান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সেনা অপারেশন শুরু করে দেন। বিহারিদের বেশির ভাগ ওই সেনা অপারেশনে সহায়তা করে। অনেক বিহারি পাকবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যায়। পাাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়- যার অধীনে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নিতে দায়বদ্ধ হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার এক লাখেরও বেশি বিহারি পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যায়। কিন্তু এরপর এ ধারা বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর মানবেতর জীবন যাপন করার পর অনেক বিহারি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করে। বাংলাদেশ সরকার তাদের ভোটাধিকারও দিয়েছে। কিন্তু পাঁচ লাখ ৩৯ হাজার পাকিস্তানি বাংলাদেশের নাগিরকত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা পাকিস্তান আসতে চায়। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে একটি দরখাস্ত পেশ করে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা হোক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আদালতে বলেছে, ওই পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে আনা আমাদের দায়িত্ব নয়। এই দরখাস্ত ২০১৫ সালে প্রত্যাখ্যাত হয়। এখন এই লাখ লাখ পাকিস্তানি বাংলাদেশে কীটস্য কীট হয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। জেনেভা ক্যাম্পের একেকটি কামরায় দশজন লোক বাস করে। ৯০ পরিবার মিলে একটি টয়লেট ব্যবহার করে। পাকিস্তানের কোনো বড় রাজনৈতিক দল ওই নিপীড়িত মানুষদের কথা আলোচনা করে না। কেননা সিন্ধু জাতীয়তাবাদ এতে নারাজ হয়ে যাবে। পাখতুন ও বেলুচ দলগুলোর জন্য এটা কোনো জাতীয় সমস্যা বা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। মুত্তাহেদা কওমি মুভমেন্টও এখন বিহারিদের কথা বলে না।
পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার সবচেয়ে বেশি দাবিদার পাঞ্জাবিরা। এই নিপীড়িত আটকেপড়া পাকিস্তানিরা পাঞ্জাবিদেরও নজরে আসে না। ১৯৭১ সালে ওই বিহারি পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলায় পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মোশাররফের সময় ওই নিপীড়িত আকটেপড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে নিয়ে এসে শুধু একটি ডিফেন্স হাউজিং স্কিমে তাদের আত্তীকরণ করা যেত। কিন্তু পাকিস্তানের ডিফেন্সের যোদ্ধাদের কারো ওই পাকিস্তানিদের ডিফেন্সের কথা মনে নেই। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সবচেয়ে বড় অপরাধ পাকিস্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আনুগত্য। তারা পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ করেছেন, অথচ পাকিস্তানের সরকারগুলো তাদের ভুলে গেছে। কোরবানির ঈদে বাংলাদেশে লাখ লাখ আকটেপড়া পাকিস্তানির দুঃখগাথা আমাদের জন্য বড় লজ্জার ব্যাপার।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ থেকে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
আপনারা ওইসব বিহারিকে ভালো মনে করুন বা খারাপ মনে করুন, বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে মানবেতর জীবনযাপনকারী ওই তিন লাখ মানুষ পাকিস্তানের ইসলামের প্রতি ভালোবাসা এবং পাকিস্তান ভূমির জন্য প্রাণ দেয়ার দাবির সামনে এক বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি জানি, ওইসব হতদরিদ্র বিহারি পাকিস্তানিদের জন্য সোচ্চার হওয়ার প্রচলন এখন আর নেই। পাকিস্তানি ইসলামি দলগুলোও তাদের নিয়ে আলোচনা ছেড়ে দিয়েছে। আজকাল এরা মিয়ানমার, কাশ্মির ও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের নামে অর্থ সংগ্রহ করে নিজেদের ঈমান তাজা করছে। বিহারি পাকিস্তানিদের কথা এখন তাদের মনে নেই। যদি বিহারিরা পাকিস্তান চলে আসে, তাহলে তাদের নামে সংগ্রহ করা অর্থ তাদের জন্য ব্যয় করতে হবে। সুতরাং কোনো দলই এই ঘাটের কারবারে হাত দিতে প্রস্তুত নয়। আমি জানি, আমার এই ঔদ্ধত্যিক মতামত পড়ে অনেক শক্তিশালী ও বদমেজাজি পাকিস্তানি আমাকে ভালোমন্দ বলবেন এবং এ ফতওয়া জারি করতে বিন্দুমাত্র দেরি হবে না যে, হামিদ মীর অসময়ের রাগিণী ছড়িয়ে পাকিস্তানের স্বার্থের ক্ষতি করার নিন্দনীয় চেষ্টা করছেন। ওই ফতোয়া দিয়ে আমার কিছুই আসে-যায় না। আমি একজন গুনাহগার মানুষ। গাদ্দারি আর কুফরের ফতোয়া বিক্রেতাদের কাছে নয়, বরং আমাদের জবাব দিতে হবে আল্লাহর কাছে। আমি যখন কোরবানির ঈদে কোরবানির দর্শনপূর্ণ ভাষণ শুনি, তখন লজ্জা-অনুতাপ আমার অন্তর ও স্নায়ুকে ঘিরে নেয়। আমি ভাবতে থাকি, আমরা কেমন পাকিস্তানি, যারা পাকিস্তানের জন্য মুহাজিরদের ভুলে বসে আছি এবং তাদের জন্য বিন্দুমাত্র কোরবানি দিতে আমাদের মন চায় না।
আপনার অন্তরে যদি সামান্যতম আল্লাহর ভয় থাকে, তাহলে অন্তরে হাত রেখে ভেবে বলুন তো, বাংলাদেশে মানবেতর জীবনযাপনকারী তিন লাখ বিহারি পাকিস্তানির আসল অপরাধ কী? এ প্রশ্ন নিয়ে ভাবুন। যদি আপনার ভেতর কিছু মানবতা অবশিষ্ট থাকে, তাহলে আপনি নিজে নিজেই লজ্জা পাবেন। ইতিহাসের সত্যতা হচ্ছে, পাকিস্তান সৃষ্টিকারী দল মুসলিম লীগ আজকের পাকিস্তানে জন্ম নেয়নি, বরং পাকিস্তানের স্রষ্টা মুসলিম লীগের জন্ম হয়েছে ঢাকায়। মুসলিম লীগ তার প্রথম ক্ষমতা লাভ করেছিল অখণ্ড বাংলায়, পাঞ্জাবে নয়। বিহার, ইউপি, সিপি, গুজরাট ও মাদ্রাজের মুসলমান নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের আন্দোলনে সবার আগে ছিল। আল্লামা ইকবালের এলাহাবাদ ভাষণের পর ওই আন্দোলন সিন্ধু, পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশের (খায়বার পাখতুনখাওয়া) দিকে অগ্রসর হয়। ১৯৪৬ সালে বিহারের মুসলমানদের সংখ্যা প্রদেশের মোট জনসংখ্যার ১০ শতাংশ ছিল। অথচ প্রাদেশিক নির্বাচনে এরা কংগ্রেসের ১৫২ আসনের বিপরীতে মুসলিম লীগকে ৩৪ আসনের ব্যবস্থা করে দেয়। এরা জানত, বিহার পাকিস্তানের অংশ হবে না। এর পরও এরা পাকিস্তানকে ভোট দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার কারণে ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় হাজার হাজার বিহারি মুসলমানদের প্রাণ দিতে হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনে মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদবী ও মাওলানা মানাজের আহসান গিলানির মতো বিহারি ওলামায়ে কেরামের ভূমিকা পাকিস্তানিদের স্মরণে আছে; কিন্তু ওই ওলামায়ে কেরামের খান্দানকে এরা ভুলে গেছে। ওই খান্দানের মধ্যে অল্প কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানে এসেছে, আর বেশির ভাগই পাড়ি জমিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। তাদের ভাষা ছিল উর্দু। বাঙালিরা পাকিস্তানকে ভালোবাসার পাশাপাশি নিজেদের মাতৃভাষাকেও ভালোবাসত। উর্দুকে যখন পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ঘোষণা করা হলো এবং প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা উপেক্ষিত হলো, তখন ভাষা আন্দোলন শুরু হলো। ওই আন্দোলন বিহারি পাকিস্তানি আর বাঙালিদের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি করে। ১৯৬৪ সালে বাঙালি আর বিহারিরা এক হয়ে জেনারেল আইউব খানের মোকাবেলায় ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষ নেয়। কিন্তু রাষ্ট্রীয় প্রভাব ও ষড়যন্ত্র ফাতেমা জিন্নাহকে পরাজিত করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিহারিরা আওয়ামী লীগের পরিবর্তে জামায়াতে ইসলামী ও কনভেনশন লীগকে সমর্থন করে। আওয়ামী লীগ ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ও পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। পাকিস্তানের সেনাশাসক জেনারেল ইয়াহইয়া খান সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার পরিবর্তে সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সেনা অপারেশন শুরু করে দেন। বিহারিদের বেশির ভাগ ওই সেনা অপারেশনে সহায়তা করে। অনেক বিহারি পাকবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অংশ নেয়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ হয়ে যায়। পাাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মাঝে ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়- যার অধীনে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে নিতে দায়বদ্ধ হয়। জুলফিকার আলী ভুট্টোর সরকার এক লাখেরও বেশি বিহারি পাকিস্তানে ফেরত নিয়ে যায়। কিন্তু এরপর এ ধারা বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক বছর মানবেতর জীবন যাপন করার পর অনেক বিহারি বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করে। বাংলাদেশ সরকার তাদের ভোটাধিকারও দিয়েছে। কিন্তু পাঁচ লাখ ৩৯ হাজার পাকিস্তানি বাংলাদেশের নাগিরকত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা পাকিস্তান আসতে চায়। পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টে একটি দরখাস্ত পেশ করে দাবি করা হয়েছিল, বাংলাদেশে আটকেপড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনা হোক। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আদালতে বলেছে, ওই পাকিস্তানিদের ফিরিয়ে আনা আমাদের দায়িত্ব নয়। এই দরখাস্ত ২০১৫ সালে প্রত্যাখ্যাত হয়। এখন এই লাখ লাখ পাকিস্তানি বাংলাদেশে কীটস্য কীট হয়ে জীবন অতিবাহিত করছে। জেনেভা ক্যাম্পের একেকটি কামরায় দশজন লোক বাস করে। ৯০ পরিবার মিলে একটি টয়লেট ব্যবহার করে। পাকিস্তানের কোনো বড় রাজনৈতিক দল ওই নিপীড়িত মানুষদের কথা আলোচনা করে না। কেননা সিন্ধু জাতীয়তাবাদ এতে নারাজ হয়ে যাবে। পাখতুন ও বেলুচ দলগুলোর জন্য এটা কোনো জাতীয় সমস্যা বা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নয়। মুত্তাহেদা কওমি মুভমেন্টও এখন বিহারিদের কথা বলে না।
পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার সবচেয়ে বেশি দাবিদার পাঞ্জাবিরা। এই নিপীড়িত আটকেপড়া পাকিস্তানিরা পাঞ্জাবিদেরও নজরে আসে না। ১৯৭১ সালে ওই বিহারি পাকিস্তানিরা মুক্তিবাহিনীর মোকাবেলায় পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছিল। জেনারেল জিয়া ও জেনারেল মোশাররফের সময় ওই নিপীড়িত আকটেপড়া পাকিস্তানিদের পাকিস্তানে নিয়ে এসে শুধু একটি ডিফেন্স হাউজিং স্কিমে তাদের আত্তীকরণ করা যেত। কিন্তু পাকিস্তানের ডিফেন্সের যোদ্ধাদের কারো ওই পাকিস্তানিদের ডিফেন্সের কথা মনে নেই। আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সবচেয়ে বড় অপরাধ পাকিস্তানের প্রতি তাদের ভালোবাসা ও আনুগত্য। তারা পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ করেছেন, অথচ পাকিস্তানের সরকারগুলো তাদের ভুলে গেছে। কোরবানির ঈদে বাংলাদেশে লাখ লাখ আকটেপড়া পাকিস্তানির দুঃখগাথা আমাদের জন্য বড় লজ্জার ব্যাপার।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৫ থেকে
উর্দু থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
* হামিদ মীর : পাকিস্তানের জিও টিভির নির্বাহী সম্পাদক
No comments