মেধাবী বনাম নকলবাজ by আসিফ নজরুল
মেয়েটি
প্রতিবন্ধী বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। একটু বড় হওয়ার পর থেকে তার স্বপ্ন
ছিল চিকিৎসক হওয়ার। এসএসসি আর এইচএসসিতে গোল্ডেন জিপিএ-৫ ছিল। সরকারি
মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য কঠোর প্রস্তুতি ছিল। পরীক্ষার প্রশ্নও তার জন্য
সহজ ছিল। কিন্তু সে পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছেই বুঝে যায় হবে না তার। পরীক্ষার
প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে—এই গুঞ্জন তার কানে আগেই পৌঁছেছিল। পরীক্ষা শেষে দেখা
গেল গুঞ্জন নয়, এটিই সম্ভবত সত্যি। তার কেন্দ্রেই কেউ কেউ আনন্দে উদ্বেল
হয়ে আছে ১০০টির মধ্যে ১০০টি অবজেকটিভ প্রশ্ন কমন পড়েছে বলে। কীভাবে সম্ভব
এটি? পরীক্ষাকেন্দ্রেই নির্দ্বিধায় বলাবলি হয়েছে যে প্রশ্ন পেয়েছিল কেউ কেউ
পরীক্ষার আগে। ফেসবুকে সেই প্রশ্ন দেওয়া হয়েছিল। এবার আগেই ফাঁস হওয়া
প্রশ্ন পেয়ে উল্লসিত কারও কারও ফেসবুকের কথোপকথনের স্ক্রিনশট এল মেয়েটির
প্রোফাইলে।
মেয়েটি আমার স্ত্রীর নিকটাত্মীয়। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার স্বপ্নভঙ্গের পর সে কারও সঙ্গে কথা বলেনি। নিজের ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাস দিয়ে সে তার হাহাকারের কথা জানিয়েছে। তার প্রশ্ন: আগে প্রশ্ন পেয়ে নকলভাবে যারা পাস করেছে, তাদের কী অধিকার আছে ডাক্তারি পড়ার? মেয়েটি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময়ও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। এবারও এটি হওয়ার পর সে লিখেছে, এ দেশে পড়াশোনা করার ইচ্ছাই চলে গেছে তার!
এই মেয়েটির মতো লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন হরণ করা হয়েছে এসএসসি, এইচএসসি, ভর্তি, নিয়োগের বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অজস্র ঘটনায়। বহুবার এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে, বহু প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, বহু ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই সরকারের টনক নড়েনি। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এবার যা হলো—এত প্রমাণ, এত প্রতিবাদ আর এত লেখালেখি—তারপরও কি কিছুই হবে না?
আমরা কি তাহলে আমাদের সন্তানদের এই বার্তাই দিচ্ছি যে পড়াশোনা করে কোনো লাভ নেই, নিজের ভাগ্য গড়তে হলে জালিয়াতি করা শিখতে হবে? যারা জালিয়াতি করতে পারবে, তারাই ভালো জায়গায় পড়বে, ভালো চাকরি পাবে? যাদের জালিয়াতি করার বা অসৎ হওয়ার মানসিকতা বা রুচি নেই, তাদের বুকে রক্তক্ষরণ নিয়ে বাঁচতে হবে, হয়তো সারা জীবন এর মাশুল দিতে হবে নানাভাবে?
আর যারা বিভিন্ন পরীক্ষায় জালিয়াতি করেছে বা করবে, তাদের পাপের মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে। যদি ১০০ জনের মধ্যে অর্ধেকও হয় এমন, তাহলে এরা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে করতে নিজেরাই বড় জালিয়াত আর দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠবে। অন্তত তা হওয়ার প্রণোদনা পাবে। মেধা নয়, জালিয়াতি আর চৌর্যবৃত্তিকে এভাবে পুরস্কৃত করে আমরা এ কোন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমাদের তরুণ সমাজ আর দেশকে?
২.
আমাদের প্রথমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আবার তিনিই বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রশ্নগুলো ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন কি না, তা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে খতিয়ে দেখা হয়নি। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, খতিয়ে দেখার আগে উনি প্রশ্ন ফাঁস হয়নি এই দাবি করেন কীভাবে? প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে—এমন অভিযোগকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগের জন্য এত দক্ষতা সরকারের যেসব এজেন্সি দেখাতে পারে, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের নমুনা পাচ্ছে না, তা তো হতে পারে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অবশ্যই সরকারের জানার কথা। প্রশ্নপত্র ফাঁস তাই বলে শিক্ষামন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রীর নির্দেশে হতে পারে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও হতে পারে না। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো বেপরোয়া অন্যায় করতে হলে সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কারও কারও সঙ্গে যোগসাজশ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
আমাদের মনে আছে, ১৮ সেপ্টেম্বর মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দপ্তর থেকে কমিশনের সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজ, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ভান্ডাররক্ষক রেজাউল করিম ও তাঁদের সহযোগী ঈশান ইমতিয়াজকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যা ব। তখন র্যা ব জানিয়েছিল যে এই চক্রটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে ১৫ লাখ টাকা, জুডিশিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ দিতে ১০ লাখ টাকা এবং কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ছয় লাখ টাকা করে নিত।
র্যা ব তখন দাবি করেছিল, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ওই চক্রটির মূল হোতা ওমর সিরাজ। র্যা বের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৩ অক্টোবর তিনি মারা যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন উঠছে, এটি কেন ঘটল? ওমর সিরাজের বিচারকাজ সম্পন্ন হলে ভুয়া প্রশ্নপত্র তৈরি বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলো সম্পর্কে অনেক প্রমাণিত তথ্য পাওয়া যেত। এমন একজন ব্যক্তি র্যা বের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অন্যদের নাম জানার সুযোগ থাকল না। এই মৃত্যু স্বাভাবিক কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্মমতাও বিস্ময়কর। এই প্রতিবাদকারীরা সরকারের পতন চায়নি, সরকারবিরোধী কোনো স্লোগান দেয়নি। তারা শুধু তদন্ত আর পুনরায় পরীক্ষার দাবি জানিয়েছে। এই দাবির উত্তর কি রাইফেলের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো আর মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে টানাহেঁচড়া হওয়া উচিত? তাহলে কি এমন কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি এতে জড়িত যে কোনো সুষ্ঠু তদন্তের দাবি উঠলে যেভাবেই হোক তার কণ্ঠরোধ করতে হবে?
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী একবার বলেছিলেন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস সরকারের জীবন-মরণ সমস্যা। যদি তা-ই হয়, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জোরালো অভিযোগ উঠেছে এমন একটি পরীক্ষাও বাতিল করা হয়নি কেন? কেন বছরের পর বছর ধরে এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না? কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বহু প্রস্তাব থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি? জামিলুর রেজা চৌধুরী, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ বহু বরেণ্য ব্যক্তি প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নানা প্রস্তাব বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন। এসব প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখা দূরের কথা, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে আন্তরিক ও অর্থবহ কোনো পরামর্শসভাও সরকারকে আমরা আহ্বান করতে দেখিনি।
৩.
প্রশ্নপত্র ফাঁসের পাশাপাশি সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় নানা বৈষম্যের অভিযোগ আমরা অনেক দিন ধরে শুনে আসছি। বিএনপি-জামায়াত আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌখিক পরীক্ষাকালে বৈষম্যের শিকার হতেন বলে অভিযোগ ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এমন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ শোনা যায়। এ ছাড়া প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের আমলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের প্রতি অবিচারের অভিযোগও বহু পুরোনো। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এসব বৈষম্যের সংস্কৃতি এখন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিচয়কে ছাড়িয়ে প্রায় সর্বজনীন হতে চলেছে। অন্ধ দলীয়করণ ও দুর্নীতির প্রকোপে সাধারণ নির্বিরোধী তরুণ সমাজও এখন নানা অনিশ্চয়তার বলি হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলছি, কিছুদিন আগে বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছিল। এই পরীক্ষার জন্য প্রায় আড়াই বছর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। নানা ধাপের পরীক্ষা শেষে লিখিত পরীক্ষার ফল যখন বের হলো, দেখা গেল মেধা আর কোটায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করার কোনো উপায় নেই। কোটাধারীদের উৎপাতে এমনি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের ঢোকার সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মেধা আর কোটার আলাদা তালিকা না থাকার কারণে এবার আর বোঝারই উপায় রইল না যে আসলে মেধাবীদের ঠিক কতটুকু সুযোগ দেওয়া হলো, আর কতটুকু কোটার নামে পছন্দের প্রার্থীদের চাকরিতে ঢোকানোর জন্য রাখা হলো। পিএসসিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানাল যে তাড়াহুড়া করে রেজাল্ট প্রস্তুত করার কারণে আলাদা কোনো তালিকা তৈরি করা যায়নি!
এত বড় খামখেয়ালিপনা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হলো না দেশে। সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় নন-ক্যাডার নামের যে ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে, তার অস্বচ্ছতা নিয়েও কথা বলি না আমরা। অথচ ভুক্তভোগীরা জানেন এসবের কত যন্ত্রণা। আমাকে একজন মেইল করেছেন। তাঁর কথাই তুলে ধরছি: ‘কত নির্ঘুম রাত, কষ্ট, পরিশ্রম আর সাধনার ছিল ৩৪তম বিসিএস। ২৯ আগস্ট রাত ৯টায় আমাদের সেই সাধনা, কষ্ট আর অমানুষিক পরিশ্রম নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা হলো। নন-ক্যাডার নামক প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করা হলো ৬১৮৫ জন মেধাবীর সঙ্গে। প্রিলি, রিটেন, ভাইভা পাস, কিন্তু পদ স্বল্পতার কারণে চাকরি নেই। তাহলে ২.৫ বছর আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিল কেনো? পদ স্বল্পতা বলছে অথচ রেজাল্ট নিয়ে কি কারচুপি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মেধা আর কোটা আলাদা না করে মনগড়া রেজাল্ট দিয়েছে!’
হতে পারে এসব অভিযোগে অতিশয়োক্তি রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বা নিয়োগ দুর্নীতির কিছু অভিযোগ সত্যি না–ও হতে পারে। কিন্তু ১০টি পরীক্ষার মধ্যে সাত–আটটিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে বাকিগুলোতেও ফাঁস হয়েছে—এই আশঙ্কা জাগাই স্বাভাবিক বঞ্চনাবোধ রয়েছে এমন তরুণদের মধ্যে।
এমন বঞ্চনাবোধ দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণের মধ্যে হতাশাবোধ জাগাচ্ছে। অন্যদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নানা অনিয়মের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের মধ্যে নৈতিকতাবোধের মারাত্মক সংকট তৈরি করছে। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানো অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এ জন্য পদক্ষেপের সূচনা হতে পারে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্ত করা এবং অন্তত উত্তীর্ণ ও অপেক্ষমাণ তালিকাভুক্তদের পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
মূল কথা হচ্ছে, একটা কিছু সরকারকে করতেই হবে। ভর্তি, নিয়োগ আর স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ও নানা দুর্নীতির অভিযোগ একটি জাতি অনাদিকাল বহন করতে পারে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
মেয়েটি আমার স্ত্রীর নিকটাত্মীয়। মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষার স্বপ্নভঙ্গের পর সে কারও সঙ্গে কথা বলেনি। নিজের ফেসবুকে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাস দিয়ে সে তার হাহাকারের কথা জানিয়েছে। তার প্রশ্ন: আগে প্রশ্ন পেয়ে নকলভাবে যারা পাস করেছে, তাদের কী অধিকার আছে ডাক্তারি পড়ার? মেয়েটি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার সময়ও প্রশ্ন ফাঁস হয়েছিল। এবারও এটি হওয়ার পর সে লিখেছে, এ দেশে পড়াশোনা করার ইচ্ছাই চলে গেছে তার!
এই মেয়েটির মতো লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর স্বপ্ন হরণ করা হয়েছে এসএসসি, এইচএসসি, ভর্তি, নিয়োগের বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অজস্র ঘটনায়। বহুবার এ নিয়ে লেখালেখি হয়েছে, বহু প্রমাণ পেশ করা হয়েছে, বহু ধরনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। কিছুতেই সরকারের টনক নড়েনি। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে এবার যা হলো—এত প্রমাণ, এত প্রতিবাদ আর এত লেখালেখি—তারপরও কি কিছুই হবে না?
আমরা কি তাহলে আমাদের সন্তানদের এই বার্তাই দিচ্ছি যে পড়াশোনা করে কোনো লাভ নেই, নিজের ভাগ্য গড়তে হলে জালিয়াতি করা শিখতে হবে? যারা জালিয়াতি করতে পারবে, তারাই ভালো জায়গায় পড়বে, ভালো চাকরি পাবে? যাদের জালিয়াতি করার বা অসৎ হওয়ার মানসিকতা বা রুচি নেই, তাদের বুকে রক্তক্ষরণ নিয়ে বাঁচতে হবে, হয়তো সারা জীবন এর মাশুল দিতে হবে নানাভাবে?
আর যারা বিভিন্ন পরীক্ষায় জালিয়াতি করেছে বা করবে, তাদের পাপের মাশুল দিতে হবে গোটা জাতিকে। যদি ১০০ জনের মধ্যে অর্ধেকও হয় এমন, তাহলে এরা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে করতে নিজেরাই বড় জালিয়াত আর দুর্নীতিবাজ হয়ে উঠবে। অন্তত তা হওয়ার প্রণোদনা পাবে। মেধা নয়, জালিয়াতি আর চৌর্যবৃত্তিকে এভাবে পুরস্কৃত করে আমরা এ কোন অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দিচ্ছি আমাদের তরুণ সমাজ আর দেশকে?
২.
আমাদের প্রথমে প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগকে খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আবার তিনিই বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রশ্নগুলো ফাঁস হয়ে যাওয়া প্রশ্ন কি না, তা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে খতিয়ে দেখা হয়নি। আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, খতিয়ে দেখার আগে উনি প্রশ্ন ফাঁস হয়নি এই দাবি করেন কীভাবে? প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে—এমন অভিযোগকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা প্রয়োগের জন্য এত দক্ষতা সরকারের যেসব এজেন্সি দেখাতে পারে, তারা প্রশ্নপত্র ফাঁসের নমুনা পাচ্ছে না, তা তো হতে পারে না। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অবশ্যই সরকারের জানার কথা। প্রশ্নপত্র ফাঁস তাই বলে শিক্ষামন্ত্রী বা অন্য কোনো মন্ত্রীর নির্দেশে হতে পারে না। প্রশ্নপত্র ফাঁস রাজনৈতিক সিদ্ধান্তেও হতে পারে না। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁসের মতো বেপরোয়া অন্যায় করতে হলে সরকারের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কারও কারও সঙ্গে যোগসাজশ থাকাটা অস্বাভাবিক নয়।
আমাদের মনে আছে, ১৮ সেপ্টেম্বর মেডিকেল কলেজের ভর্তি পরীক্ষা চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দপ্তর থেকে কমিশনের সহকারী পরিচালক ওমর সিরাজ, জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ভান্ডাররক্ষক রেজাউল করিম ও তাঁদের সহযোগী ঈশান ইমতিয়াজকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যা ব। তখন র্যা ব জানিয়েছিল যে এই চক্রটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষায় পাস করিয়ে দিতে ১৫ লাখ টাকা, জুডিশিয়াল সার্ভিসে নিয়োগ দিতে ১০ লাখ টাকা এবং কৃষি ব্যাংকের কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেওয়ার জন্য ছয় লাখ টাকা করে নিত।
র্যা ব তখন দাবি করেছিল, গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ওই চক্রটির মূল হোতা ওমর সিরাজ। র্যা বের হেফাজতে থাকা অবস্থায় ৩ অক্টোবর তিনি মারা যাওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই এখন প্রশ্ন উঠছে, এটি কেন ঘটল? ওমর সিরাজের বিচারকাজ সম্পন্ন হলে ভুয়া প্রশ্নপত্র তৈরি বা প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলো সম্পর্কে অনেক প্রমাণিত তথ্য পাওয়া যেত। এমন একজন ব্যক্তি র্যা বের রিমান্ডে থাকা অবস্থায় মারা যাওয়ায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িত অন্যদের নাম জানার সুযোগ থাকল না। এই মৃত্যু স্বাভাবিক কারণেই নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে।
প্রশ্নপত্র ফাঁসের প্রতিবাদে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের নির্মমতাও বিস্ময়কর। এই প্রতিবাদকারীরা সরকারের পতন চায়নি, সরকারবিরোধী কোনো স্লোগান দেয়নি। তারা শুধু তদন্ত আর পুনরায় পরীক্ষার দাবি জানিয়েছে। এই দাবির উত্তর কি রাইফেলের বাঁট দিয়ে নির্মমভাবে পেটানো আর মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে টানাহেঁচড়া হওয়া উচিত? তাহলে কি এমন কিছু ক্ষমতাধর ব্যক্তি এতে জড়িত যে কোনো সুষ্ঠু তদন্তের দাবি উঠলে যেভাবেই হোক তার কণ্ঠরোধ করতে হবে?
আমাদের শিক্ষামন্ত্রী একবার বলেছিলেন যে প্রশ্নপত্র ফাঁস সরকারের জীবন-মরণ সমস্যা। যদি তা-ই হয়, তাহলে প্রশ্নপত্র ফাঁসের জোরালো অভিযোগ উঠেছে এমন একটি পরীক্ষাও বাতিল করা হয়নি কেন? কেন বছরের পর বছর ধরে এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না? কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে বহু প্রস্তাব থাকলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি? জামিলুর রেজা চৌধুরী, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ বহু বরেণ্য ব্যক্তি প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে নানা প্রস্তাব বিভিন্ন সময়ে দিয়েছেন। এসব প্রস্তাব পরীক্ষা করে দেখা দূরের কথা, প্রশ্নপত্র ফাঁস বন্ধে আন্তরিক ও অর্থবহ কোনো পরামর্শসভাও সরকারকে আমরা আহ্বান করতে দেখিনি।
৩.
প্রশ্নপত্র ফাঁসের পাশাপাশি সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় নানা বৈষম্যের অভিযোগ আমরা অনেক দিন ধরে শুনে আসছি। বিএনপি-জামায়াত আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা মৌখিক পরীক্ষাকালে বৈষম্যের শিকার হতেন বলে অভিযোগ ছিল। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা এমন বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন বলেও অভিযোগ শোনা যায়। এ ছাড়া প্রতিটি রাজনৈতিক সরকারের আমলে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের প্রতি অবিচারের অভিযোগও বহু পুরোনো। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এসব বৈষম্যের সংস্কৃতি এখন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিচয়কে ছাড়িয়ে প্রায় সর্বজনীন হতে চলেছে। অন্ধ দলীয়করণ ও দুর্নীতির প্রকোপে সাধারণ নির্বিরোধী তরুণ সমাজও এখন নানা অনিশ্চয়তার বলি হচ্ছে।
উদাহরণ হিসেবে বলছি, কিছুদিন আগে বিসিএস পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়েছিল। এই পরীক্ষার জন্য প্রায় আড়াই বছর প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ছাত্রছাত্রীরা। নানা ধাপের পরীক্ষা শেষে লিখিত পরীক্ষার ফল যখন বের হলো, দেখা গেল মেধা আর কোটায় উত্তীর্ণ ছাত্রছাত্রীদের আলাদা করার কোনো উপায় নেই। কোটাধারীদের উৎপাতে এমনি সরকারি চাকরিতে মেধাবীদের ঢোকার সুযোগ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। মেধা আর কোটার আলাদা তালিকা না থাকার কারণে এবার আর বোঝারই উপায় রইল না যে আসলে মেধাবীদের ঠিক কতটুকু সুযোগ দেওয়া হলো, আর কতটুকু কোটার নামে পছন্দের প্রার্থীদের চাকরিতে ঢোকানোর জন্য রাখা হলো। পিএসসিকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা জানাল যে তাড়াহুড়া করে রেজাল্ট প্রস্তুত করার কারণে আলাদা কোনো তালিকা তৈরি করা যায়নি!
এত বড় খামখেয়ালিপনা নিয়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য হলো না দেশে। সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় নন-ক্যাডার নামের যে ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছে, তার অস্বচ্ছতা নিয়েও কথা বলি না আমরা। অথচ ভুক্তভোগীরা জানেন এসবের কত যন্ত্রণা। আমাকে একজন মেইল করেছেন। তাঁর কথাই তুলে ধরছি: ‘কত নির্ঘুম রাত, কষ্ট, পরিশ্রম আর সাধনার ছিল ৩৪তম বিসিএস। ২৯ আগস্ট রাত ৯টায় আমাদের সেই সাধনা, কষ্ট আর অমানুষিক পরিশ্রম নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করা হলো। নন-ক্যাডার নামক প্রহসনের নাটক মঞ্চস্থ করা হলো ৬১৮৫ জন মেধাবীর সঙ্গে। প্রিলি, রিটেন, ভাইভা পাস, কিন্তু পদ স্বল্পতার কারণে চাকরি নেই। তাহলে ২.৫ বছর আমাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নিল কেনো? পদ স্বল্পতা বলছে অথচ রেজাল্ট নিয়ে কি কারচুপি হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। মেধা আর কোটা আলাদা না করে মনগড়া রেজাল্ট দিয়েছে!’
হতে পারে এসব অভিযোগে অতিশয়োক্তি রয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বা নিয়োগ দুর্নীতির কিছু অভিযোগ সত্যি না–ও হতে পারে। কিন্তু ১০টি পরীক্ষার মধ্যে সাত–আটটিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে বাকিগুলোতেও ফাঁস হয়েছে—এই আশঙ্কা জাগাই স্বাভাবিক বঞ্চনাবোধ রয়েছে এমন তরুণদের মধ্যে।
এমন বঞ্চনাবোধ দেশের বিপুলসংখ্যক তরুণের মধ্যে হতাশাবোধ জাগাচ্ছে। অন্যদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নানা অনিয়মের সুবিধাপ্রাপ্ত অংশের মধ্যে নৈতিকতাবোধের মারাত্মক সংকট তৈরি করছে। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানো অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। আর এ জন্য পদক্ষেপের সূচনা হতে পারে মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ সর্বোচ্চ আন্তরিকতার সঙ্গে তদন্ত করা এবং অন্তত উত্তীর্ণ ও অপেক্ষমাণ তালিকাভুক্তদের পুনরায় পরীক্ষা গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
মূল কথা হচ্ছে, একটা কিছু সরকারকে করতেই হবে। ভর্তি, নিয়োগ আর স্কুল সমাপনী পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ও নানা দুর্নীতির অভিযোগ একটি জাতি অনাদিকাল বহন করতে পারে না।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments