বাংলাদেশকে ‘ছেড়ে দেয়ার’ পরিকল্পনা ছিল পাকিস্তানের! by মো: ইখতিয়ার উদ্দিন রিবা
১৯৪৭
সালে ভাগের পরেও ভারতের যে রাজনৈতিক প্রভাব বাংলাদেশে রয়ে গেছে, তা
পাকিস্তানে না থাকার কথাটি পাকিস্তানের। অন্য দিকে ভারতের ঘিরে থাকা
বাংলাদেশে পাকিস্তানি নীতি বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা বলে ’৭১-এ ভারতীয়দের
ভাষ্যের তথ্য রয়েছে। এই প্রত্যক্ষ কথার পরোক্ষ স্বীকৃতির পর্যালোচিত ইতিহাস
অনেক আগেই পাকিস্তানের এমন পরিকল্পনার কারণ বৈকি।
১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম দ্বিজাতিতত্ত্বের উপস্থাপক বলে স্যার সৈয়দ আহাম্মদকে বলা হয়। কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসের বিচারে এর উদ্ভাবনা প্রায় হাজার বছরের পুরনো এবং ছিল প্রবহমান। অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রতিদানস্বরূপ স্যার সৈয়দ শুধু এর প্রতিধ্বনি করেছেন মাত্র। দ্বিতীয় উপস্থাপনটি হয় ১৯৩০ সালে। লক্ণেৌ অধিবেশনে মুসলিম লীগ সভাপতি স্যার মোহাম্মদ ইকবালের উত্তর-পশ্চিম ভারতে মুসলিম অধ্যুষিত চারটি প্রদেশ একত্র করে আলাদা রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম দাবির কারণে। তৃতীয়টি ’৩৩ সালে। ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পাঞ্জাবের চৌধুরী রহমত আলী এবং তার সহপাঠী ও সহযোগী মোহাম্মদ আসলাম খান, শেখ মোহাম্মদ সাদিক এবং এনায়েত উল্লাহ খান। তবে তারা ওই অঞ্চলেই পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি করেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ পাঞ্জাবের P, কাশ্মিরের K, সিন্ধুর S এবং বেলুচিস্তানের TAN নিয়ে পাকিস্তান নামকরণটি তারাই করে সর্বপ্রথম প্রচারপত্রে উল্লেখ করেন। ’৪০ সালে চতুর্থ দাবিটি হয় আমাদের পক্ষ থেকে। সেটা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ সব মুসলিম প্রদেশের স্বাতন্ত্র্যের। এর অসাধ্যতার প্রমাণ বিভাজ্য পাঞ্জাব ও বাংলার অংশগ্রহণ।
The Penguin Atlas of World History, Vol-23, page-220 মতে, ভারতবর্ষ ভাগের ফলে আমাদের এখান থেকে ভারতে যায় ৩৩ লাখ, আসে ১০ লাখ মানুষ। পাকিস্তান থেকে ভারতে যায় ৫৫ লাখ, আসে ৭৫ লাখ। বিবিধ তথ্য মতে, ব্রিটিশ-ভারতে মোট আইসিএস এবং আইপিএস ছিলেন ১১৫৭ জন। এর মধ্যে ৬০৮ জন ব্রিটিশ এবং ৪৪৮ জন হিন্দু। অবশিষ্ট ১০১ জন মুসলমানের মধ্যে পাকিস্তানে আসা ৯৫ জনের মাত্র একজন আইসিএস এবং ১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন বাঙালি। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ জেনারেল লকহার্ট-এর তথ্য মতে, ’৪১ সালে ভারতীয় সেনাসংখ্যা ছিল ৪,১৮,০০০। এর মধ্যে ২,০১,০০০ পাঞ্জাবির ৯৬ হাজার ছিল মুসলমান। ভাগে পাকিস্তানের পাওয়া প্রায় দুই লাখের মধ্যে কর্নেল থেকে মেজর জেনারেল পদমর্যাদার মোট ৫৬ জনই অবাঙালি এবং অফিসার পদমর্যাদার ১৫৫ জন ছিলেন বাঙালি।
প্রফেসর গোলাম কবিরের ‘মাইনোরিটি পলিটিকস ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের তথ্য মতে, ৬৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অব পাকিস্তান তথা পাকিস্তান শাসনতন্ত্র পরিষদ। এর ৪৯ জন মুসলমান, ১৬ জন সংখ্যালঘু এবং চারজন স্বতন্ত্র। আনুপাতিক অংশে আমাদের সংরক্ষিত ১৩ জন সংখ্যালঘু ও ৪৪সহ মোট ৫৭ জন। মোহাম্মদ রফিক আফজালের ‘পাকিস্তান : হিস্ট্রি অ্যান্ড পলিটিকস’, পৃষ্ঠা ৪৭, নোট ২৪ মতে- লিয়াকত আলী খান এবং কাইউম খান ছাড়া আরো চারজন ছিলেন আমাদের কোটায় মনোনীত। পূর্বোল্লিখিত গোলাম কবিরের বই মতে, আমাদের সংখ্যালঘু সদস্যের ছয়জন অনেক আগে থেকেই কলকাতায় থাকতেন। তাদের একজন ছাড়া সবাই ছিলেন জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা, যারা বাংলার স্বাধীনতা ও ভারত ভাগের বিরোধী ছিলেন। রাজশাহীর বাবু প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন প্রভাবশালী নেতা। বাবু সতীশ দাস গুপ্তের খাদি প্রতিষ্ঠান এবং কুমিল্লায় ড. পি সি ঘোষের অভয় আশ্রম ছিল কংগ্রেস সমর্থিত শক্তিশালী দু’টি প্রতিষ্ঠান। এখানের কংগ্রেসের প্রস্তাব মতে, ড. পি সি ঘোষ হন পশ্চিম বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। বাবু কিরণ শঙ্কর রায় ৬ মাস পরই মন্ত্রিত্ব নিতে দেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। এখানে কংগ্রেসের তুলনায় দুর্বল মুসলিম লীগের হাতেগোনা নেতাদের নির্ভর করতে হয়েছে স্বল্প শিক্ষিত কিছু মধ্যবিত্ত, ছাত্র, কৃষক এবং পশ্চিম বাংলা ছাড়াও অবাঙালি মুসলিম নেতাদের ওপর।
প্রথম অধিবেশনে কলকাতা থেকে অংশ নেয়া সদস্য প্রফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী ’৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক সংশোধনী প্রস্তাবে বছরে অন্তত একবার ঢাকায় অধিবেশনের দাবি করেন। পরের দিন আর এক সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (’৭১ সালে পুত্রসহ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত) অধিবেশনে বাংলাকেও একটি সরকারি ভাষায় অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করলে আপত্তি তোলা হয়। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাতৃভাষা গুজরাটি, লিয়াকত আলী খানের পাঞ্জাবি এবং পাকিস্তানে শতকরা ৭.২ ভাগ উর্দুভাষীর প্রায় শতভাগ হলেন ভারত থেকে আসা মোহাজির। ওই বছরই ১৩ জুলাই ঢাকায় পুলিশ বিদ্রোহ দমনের সময় গুলিতে দুইজন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। ১৮ জুলাই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে কুমিল্লায় এক রাজনৈতিক সম্মেলনে কংগ্রেসের পরিবর্তে গণসমিতি নামে একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবিতে তিনি দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করেন। এই দলটিই পরে ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ পার্টি তথা ইউপিপি নামে রূপান্তরিত হয়। ’৪৯ সালের ১২ মার্চ অধিবেশনে সংখ্যালঘু সদস্যরা কার্যবিধির সিদ্ধান্তে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবি জানান।
ওই বছর ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালের ২৪ অক্টোবর মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। (তথ্যে বলা হয় যে ১৯৫৪-এর নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু ৭২ সদস্যের সমর্থন লাভ এর কারণ)। প্রফেসর লরেন্স জিরিংয়ের ‘বাংলাদেশ ফ্রম মুজিব টু এরশাদ’ বইয়ের ২০ পৃষ্ঠা মতে, ’৪৯ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় হিন্দু মহাসভার জনসভায় বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান ও পাকিস্তানকে পুনঃ যুক্ত করে অখণ্ড ভারতের দাবি করা হয়। ’৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীতে জেল পুলিশের গুলিতে ৭ জন কমিউনিস্ট নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। ’৫২ সালে আমাদের ভাষা আন্দোলন। ’৫৪ সালের ২৩ মার্চ চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা হয়। শুধু এ পর্যন্ত বর্ণিত তথ্যের নিরিখে, পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তিকে অদূরদর্শিতা না আত্মসমর্পণ মনে করা কতটা অযৌক্তিক? দুঃখিত- যৌক্তিক ব্যাখ্যাও আছে। কিন্তু পাকিস্তান তার স্বার্থে এতে বাধ্য করার আদৌ কোনো তথ্য পাওয়া ভার।
আলতাফ গওহরের ‘আইয়ুব খান’ নামের বইয়ের ’৫৯ পৃষ্ঠা মতে ইস্কানদার মীর্জা, আইয়ুব খান ও তার একান্ত সহযোগী এই লেখক বাগদাদ প্যাক্টের অধিবেশনে আঙ্কারা যান ১৯৫৮ সালের ১৪ জুলাই। পরের দিন ইরানের শাহ আলতাফ গওহরকে জিজ্ঞেস করেন, ইরান-পাকিস্তান কনফেডারেশন করে বাংলাদেশের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কাশ্মির নেয়ার পরিকল্পনার কথা সে জানে কি না। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ তার ‘ক্রিটিক্যাল টাইমস’ বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ১৯৬০-৬১ সালে আইয়ুব খান ভারতের হাইকমিশনার রাজেশ্বর দয়ালকে বলেছিলেন, কাশ্মির দিলে ভারতকে বাংলাদেশ ছেড়ে দেয়া হবে। রোয়েদাদ খানের ‘দ্য অ্যামেরিকান পেপারস’ (পৃষ্ঠা ২৮২) মতে, খান আব্দুল কাইউম খান ’৭০ সালে পেশোয়ার নির্বাচনী জনসভায় ডুরান্ড লাইনকে কৃত্রিম বলে আফগানিস্তান ও ইরানের সাথে পাকিস্তানের কনফেডারেশন সমর্থন করেন। ২৫ জুন ওয়ালী খান এর ব্যাখ্যায় বলেন, পাকিস্তানের নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থে অনেকেই বাংলাদেশের সাথে কমই জাতিত্বের সম্পর্ক মনে করেন। কাইউম খান তার বক্তব্যের ব্যাখ্যায় সামরিক ও অন্যান্য জাতীয় ক্ষেত্রে তাদের একে অন্যের সাহায্য করা উচিত বলে বোঝাতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতায় তখনই অনেকে সমর্থন এবং পেশোয়ারে কারো কারো সন্তোষ প্রকাশের কথা এই বইটিতেই আছে। ১৯৮০-৮১’র দিকে বাংলাদেশের সাথে কনফেডারেশনের পক্ষে করাচিতে জনমত প্রকাশ পায়। যত দূর মনে পড়ে জনৈক কোরেশী বা রাশেদি নামের এক রাজনীতিবিদ তখন দৈনিক জং পত্রিকায় লেখা দীর্ঘ কলামে উল্লেখ করেন, আইউব খান বাংলাদেশ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। ‘যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, খোদা হাফেজ’ বলে লেখাটির তিনি ইতি টানেন।
১৮৮৮ সালে সর্বপ্রথম দ্বিজাতিতত্ত্বের উপস্থাপক বলে স্যার সৈয়দ আহাম্মদকে বলা হয়। কিন্তু ভারতীয় ইতিহাসের বিচারে এর উদ্ভাবনা প্রায় হাজার বছরের পুরনো এবং ছিল প্রবহমান। অবস্থার প্রেক্ষাপটে প্রতিদানস্বরূপ স্যার সৈয়দ শুধু এর প্রতিধ্বনি করেছেন মাত্র। দ্বিতীয় উপস্থাপনটি হয় ১৯৩০ সালে। লক্ণেৌ অধিবেশনে মুসলিম লীগ সভাপতি স্যার মোহাম্মদ ইকবালের উত্তর-পশ্চিম ভারতে মুসলিম অধ্যুষিত চারটি প্রদেশ একত্র করে আলাদা রাষ্ট্রের সর্বপ্রথম দাবির কারণে। তৃতীয়টি ’৩৩ সালে। ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত পাঞ্জাবের চৌধুরী রহমত আলী এবং তার সহপাঠী ও সহযোগী মোহাম্মদ আসলাম খান, শেখ মোহাম্মদ সাদিক এবং এনায়েত উল্লাহ খান। তবে তারা ওই অঞ্চলেই পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে আলাদা রাষ্ট্র গঠনের দাবি করেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ পাঞ্জাবের P, কাশ্মিরের K, সিন্ধুর S এবং বেলুচিস্তানের TAN নিয়ে পাকিস্তান নামকরণটি তারাই করে সর্বপ্রথম প্রচারপত্রে উল্লেখ করেন। ’৪০ সালে চতুর্থ দাবিটি হয় আমাদের পক্ষ থেকে। সেটা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ সব মুসলিম প্রদেশের স্বাতন্ত্র্যের। এর অসাধ্যতার প্রমাণ বিভাজ্য পাঞ্জাব ও বাংলার অংশগ্রহণ।
The Penguin Atlas of World History, Vol-23, page-220 মতে, ভারতবর্ষ ভাগের ফলে আমাদের এখান থেকে ভারতে যায় ৩৩ লাখ, আসে ১০ লাখ মানুষ। পাকিস্তান থেকে ভারতে যায় ৫৫ লাখ, আসে ৭৫ লাখ। বিবিধ তথ্য মতে, ব্রিটিশ-ভারতে মোট আইসিএস এবং আইপিএস ছিলেন ১১৫৭ জন। এর মধ্যে ৬০৮ জন ব্রিটিশ এবং ৪৪৮ জন হিন্দু। অবশিষ্ট ১০১ জন মুসলমানের মধ্যে পাকিস্তানে আসা ৯৫ জনের মাত্র একজন আইসিএস এবং ১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন বাঙালি। ১৯৪২ সালে ব্রিটিশ জেনারেল লকহার্ট-এর তথ্য মতে, ’৪১ সালে ভারতীয় সেনাসংখ্যা ছিল ৪,১৮,০০০। এর মধ্যে ২,০১,০০০ পাঞ্জাবির ৯৬ হাজার ছিল মুসলমান। ভাগে পাকিস্তানের পাওয়া প্রায় দুই লাখের মধ্যে কর্নেল থেকে মেজর জেনারেল পদমর্যাদার মোট ৫৬ জনই অবাঙালি এবং অফিসার পদমর্যাদার ১৫৫ জন ছিলেন বাঙালি।
প্রফেসর গোলাম কবিরের ‘মাইনোরিটি পলিটিকস ইন বাংলাদেশ’ বইয়ের তথ্য মতে, ৬৯ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হয় কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি অব পাকিস্তান তথা পাকিস্তান শাসনতন্ত্র পরিষদ। এর ৪৯ জন মুসলমান, ১৬ জন সংখ্যালঘু এবং চারজন স্বতন্ত্র। আনুপাতিক অংশে আমাদের সংরক্ষিত ১৩ জন সংখ্যালঘু ও ৪৪সহ মোট ৫৭ জন। মোহাম্মদ রফিক আফজালের ‘পাকিস্তান : হিস্ট্রি অ্যান্ড পলিটিকস’, পৃষ্ঠা ৪৭, নোট ২৪ মতে- লিয়াকত আলী খান এবং কাইউম খান ছাড়া আরো চারজন ছিলেন আমাদের কোটায় মনোনীত। পূর্বোল্লিখিত গোলাম কবিরের বই মতে, আমাদের সংখ্যালঘু সদস্যের ছয়জন অনেক আগে থেকেই কলকাতায় থাকতেন। তাদের একজন ছাড়া সবাই ছিলেন জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতা, যারা বাংলার স্বাধীনতা ও ভারত ভাগের বিরোধী ছিলেন। রাজশাহীর বাবু প্রভাস চন্দ্র লাহিড়ী ছিলেন প্রভাবশালী নেতা। বাবু সতীশ দাস গুপ্তের খাদি প্রতিষ্ঠান এবং কুমিল্লায় ড. পি সি ঘোষের অভয় আশ্রম ছিল কংগ্রেস সমর্থিত শক্তিশালী দু’টি প্রতিষ্ঠান। এখানের কংগ্রেসের প্রস্তাব মতে, ড. পি সি ঘোষ হন পশ্চিম বাংলার প্রথম মুখ্যমন্ত্রী। বাবু কিরণ শঙ্কর রায় ৬ মাস পরই মন্ত্রিত্ব নিতে দেশ ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। এখানে কংগ্রেসের তুলনায় দুর্বল মুসলিম লীগের হাতেগোনা নেতাদের নির্ভর করতে হয়েছে স্বল্প শিক্ষিত কিছু মধ্যবিত্ত, ছাত্র, কৃষক এবং পশ্চিম বাংলা ছাড়াও অবাঙালি মুসলিম নেতাদের ওপর।
প্রথম অধিবেশনে কলকাতা থেকে অংশ নেয়া সদস্য প্রফেসর রাজকুমার চক্রবর্তী ’৪৮ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি এক সংশোধনী প্রস্তাবে বছরে অন্তত একবার ঢাকায় অধিবেশনের দাবি করেন। পরের দিন আর এক সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত (’৭১ সালে পুত্রসহ পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নিহত) অধিবেশনে বাংলাকেও একটি সরকারি ভাষায় অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করলে আপত্তি তোলা হয়। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর মাতৃভাষা গুজরাটি, লিয়াকত আলী খানের পাঞ্জাবি এবং পাকিস্তানে শতকরা ৭.২ ভাগ উর্দুভাষীর প্রায় শতভাগ হলেন ভারত থেকে আসা মোহাজির। ওই বছরই ১৩ জুলাই ঢাকায় পুলিশ বিদ্রোহ দমনের সময় গুলিতে দুইজন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। ১৮ জুলাই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নেতৃত্বে কুমিল্লায় এক রাজনৈতিক সম্মেলনে কংগ্রেসের পরিবর্তে গণসমিতি নামে একটি দল প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থার দাবিতে তিনি দেশব্যাপী প্রচারণা শুরু করেন। এই দলটিই পরে ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ পার্টি তথা ইউপিপি নামে রূপান্তরিত হয়। ’৪৯ সালের ১২ মার্চ অধিবেশনে সংখ্যালঘু সদস্যরা কার্যবিধির সিদ্ধান্তে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের দাবি জানান।
ওই বছর ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫ সালের ২৪ অক্টোবর মুসলিম শব্দটি বাদ দেয়া হয়। (তথ্যে বলা হয় যে ১৯৫৪-এর নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে সংখ্যালঘু ৭২ সদস্যের সমর্থন লাভ এর কারণ)। প্রফেসর লরেন্স জিরিংয়ের ‘বাংলাদেশ ফ্রম মুজিব টু এরশাদ’ বইয়ের ২০ পৃষ্ঠা মতে, ’৪৯ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় হিন্দু মহাসভার জনসভায় বিভাজনকে প্রত্যাখ্যান ও পাকিস্তানকে পুনঃ যুক্ত করে অখণ্ড ভারতের দাবি করা হয়। ’৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহীতে জেল পুলিশের গুলিতে ৭ জন কমিউনিস্ট নিহত ও বেশ কয়েকজন আহত হন। ’৫২ সালে আমাদের ভাষা আন্দোলন। ’৫৪ সালের ২৩ মার্চ চন্দ্রঘোনা পেপার মিলে বাঙালি-বিহারি দাঙ্গা হয়। শুধু এ পর্যন্ত বর্ণিত তথ্যের নিরিখে, পাকিস্তানের সাথে সংযুক্তিকে অদূরদর্শিতা না আত্মসমর্পণ মনে করা কতটা অযৌক্তিক? দুঃখিত- যৌক্তিক ব্যাখ্যাও আছে। কিন্তু পাকিস্তান তার স্বার্থে এতে বাধ্য করার আদৌ কোনো তথ্য পাওয়া ভার।
আলতাফ গওহরের ‘আইয়ুব খান’ নামের বইয়ের ’৫৯ পৃষ্ঠা মতে ইস্কানদার মীর্জা, আইয়ুব খান ও তার একান্ত সহযোগী এই লেখক বাগদাদ প্যাক্টের অধিবেশনে আঙ্কারা যান ১৯৫৮ সালের ১৪ জুলাই। পরের দিন ইরানের শাহ আলতাফ গওহরকে জিজ্ঞেস করেন, ইরান-পাকিস্তান কনফেডারেশন করে বাংলাদেশের বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কাশ্মির নেয়ার পরিকল্পনার কথা সে জানে কি না। বাংলাদেশের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দীন আহমদ তার ‘ক্রিটিক্যাল টাইমস’ বইয়ের ৩৯ পৃষ্ঠায় লিখেছেন, ১৯৬০-৬১ সালে আইয়ুব খান ভারতের হাইকমিশনার রাজেশ্বর দয়ালকে বলেছিলেন, কাশ্মির দিলে ভারতকে বাংলাদেশ ছেড়ে দেয়া হবে। রোয়েদাদ খানের ‘দ্য অ্যামেরিকান পেপারস’ (পৃষ্ঠা ২৮২) মতে, খান আব্দুল কাইউম খান ’৭০ সালে পেশোয়ার নির্বাচনী জনসভায় ডুরান্ড লাইনকে কৃত্রিম বলে আফগানিস্তান ও ইরানের সাথে পাকিস্তানের কনফেডারেশন সমর্থন করেন। ২৫ জুন ওয়ালী খান এর ব্যাখ্যায় বলেন, পাকিস্তানের নির্দিষ্ট কিছু স্বার্থে অনেকেই বাংলাদেশের সাথে কমই জাতিত্বের সম্পর্ক মনে করেন। কাইউম খান তার বক্তব্যের ব্যাখ্যায় সামরিক ও অন্যান্য জাতীয় ক্ষেত্রে তাদের একে অন্যের সাহায্য করা উচিত বলে বোঝাতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের সম্ভাব্য বিচ্ছিন্নতায় তখনই অনেকে সমর্থন এবং পেশোয়ারে কারো কারো সন্তোষ প্রকাশের কথা এই বইটিতেই আছে। ১৯৮০-৮১’র দিকে বাংলাদেশের সাথে কনফেডারেশনের পক্ষে করাচিতে জনমত প্রকাশ পায়। যত দূর মনে পড়ে জনৈক কোরেশী বা রাশেদি নামের এক রাজনীতিবিদ তখন দৈনিক জং পত্রিকায় লেখা দীর্ঘ কলামে উল্লেখ করেন, আইউব খান বাংলাদেশ ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। ‘যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, খোদা হাফেজ’ বলে লেখাটির তিনি ইতি টানেন।
No comments