মুখের কথায় চিড়া ভেজে না by সৈয়দ আবুল মকসুদ
যিশুখ্রিষ্টের
জন্মের প্রায় ৩০০ বছর আগে চৈনিক রণকৌশল বিশেষজ্ঞ বলে গেছেন, একজনকে
এমনভাবে হত্যা করো যেন ১০ হাজার মানুষ আতঙ্কে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। তাঁর সেই
শেখানো বিদ্যা ২ হাজার ৩০০ বছর পরে আজ পৃথিবীর কোনো কোনো গোত্র দক্ষতার
সঙ্গে প্রয়োগ করছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কয়েক মাস আগে বিশ্বত্রাস
আইএস-এর শিরশ্ছেদ কর্মসূচি। পৃথিবীতে একদিন প্রযুক্তি কোন পর্যায়ে যাবে, সে
সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না ওই চীনা পণ্ডিতের। বহু মানুষকে গোপনে শিরশ্ছেদ
করলে কোনো কথা ছিল না, তেমনটি অতীতে বহু জায়গায় হয়েছে। আইএস রণকুশলীরা
আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের শত্রুপক্ষের হতভাগ্য মানুষটিকে, যিনি কোনো অপরাধ
করেননি, হাঁটু গেড়ে বসিয়ে ধড় থেকে মাথাকে বিচ্ছিন্ন করে। সেই দৃশ্য
ক্যামেরায় ধারণ করে প্রচারমাধ্যমের হাতে দিয়ে দেয়। সেই চিত্র শত্রুপক্ষ
দেখে যত ক্রুদ্ধই হোক না কেন, ভয়ে বুক যে একেবারে কাঁপেনি তা নয়।
নরহত্যায় মানবজাতির ইতিহাসে আমেরিকার রেকর্ড সর্বোচ্চ। যার যখন খুশি, যাকে খুশি, চেনা হোক, অচেনা হোক, ঠা ঠা করে গুলি চালিয়ে ফেলে দিতে পারে। হাজার হাজার স্কুল-কলেজের নিষ্পাপ ছেলেমেয়েকে ওভাবে দিনদুপুরে হত্যা করা হয়েছে। শুধু বর্তমান বছরেই আমেরিকায় ৪৫টি স্কুলে হামলা হয়েছে। নিহত হয়েছে শতাধিক, আহত বহু। গত সপ্তাহে সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ওরেগনের এক কমিউনিটি কলেজে। নিহত হয়েছে ১০ জন শিক্ষার্থী। আততায়ীর কাছ থেকে ১৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তার মধ্যে ছয়টি কলেজ থেকে এবং সাতটি তার বাড়ি থেকে। সব কটি অস্ত্রই বৈধভাবে কেনা। আমেরিকায় যার যত খুশি আগ্নেয়াস্ত্র কিনে ঘর ভরে রাখতে পারে। যেমন আমাদের কোনো কোনো এমপির ঘরে আছে অবৈধ ‘অস্ত্রভান্ডার’।
আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ওভাবে হত্যাকাণ্ড হওয়ার কথা জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মাতা–পিতা তাঁদের সন্তানদের আকিকা ও অন্নপ্রাশনের সময়ই ঠিক করে ফেলেন কোথায় পাঠাবেন—নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা, মিশিগান না লস অ্যাঞ্জেলেস। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যে দেশে প্রতি তিন ঘণ্টায় একজন খুন হয়, সেখানে ‘নিরাপত্তার কারণে সফর স্থগিত’ করছে না কোনো দেশই। আমেরিকান যুদ্ধজোটের সহযোগী অস্ট্রেলিয়া তো নয়ই। বিস্মিত হয়েছি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) বাংলাদেশ সফর স্থগিত করার ঘোষণায়। তার প্রধান নির্বাহীর ঘোষণাটি বেদনাদায়ক, ‘ছয় দিনের ব্যাপক সন্ধান ও গবেষণার পর আমরা এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে বাংলাদেশ সফর স্থগিত করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।’ বাংলাদেশের অবস্থা এতই ভয়াবহ যে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে ফুটবল টিমও আসতে চাইছে না।
এই প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি প্রবচনের কথাই শুধু স্মরণ করতে পারি: গিভ আ ডগ আ ব্যাড নেম অ্যান্ড হ্যাং হিম—কুকুরটাকে হত্যা করার আগে তার বিরুদ্ধে দুর্নাম রটাও। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে কোনো দেশকে বেকায়দায় ফেলার বাসনা থাকলে বড় দেশগুলো থেকে রটিয়ে দিলেই হলো যে দেশটিতে প্রচণ্ড সন্ত্রাস, সুতরাং জীবনের নিরাপত্তা নেই। সাধারণ সব নাগরিককে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা দিতে না পারলেও বিদেশি ক্রিকেট টিমকে সরকার ভিভিআইপি নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এ অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের নেতাদের ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা কিরোর মতো আগাম অমঙ্গল দেখতে পাওয়াটা বিস্ময়কর শুধু নয়, রহস্যজনকই বটে।
তবে অস্ট্রেলিয়ার আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়নি। তাদের আশঙ্কার অব্যবহিত পরে ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ার কড়া নজরদারির মধ্যেও প্রকাশ্য রাস্তায় নিহত হন এক ইতালীয় এনজিও কর্মকর্তা। ওই ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার আত্মতৃপ্তি লাভ করা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সন্তুষ্টির রেশ মিলিয়ে যেতে না-যেতেই বিধাতার কী খেয়াল, সিডনিতে পুলিশের সদর দপ্তরের বাইরে দিনদুপুরে গুলিতে দুজন নিহত হন। ওই হত্যাকাণ্ডের কথা যখন গাড়ির ভেতরে রেডিওর খবরে শুনি, তখন একজন বলল, অস্ট্রেলিয়াতেও তো নিরাপত্তা নেই। আমি বললাম, তা বটে, তবে শোনোনি কি সেই প্রবাদ যে রাজার পা... গন্ধ নেই?
কূটনৈতিকপাড়ায় একজন বিদেশি উন্নয়নকর্মী গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন—বিষয়টি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য খুবই ক্ষতিকর। ঘটনাটি সভা-সমাবেশে নেতাদের বাহাস করার বিষয় নয়। সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বসে যৌথভাবে ও পৃথকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তার পরিবর্তে আমরা দেখলাম, কর্মকর্তারা মিডিয়ার সামনে হড়হড় করে বক্তব্য দিচ্ছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের মুখনিঃসৃত যেসব বাণী টিভির পর্দায় ধ্বনিত হলো, তা আরও মাধুর্যমণ্ডিত। অনেকে আভাসে-ইঙ্গিতে নয়, সুস্পষ্ট ভাষায় রায় দিয়ে দিলেন: এটা মা ও ছেলের কাজ এবং বিদেশে বসেই তা করা হয়েছে। বাংলাদেশে কে মা আর কে তাঁর ছেলে, তা মানুষের বোঝার মতো আক্কেল যথেষ্ট। এবং কোন মা ও তাঁর ছেলে বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন, তা দুগ্ধপোষ্য শিশু ছাড়া সবাই জানে।
ইতালীয় হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো কূলকিনারা না হতেই রংপুর শহরের উপকণ্ঠে কুনিও হোশি নামের এক জাপানি নাগরিক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তিনিও একজন উন্নয়নকর্মী, যিনি পশুখাদ্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন স্বপ্রণোদিত হয়ে। পৃথিবীর কল্যাণে এ ধরনের মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁর ওই মর্মান্তিক মৃত্যুর পরেও সরকারি দলের নেতারা মনে যা আসে তা-ই ভাষায় প্রকাশ করে যেতে থাকেন। তাঁদের কথাবার্তায় বিদেশিদের মধ্যে যেমন আস্থার সৃষ্টি হয়নি, তেমনি তাদের শঙ্কাও কাটেনি। যেদিন জাপানি নিহত হন, সেই দিনই এক অনুষ্ঠানে বিদেশি মিশনের কোনো কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার উদ্বেগ লক্ষ করি।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন বিরোধী দলের বাইরে বেসরকারি বিরোধী দলও রয়েছে। তারা সরকারে নেই তা জানি, কিন্তু জনগণের সঙ্গেও আছে কি না, তা বোঝা যায় না। ওই দলের যেহেতু আর কোনো কাজকাম নেই, তাই তারা প্রতিদিন আসরের নামাজের আগে মিডিয়াকে কিছু বাণী উপহার দেয়। সে বাণী মাগরিবের নামাজের পরপর প্রচারিত হয়। তারা পাঁচ দুগুণে দশ বছর ক্ষমতায় ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বা আইজেনহাওয়ার কিংবা প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বা মার্গারেট থ্যাচারের চেয়ে কম নয়। কিন্তু তারা সরকারের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়েই খালাস। সব ব্যাপারে তাদের কথা বলার দরকার কী এবং কে তাদের কথা শুনতে চায়। মনে হয়, তাদের আমলে একজন মানুষও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি। তাদের দ্বিতীয় মেয়াদে যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তিনি ছিলেন স্মরণকালের সবচেয়ে সুযোগ্য মন্ত্রী। বিএনপিতে বহু দক্ষ সিএসপি কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের কাউকে নিয়োগ না দিয়ে খালেদা জিয়া প্রথমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বসান এক বিধ্বস্ত মুসলিম লীগ নেতাকে এবং পরেরবার তাঁর পুত্রের অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে, শারীরিক কারণে যাঁকে ঘন ঘন চিকিৎসা নিতে ব্যাংককে যেতে হতো। তাঁর মন্ত্রিত্বকালে স্মরণকালের বীভৎস ঘটনা ঘটে একুশে আগস্ট। বিস্ফোরণের দুই ঘণ্টা পরে আমি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গিয়ে দূর থেকে দেখতে পাই রক্ত ও শত শত স্যান্ডেল-জুতা। ঢাকা মেডিকেল ও প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে দেখি আহত ব্যক্তিদের যন্ত্রণায় কাতরানি।
সরকারি দল ও বিরোধী দল যা-ই বলুক, মানুষ দেখতে চায় সত্য উদ্ঘাটিত হোক এবং প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ুক। কিন্তু বাংলার মাটিতে তা যে হবে, সে ভরসা নেই। পাবলিক পারসেপশন বা সাধারণ মানুষের যে ধারণা, তার বাইরে মনগড়া কোনো তত্ত্ব খাড়া করতে চাইলে খুব শক্ত যুক্তি-প্রমাণ থাকা চাই। তা না হলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। যাঁরা রাষ্ট্র চালান, তাঁরা যদি জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারান, তা খুব বড় ক্ষতি।
দুই বিদেশির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই গাইবান্ধায় এক শিশু গুলিতে নিহত হতে হতেও প্রাণে বেঁচে গেছে। লিমনের মতো তাকেও পা খোয়াতে হয় কি না বলা যায় না। শিশু রাজনকে হত্যা করেছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। কিন্তু গাইবান্ধার সৌরভকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন সরকারি দলের সাংসদ। ‘তুই জামায়াত-শিবির করিস, তোরে মারি ফেলব’—এ কথা বলে গুলি চালান অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা আমাদের মাননীয়। পুলিশ হয়তো মাননীয়কে গা–ঢাকা দিতে বা পালিয়ে যেতে পূর্ণ সহায়তা দিয়ে থাকবে। জনগণ দেখতে চায় যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ড থেকে যে প্রক্রিয়ায় এক মাননীয়কে পুলিশ বাঁচিয়ে দিয়েছে, সৌরভকে যিনি গুলি করেছেন, তিনি যেন সেভাবে দায়মুক্তি না পান।
আমরা যতই বলি বাংলাদেশ একটি মোটামুটি শান্তিপূর্ণ দেশ, ততই কয়েকজন নেতা প্রচার করেন বিরোধী দলের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে জঙ্গি গিজগিজ করছে। শত্রুর মুখে শুধু কালি মাখাতে গিয়ে নিজের মুখে চুন ও কালি দুটোই মাখাতে পছন্দ করে বাঙালি। আমাদের যে আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে, তাতে বিদেশিদের ভূমিকা বিরাট। আজ খুনখারাবির কারণে তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। ভুলে গেলে চলবে না, সোয়া কোটি বাংলাদেশি বাস করে বিভিন্ন দেশে। দেশের বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতেই পারে। তবে কোথায়, কারা, কী ধরনের ষড়যন্ত্র করছে, তা সভা-সমাবেশে বলাবলি না করে তথ্য-প্রমাণসহ জনগণকে জানানোই সরকারের দায়িত্ব। মুখের কথায় চিড়া ভেজে না। দেশবাসী ও বিদেশিরা সরকারের যথাযথ ভূমিকা দেখতে চায়, শুধু মুখের কথা শুনতে চায় না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
নরহত্যায় মানবজাতির ইতিহাসে আমেরিকার রেকর্ড সর্বোচ্চ। যার যখন খুশি, যাকে খুশি, চেনা হোক, অচেনা হোক, ঠা ঠা করে গুলি চালিয়ে ফেলে দিতে পারে। হাজার হাজার স্কুল-কলেজের নিষ্পাপ ছেলেমেয়েকে ওভাবে দিনদুপুরে হত্যা করা হয়েছে। শুধু বর্তমান বছরেই আমেরিকায় ৪৫টি স্কুলে হামলা হয়েছে। নিহত হয়েছে শতাধিক, আহত বহু। গত সপ্তাহে সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ওরেগনের এক কমিউনিটি কলেজে। নিহত হয়েছে ১০ জন শিক্ষার্থী। আততায়ীর কাছ থেকে ১৩টি অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। তার মধ্যে ছয়টি কলেজ থেকে এবং সাতটি তার বাড়ি থেকে। সব কটি অস্ত্রই বৈধভাবে কেনা। আমেরিকায় যার যত খুশি আগ্নেয়াস্ত্র কিনে ঘর ভরে রাখতে পারে। যেমন আমাদের কোনো কোনো এমপির ঘরে আছে অবৈধ ‘অস্ত্রভান্ডার’।
আমেরিকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ওভাবে হত্যাকাণ্ড হওয়ার কথা জানা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত মাতা–পিতা তাঁদের সন্তানদের আকিকা ও অন্নপ্রাশনের সময়ই ঠিক করে ফেলেন কোথায় পাঠাবেন—নিউইয়র্ক, ফ্লোরিডা, মিশিগান না লস অ্যাঞ্জেলেস। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যে দেশে প্রতি তিন ঘণ্টায় একজন খুন হয়, সেখানে ‘নিরাপত্তার কারণে সফর স্থগিত’ করছে না কোনো দেশই। আমেরিকান যুদ্ধজোটের সহযোগী অস্ট্রেলিয়া তো নয়ই। বিস্মিত হয়েছি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার (সিএ) বাংলাদেশ সফর স্থগিত করার ঘোষণায়। তার প্রধান নির্বাহীর ঘোষণাটি বেদনাদায়ক, ‘ছয় দিনের ব্যাপক সন্ধান ও গবেষণার পর আমরা এ উপসংহারে পৌঁছেছি যে বাংলাদেশ সফর স্থগিত করা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা ছিল না।’ বাংলাদেশের অবস্থা এতই ভয়াবহ যে অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে ফুটবল টিমও আসতে চাইছে না।
এই প্রসঙ্গে একটি ইংরেজি প্রবচনের কথাই শুধু স্মরণ করতে পারি: গিভ আ ডগ আ ব্যাড নেম অ্যান্ড হ্যাং হিম—কুকুরটাকে হত্যা করার আগে তার বিরুদ্ধে দুর্নাম রটাও। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতিতে কোনো দেশকে বেকায়দায় ফেলার বাসনা থাকলে বড় দেশগুলো থেকে রটিয়ে দিলেই হলো যে দেশটিতে প্রচণ্ড সন্ত্রাস, সুতরাং জীবনের নিরাপত্তা নেই। সাধারণ সব নাগরিককে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিরাপত্তা দিতে না পারলেও বিদেশি ক্রিকেট টিমকে সরকার ভিভিআইপি নিরাপত্তা দিয়ে থাকে। এ অবস্থায় অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেট দলের নেতাদের ভবিষ্যদ্দ্রষ্টা কিরোর মতো আগাম অমঙ্গল দেখতে পাওয়াটা বিস্ময়কর শুধু নয়, রহস্যজনকই বটে।
তবে অস্ট্রেলিয়ার আশঙ্কা অমূলক প্রমাণিত হয়নি। তাদের আশঙ্কার অব্যবহিত পরে ঢাকার কূটনৈতিকপাড়ার কড়া নজরদারির মধ্যেও প্রকাশ্য রাস্তায় নিহত হন এক ইতালীয় এনজিও কর্মকর্তা। ওই ঘটনায় অস্ট্রেলিয়ার আত্মতৃপ্তি লাভ করা স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের সন্তুষ্টির রেশ মিলিয়ে যেতে না-যেতেই বিধাতার কী খেয়াল, সিডনিতে পুলিশের সদর দপ্তরের বাইরে দিনদুপুরে গুলিতে দুজন নিহত হন। ওই হত্যাকাণ্ডের কথা যখন গাড়ির ভেতরে রেডিওর খবরে শুনি, তখন একজন বলল, অস্ট্রেলিয়াতেও তো নিরাপত্তা নেই। আমি বললাম, তা বটে, তবে শোনোনি কি সেই প্রবাদ যে রাজার পা... গন্ধ নেই?
কূটনৈতিকপাড়ায় একজন বিদেশি উন্নয়নকর্মী গুপ্তহত্যার শিকার হয়েছেন—বিষয়টি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য খুবই ক্ষতিকর। ঘটনাটি সভা-সমাবেশে নেতাদের বাহাস করার বিষয় নয়। সঙ্গে সঙ্গে অপরাধ বিশেষজ্ঞ, কূটনীতিবিদ, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তারা বসে যৌথভাবে ও পৃথকভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারতেন। তার পরিবর্তে আমরা দেখলাম, কর্মকর্তারা মিডিয়ার সামনে হড়হড় করে বক্তব্য দিচ্ছেন। একই সঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের মুখনিঃসৃত যেসব বাণী টিভির পর্দায় ধ্বনিত হলো, তা আরও মাধুর্যমণ্ডিত। অনেকে আভাসে-ইঙ্গিতে নয়, সুস্পষ্ট ভাষায় রায় দিয়ে দিলেন: এটা মা ও ছেলের কাজ এবং বিদেশে বসেই তা করা হয়েছে। বাংলাদেশে কে মা আর কে তাঁর ছেলে, তা মানুষের বোঝার মতো আক্কেল যথেষ্ট। এবং কোন মা ও তাঁর ছেলে বর্তমানে বিদেশে রয়েছেন, তা দুগ্ধপোষ্য শিশু ছাড়া সবাই জানে।
ইতালীয় হত্যাকাণ্ডের তদন্তে কোনো কূলকিনারা না হতেই রংপুর শহরের উপকণ্ঠে কুনিও হোশি নামের এক জাপানি নাগরিক আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। তিনিও একজন উন্নয়নকর্মী, যিনি পশুখাদ্য নিয়ে গবেষণা করছিলেন স্বপ্রণোদিত হয়ে। পৃথিবীর কল্যাণে এ ধরনের মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজন। তাঁর ওই মর্মান্তিক মৃত্যুর পরেও সরকারি দলের নেতারা মনে যা আসে তা-ই ভাষায় প্রকাশ করে যেতে থাকেন। তাঁদের কথাবার্তায় বিদেশিদের মধ্যে যেমন আস্থার সৃষ্টি হয়নি, তেমনি তাদের শঙ্কাও কাটেনি। যেদিন জাপানি নিহত হন, সেই দিনই এক অনুষ্ঠানে বিদেশি মিশনের কোনো কোনো শীর্ষ কর্মকর্তার উদ্বেগ লক্ষ করি।
বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন বিরোধী দলের বাইরে বেসরকারি বিরোধী দলও রয়েছে। তারা সরকারে নেই তা জানি, কিন্তু জনগণের সঙ্গেও আছে কি না, তা বোঝা যায় না। ওই দলের যেহেতু আর কোনো কাজকাম নেই, তাই তারা প্রতিদিন আসরের নামাজের আগে মিডিয়াকে কিছু বাণী উপহার দেয়। সে বাণী মাগরিবের নামাজের পরপর প্রচারিত হয়। তারা পাঁচ দুগুণে দশ বছর ক্ষমতায় ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনায় তাদের অভিজ্ঞতা প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বা আইজেনহাওয়ার কিংবা প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বা মার্গারেট থ্যাচারের চেয়ে কম নয়। কিন্তু তারা সরকারের ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়েই খালাস। সব ব্যাপারে তাদের কথা বলার দরকার কী এবং কে তাদের কথা শুনতে চায়। মনে হয়, তাদের আমলে একজন মানুষও হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়নি। তাদের দ্বিতীয় মেয়াদে যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তিনি ছিলেন স্মরণকালের সবচেয়ে সুযোগ্য মন্ত্রী। বিএনপিতে বহু দক্ষ সিএসপি কর্মকর্তা ছিলেন। তাঁদের কাউকে নিয়োগ না দিয়ে খালেদা জিয়া প্রথমবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বসান এক বিধ্বস্ত মুসলিম লীগ নেতাকে এবং পরেরবার তাঁর পুত্রের অভিন্নহৃদয় বন্ধুকে, শারীরিক কারণে যাঁকে ঘন ঘন চিকিৎসা নিতে ব্যাংককে যেতে হতো। তাঁর মন্ত্রিত্বকালে স্মরণকালের বীভৎস ঘটনা ঘটে একুশে আগস্ট। বিস্ফোরণের দুই ঘণ্টা পরে আমি বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে গিয়ে দূর থেকে দেখতে পাই রক্ত ও শত শত স্যান্ডেল-জুতা। ঢাকা মেডিকেল ও প্রাইভেট হাসপাতালে গিয়ে দেখি আহত ব্যক্তিদের যন্ত্রণায় কাতরানি।
সরকারি দল ও বিরোধী দল যা-ই বলুক, মানুষ দেখতে চায় সত্য উদ্ঘাটিত হোক এবং প্রকৃত অপরাধী ধরা পড়ুক। কিন্তু বাংলার মাটিতে তা যে হবে, সে ভরসা নেই। পাবলিক পারসেপশন বা সাধারণ মানুষের যে ধারণা, তার বাইরে মনগড়া কোনো তত্ত্ব খাড়া করতে চাইলে খুব শক্ত যুক্তি-প্রমাণ থাকা চাই। তা না হলে বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। যাঁরা রাষ্ট্র চালান, তাঁরা যদি জনগণের বিশ্বাসযোগ্যতা হারান, তা খুব বড় ক্ষতি।
দুই বিদেশির হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই গাইবান্ধায় এক শিশু গুলিতে নিহত হতে হতেও প্রাণে বেঁচে গেছে। লিমনের মতো তাকেও পা খোয়াতে হয় কি না বলা যায় না। শিশু রাজনকে হত্যা করেছিল উচ্ছৃঙ্খল জনতা। কিন্তু গাইবান্ধার সৌরভকে হত্যা করতে গিয়েছিলেন সরকারি দলের সাংসদ। ‘তুই জামায়াত-শিবির করিস, তোরে মারি ফেলব’—এ কথা বলে গুলি চালান অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল গণতন্ত্রের পরাকাষ্ঠা আমাদের মাননীয়। পুলিশ হয়তো মাননীয়কে গা–ঢাকা দিতে বা পালিয়ে যেতে পূর্ণ সহায়তা দিয়ে থাকবে। জনগণ দেখতে চায় যুবলীগ নেতা ইব্রাহিম হত্যাকাণ্ড থেকে যে প্রক্রিয়ায় এক মাননীয়কে পুলিশ বাঁচিয়ে দিয়েছে, সৌরভকে যিনি গুলি করেছেন, তিনি যেন সেভাবে দায়মুক্তি না পান।
আমরা যতই বলি বাংলাদেশ একটি মোটামুটি শান্তিপূর্ণ দেশ, ততই কয়েকজন নেতা প্রচার করেন বিরোধী দলের পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে জঙ্গি গিজগিজ করছে। শত্রুর মুখে শুধু কালি মাখাতে গিয়ে নিজের মুখে চুন ও কালি দুটোই মাখাতে পছন্দ করে বাঙালি। আমাদের যে আর্থসামাজিক উন্নতি হয়েছে, তাতে বিদেশিদের ভূমিকা বিরাট। আজ খুনখারাবির কারণে তাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হলে উন্নয়ন ব্যাহত হবে। ভুলে গেলে চলবে না, সোয়া কোটি বাংলাদেশি বাস করে বিভিন্ন দেশে। দেশের বিরুদ্ধে বা সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হতেই পারে। তবে কোথায়, কারা, কী ধরনের ষড়যন্ত্র করছে, তা সভা-সমাবেশে বলাবলি না করে তথ্য-প্রমাণসহ জনগণকে জানানোই সরকারের দায়িত্ব। মুখের কথায় চিড়া ভেজে না। দেশবাসী ও বিদেশিরা সরকারের যথাযথ ভূমিকা দেখতে চায়, শুধু মুখের কথা শুনতে চায় না।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments