জননিরাপত্তার প্রথম দায়িত্ব রাষ্ট্রেরই by ইশফাক ইলাহী চৌধুরী
দুই
বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনাটি দেশে-বিদেশে আলোচিত। নাগরিক নিরাপত্তার
সঙ্গে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটিও সামনে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে প্রকাশ
করা হলো নিরাপত্তা বিশ্লেষক আশফাক ইলাহী চৌধুরীর বিশ্লেষণ বাংলাদেশে
সম্প্রতি দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হয়েছেন। এ ঘটনায় জনমনে যথেষ্ট উদ্বেগ ও
উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা ইতিপূর্বে ঘটেনি। এখানে
রাজনৈতিক সহিংসতা হয়েছে, পেট্রলবোমায় পুড়ে মানুষ মারা গেছে, কিন্তু খুব
কম ক্ষেত্রেই বিদেশিরা আক্রান্ত হয়েছে। প্রথম ঘটনার পর মনে হয়েছিল, সেটা
হয়তো বিচ্ছিন্ন ব্যাপার, ব্যক্তিগত বা পেশাগত কারণে এ খুন হয়ে থাকতে পারে।
কিন্তু দ্বিতীয় খুনের পর ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। আমরা বুঝতে পারি,
ঘটনা দুটির মধ্যে যোগসূত্র আছে। হামলাকারীরা অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে দুটি
হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস দুটি হত্যাকাণ্ডেরই দায় স্বীকার করেছে। তবে আসল ব্যাপার কী, সেটা আমরা এখনো জানি না। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইএসের দাবির ভিত্তি পাওয়া যায়নি। আবার অনেক বাংলাদেশি তরুণ আইএসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সংগঠনটিতে যোগ দিয়েছে, এমন খবরও আমরা পেয়েছি।
আবার বছরের শুরুর দিকে যারা রাজনৈতিক সহিংসতা করেছে, তাদের মধ্যকার একটি বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীও এ কাজ করে থাকতে পারে। যেহেতু দেশে এখন রাজনৈতিক উত্তেজনা নেই বা তারা কিছু করতে পারছে না, সে কারণে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতেও তারা এ কাজ করে থাকতে পারে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, যাদের সাধারণভাবে নিশানা হওয়ার কথা নয়, তারাই কিন্তু নিশানা হচ্ছে। এতে যেমন হত্যাকারীরা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, তেমনি নির্বিঘ্ন থাকতে পারছে। কারণ, হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের নিরাপত্তা থাকে, তাদের খুন করতে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার তেমন কাউকে হত্যা করা সম্ভব হলেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতায় অপরাধীদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সাধারণ মানুষকে হত্যা করলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা অতটা তৎপর হবে না, যেমনটা তারা হবে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
এ দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উন্নয়ন সংস্থাগুলো রাতারাতি এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবে, তা নয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এ কারণে দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে, আন্তর্জাতিক পরিসরে নেতিবাচক প্রভাব অনুভূত হবে। সে কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের তদন্ত করা উচিত। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন মানুষ হত্যার দৃষ্টান্ত দেখা যায়—এ কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। আমাদের নিজেদের ঘর গোছাতে হবে, তা না হলে আমরা মুখ দেখাতে পারব না।
একটি ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন হয়েছি। দুটি হত্যাকাণ্ডের পরই দেখা গেল, জনসাধারণ এ ব্যাপারে তেমন এগিয়ে আসছে না। প্রত্যক্ষদর্শীরাও তেমন একটা তথ্য দিচ্ছে না, অন্যরাও কিছু বলছে না।
কিন্তু এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, স্রেফ গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে চলবে না। জনগণকে যুক্ত করার জন্য সরকার ও গণমাধ্যমকে উদ্যোগ নিতে হবে, তারা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। পাড়া-মহল্লায় নতুন বা সন্দেহজনক কেউ এল কি না বা কেউ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছে কি না, সে খবর মানুষ যদি আগেভাগেই পুলিশকে দেয়, তাহলে অপরাধ প্রতিরোধ করাও সম্ভব হবে।
একই সঙ্গে অতীতের সব সন্ত্রাসী হামলার বিচার করতে হবে। বিচার না হলে অপরাধীরা ভরসা পায়, অপরাধ করে নির্বিঘ্নে থাকা যায়। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। কারণ বিরোধী দলেরও দায়িত্ব আছে, শুধু সমালোচনা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ হতে পারে না। একইভাবে এখন তথ্যপ্রযুক্তির যে উন্নতি ঘটেছে, তাতে সরকার এ কথা বলে পার পেতে পারে না যে তারা তদন্তের কূলকিনারা করতে পারছে না। সে কথা বললে বিশ্ব সম্প্রদায় মেনে নেবে না। যেমন: থাইল্যান্ডে বোমা হামলার পর আমরা দেখলাম, তারা সিসিটিভির ফুটেজ থেকে সন্দেহভাজন হামলাকারীকে শনাক্ত করার পর তার গতিবিধি নজরদারি করে শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তারও করে ফেলল। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব।
বড় কথা হলো, এ দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হলো। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজই হলো জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া বা রক্ষা করা, সেটা যেমন বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে, তেমনি অভ্যন্তরীণ শত্রুর আক্রমণ থেকেও। হিসাব করলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রের বাজেটের বড় অংশই যাচ্ছে জননিরাপত্তায়। ফলে এত টাকা ব্যয় করার পরও জনগণের নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা যাবে না, সে প্রশ্ন আমাদের তুলতে হবে।
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর।
আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস দুটি হত্যাকাণ্ডেরই দায় স্বীকার করেছে। তবে আসল ব্যাপার কী, সেটা আমরা এখনো জানি না। কিন্তু এখন পর্যন্ত আইএসের দাবির ভিত্তি পাওয়া যায়নি। আবার অনেক বাংলাদেশি তরুণ আইএসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সংগঠনটিতে যোগ দিয়েছে, এমন খবরও আমরা পেয়েছি।
আবার বছরের শুরুর দিকে যারা রাজনৈতিক সহিংসতা করেছে, তাদের মধ্যকার একটি বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীও এ কাজ করে থাকতে পারে। যেহেতু দেশে এখন রাজনৈতিক উত্তেজনা নেই বা তারা কিছু করতে পারছে না, সে কারণে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিতেও তারা এ কাজ করে থাকতে পারে। একটি বিষয় লক্ষণীয়, যাদের সাধারণভাবে নিশানা হওয়ার কথা নয়, তারাই কিন্তু নিশানা হচ্ছে। এতে যেমন হত্যাকারীরা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে, তেমনি নির্বিঘ্ন থাকতে পারছে। কারণ, হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের নিরাপত্তা থাকে, তাদের খুন করতে গেলে ধরা পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার তেমন কাউকে হত্যা করা সম্ভব হলেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তৎপরতায় অপরাধীদের ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সাধারণ মানুষকে হত্যা করলে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থা অতটা তৎপর হবে না, যেমনটা তারা হবে হাই প্রোফাইল ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে।
এ দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় উন্নয়ন সংস্থাগুলো রাতারাতি এখান থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাবে, তা নয়। কিন্তু নিশ্চিতভাবেই এ কারণে দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে, আন্তর্জাতিক পরিসরে নেতিবাচক প্রভাব অনুভূত হবে। সে কারণে দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমাদের তদন্ত করা উচিত। পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন মানুষ হত্যার দৃষ্টান্ত দেখা যায়—এ কথা বলে পার পাওয়া যাবে না। আমাদের নিজেদের ঘর গোছাতে হবে, তা না হলে আমরা মুখ দেখাতে পারব না।
একটি ব্যাপারে আমরা উদ্বিগ্ন হয়েছি। দুটি হত্যাকাণ্ডের পরই দেখা গেল, জনসাধারণ এ ব্যাপারে তেমন এগিয়ে আসছে না। প্রত্যক্ষদর্শীরাও তেমন একটা তথ্য দিচ্ছে না, অন্যরাও কিছু বলছে না।
কিন্তু এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিহত করতে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, স্রেফ গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর নির্ভর করলে চলবে না। জনগণকে যুক্ত করার জন্য সরকার ও গণমাধ্যমকে উদ্যোগ নিতে হবে, তারা জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। পাড়া-মহল্লায় নতুন বা সন্দেহজনক কেউ এল কি না বা কেউ নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছে কি না, সে খবর মানুষ যদি আগেভাগেই পুলিশকে দেয়, তাহলে অপরাধ প্রতিরোধ করাও সম্ভব হবে।
একই সঙ্গে অতীতের সব সন্ত্রাসী হামলার বিচার করতে হবে। বিচার না হলে অপরাধীরা ভরসা পায়, অপরাধ করে নির্বিঘ্নে থাকা যায়। সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। কারণ বিরোধী দলেরও দায়িত্ব আছে, শুধু সমালোচনা করেই তাদের দায়িত্ব শেষ হতে পারে না। একইভাবে এখন তথ্যপ্রযুক্তির যে উন্নতি ঘটেছে, তাতে সরকার এ কথা বলে পার পেতে পারে না যে তারা তদন্তের কূলকিনারা করতে পারছে না। সে কথা বললে বিশ্ব সম্প্রদায় মেনে নেবে না। যেমন: থাইল্যান্ডে বোমা হামলার পর আমরা দেখলাম, তারা সিসিটিভির ফুটেজ থেকে সন্দেহভাজন হামলাকারীকে শনাক্ত করার পর তার গতিবিধি নজরদারি করে শেষ পর্যন্ত তাকে গ্রেপ্তারও করে ফেলল। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি দিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভব।
বড় কথা হলো, এ দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিয়ে কথা বলার সুযোগ সৃষ্টি হলো। রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান কাজই হলো জনগণকে নিরাপত্তা দেওয়া বা রক্ষা করা, সেটা যেমন বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে, তেমনি অভ্যন্তরীণ শত্রুর আক্রমণ থেকেও। হিসাব করলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রের বাজেটের বড় অংশই যাচ্ছে জননিরাপত্তায়। ফলে এত টাকা ব্যয় করার পরও জনগণের নিরাপত্তা কেন নিশ্চিত করা যাবে না, সে প্রশ্ন আমাদের তুলতে হবে।
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমোডর।
No comments