ইরানি চলচ্চিত্র মুহাম্মদ (সা.)- আকাশ থেকে যেন ভেসে আসে ঐশী বাণী by সিরাজুল ইসলাম
খ্যাতনামা
সিনেমা পরিচালক মাজিদ মাজিদির ইতিহাসনির্ভর সিনেমা ‘মুহাম্মদ (সা.)’
সগৌরবে চলছে ইরানের সিনেমা হলগুলোতে। দিন যত যাচ্ছে ততই যেন সিনেমা
হলগুলোতে দর্শক সমাগম বাড়ছে। এরই মধ্যে কেউ কেউ কয়েকবার করে সিনেমাটি
দেখেছেন। এ সিনেমার মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ইসলামের শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ
(সা.)-এর আগমনের সময়কালের চিত্রটা একেবারে জীবন্ত করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
পরিচালক, অভিনয় শিল্পী এবং কলাকুশলীরা তাদের দক্ষতা ও সুনিপুণ অভিনয় দিয়ে
দর্শকদের সেই দেড় হাজার বছর আগের আরবের পরিবেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম
হয়েছেন। এ সিনেমায় দেড় হাজার বছর আগের আরবের চিত্র অসম্ভব দক্ষতার সঙ্গে
ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ছবিটি যে বাণিজ্যিকভাবে সফল হবে তা বলার অপেক্ষাই রাখে
না।
সিনেমার ঘটনাপ্রবাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও তার চরিত্রে অভিনয়কারী শিশুটির মুখমণ্ডল দেখানো হয়নি। এমনকি যে শিশুটি মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্রে অভিনয় করেছে তার নামও দেখানো হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সিনেমাটি দেখার সময় রাসূল (সা.)-কে দেখার একটা অদম্য বাসনা জাগে। তার দুনিয়াতে আসা, মা আমিনার কোলে ধারণ, দুধ মা হালিমার কাছে দেয়া, দাদা আবদুল মুত্তালিবের নিবিড় স্নেহ, আরবের খেজুর বাগানে ছাগল চরানো, চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বাণিজ্য কাফেলায় তখনকার শ্যাম দেশে (আজকের সিরিয়া) গমন- এসবই যেন বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে। রাসূল (সা.)-এর বাল্যবেলার বেশকিছু মোজেজাও দেখানো হয়েছে এ ছবিতে। ছবির কিছু কিছু দৃশ্য এমন জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছেন শিল্পীরা তাতে বারবার দর্শকের চোখ ভিজে যায়। সিনেমার কোথাও কোথাও অভিনয় শিল্পীদের চরিত্রগুলো এমনভাবে ফুটে উঠছে তাতে আবেগ-আপ্লুত না হয়ে উপায় নেই। মুহাম্মদ (সা.) ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে অসম্ভব নিপুণভাবে শিল্পীরা দর্শকদের নিয়ে গেছেন সেই আরব সমাজে যেখানে জাহেলিয়াত জেঁকে বসেছিল ভয়াবহভাবে। আর কথায় কথায় আরব লোকজনের তলোয়ার বেরিয়ে আসত খাপ থেকে। আবরাহার হস্তিবাহিনীর চরম পরাজয় আলাদা উৎসাহের উদ্রেক করে বটে।
এ সিনেমায় রাসূল (সা.) চরিত্রে অভিনয়কারী শিশুর মুখমণ্ডল দেখানো হয়নি। তবে তার হাত, পা দেখানো হয়েছে। এছাড়া পূর্ণাঙ্গভাবে দেখানোর সময় পেছন থেকে কিংবা পাশ থেকে দেখানো হয়েছে; কোথায়ও মুখ দেখা যায়নি। তবে সিনেমাতে আবদুল মোত্তালিব, আবু তালিব, রাসূল (সা.) এর মা আমিনা, দুধ মা হালিমা, আবু সুফিয়ান এবং আবু লাহাবসহ তৎকালীন কুরাইশ ও আরব নেতাদের চরিত্রে অভিনয়কারী ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে দেখানো হয়েছে।
মুহাম্মদ (সা.) ছবিতে রাসূল (সা.)-এর বাল্যবেলার ১৩ বছর সময়কালের ঘটনাবলি ফুটে উঠছে। পাঠকদের হয়ত জানতে ইচ্ছে করছে কেমন হয়েছে রাসূল (সা.) চরিত্রে শিশু শিল্পীর অভিনয়? সত্যি বলতে কী- সিনেমাটি দেখলে মনে হবে যেন সত্যিকারের রাসূল (সা.)কে দেখছি। বারবার তার মুখটি দেখতে ইচ্ছে করবে।
রাসূল (সা.)-এর মা অর্থাৎ আমিনার চরিত্রে অভিনয়কারী মিনা সাদাতিকে মনে হবে তিনিই যেন সত্যিকারের মা। দাদা আবদুল মুত্তালিব আর চাচা আবু তালিবের অফুরন্ত স্নেহ-ভালবাসা রাসূল (সা.) কে সর্বক্ষণ ঘিরে রাখে।
মুহাম্মদ (সা.) সিনেমাটি দেখলে দেড় হাজার বছর আগের কাবা ঘর কেমন ছিল তারও একটা রূপকল্প পাওয়া যায়। খানিকটা এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে দেয়ালে তৈরি কাবা ঘর। ভেতরে এবং বাইরে বহুসংখ্যক মূর্তি। আশপাশে কাঠের খুঁটিতে নির্মিত ছোট ছোট ঘর। হজের সময় তখনও কাবা ঘর ধোয়ামোছার কাজ চলতো তা দেখানো হয়েছে। রাসূল (সা.) নিজেও দাদা আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে কাজে অংশ নেন। হজের তাওয়াফ করতে গিয়েই একপর্যায়ে আবদুল মুত্তালিব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরে ইন্তিকাল করেন। শিশু মুহাম্মদ (সা.)কে তুলে দিয়ে যান ছেলে আবু তালিবের কাছে। আবু লাহাব রাসূল (সা.)-এর দায়িত্ব নিতে চাইলেও তা দেননি আবদুল মুত্তালিব। ছবিতে দেখা যায় কয়েক বছরের মধ্যে কাবা ঘরের ডিজাইন কিছুটা পাল্টেছে। পাথরের এবড়ো-থেবড়ো দেয়ালের পরিবর্তে মসৃণ কালো পাথরের দেয়াল।
ছবিতে দুধ মা হালিমার কাছে তুলে দেয়া, আবার মায়ের কাছে ফিরে আসা, মা আমিনার সঙ্গে ইয়াসরিব বা মদিনায় নানাবাড়ি যাওয়া, রাসূল (রা.) এবং আমিনাকে সেখানে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ, ফেরার পথে মাকে হারানো, অসুস্থ রাসূল (সা.)কে হত্যার জন্য ইহুদিদের হামলা এবং সেখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ- সবই ফুটে উঠেছে অসম্ভব নিপুণতায়।
সিনেমার শুরুটা হয় ‘শোয়াবে আবু তালিব উপত্যকা’য় মুসলমানদের অবরুদ্ধ জীবনের দুঃখ-কষ্টের চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে। কুরাইশদের নির্যাতনমূলক চুক্তির ফলে মুসলমানরা নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করে আবু তালিব উপত্যকায়। সে সময় বিবি খাদিজা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের সহযোগিতা করেছেন। তবে এ সিনেমায় হযরত খাদিজাকে (রা.) অবশ্য কখনও দেখানো হয়নি।
শোয়াবে আবু তালিবের ঘটনাপ্রবাহ ২০ মিনিট দেখানো হলেও রাসূল (সা.)কে একবারও দেখানো হয়নি। একপর্যায়ে পবিত্র কুরআনের সূরা ফিলে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহ দেখানো হয়। আবিসিনিয়ার বাদশাহ আবরাহার হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ ও আবাবিল পাখি দিয়ে পাথর মারার মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিরোধ চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আবরাহার পতনের প্রায় দুমাস পর রাসূল (সা.)-এর জন্ম হয়। জন্মের সময়কার কিছু অলৌকিক ঘটনা, মুহাম্মদ (সা.)এর বিরুদ্ধে ইহুদিদের চক্রান্ত ও হত্যাপ্রচেষ্টা, তখনকার আরবে কন্যাশিশুকে জীবন্ত হত্যা, শিশু বলিদানের বিরুদ্ধে শিশু মুহাম্মদ (সা.) এর অবস্থান, দাস প্রথা, দাস মুক্তির বিষয়ে মুহাম্মদ (সা.)-এর ভূমিকা, খ্রিষ্টান পাদ্রী বুহাইরার সঙ্গে রাসূল (সা.) এর সাক্ষাৎ, বুহাইরা কর্তৃক রাসূল (সা.)কে শনাক্ত করা, বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ায় যাওয়ার দৃশ্য এবং রাসূল (সা.) এর ওপর মেঘের আবরণ এসব ঘটনাই আবিষ্ট করে তোলে দর্শককে। মাঝে মাঝেই নেপথ্য কণ্ঠে পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত- মনে হয় যেন আসমান থেকে নেমে আসছে ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআন।
সিনেমার শেষাংশে আবারো শোয়াবে আবু তালিবের ঘটনা দেখানো হয়েছে যেখানে দেখা যায়, মক্কার কুরাইশরা বনু হাশিম গোত্রের সঙ্গে যে নির্যাতনমূলক চুক্তি করেছিল সেই চুক্তির দলিল পোকায় খেয়ে ফেলেছে। ফলে চুক্তি বাতিল হয়ে যায় এবং নির্বাসিত বা অবরুদ্ধ মুসলমানরা মুক্তি পায়। মুভিটি শেষ হয়েছে অস্কার পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় সুরকার এ আর রহমানের কম্পোজ করা একটি নাতে রসূল দিয়ে।
চলচ্চিত্র মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে নির্মিতব্য ট্রাইলজি বা তিনখণ্ডের ছায়াছবির প্রথম খণ্ড। এতে মহানবী (সা.)-এর মক্কার জীবনালেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৭১ মিনিটের এ ছায়াছবি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছে। ইরানের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ ছবি নির্মাণে সাড়ে পাঁচ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। মোহাম্মদ মাহদি হায়দারিয়ান প্রযোজিত এ ছবির চিত্র ধারণ করা হয়েছে ইরান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শহর বেলা-বেলাতে।
ছায়াছবিতে মহানবী (সা.)-কে তুলে ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরি স্টেডিক্যাম ব্যবহার করা হয়। চলচ্চিত্রটির যে দৃশ্যেই রাসূল (সা.)-কে দেখানো হয়েছে সেখানেই দৃশ্যটি নবীর দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ চলচ্চিত্রের ভাষায় ক্যারেক্টারস পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখানো হয়েছে। এমনকি নবীজির শৈশবের দৃশ্যও এভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। কানাডার মন্ট্রিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও তিন ঘণ্টার পূর্ণদৈর্ঘ্য এ ছায়াছবি দেখানো হয়েছে।
ছবিটি নির্মাণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা সহযোগিতা করেছেন। এতে কাজ করেছেন ইতালির তিনবারের অস্কারজয়ী সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো, ইতালির ফিল্ম এডিটর রোবাতো পেরপিগানি, মার্কিন স্পেশাল এফেক্ট শিল্পী স্কট ই অ্যান্ডারসন, ইতালির মেকআপ আর্টিস্ট গিয়ানেত্তো ডি রোসি এবং ভারতীয় প্রখ্যাত সুরকার আল্লা রাখা রহমান (এ আর রহমান)।
মুহাম্মদ (সা.) চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনটি শিশু। ছয় বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আলী রেজা জালিলি, আট বছর বয়সে হোসেইন জালালি এবং ১৩ বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আমির হায়দারি।
এছাড়া, মা আমিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মিনা সাদাতি, দাদা আবদুল মুত্তালিব-আলী রেজা সুজা নুরি, চাচা আবু তালিব- মাহদি পাকদেল, আবু লাহাব- মুহাম্মাদ আসগরী, আবু লাহাবের স্ত্রী জামিলা- রানা আজাদিভার এবং হামযা চরিত্রে অভিনয় করেছেন হামিদ রেজা দৌলতি। এছাড়া হালিমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সারেহ বাইয়াত।
সিনেমার ঘটনাপ্রবাহ হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও তার চরিত্রে অভিনয়কারী শিশুটির মুখমণ্ডল দেখানো হয়নি। এমনকি যে শিশুটি মুহাম্মদ (সা.)-এর চরিত্রে অভিনয় করেছে তার নামও দেখানো হয়নি। তবে সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সিনেমাটি দেখার সময় রাসূল (সা.)-কে দেখার একটা অদম্য বাসনা জাগে। তার দুনিয়াতে আসা, মা আমিনার কোলে ধারণ, দুধ মা হালিমার কাছে দেয়া, দাদা আবদুল মুত্তালিবের নিবিড় স্নেহ, আরবের খেজুর বাগানে ছাগল চরানো, চাচা আবু তালিবের সঙ্গে বাণিজ্য কাফেলায় তখনকার শ্যাম দেশে (আজকের সিরিয়া) গমন- এসবই যেন বাস্তব হয়ে ফুটে ওঠে। রাসূল (সা.)-এর বাল্যবেলার বেশকিছু মোজেজাও দেখানো হয়েছে এ ছবিতে। ছবির কিছু কিছু দৃশ্য এমন জীবনঘনিষ্ঠ করে তুলেছেন শিল্পীরা তাতে বারবার দর্শকের চোখ ভিজে যায়। সিনেমার কোথাও কোথাও অভিনয় শিল্পীদের চরিত্রগুলো এমনভাবে ফুটে উঠছে তাতে আবেগ-আপ্লুত না হয়ে উপায় নেই। মুহাম্মদ (সা.) ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে অসম্ভব নিপুণভাবে শিল্পীরা দর্শকদের নিয়ে গেছেন সেই আরব সমাজে যেখানে জাহেলিয়াত জেঁকে বসেছিল ভয়াবহভাবে। আর কথায় কথায় আরব লোকজনের তলোয়ার বেরিয়ে আসত খাপ থেকে। আবরাহার হস্তিবাহিনীর চরম পরাজয় আলাদা উৎসাহের উদ্রেক করে বটে।
এ সিনেমায় রাসূল (সা.) চরিত্রে অভিনয়কারী শিশুর মুখমণ্ডল দেখানো হয়নি। তবে তার হাত, পা দেখানো হয়েছে। এছাড়া পূর্ণাঙ্গভাবে দেখানোর সময় পেছন থেকে কিংবা পাশ থেকে দেখানো হয়েছে; কোথায়ও মুখ দেখা যায়নি। তবে সিনেমাতে আবদুল মোত্তালিব, আবু তালিব, রাসূল (সা.) এর মা আমিনা, দুধ মা হালিমা, আবু সুফিয়ান এবং আবু লাহাবসহ তৎকালীন কুরাইশ ও আরব নেতাদের চরিত্রে অভিনয়কারী ব্যক্তিদের প্রকাশ্যে দেখানো হয়েছে।
মুহাম্মদ (সা.) ছবিতে রাসূল (সা.)-এর বাল্যবেলার ১৩ বছর সময়কালের ঘটনাবলি ফুটে উঠছে। পাঠকদের হয়ত জানতে ইচ্ছে করছে কেমন হয়েছে রাসূল (সা.) চরিত্রে শিশু শিল্পীর অভিনয়? সত্যি বলতে কী- সিনেমাটি দেখলে মনে হবে যেন সত্যিকারের রাসূল (সা.)কে দেখছি। বারবার তার মুখটি দেখতে ইচ্ছে করবে।
রাসূল (সা.)-এর মা অর্থাৎ আমিনার চরিত্রে অভিনয়কারী মিনা সাদাতিকে মনে হবে তিনিই যেন সত্যিকারের মা। দাদা আবদুল মুত্তালিব আর চাচা আবু তালিবের অফুরন্ত স্নেহ-ভালবাসা রাসূল (সা.) কে সর্বক্ষণ ঘিরে রাখে।
মুহাম্মদ (সা.) সিনেমাটি দেখলে দেড় হাজার বছর আগের কাবা ঘর কেমন ছিল তারও একটা রূপকল্প পাওয়া যায়। খানিকটা এবড়ো-খেবড়ো পাথুরে দেয়ালে তৈরি কাবা ঘর। ভেতরে এবং বাইরে বহুসংখ্যক মূর্তি। আশপাশে কাঠের খুঁটিতে নির্মিত ছোট ছোট ঘর। হজের সময় তখনও কাবা ঘর ধোয়ামোছার কাজ চলতো তা দেখানো হয়েছে। রাসূল (সা.) নিজেও দাদা আবদুল মুত্তালিবের সঙ্গে কাজে অংশ নেন। হজের তাওয়াফ করতে গিয়েই একপর্যায়ে আবদুল মুত্তালিব অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পরে ইন্তিকাল করেন। শিশু মুহাম্মদ (সা.)কে তুলে দিয়ে যান ছেলে আবু তালিবের কাছে। আবু লাহাব রাসূল (সা.)-এর দায়িত্ব নিতে চাইলেও তা দেননি আবদুল মুত্তালিব। ছবিতে দেখা যায় কয়েক বছরের মধ্যে কাবা ঘরের ডিজাইন কিছুটা পাল্টেছে। পাথরের এবড়ো-থেবড়ো দেয়ালের পরিবর্তে মসৃণ কালো পাথরের দেয়াল।
ছবিতে দুধ মা হালিমার কাছে তুলে দেয়া, আবার মায়ের কাছে ফিরে আসা, মা আমিনার সঙ্গে ইয়াসরিব বা মদিনায় নানাবাড়ি যাওয়া, রাসূল (রা.) এবং আমিনাকে সেখানে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ, ফেরার পথে মাকে হারানো, অসুস্থ রাসূল (সা.)কে হত্যার জন্য ইহুদিদের হামলা এবং সেখানে প্রতিরোধ যুদ্ধ- সবই ফুটে উঠেছে অসম্ভব নিপুণতায়।
সিনেমার শুরুটা হয় ‘শোয়াবে আবু তালিব উপত্যকা’য় মুসলমানদের অবরুদ্ধ জীবনের দুঃখ-কষ্টের চিত্র তুলে ধরার মাধ্যমে। কুরাইশদের নির্যাতনমূলক চুক্তির ফলে মুসলমানরা নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করে আবু তালিব উপত্যকায়। সে সময় বিবি খাদিজা বিভিন্নভাবে মুসলমানদের সহযোগিতা করেছেন। তবে এ সিনেমায় হযরত খাদিজাকে (রা.) অবশ্য কখনও দেখানো হয়নি।
শোয়াবে আবু তালিবের ঘটনাপ্রবাহ ২০ মিনিট দেখানো হলেও রাসূল (সা.)কে একবারও দেখানো হয়নি। একপর্যায়ে পবিত্র কুরআনের সূরা ফিলে বর্ণিত ঘটনাপ্রবাহ দেখানো হয়। আবিসিনিয়ার বাদশাহ আবরাহার হস্তিবাহিনী নিয়ে মক্কা আক্রমণ ও আবাবিল পাখি দিয়ে পাথর মারার মাধ্যমে তাদেরকে প্রতিরোধ চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আবরাহার পতনের প্রায় দুমাস পর রাসূল (সা.)-এর জন্ম হয়। জন্মের সময়কার কিছু অলৌকিক ঘটনা, মুহাম্মদ (সা.)এর বিরুদ্ধে ইহুদিদের চক্রান্ত ও হত্যাপ্রচেষ্টা, তখনকার আরবে কন্যাশিশুকে জীবন্ত হত্যা, শিশু বলিদানের বিরুদ্ধে শিশু মুহাম্মদ (সা.) এর অবস্থান, দাস প্রথা, দাস মুক্তির বিষয়ে মুহাম্মদ (সা.)-এর ভূমিকা, খ্রিষ্টান পাদ্রী বুহাইরার সঙ্গে রাসূল (সা.) এর সাক্ষাৎ, বুহাইরা কর্তৃক রাসূল (সা.)কে শনাক্ত করা, বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে সিরিয়ায় যাওয়ার দৃশ্য এবং রাসূল (সা.) এর ওপর মেঘের আবরণ এসব ঘটনাই আবিষ্ট করে তোলে দর্শককে। মাঝে মাঝেই নেপথ্য কণ্ঠে পবিত্র কুরআনের কিছু আয়াত- মনে হয় যেন আসমান থেকে নেমে আসছে ঐশী গ্রন্থ আল-কুরআন।
সিনেমার শেষাংশে আবারো শোয়াবে আবু তালিবের ঘটনা দেখানো হয়েছে যেখানে দেখা যায়, মক্কার কুরাইশরা বনু হাশিম গোত্রের সঙ্গে যে নির্যাতনমূলক চুক্তি করেছিল সেই চুক্তির দলিল পোকায় খেয়ে ফেলেছে। ফলে চুক্তি বাতিল হয়ে যায় এবং নির্বাসিত বা অবরুদ্ধ মুসলমানরা মুক্তি পায়। মুভিটি শেষ হয়েছে অস্কার পুরস্কার বিজয়ী ভারতীয় সুরকার এ আর রহমানের কম্পোজ করা একটি নাতে রসূল দিয়ে।
চলচ্চিত্র মুহাম্মদ (সা.) হচ্ছে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে নির্মিতব্য ট্রাইলজি বা তিনখণ্ডের ছায়াছবির প্রথম খণ্ড। এতে মহানবী (সা.)-এর মক্কার জীবনালেখ্য তুলে ধরা হয়েছে। ১৭১ মিনিটের এ ছায়াছবি নির্মাণে সাত বছর সময় লেগেছে। ইরানের সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ ছবি নির্মাণে সাড়ে পাঁচ কোটি ডলার ব্যয় হয়েছে। মোহাম্মদ মাহদি হায়দারিয়ান প্রযোজিত এ ছবির চিত্র ধারণ করা হয়েছে ইরান এবং দক্ষিণ আফ্রিকার শহর বেলা-বেলাতে।
ছায়াছবিতে মহানবী (সা.)-কে তুলে ধরার জন্য বিশেষভাবে তৈরি স্টেডিক্যাম ব্যবহার করা হয়। চলচ্চিত্রটির যে দৃশ্যেই রাসূল (সা.)-কে দেখানো হয়েছে সেখানেই দৃশ্যটি নবীর দৃষ্টিভঙ্গি অর্থাৎ চলচ্চিত্রের ভাষায় ক্যারেক্টারস পয়েন্ট অব ভিউ থেকে দেখানো হয়েছে। এমনকি নবীজির শৈশবের দৃশ্যও এভাবে চিত্রায়িত হয়েছে। কানাডার মন্ট্রিল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবেও তিন ঘণ্টার পূর্ণদৈর্ঘ্য এ ছায়াছবি দেখানো হয়েছে।
ছবিটি নির্মাণে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বরা সহযোগিতা করেছেন। এতে কাজ করেছেন ইতালির তিনবারের অস্কারজয়ী সিনেমাটোগ্রাফার ভিত্তোরিও স্তোরারো, ইতালির ফিল্ম এডিটর রোবাতো পেরপিগানি, মার্কিন স্পেশাল এফেক্ট শিল্পী স্কট ই অ্যান্ডারসন, ইতালির মেকআপ আর্টিস্ট গিয়ানেত্তো ডি রোসি এবং ভারতীয় প্রখ্যাত সুরকার আল্লা রাখা রহমান (এ আর রহমান)।
মুহাম্মদ (সা.) চরিত্রে অভিনয় করেছেন তিনটি শিশু। ছয় বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আলী রেজা জালিলি, আট বছর বয়সে হোসেইন জালালি এবং ১৩ বছর বয়সে অভিনয় করেছেন আমির হায়দারি।
এছাড়া, মা আমিনার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন মিনা সাদাতি, দাদা আবদুল মুত্তালিব-আলী রেজা সুজা নুরি, চাচা আবু তালিব- মাহদি পাকদেল, আবু লাহাব- মুহাম্মাদ আসগরী, আবু লাহাবের স্ত্রী জামিলা- রানা আজাদিভার এবং হামযা চরিত্রে অভিনয় করেছেন হামিদ রেজা দৌলতি। এছাড়া হালিমা চরিত্রে অভিনয় করেছেন সারেহ বাইয়াত।
No comments