মানুষ পরিচয়ই প্রধান পরিচয় by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বাংলার
মাটিতে যেকোনো ব্যাপারে একটা ভজকট বাধবেই। সরলরেখার মতো সোজা এখানে
কিছুই নয়, সবকিছুতেই জিলাপির প্যাঁচ। তা ছাড়া কে আসল আর কে নকল আর কে
ভুয়া, তা নির্ণয় করার সাধ্য বিধাতা ছাড়া কারও নেই। আমরা এত দিন শুনে এসেছি
চাকরি পেতে ঘুষ খুবই ভালো উপায়, এখন শুরু হয়েছে ঘুষের তহবিল গঠন। চাকরি
পাইয়ে দিতে ঘুষ নিয়ে তহবিল গঠন করে শেষ মুহূর্তে মিডিয়ার কারণে ধরা পড়ে এক
পুলিশ অফিসারের চাকরি খোয়ানোর ব্যবস্থা হয়েছে। তবে তাঁর বা তাঁদের কারও
চাকরিই যাবে না বলে দেশের পনেরো আনা মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস। এ মাটিতে
ঘুষ-দুর্নীতি করলেই এবং তা ধরা পড়লেই যদি শাস্তি হতো, তাহলে রাষ্ট্রের
তিন বিভাগের হাজার হাজার পদস্থ কর্মকর্তা নিজেদের প্রকাণ্ড বাড়িতে অথবা
সরকারি কোয়ার্টারে থাকতে পারতেন না। তাঁদের বাস করতে হতো নাজিমুদ্দিন
রোড অথবা কাশিমপুরের পাঁচিলঘেরা বাড়িতে। খেতে হতো সকালে পচা গমের
পুষ্টিকর রুটি এবং দুপুরে কাঁকর মেশানো মোটা চালের ভাত ও লেগুনে চাষ করা
পাঙাশ মাছের ঝোল।
হিজড়াদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার দাবি সমাজসেবীরা করে আসছেন অনেক দিন ধরে। তা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমিও হিজড়াদের প্রশ্নে মানববন্ধন, সমাবেশ বা সেমিনারে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছি। কয়েকটি এনজিও তাঁদের নিয়ে কাজ করছে। সেই সব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে ২০১৪-তে। যোগ্যতা অনুযায়ী হিজড়াদের সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর হিজড়াদের পুনর্বাসন চায়। সে জন্যই দরখাস্ত আহ্বান করা হলো। সব প্রক্রিয়া শেষে ১২ জন মনোনয়নও পেলেন। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেল, এঁরা আসলে হিজড়া নন। ১২ জনই পুরোদস্তুর পুরুষ। হিজড়া সেজে এসেছিলেন।’ [প্রথম আলো, ২ জুলাই] ‘ঢাকার সিভিল সার্জনের দপ্তর তাদের পরীক্ষার রিপোর্টে বলেছে, ওই ১২ জন “পূর্ণাঙ্গ পুরুষ” বলে প্রতীয়মান হয়েছে।’ [কালের কণ্ঠ]
মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়ার পর সমাজসেবা অধিদপ্তর নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। যেকোনো সরকারি চাকরিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা আবশ্যকীয় এবং বাধ্যতামূলক। চোখ, কান, এমনকি যৌনাঙ্গ পর্যন্ত পরীক্ষা করার নিয়ম। হিজড়ার কোটায় চাকরি পেতে হলে আবেদনকারী যে হিজড়া, তার প্রমাণ তো দিতেই হবে। হিজড়াদের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে গিয়ে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ শুরুতেই হোঁচট খেল। বিষয়টি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।
বাংলাদেশে কোন শ্রেণি-পেশায় ভুয়া নেই? ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিবি পুলিশের কথা পত্রিকায় আসে। ভুয়া সাংবাদিক ধরা পড়ার খবর পাওয়া যায়। সম্ভবত এখনো ও রকম অনেক ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, ভুয়া পুলিশ, ভুয়া পরীক্ষার্থী জেলের ভাত খাচ্ছে। ভুয়া ডাক্তারে আজ দেশ সয়লাব।
প্রতারণা যখন জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন যে কেউ যেকোনো কিছু সাজতে পারে। তবে চাকরিবাকরির ক্ষেত্রেই ভুয়াত্বের প্রয়োজন পড়ে বেশি। বেকার যুবক হিজড়া সেজে চাকরি চাইতে গেছেন, সেটা অবশ্যই অন্যায়: কিন্তু ততটা অন্যায় নিশ্চয়ই নয়, যতটা অন্যায় ও অপরাধ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট কিনে সচিবদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো। তফাত হলো এই যে, ধরা পড়ে হিজড়াবেশী যুবকদের চাকরি হয়নি, ওই সচিবেরা প্রতারণা ধরা পড়েও চাকরিতে বহাল ছিলেন বা আছেন। যে দেশে তামা বা পিতলকে খাঁটি সোনা বলে চালালো হয়, সেখানে নকল হিজড়া থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাস্তবতা হলো এই যে পূর্ণাঙ্গ যুবকেরা হিজড়া সেজে চাকরি চাইতে গিয়েছিলেন, কারণ তাঁদের চাকরিটা দরকার।
কোনো প্রাণীই তার জন্মের জন্য নিজে দায়ী নয়। কোনো মানুষও নয়। মাতৃগর্ভ থেকে কে নারী আর কে পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে, সেটা বিধাতার বিষয়। এমনকি কারও মা-বাবারও হাত নেই। প্রকৃতির মর্জিমতোই কেউ পুরুষ, কেউ নারী, কেউ-বা উভলিঙ্গ বা হিজড়া। কেউবা অটিস্টিক। কেউ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কেউ আইনস্টাইনের মতো বুদ্ধিমান। কেউ গ্রিক-রোমান পৌরাণিক বীর হারকিউলিসের মতো শারীরিক শক্তির অধিকারী।
আমার একটি বিনীত প্রস্তাব। সরকার যেমন উদ্যোগ নিয়েছে, তেমনি এনজিও ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও হিজড়াদের নিয়োগ দিয়ে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাজে তাঁদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসবে।
যতটুকু শুনেছি, হিজড়ারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ। তাঁদের কারও শরীরে নারী হরমোন বেশি, কারও শরীরে পুরুষের হরমোন বেশি। তাতে কারও শারীরিক সুস্থতার হেরফের হয় না। হিজড়াদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার একটি সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে তেজগাঁও এলাকায় এক ব্লগারকে দুর্বৃত্তরা খুন করে পালিয়ে যাচ্ছিল। আশপাশে ‘পুরুষ মানুষ’ ছিল অনেকেই। কিন্তু দুজন হিজড়া দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করে পাকড়াও করেন। অতি সাহসী ও সুনাগরিকের কাজ। তাঁদের রাষ্ট্র পুরস্কৃত করেছে, সে খবর পাইনি। ওই কাজটিই যদি গুলশান-বারিধারার বড়লোকদের কোনো ছেলে করতেন, বহু টিভি চ্যানেলের টক শোতে তাঁদের ডাক পড়ত তাঁদের বীরত্বের কাহিনি শোনানোর জন্য। ওই দিন যদি হিজড়াদের সঙ্গে আশপাশের ‘পুরুষেরাও’ যোগ দিত, সব খুনিকে হাতেনাতে ধরা যেত।
বিভিন্ন দেশে আজ হিজড়ারা সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত। বেশ অনেক দিন আগে একটি খবরে দেখেছি, ভারতের উত্তর প্রদেশের বা মধ্যপ্রদেশের কোনো শহরের পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন একজন হিজড়া। পরবর্তীকালে ভারতে আরও অনেক জনপ্রতিনিধি হিজড়াদের থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। এখন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ভারতে হিজড়ারা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন।
উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিলে হিজড়ারা সমাজের যেকোনো মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। খুব দরকার তাঁদের সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসা। যদি তাঁদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাঁদের দিয়ে জাতি উপকৃত হতে পারে। তাঁদের অবহেলা করা চলবে না। তাঁদের জীবিকার সম্মানজনক ব্যবস্থা করে দিলে তাঁরা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবেন না। কেন তাঁরা ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীদের কাছে সাহায্য চাইবেন?
একটি প্রশ্ন অনেকে করেন না, হিজড়ারা কি শুধু নিম্ন আয়ের বাবা-মায়ের ঘরেই জন্ম নেন? উচ্চবিত্ত পরিবারে হিজড়া নেই কেন? ধনী পরিবারে কোনো হিজড়া জন্ম নিলে বাবা-মা তাঁদের সেই সন্তানকে কোনো গরিবকে লালন-পালনের জন্য দিয়ে দেন কি না, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
একজন হিজড়া যদি স্বাভাবিক মানুষের পরিচয়ে পরিচিত হতেন, বলার কিছু থাকত না। তাই তো হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কয়েকজন ‘পূর্ণাঙ্গ পুরুষ’ যখন হিজড়া সেজে চাকরি নিতে গেছেন, তখন সমাজের সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন জাগে। সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ শুরুতেই অশুভ তৎপরতায় বিনষ্ট হয়ে গেল। এরপর শক্তিশালী মেডিকেল বোর্ড দ্বারা হিজড়াদের ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়া কোনো নিয়োগই হবে না।
আমার একটি বিনীত প্রস্তাব। সরকার যেমন উদ্যোগ নিয়েছে, তেমনি এনজিও ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও হিজড়াদের নিয়োগ দিয়ে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাজে তাঁদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসবে।
জীবনই আসল। কেউ নারী, কেউ পুরুষ, কেউ হিজড়া—সেটা গৌণ। নাগরিক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হিজড়াদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। নারী ও পুরুষ, অহিজড়া ও হিজড়া—সবারই প্রধান ও একমাত্র পরিচয় হোক তাঁরা মানুষ। মানুষের অধিকার সব মানবসন্তানকেই ভোগ করতে দিতে হবে। সে অধিকার থেকে কোনো নারী, পুরুষ বা হিজড়াকেই বঞ্চিত করা যাবে না। মানুষের মর্যাদা নারী, পুরুষ, হিজড়ার সমান প্রাপ্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
হিজড়াদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করার দাবি সমাজসেবীরা করে আসছেন অনেক দিন ধরে। তা নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আমিও হিজড়াদের প্রশ্নে মানববন্ধন, সমাবেশ বা সেমিনারে সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছি। কয়েকটি এনজিও তাঁদের নিয়ে কাজ করছে। সেই সব দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকার একটি ভালো উদ্যোগ নিয়েছে ২০১৪-তে। যোগ্যতা অনুযায়ী হিজড়াদের সরকারি চাকরি দেওয়া হবে। ‘সমাজসেবা অধিদপ্তর হিজড়াদের পুনর্বাসন চায়। সে জন্যই দরখাস্ত আহ্বান করা হলো। সব প্রক্রিয়া শেষে ১২ জন মনোনয়নও পেলেন। কিন্তু ডাক্তারি পরীক্ষায় দেখা গেল, এঁরা আসলে হিজড়া নন। ১২ জনই পুরোদস্তুর পুরুষ। হিজড়া সেজে এসেছিলেন।’ [প্রথম আলো, ২ জুলাই] ‘ঢাকার সিভিল সার্জনের দপ্তর তাদের পরীক্ষার রিপোর্টে বলেছে, ওই ১২ জন “পূর্ণাঙ্গ পুরুষ” বলে প্রতীয়মান হয়েছে।’ [কালের কণ্ঠ]
মেডিকেল রিপোর্ট পাওয়ার পর সমাজসেবা অধিদপ্তর নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্থগিত করেছে। এবং সেটাই স্বাভাবিক। যেকোনো সরকারি চাকরিতে স্বাস্থ্য পরীক্ষা আবশ্যকীয় এবং বাধ্যতামূলক। চোখ, কান, এমনকি যৌনাঙ্গ পর্যন্ত পরীক্ষা করার নিয়ম। হিজড়ার কোটায় চাকরি পেতে হলে আবেদনকারী যে হিজড়া, তার প্রমাণ তো দিতেই হবে। হিজড়াদের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে গিয়ে সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ শুরুতেই হোঁচট খেল। বিষয়টি একেবারেই অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল।
বাংলাদেশে কোন শ্রেণি-পেশায় ভুয়া নেই? ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট ও ডিবি পুলিশের কথা পত্রিকায় আসে। ভুয়া সাংবাদিক ধরা পড়ার খবর পাওয়া যায়। সম্ভবত এখনো ও রকম অনেক ভুয়া সাংবাদিক, ভুয়া ম্যাজিস্ট্রেট, ভুয়া পুলিশ, ভুয়া পরীক্ষার্থী জেলের ভাত খাচ্ছে। ভুয়া ডাক্তারে আজ দেশ সয়লাব।
প্রতারণা যখন জাতীয় বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়, তখন যে কেউ যেকোনো কিছু সাজতে পারে। তবে চাকরিবাকরির ক্ষেত্রেই ভুয়াত্বের প্রয়োজন পড়ে বেশি। বেকার যুবক হিজড়া সেজে চাকরি চাইতে গেছেন, সেটা অবশ্যই অন্যায়: কিন্তু ততটা অন্যায় নিশ্চয়ই নয়, যতটা অন্যায় ও অপরাধ মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট কিনে সচিবদের চাকরির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো। তফাত হলো এই যে, ধরা পড়ে হিজড়াবেশী যুবকদের চাকরি হয়নি, ওই সচিবেরা প্রতারণা ধরা পড়েও চাকরিতে বহাল ছিলেন বা আছেন। যে দেশে তামা বা পিতলকে খাঁটি সোনা বলে চালালো হয়, সেখানে নকল হিজড়া থাকা অস্বাভাবিক নয়। বাস্তবতা হলো এই যে পূর্ণাঙ্গ যুবকেরা হিজড়া সেজে চাকরি চাইতে গিয়েছিলেন, কারণ তাঁদের চাকরিটা দরকার।
কোনো প্রাণীই তার জন্মের জন্য নিজে দায়ী নয়। কোনো মানুষও নয়। মাতৃগর্ভ থেকে কে নারী আর কে পুরুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে, সেটা বিধাতার বিষয়। এমনকি কারও মা-বাবারও হাত নেই। প্রকৃতির মর্জিমতোই কেউ পুরুষ, কেউ নারী, কেউ-বা উভলিঙ্গ বা হিজড়া। কেউবা অটিস্টিক। কেউ বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। কেউ আইনস্টাইনের মতো বুদ্ধিমান। কেউ গ্রিক-রোমান পৌরাণিক বীর হারকিউলিসের মতো শারীরিক শক্তির অধিকারী।
আমার একটি বিনীত প্রস্তাব। সরকার যেমন উদ্যোগ নিয়েছে, তেমনি এনজিও ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও হিজড়াদের নিয়োগ দিয়ে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাজে তাঁদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসবে।
যতটুকু শুনেছি, হিজড়ারা শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ মানুষ। তাঁদের কারও শরীরে নারী হরমোন বেশি, কারও শরীরে পুরুষের হরমোন বেশি। তাতে কারও শারীরিক সুস্থতার হেরফের হয় না। হিজড়াদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার একটি সর্বশেষ দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। কিছুদিন আগে তেজগাঁও এলাকায় এক ব্লগারকে দুর্বৃত্তরা খুন করে পালিয়ে যাচ্ছিল। আশপাশে ‘পুরুষ মানুষ’ ছিল অনেকেই। কিন্তু দুজন হিজড়া দুর্বৃত্তদের ধাওয়া করে পাকড়াও করেন। অতি সাহসী ও সুনাগরিকের কাজ। তাঁদের রাষ্ট্র পুরস্কৃত করেছে, সে খবর পাইনি। ওই কাজটিই যদি গুলশান-বারিধারার বড়লোকদের কোনো ছেলে করতেন, বহু টিভি চ্যানেলের টক শোতে তাঁদের ডাক পড়ত তাঁদের বীরত্বের কাহিনি শোনানোর জন্য। ওই দিন যদি হিজড়াদের সঙ্গে আশপাশের ‘পুরুষেরাও’ যোগ দিত, সব খুনিকে হাতেনাতে ধরা যেত।
বিভিন্ন দেশে আজ হিজড়ারা সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত। বেশ অনেক দিন আগে একটি খবরে দেখেছি, ভারতের উত্তর প্রদেশের বা মধ্যপ্রদেশের কোনো শহরের পৌরসভার মেয়র নির্বাচিত হন একজন হিজড়া। পরবর্তীকালে ভারতে আরও অনেক জনপ্রতিনিধি হিজড়াদের থেকে নির্বাচিত হয়েছেন। এখন উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ভারতে হিজড়ারা নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন।
উপযুক্ত শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিলে হিজড়ারা সমাজের যেকোনো মানুষের মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন। খুব দরকার তাঁদের সমাজের মূলধারায় নিয়ে আসা। যদি তাঁদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায়, তাঁদের দিয়ে জাতি উপকৃত হতে পারে। তাঁদের অবহেলা করা চলবে না। তাঁদের জীবিকার সম্মানজনক ব্যবস্থা করে দিলে তাঁরা আর সমাজের বোঝা হয়ে থাকবেন না। কেন তাঁরা ট্রাফিক সিগন্যালে যানবাহনের যাত্রী ও পথচারীদের কাছে সাহায্য চাইবেন?
একটি প্রশ্ন অনেকে করেন না, হিজড়ারা কি শুধু নিম্ন আয়ের বাবা-মায়ের ঘরেই জন্ম নেন? উচ্চবিত্ত পরিবারে হিজড়া নেই কেন? ধনী পরিবারে কোনো হিজড়া জন্ম নিলে বাবা-মা তাঁদের সেই সন্তানকে কোনো গরিবকে লালন-পালনের জন্য দিয়ে দেন কি না, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার।
একজন হিজড়া যদি স্বাভাবিক মানুষের পরিচয়ে পরিচিত হতেন, বলার কিছু থাকত না। তাই তো হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু কয়েকজন ‘পূর্ণাঙ্গ পুরুষ’ যখন হিজড়া সেজে চাকরি নিতে গেছেন, তখন সমাজের সুস্থতা নিয়েই প্রশ্ন জাগে। সরকারের একটি ভালো উদ্যোগ শুরুতেই অশুভ তৎপরতায় বিনষ্ট হয়ে গেল। এরপর শক্তিশালী মেডিকেল বোর্ড দ্বারা হিজড়াদের ডাক্তারি পরীক্ষা ছাড়া কোনো নিয়োগই হবে না।
আমার একটি বিনীত প্রস্তাব। সরকার যেমন উদ্যোগ নিয়েছে, তেমনি এনজিও ও ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোও হিজড়াদের নিয়োগ দিয়ে তাঁদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে সমাজে তাঁদের পুনর্বাসনে এগিয়ে আসবে।
জীবনই আসল। কেউ নারী, কেউ পুরুষ, কেউ হিজড়া—সেটা গৌণ। নাগরিক সমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে হিজড়াদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়েছে। নারী ও পুরুষ, অহিজড়া ও হিজড়া—সবারই প্রধান ও একমাত্র পরিচয় হোক তাঁরা মানুষ। মানুষের অধিকার সব মানবসন্তানকেই ভোগ করতে দিতে হবে। সে অধিকার থেকে কোনো নারী, পুরুষ বা হিজড়াকেই বঞ্চিত করা যাবে না। মানুষের মর্যাদা নারী, পুরুষ, হিজড়ার সমান প্রাপ্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments