বাংলার বাজেট বক্তৃতার বৃত্তান্ত by সৈয়দ আবুল মকসুদ
বাংলাদেশে
ইতিহাসচর্চা হয় চুটিয়ে। মানববন্ধনে ইতিহাস, গোলটেবিলে ইতিহাস, পাবলিক
টয়লেট উদ্বোধন উপলক্ষে ফিতা কাটার সময় ইতিহাস, ফজলি বা ল্যাংড়া আমের
ফলনের প্রসঙ্গ উঠলেও ইতিহাস। তবে সে ইতিহাস বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস,
একাত্তরের ইতিহাস। বাংলার বাজেটেরও রয়েছে দীর্ঘ ইতিহাস। এ ভূখণ্ডের মানুষের
স্বাধীনতার ইতিহাসের মতোই বাংলার বাজেটের ইতিহাসেরও সূচনা ইংরেজ
শাসনামলে। বাহাদুর শাহ জাফরের সময় এভাবে বাজেট ঘোষিত হতো না। লাখো
বাঙালিকে ফাঁসির মঞ্চে উঠিয়ে, আন্দামানে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে, কারাগারের
নির্জন কক্ষে তিলে তিলে হত্যা করে, ইংরেজ প্রভুরা ১৯৪৭-এর ১৫ আগস্ট সকালে
বিদায় নেয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ দেশের প্রথম বাজেট মুসলিম লীগ সরকার
উপস্থাপন করে ১৯৪৮ সালের মার্চে। সেকালে অর্থবছর এপ্রিল থেকে শুরু হতো।
ষড়ঋতুর কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে অর্থবছর ১ বৈশাখ বা ১৪ এপ্রিল থেকেই শুরু হওয়া
যুক্তিযুক্ত।
পূর্ব বাংলার পলিমাটি অতি উর্বর। কৃষকেরা পরিশ্রমী। পূর্ব বাংলার ধান-পাট বিক্রি করা টাকায় হিন্দু ও মুসলমান জমিদার-ব্যবসায়ীরা কলকাতায় প্রকাণ্ড সব বাড়ি বানিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন কলকাতা মহানগর। বাংলার জনগণের অধিকাংশই কৃষক ও কৃষিশ্রমিক। তাঁদের শরীরের ওপরটা উদোম এবং কোমর থেকে নিচের দিকে নেংটি। তাঁরা ভেবেছিলেন, ইংরেজরা চলে গেলে, দেশটা স্বশাসিত হলে, তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু বাংলার মাটি উর্বর হলেও বাঙালির আড়াই ইঞ্চি কপালটা বড়ই অনুর্বর। বারবার সে হোঁচট খায় এবং তার কপাল ভাঙে। নানা বিপর্যয় সত্ত্বেও এ দেশের মানুষের অনেক উন্নতি হয়েছে। এতটাই উন্নতি হয়েছে, যা ১৯৪৮-এ বা ১৯৭২-এ অনেকে ভাবতেও পারেননি।
অতি সুরম্য ভবনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরাসহ প্রায় সব সাংসদ উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও গিয়েছিলেন বাজেট বক্তৃতা শুনতে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর আমন্ত্রণে আমিও দর্শক গ্যালারিতে বসে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনা উপভোগ করেছি। ওখানে বসে সেদিন মনে পড়ে স্বাধীনতার পর ’৭২-এ অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাজেট ঘোষণার স্মৃতি।
১৯৭৩-এ ছিল নির্বাচিত সরকারের প্রথম বাজেট। এখনকার তুলনায় সংক্ষিপ্ত বাজেট বক্তৃতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ক্যানটিনে ঢুকলেন। আমরা সবাই তাঁদের পিছে পিছে। বঙ্গবন্ধু হাস্যরস করছিলেন। তিনি ফয়েজ আহমদ ও বার্তা সংস্থা এনার গোলাম রসুল মল্লিককে দেখিয়ে অর্থমন্ত্রীকে বললেন, ‘তাজউদ্দীন, তুমি যত ভালো বাজেটই দাও না কেন, ওরা মন্দ বলবেই। যদি কিছু প্রশংসা চাও তো ওদের বেশি বেশি বিরিয়ানি-টিরিয়ানি খাওয়াও।’ চা-নাশতা খাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু সব সাংবাদিকের সঙ্গেই হাস্যরস করলেন। ছোট ঘর। সাংসদদের ও সংবাদমাধ্যমের লোকজনের মধ্যে একটি অন্তরঙ্গ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।
আমরা সবকিছুর মহিমা খুইয়েছি। অবশ্য যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই মূল্যহীন, সেখানে অন্যান্য বিষয় কী গুরুত্ব বহন করবে! একটি আধুনিক রাষ্ট্রে বাজেট অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে জনপ্রতিনিধিদের কণ্ঠে বাজেট বিতর্কে জাতির আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়। একটি প্রশ্নে আমার বালুকণা পরিমাণ সন্দেহ নেই। তা হলো বর্তমান মহাজোট সরকার যেসব উন্নয়নমূলক ভালো কাজ করেছে, ২০৪১ সালে যাঁরা দেশ শাসন করবেন, তাঁরা তা স্বীকার করবেন না। তার কারণ হলো সাধারণ বাঙালি অতটা না হলেও বিদ্বান বাঙালিরা কারও কোনো কাজের স্বীকৃতি দেন না।
যমুনা সেতু নির্মাণের কৃতিত্ব বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ তিন দলের নেতারাই ষোলো আনা নেওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি করেছেন, তা আমরা দেখেছি। কারণ, সবাই একাত্তরের ওপাশে যাওয়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব কে কোন জনসভায় প্রথম উচ্চারণ করেন, সে প্রসঙ্গে আমি যাব না। কারণ, তা খবরের কাগজে লেখা আছে। ষাটের দশকের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনে যমুনা সেতু নির্মাণের প্রশ্নে আলোচনা হয়। আবদুল আলিম ‘যমুনা নদীর ওপর ফুলছড়ি ঘাট ও উত্তরবঙ্গের বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী সেতু নির্মাণের একটি প্রস্তাব’ উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি নিয়ে ‘সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা...তুমুল বিতর্ক’ করেন।
বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যরাও ছিলেন।
‘প্রস্তাবে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে প্রদেশের বাকি অংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকারের প্রতি উক্ত সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। প্রস্তাবটি গ্রহণ করে প্রাদেশিক সড়ক ও পরিবহন দপ্তরের মন্ত্রী সুলতান আহমদ পরিষদকে জানান যে কেন্দ্রীয় সরকার এই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সব রকম সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তবে এটি একটি বিরাট প্রকল্প এবং এতে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে।’ আড়াই শ কোটি টাকায় প্রমত্ত যমুনার ওপর সেতু! অকল্পনীয়। এখন তো অনেক যুবনেতার একটি মাত্র অ্যাকাউন্টেই আড়াই শ কোটি টাকা আছে।
সড়ক ও পরিবহনমন্ত্রী সেদিন জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ‘কতিপয় বিদেশি রাষ্ট্রের’ সঙ্গে ‘এই পরিকল্পনায় সহায়তার জন্য রিপোর্ট প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রদানের জন্য অনুরোধ’ করেছে। ১৫ জুন ১৯৬৭, অর্থমন্ত্রী এম এন হুদা পরিষদে জানান, যমুনা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সরকার কাজ দ্রুত শেষ করতে আগ্রহী। পরিকল্পনাটি তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। পরদিন সড়ক নির্মাণ দপ্তরের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (পদটি এখন নেই) আলতাফ হোসেন পরিষদকে জানান, যমুনা সেতু প্রকল্পে জাপান ও রাশিয়াকে যুক্ত করা হয়েছে।
একদিন পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে যখন গাড়ি ও রেলগাড়ি চলবে, সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী মুহিত ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথা ভুলে গেলে হবে অকৃতজ্ঞতা। এখন যমুনা সেতুর দুই পাশে যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়, তখন নিহত ব্যক্তিদের আত্মা আবদুল আলিম, সুলতান আহমদ, ড. এম এন হুদাকে শুধু নয়, আইয়ুব খানকেও অভিশাপ দেয়।
লুই কানের নকশা করা ভবনে বসে বাজেট বক্তৃতা উপভোগের সময় আমার মনে এল, এ দেশের প্রথম বাজেট কবে কোন ঘরে ঘোষিত হয়েছিল। এবং স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বাজেটই-বা কোন কক্ষে ঘোষিত হয়। সেই ঘর দুটির সঙ্গে এই অধিবেশনকক্ষের পার্থক্য কতটা?
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চির-অবহেলিত পূর্ব বাংলা প্রদেশে কোনো পরিষদ ভবন ছিল না। এমনকি প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাতে কোনো বড় হলঘরও ছিল না। প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সেই হলঘরে, যেটি ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ধসে পড়ে। নিহত হন বহু ছাত্র। ওই ঘরেই দেশের প্রথম বাজেট অধিবেশন বসে মার্চ ১৯৪৮-এ। মাওলানা ভাসানী ছিলেন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের টিকিটে টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত সদস্য। সরকারি দলের হলেও তিনি বাজেটের তীব্র সমালোচনা করেন। সেদিন তিনি দুটি ঐতিহাসিক কাজ করেছিলেন, যা বাংলাদেশের পরবর্তী ২৩ বছরের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। বাজেট পরিবেশিত হয়েছিল ইংরেজিতে। মাওলানা রেগে যান। তিনি দাবি করেন, পরিষদে সব আলোচনা বাংলায় করতে হবে। ১৭ মার্চ আলোচনাকালে ভাসানী বলেন: ‘এটা বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ, এই অ্যাসেমব্লির যিনি সদর (স্পিকার), তিনিও নিশ্চয়ই বাংলাতেই বলবেন।’ প্রত্যুত্তরে স্পিকার বলেন, ‘যিনি যে ভাষা জানেন, তিনি সেই ভাষায় বলবেন।’ মাওলানা বলেন, ‘তা হবে না, আপনি রুলিং দেন বাংলায় বলতে।’ ১৯ মার্চ বক্তৃতায় ভাসানী বলেন, ‘...আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের গোলামি করি নাই, ন্যায়সংগত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব। আমরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পাট উৎপাদন করব আর...ট্যাক্স নিয়ে যাবে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট। এই সব ট্যাক্স শতকরা ৭৫ ভাগ প্রদেশের জন্য রেখে বাকি অংশ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টকে দেওয়া হোক।’ সেদিনই ছিল ভাসানীর জীবনের শেষ সংসদে যোগদান। চক্রান্ত করে সরকার তাঁর সদস্যপদ বাতিল করে।
১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বাজেটও জগন্নাথ হলেই ঘোষিত হয়। সেখানে একটি বিষেয় তুমুল বিতর্ক হয়। তা হলো নোয়াখালীতে গান্ধী ক্যাম্পের কার্যক্রম ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাজেট পেশ করেছিলেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। পুলিশের খাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বরাদ্দ চাইলে বিরোধী কংগ্রেস দলের সদস্যরা আপত্তি করেন। তাঁদের মধ্যে মণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, গোবিন্দলাল, ভোলানাথ বিশ্বাস, অমূল্য অধিকারী, হারাণচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ বলেন, যে পুলিশ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাদের জন্য এত টাকা কেন?
বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের বাজেট ১৯৭৩-এ ঘোষিত হয় পুরোনো সংসদকক্ষে, এখন যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বাজেট ও বাজেট নিয়ে আলোচনায় দেশবাসীর অনেক কিছু শেখার থাকে, ব্লেডের দাম বাড়ল কি না, তা নিয়ে হাহাকার বাজেট আলোচনা নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান নিম্নগামী। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা কিছু ফটোকপি মুখস্থ করে সার্টিফিকেট পাচ্ছে। জীবন গড়ে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে যুবসমাজকে শিখতে হবে জীবন থেকে। আজ যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৫, তারাই ১৫ বছর পরে দেশ চালাবে।
কেউ এমপি হবে, কেউ পদস্থ আমলা, কেউ বিচারক, কেউ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ। তারা কী শিখছে? অর্থমন্ত্রীদের বাজেট ঘোষণা ও তার প্রতিক্রিয়া ৪৩ বছর যাবৎ যা হচ্ছে, তাতে যুবসমাজের শেখার কিছু নেই। যা শিখছে তা ফালতু কথা বলা।
আমি শতভাগ নিশ্চিত, বিএনপি নেতারা বাজেট না পড়েই দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাষায় সমালোচনা করছেন। অথচ তাঁদের দলেও বহু ভালো অর্থনীতিবিদ আছেন। বাম দলের নেতারা অগ্রাধিকার দেন বাজেটের চেয়ে বিপ্লবকে। জাতির চৈতন্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ডিসকোর্সের অবকাশ কম। একটি জাতিকে চারদিক থেকে প্রথার মধ্যে বন্দী করে ফেলা হয়েছে। সৃষ্টিশীলতা নেই। যুক্তিশীলতা নেই। যাদের মধ্যে তা আছে, তা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। বাজেটের অঙ্কটা কত বড়, তাতেই সবাই মুগ্ধ। বেশি টাকার চেয়ে প্রয়োজন বেশি মানুষের কল্যাণ ও কর্মসংস্থান। জাতির উজ্জ্বল ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা। তা নিয়ে বিতর্ক–বাজে কথা নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
পূর্ব বাংলার পলিমাটি অতি উর্বর। কৃষকেরা পরিশ্রমী। পূর্ব বাংলার ধান-পাট বিক্রি করা টাকায় হিন্দু ও মুসলমান জমিদার-ব্যবসায়ীরা কলকাতায় প্রকাণ্ড সব বাড়ি বানিয়েছেন। গড়ে তুলেছেন কলকাতা মহানগর। বাংলার জনগণের অধিকাংশই কৃষক ও কৃষিশ্রমিক। তাঁদের শরীরের ওপরটা উদোম এবং কোমর থেকে নিচের দিকে নেংটি। তাঁরা ভেবেছিলেন, ইংরেজরা চলে গেলে, দেশটা স্বশাসিত হলে, তাঁদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটবে। কিন্তু বাংলার মাটি উর্বর হলেও বাঙালির আড়াই ইঞ্চি কপালটা বড়ই অনুর্বর। বারবার সে হোঁচট খায় এবং তার কপাল ভাঙে। নানা বিপর্যয় সত্ত্বেও এ দেশের মানুষের অনেক উন্নতি হয়েছে। এতটাই উন্নতি হয়েছে, যা ১৯৪৮-এ বা ১৯৭২-এ অনেকে ভাবতেও পারেননি।
অতি সুরম্য ভবনে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরাসহ প্রায় সব সাংসদ উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদও গিয়েছিলেন বাজেট বক্তৃতা শুনতে। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর আমন্ত্রণে আমিও দর্শক গ্যালারিতে বসে অর্থমন্ত্রীর বাজেট উপস্থাপনা উপভোগ করেছি। ওখানে বসে সেদিন মনে পড়ে স্বাধীনতার পর ’৭২-এ অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাজেট ঘোষণার স্মৃতি।
১৯৭৩-এ ছিল নির্বাচিত সরকারের প্রথম বাজেট। এখনকার তুলনায় সংক্ষিপ্ত বাজেট বক্তৃতার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ক্যানটিনে ঢুকলেন। আমরা সবাই তাঁদের পিছে পিছে। বঙ্গবন্ধু হাস্যরস করছিলেন। তিনি ফয়েজ আহমদ ও বার্তা সংস্থা এনার গোলাম রসুল মল্লিককে দেখিয়ে অর্থমন্ত্রীকে বললেন, ‘তাজউদ্দীন, তুমি যত ভালো বাজেটই দাও না কেন, ওরা মন্দ বলবেই। যদি কিছু প্রশংসা চাও তো ওদের বেশি বেশি বিরিয়ানি-টিরিয়ানি খাওয়াও।’ চা-নাশতা খাওয়ার সময় বঙ্গবন্ধু সব সাংবাদিকের সঙ্গেই হাস্যরস করলেন। ছোট ঘর। সাংসদদের ও সংবাদমাধ্যমের লোকজনের মধ্যে একটি অন্তরঙ্গ পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল।
আমরা সবকিছুর মহিমা খুইয়েছি। অবশ্য যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই মূল্যহীন, সেখানে অন্যান্য বিষয় কী গুরুত্ব বহন করবে! একটি আধুনিক রাষ্ট্রে বাজেট অধিবেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে জনপ্রতিনিধিদের কণ্ঠে বাজেট বিতর্কে জাতির আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়। একটি প্রশ্নে আমার বালুকণা পরিমাণ সন্দেহ নেই। তা হলো বর্তমান মহাজোট সরকার যেসব উন্নয়নমূলক ভালো কাজ করেছে, ২০৪১ সালে যাঁরা দেশ শাসন করবেন, তাঁরা তা স্বীকার করবেন না। তার কারণ হলো সাধারণ বাঙালি অতটা না হলেও বিদ্বান বাঙালিরা কারও কোনো কাজের স্বীকৃতি দেন না।
যমুনা সেতু নির্মাণের কৃতিত্ব বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগ তিন দলের নেতারাই ষোলো আনা নেওয়ার জন্য কামড়াকামড়ি করেছেন, তা আমরা দেখেছি। কারণ, সবাই একাত্তরের ওপাশে যাওয়াকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেছেন। যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণের প্রস্তাব কে কোন জনসভায় প্রথম উচ্চারণ করেন, সে প্রসঙ্গে আমি যাব না। কারণ, তা খবরের কাগজে লেখা আছে। ষাটের দশকের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের বাজেট অধিবেশনে যমুনা সেতু নির্মাণের প্রশ্নে আলোচনা হয়। আবদুল আলিম ‘যমুনা নদীর ওপর ফুলছড়ি ঘাট ও উত্তরবঙ্গের বাহাদুরাবাদ ঘাটের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনকারী সেতু নির্মাণের একটি প্রস্তাব’ উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি নিয়ে ‘সরকারি ও বিরোধী দলের সদস্যরা...তুমুল বিতর্ক’ করেন।
বিরোধী দলের সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সদস্যরাও ছিলেন।
‘প্রস্তাবে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোর সঙ্গে প্রদেশের বাকি অংশের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে সরকারের প্রতি উক্ত সেতু নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়। প্রস্তাবটি গ্রহণ করে প্রাদেশিক সড়ক ও পরিবহন দপ্তরের মন্ত্রী সুলতান আহমদ পরিষদকে জানান যে কেন্দ্রীয় সরকার এই সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সব রকম সাহায্য দেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে। তবে এটি একটি বিরাট প্রকল্প এবং এতে প্রায় আড়াই শ কোটি টাকা ব্যয় হবে বলে অনুমান করা যাচ্ছে।’ আড়াই শ কোটি টাকায় প্রমত্ত যমুনার ওপর সেতু! অকল্পনীয়। এখন তো অনেক যুবনেতার একটি মাত্র অ্যাকাউন্টেই আড়াই শ কোটি টাকা আছে।
সড়ক ও পরিবহনমন্ত্রী সেদিন জানিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় সরকার জাপান, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ ‘কতিপয় বিদেশি রাষ্ট্রের’ সঙ্গে ‘এই পরিকল্পনায় সহায়তার জন্য রিপোর্ট প্রণয়ন ও প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা প্রদানের জন্য অনুরোধ’ করেছে। ১৫ জুন ১৯৬৭, অর্থমন্ত্রী এম এন হুদা পরিষদে জানান, যমুনা সেতু প্রকল্পের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা করা হচ্ছে। সরকার কাজ দ্রুত শেষ করতে আগ্রহী। পরিকল্পনাটি তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত। পরদিন সড়ক নির্মাণ দপ্তরের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি (পদটি এখন নেই) আলতাফ হোসেন পরিষদকে জানান, যমুনা সেতু প্রকল্পে জাপান ও রাশিয়াকে যুক্ত করা হয়েছে।
একদিন পদ্মা নদীর ওপর দিয়ে যখন গাড়ি ও রেলগাড়ি চলবে, সেদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, অর্থমন্ত্রী মুহিত ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের কথা ভুলে গেলে হবে অকৃতজ্ঞতা। এখন যমুনা সেতুর দুই পাশে যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়, তখন নিহত ব্যক্তিদের আত্মা আবদুল আলিম, সুলতান আহমদ, ড. এম এন হুদাকে শুধু নয়, আইয়ুব খানকেও অভিশাপ দেয়।
লুই কানের নকশা করা ভবনে বসে বাজেট বক্তৃতা উপভোগের সময় আমার মনে এল, এ দেশের প্রথম বাজেট কবে কোন ঘরে ঘোষিত হয়েছিল। এবং স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বাজেটই-বা কোন কক্ষে ঘোষিত হয়। সেই ঘর দুটির সঙ্গে এই অধিবেশনকক্ষের পার্থক্য কতটা?
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চির-অবহেলিত পূর্ব বাংলা প্রদেশে কোনো পরিষদ ভবন ছিল না। এমনকি প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাতে কোনো বড় হলঘরও ছিল না। প্রথম প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন বসত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের সেই হলঘরে, যেটি ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর ধসে পড়ে। নিহত হন বহু ছাত্র। ওই ঘরেই দেশের প্রথম বাজেট অধিবেশন বসে মার্চ ১৯৪৮-এ। মাওলানা ভাসানী ছিলেন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের টিকিটে টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত সদস্য। সরকারি দলের হলেও তিনি বাজেটের তীব্র সমালোচনা করেন। সেদিন তিনি দুটি ঐতিহাসিক কাজ করেছিলেন, যা বাংলাদেশের পরবর্তী ২৩ বছরের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রিত করেছে। বাজেট পরিবেশিত হয়েছিল ইংরেজিতে। মাওলানা রেগে যান। তিনি দাবি করেন, পরিষদে সব আলোচনা বাংলায় করতে হবে। ১৭ মার্চ আলোচনাকালে ভাসানী বলেন: ‘এটা বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ, এই অ্যাসেমব্লির যিনি সদর (স্পিকার), তিনিও নিশ্চয়ই বাংলাতেই বলবেন।’ প্রত্যুত্তরে স্পিকার বলেন, ‘যিনি যে ভাষা জানেন, তিনি সেই ভাষায় বলবেন।’ মাওলানা বলেন, ‘তা হবে না, আপনি রুলিং দেন বাংলায় বলতে।’ ১৯ মার্চ বক্তৃতায় ভাসানী বলেন, ‘...আমরা কি সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের গোলাম? ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের গোলামি করি নাই, ন্যায়সংগত অধিকারের জন্য চিরকাল লড়াই করেছি, আজও করব। আমরা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে পাট উৎপাদন করব আর...ট্যাক্স নিয়ে যাবে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট। এই সব ট্যাক্স শতকরা ৭৫ ভাগ প্রদেশের জন্য রেখে বাকি অংশ সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টকে দেওয়া হোক।’ সেদিনই ছিল ভাসানীর জীবনের শেষ সংসদে যোগদান। চক্রান্ত করে সরকার তাঁর সদস্যপদ বাতিল করে।
১৯৪৯ সালে দ্বিতীয় বাজেটও জগন্নাথ হলেই ঘোষিত হয়। সেখানে একটি বিষেয় তুমুল বিতর্ক হয়। তা হলো নোয়াখালীতে গান্ধী ক্যাম্পের কার্যক্রম ও সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন বাজেট পেশ করেছিলেন। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্বেও ছিলেন। পুলিশের খাতে ২ কোটি ৯৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকা বরাদ্দ চাইলে বিরোধী কংগ্রেস দলের সদস্যরা আপত্তি করেন। তাঁদের মধ্যে মণীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, গোবিন্দলাল, ভোলানাথ বিশ্বাস, অমূল্য অধিকারী, হারাণচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ বলেন, যে পুলিশ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারে না, তাদের জন্য এত টাকা কেন?
বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের বাজেট ১৯৭৩-এ ঘোষিত হয় পুরোনো সংসদকক্ষে, এখন যা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। বাজেট ও বাজেট নিয়ে আলোচনায় দেশবাসীর অনেক কিছু শেখার থাকে, ব্লেডের দাম বাড়ল কি না, তা নিয়ে হাহাকার বাজেট আলোচনা নয়।
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মান নিম্নগামী। উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েরা কিছু ফটোকপি মুখস্থ করে সার্টিফিকেট পাচ্ছে। জীবন গড়ে তুলতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে যুবসমাজকে শিখতে হবে জীবন থেকে। আজ যাদের বয়স ১৫ থেকে ২৫, তারাই ১৫ বছর পরে দেশ চালাবে।
কেউ এমপি হবে, কেউ পদস্থ আমলা, কেউ বিচারক, কেউ বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ। তারা কী শিখছে? অর্থমন্ত্রীদের বাজেট ঘোষণা ও তার প্রতিক্রিয়া ৪৩ বছর যাবৎ যা হচ্ছে, তাতে যুবসমাজের শেখার কিছু নেই। যা শিখছে তা ফালতু কথা বলা।
আমি শতভাগ নিশ্চিত, বিএনপি নেতারা বাজেট না পড়েই দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাষায় সমালোচনা করছেন। অথচ তাঁদের দলেও বহু ভালো অর্থনীতিবিদ আছেন। বাম দলের নেতারা অগ্রাধিকার দেন বাজেটের চেয়ে বিপ্লবকে। জাতির চৈতন্য ও ভবিষ্যৎ নিয়ে ডিসকোর্সের অবকাশ কম। একটি জাতিকে চারদিক থেকে প্রথার মধ্যে বন্দী করে ফেলা হয়েছে। সৃষ্টিশীলতা নেই। যুক্তিশীলতা নেই। যাদের মধ্যে তা আছে, তা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে ফেলা হচ্ছে। বাজেটের অঙ্কটা কত বড়, তাতেই সবাই মুগ্ধ। বেশি টাকার চেয়ে প্রয়োজন বেশি মানুষের কল্যাণ ও কর্মসংস্থান। জাতির উজ্জ্বল ও নিরাপদ ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পনা। তা নিয়ে বিতর্ক–বাজে কথা নয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments