মঞ্জুর হত্যায় এরশাদের আশ্চর্য জবানবন্দি -মার্কিন নথি :জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড by মিজানুর রহমান খান
জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মঞ্জুর |
জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড :
৩০ মে জিয়া হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পূর্তি। দীর্ঘ সময় পরে মার্কিন গোপন
দলিলে উদ্ঘাটিত হলো জিয়া ও মঞ্জুর হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কাহিনি। এ বিষয়ে
প্রথম আলোর বিশেষ ধারাবাহিক আয়োজনের চতুর্থ ও শেষ কিস্তি প্রকাশিত হলো
আজ।
সেনাবাহিনীর চিকিৎসক কর্নেল এ জেড তোফায়েল সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘মাথায় একটি গুলি লেগেই জেনারেল মঞ্জুর মারা যান; “অনেকগুলো গুলি” তাঁর শরীরে লাগেনি। “ক্ষুব্ধ মানুষ” বা তাঁর গার্ডদের সঙ্গে এঁদের বন্দুকযুদ্ধের সময় তাঁর শরীরে একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়নি।’
মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়েরকারী ও মঞ্জুর-ভ্রাতা আইনজীবী আবুল মনসুর ২৯ মে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মৃত্যুসনদে একটি বুলেটের কথাই আছে। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘দাবার এই ছকে ঘোড়া (ব্রিগেডিয়ার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ও হাতিরা (মেজর ও ক্যাপ্টেন) তাঁদের বড়েগুলো (সুবেদার ও নায়েক) অঙ্গুলি হেলনে চালনা করেছেন। কিন্তু আরও বড় একটি দাবার ছকে আবার এই ঘোড়া ও হাতিরা যাঁদের অঙ্গুলি হেলনে কাজ করেছেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা” (মেজর জেনারেল) এবং সিআইডির অভিযোগপত্র অনুযায়ী এরশাদ নামক একজন “লেফটেন্যান্ট জেনারেল”। এই “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ” প্রথম দিন থেকেই এক অবিশ্বাস্য গল্প ফেঁদে বসে, “ক্ষুব্ধ সৈনিকেরা” নাকি উত্তেজিত হয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন।’
জেনারেল এরশাদ এই ‘গল্প’ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড টি স্নাইডারকেও বলেছিলেন। এ বিষয়ে স্নাইডার ১৯৮১ সালের ২৫ জুন ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, এরশাদ তাঁদের কাছে সামরিক বাহিনীর তদন্তের ফলাফল এবং গ্রেপ্তার হওয়া জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। তবে রাষ্ট্রদূতের এই তারবার্তায় উল্লেখ আছে যে তাঁদের কাছে এরশাদের দেওয়া এই জবানবন্দি মার্কিন সামরিক অ্যাটাশে আলাদাভাবে ওয়াশিংটনে প্রেরণ করেছিলেন। এটি আমাদের হাতে আসেনি। এটুকু আশা করা যায়, কোনো একদিন হয়তো এর হদিস মিলবে। তবে স্নাইডার তারবার্তায় এরশাদের বক্তব্যের যে অংশটুকু উল্লেখ করেছিলেন, তা নতুন করে এরশাদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই তারবার্তায় বলেছিলেন, ‘এরশাদ আমাদের বলেন, অভ্যুত্থানচেষ্টা সম্পর্কে সামরিক তদন্ত শেষ হয়েছে। আর তাতে জেনারেল মঞ্জুরকে সম্পূর্ণরূপে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।’ উল্লেখ্য, জিয়া হত্যার বিচারের জন্য গঠিত তদন্ত আদালত–সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা ২৯ মে এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন যে, ‘ওই সামরিক তদন্ত প্রতিবেদনের কোনো কপি সেনা হেফাজতে নেই। সবই ধ্বংস করা হয়েছে।’
জেনারেল এরশাদ স্নাইডারকে বলেন, ‘মঞ্জুর অনেক দিন ধরেই জিয়ার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করে আসছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তিনি ওই দিনই যে ঘটনা ঘটাবেন, সে বিষয়ে মঞ্জুর তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৩০ মে ১৯৮১ সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার (বাদ মাগরিব) পরেই।’ স্নাইডারের এই বিবরণ সত্য হলে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এরশাদ কী করে এত নির্দিষ্টভাবে মঞ্জুরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন?
স্নাইডারের কাছে এরশাদ এই দাবিও করেন, ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। স্নাইডার এরশাদের বরাতে আরও ইঙ্গিত করেন যে অভ্যুত্থান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্থান কেবল চট্টগ্রাম নয়, ‘ঢাকা এবং অন্যত্রও’ ছিল।
মঞ্জুর হত্যা সম্পর্কে স্নাইডার লেখেন, ‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এরশাদ বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে উল্লেখ করেন যে, “চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কোনো কমান্ড কাঠামো না থাকার ফলে একদল ক্রুদ্ধ সৈনিক (অ্যান অ্যাংগ্রি মব) তাঁকে প্রথমে মারধর এবং পরে গুলি করে হত্যা করে।”
তবে এরশাদের এই বিবরণ মার্কিন দূতাবাস মেনে নেয়নি, তার প্রমাণ ৫ জুনের আরেকটি তারবার্তা। এতে ওয়াশিংটনকে আগেই জানানো হয়েছিল, “কী প্রেক্ষাপটে মঞ্জুর খুন হলেন তা অস্পষ্ট।’ রেডিও বাংলাদেশ বলেছে, তিনি “ক্রুদ্ধ সেপাই”দের হাতে নিহত হয়েছেন। আবার ৩ জুন সরকারি প্রেসে বলা হয়েছে: “কতিপয় উত্তেজিত সশস্ত্র ব্যক্তি” এবং মঞ্জুরের দেহরক্ষীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে আহত হয়ে মঞ্জুরের মৃত্যু ঘটেছে। এই যুদ্ধ হয় মঞ্জুর ও তাঁর সহযোগীদের “ছিনিয়ে” নেওয়ার চেষ্টাকালে। তাঁর দুই সহযোগী লে. কর্নেল মতিউর রহমান ও লে. কর্নেল মেহবুবুর রহমান কথিতমতে “ঘটনাস্থলেই” নিহত হয়েছেন।’
স্নাইডার তাঁর ওই তারবার্তায় (৫ জুন, ১৯৮১) মঞ্জুরকে কেন হত্যা করা হয়েছে সে সম্পর্কে ওয়াশিংটনকে জানান: ‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড বিরাট সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে বহু ধরনের গল্প চালু আছে। অনেকেই সন্দেহ করেন যে, তাঁকে সেসব মহল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যাঁরা শঙ্কিত ছিলেন যে মঞ্জুর যদি তাঁর অভ্যুত্থানের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মঞ্জুর হত্যা সম্পর্কে দুই ধরনের ভাষ্য এই সংশয়কে তীব্রতা দিয়েছে।’
তবে জেনারেল এরশাদের ভাষ্য ওয়াশিংটনকে জানানোর বার্তায় এরশাদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে স্নাইডার মন্তব্য করেননি, কিন্তু এরশাদের ওই ভাষ্য কার্যত স্নাইডার নাকচ করেন, আর সেটা এই বিবেচনায় যে, ৫ জুন ১৯৮১ স্নাইডার তাঁর তারবার্তার মন্তব্য অংশে বলেন, ‘মঞ্জুর হত্যা সম্পর্কে সরকারের প্রচারিত ভাষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষয় ঘটেছে।’
উল্লেখ্য, জেনারেল মঞ্জুরের ভাই আবুল মনসুর ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ একটি মামলা করেন। সে বছরের ২৭ জুন সিআইডি এ মামলার অভিযোগপত্র দেয়। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তাঁরা হলেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ, মেজর জেনারেল আবদুল লতিফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমান শামস, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামালউদ্দীন ভূঁইয়া ও মেজর কাজী এমদাদুল হক। এই মামলা দায়েরের পরে জেনারেল মঞ্জুরের পরিবারের সদস্যরা দুবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। তৎকালীন আইন ও বিচারমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু দুজন প্রসিকিউটর দিয়েও সহায়তা করেছিলেন। এ সময় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও মঞ্জুর পরিবার যোগাযোগ করে। জিয়া ও মঞ্জুরের পরিবার ১৯৭২ সাল থেকে পরিচিত। জানা যায়, খালেদা জিয়াও মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়েরে সহায়তা প্রদান করেন। যদিও পরে দেখা গেছে মওদুদ আহমদ এই মামলায় এরশাদের আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।
চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার জিয়াউদ্দিন তাঁর বইয়ে যদিও মন্তব্য করেছেন যে ওই সময়ের ডিআইজি (পরে আইজিপি) শাহজাহান মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত। কিন্তু মো. শাহজাহান তা অস্বীকার করেছেন। এরশাদের ‘ক্রুদ্ধ সেপাই’ তত্ত্বেও তাঁর সায় নেই। তবে এটা পরিষ্কার যে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পরে মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত বৈধ ছিল না।
এই বিষয়টির আইনি দিক ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করেছেন আইন কমিশনের সাবেক সদস্য ও ঢাকার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আবদুল মোবারক (বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার)। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৯ ধারা এবং ১৯৭০ সালের মিলিটারি অফেন্ডার্স রুলস মতে, পুলিশের তরফে মঞ্জুরকে সরাসরি সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেওয়া ছিল বেআইনি। পুলিশের উচিত ছিল মঞ্জুরকে সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করা। তখন তিনি তাঁকে জেলখানায় রাখতেন। এই জেল থেকে তাঁকে নিতে হলে সেনাপ্রধানের অনুমোদিত চিঠির দরকার পড়ত। সবকিছু রেকর্ডে এসে যেত। তাই মঞ্জুরের বেআইনি হস্তান্তরের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা মঞ্জুর হত্যায় সহায়তা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের ৩ জুন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আওয়ামী লীগ ও জাসদের সাংসদদের উপস্থিতিতে মঞ্জুর হত্যা আলোচিত হয়েছিল। এদিন বেশ কয়েকজন সাংসদ জেনারেল মঞ্জুর হত্যার তদন্ত দাবি করে বক্তব্য দেন। মঞ্জুর হত্যাসহ সামগ্রিক ঘটনাবলি খতিয়ে দেখতে সামরিক ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত হিসেবে একটি পার্লামেন্টারি কমিশন গঠনেরও দাবি জানানো হয়। কিন্তু বিএনপি কখনো তা করেনি।
১৯৯৫ থেকে দুই ডজনবার মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচারক বদলের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর মামলাটির গতি হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে যায়।
লিফশুলজ লিখেছেন, জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর নিজের বইয়ে এবং পরে আমার সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন যে সেনাপ্রধান এরশাদ ও অন্য ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা মঞ্জুরকে ফাঁসিয়ে দিয়ে একটি মিথ্যা আখ্যান বাজারে ছড়িয়ে দেন। ১ জুন ১৯৮১ হাটহাজারী থানা থেকে নিয়ে আসার পর মঞ্জুর নাকি ‘ক্ষুব্ধ’ সৈনিকদের হাতে মারা পড়েন। মঞ্জুর যে ঘরে বন্দী ছিলেন, কীভাবে সেই কর্মকর্তা সেখানে প্রবেশ করেন, জিয়াউদ্দীন সেটি তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন। জিয়াউদ্দীন বলেন, ‘তিনি (ঢাকা থেকে আগত) মঞ্জুরের ঘরে প্রবেশ করেন। মঞ্জুরের দিকে পিস্তল তাক করে গুলি করেন ও এরপর বেরিয়ে যান। সবকিছু ঘটে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক ৷
সেনাবাহিনীর চিকিৎসক কর্নেল এ জেড তোফায়েল সাক্ষ্য দিয়েছেন, ‘মাথায় একটি গুলি লেগেই জেনারেল মঞ্জুর মারা যান; “অনেকগুলো গুলি” তাঁর শরীরে লাগেনি। “ক্ষুব্ধ মানুষ” বা তাঁর গার্ডদের সঙ্গে এঁদের বন্দুকযুদ্ধের সময় তাঁর শরীরে একাধিক গুলিবিদ্ধ হয়নি।’
মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়েরকারী ও মঞ্জুর-ভ্রাতা আইনজীবী আবুল মনসুর ২৯ মে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর মৃত্যুসনদে একটি বুলেটের কথাই আছে। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ ২০১৪ সালের ২০ এপ্রিল প্রথম আলোয় লিখেছেন, ‘দাবার এই ছকে ঘোড়া (ব্রিগেডিয়ার ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ও হাতিরা (মেজর ও ক্যাপ্টেন) তাঁদের বড়েগুলো (সুবেদার ও নায়েক) অঙ্গুলি হেলনে চালনা করেছেন। কিন্তু আরও বড় একটি দাবার ছকে আবার এই ঘোড়া ও হাতিরা যাঁদের অঙ্গুলি হেলনে কাজ করেছেন, তাঁরা সেনাবাহিনীর “ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা” (মেজর জেনারেল) এবং সিআইডির অভিযোগপত্র অনুযায়ী এরশাদ নামক একজন “লেফটেন্যান্ট জেনারেল”। এই “ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ” প্রথম দিন থেকেই এক অবিশ্বাস্য গল্প ফেঁদে বসে, “ক্ষুব্ধ সৈনিকেরা” নাকি উত্তেজিত হয়ে মঞ্জুরকে হত্যা করেছেন।’
জেনারেল এরশাদ এই ‘গল্প’ তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিড টি স্নাইডারকেও বলেছিলেন। এ বিষয়ে স্নাইডার ১৯৮১ সালের ২৫ জুন ওয়াশিংটনকে জানিয়েছিলেন, এরশাদ তাঁদের কাছে সামরিক বাহিনীর তদন্তের ফলাফল এবং গ্রেপ্তার হওয়া জেনারেল মঞ্জুরের হত্যাকাণ্ড এবং অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছেন। তবে রাষ্ট্রদূতের এই তারবার্তায় উল্লেখ আছে যে তাঁদের কাছে এরশাদের দেওয়া এই জবানবন্দি মার্কিন সামরিক অ্যাটাশে আলাদাভাবে ওয়াশিংটনে প্রেরণ করেছিলেন। এটি আমাদের হাতে আসেনি। এটুকু আশা করা যায়, কোনো একদিন হয়তো এর হদিস মিলবে। তবে স্নাইডার তারবার্তায় এরশাদের বক্তব্যের যে অংশটুকু উল্লেখ করেছিলেন, তা নতুন করে এরশাদের ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত ওই তারবার্তায় বলেছিলেন, ‘এরশাদ আমাদের বলেন, অভ্যুত্থানচেষ্টা সম্পর্কে সামরিক তদন্ত শেষ হয়েছে। আর তাতে জেনারেল মঞ্জুরকে সম্পূর্ণরূপে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে।’ উল্লেখ্য, জিয়া হত্যার বিচারের জন্য গঠিত তদন্ত আদালত–সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা ২৯ মে এক প্রশ্নের জবাবে এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন যে, ‘ওই সামরিক তদন্ত প্রতিবেদনের কোনো কপি সেনা হেফাজতে নেই। সবই ধ্বংস করা হয়েছে।’
জেনারেল এরশাদ স্নাইডারকে বলেন, ‘মঞ্জুর অনেক দিন ধরেই জিয়ার বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করে আসছিলেন। কিন্তু চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে তিনি ওই দিনই যে ঘটনা ঘটাবেন, সে বিষয়ে মঞ্জুর তাঁর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ৩০ মে ১৯৮১ সন্ধ্যাকালীন প্রার্থনার (বাদ মাগরিব) পরেই।’ স্নাইডারের এই বিবরণ সত্য হলে এই প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এরশাদ কী করে এত নির্দিষ্টভাবে মঞ্জুরের অভ্যুত্থান পরিকল্পনা সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পেরেছিলেন?
স্নাইডারের কাছে এরশাদ এই দাবিও করেন, ষড়যন্ত্রকারীরা তাঁকেও হত্যার পরিকল্পনা করেছিল। স্নাইডার এরশাদের বরাতে আরও ইঙ্গিত করেন যে অভ্যুত্থান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের স্থান কেবল চট্টগ্রাম নয়, ‘ঢাকা এবং অন্যত্রও’ ছিল।
মঞ্জুর হত্যা সম্পর্কে স্নাইডার লেখেন, ‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এরশাদ বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে উল্লেখ করেন যে, “চট্টগ্রাম সেনানিবাসে কোনো কমান্ড কাঠামো না থাকার ফলে একদল ক্রুদ্ধ সৈনিক (অ্যান অ্যাংগ্রি মব) তাঁকে প্রথমে মারধর এবং পরে গুলি করে হত্যা করে।”
তবে এরশাদের এই বিবরণ মার্কিন দূতাবাস মেনে নেয়নি, তার প্রমাণ ৫ জুনের আরেকটি তারবার্তা। এতে ওয়াশিংটনকে আগেই জানানো হয়েছিল, “কী প্রেক্ষাপটে মঞ্জুর খুন হলেন তা অস্পষ্ট।’ রেডিও বাংলাদেশ বলেছে, তিনি “ক্রুদ্ধ সেপাই”দের হাতে নিহত হয়েছেন। আবার ৩ জুন সরকারি প্রেসে বলা হয়েছে: “কতিপয় উত্তেজিত সশস্ত্র ব্যক্তি” এবং মঞ্জুরের দেহরক্ষীদের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধে আহত হয়ে মঞ্জুরের মৃত্যু ঘটেছে। এই যুদ্ধ হয় মঞ্জুর ও তাঁর সহযোগীদের “ছিনিয়ে” নেওয়ার চেষ্টাকালে। তাঁর দুই সহযোগী লে. কর্নেল মতিউর রহমান ও লে. কর্নেল মেহবুবুর রহমান কথিতমতে “ঘটনাস্থলেই” নিহত হয়েছেন।’
স্নাইডার তাঁর ওই তারবার্তায় (৫ জুন, ১৯৮১) মঞ্জুরকে কেন হত্যা করা হয়েছে সে সম্পর্কে ওয়াশিংটনকে জানান: ‘মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড বিরাট সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টি করেছে। তাঁর মৃত্যু সম্পর্কে বহু ধরনের গল্প চালু আছে। অনেকেই সন্দেহ করেন যে, তাঁকে সেসব মহল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে যাঁরা শঙ্কিত ছিলেন যে মঞ্জুর যদি তাঁর অভ্যুত্থানের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করেন, তাহলে তাঁদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। মঞ্জুর হত্যা সম্পর্কে দুই ধরনের ভাষ্য এই সংশয়কে তীব্রতা দিয়েছে।’
তবে জেনারেল এরশাদের ভাষ্য ওয়াশিংটনকে জানানোর বার্তায় এরশাদের দাবির যৌক্তিকতা নিয়ে স্নাইডার মন্তব্য করেননি, কিন্তু এরশাদের ওই ভাষ্য কার্যত স্নাইডার নাকচ করেন, আর সেটা এই বিবেচনায় যে, ৫ জুন ১৯৮১ স্নাইডার তাঁর তারবার্তার মন্তব্য অংশে বলেন, ‘মঞ্জুর হত্যা সম্পর্কে সরকারের প্রচারিত ভাষ্যের বিশ্বাসযোগ্যতার ক্ষয় ঘটেছে।’
উল্লেখ্য, জেনারেল মঞ্জুরের ভাই আবুল মনসুর ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৫ একটি মামলা করেন। সে বছরের ২৭ জুন সিআইডি এ মামলার অভিযোগপত্র দেয়। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় তাঁরা হলেন জেনারেল এইচ এম এরশাদ, মেজর জেনারেল আবদুল লতিফ, লেফটেন্যান্ট কর্নেল শামসুর রহমান শামস, লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোস্তফা কামালউদ্দীন ভূঁইয়া ও মেজর কাজী এমদাদুল হক। এই মামলা দায়েরের পরে জেনারেল মঞ্জুরের পরিবারের সদস্যরা দুবার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি তাঁদের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন। তৎকালীন আইন ও বিচারমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু দুজন প্রসিকিউটর দিয়েও সহায়তা করেছিলেন। এ সময় বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও মঞ্জুর পরিবার যোগাযোগ করে। জিয়া ও মঞ্জুরের পরিবার ১৯৭২ সাল থেকে পরিচিত। জানা যায়, খালেদা জিয়াও মঞ্জুর হত্যা মামলা দায়েরে সহায়তা প্রদান করেন। যদিও পরে দেখা গেছে মওদুদ আহমদ এই মামলায় এরশাদের আইনজীবী হিসেবে দাঁড়িয়েছেন।
চট্টগ্রামের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার জিয়াউদ্দিন তাঁর বইয়ে যদিও মন্তব্য করেছেন যে ওই সময়ের ডিআইজি (পরে আইজিপি) শাহজাহান মঞ্জুর হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ভালোভাবে অবহিত। কিন্তু মো. শাহজাহান তা অস্বীকার করেছেন। এরশাদের ‘ক্রুদ্ধ সেপাই’ তত্ত্বেও তাঁর সায় নেই। তবে এটা পরিষ্কার যে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারের পরে মঞ্জুরকে সেনা হেফাজতে হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত বৈধ ছিল না।
এই বিষয়টির আইনি দিক ব্যক্তিগতভাবে পরীক্ষা করেছেন আইন কমিশনের সাবেক সদস্য ও ঢাকার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ আবদুল মোবারক (বর্তমানে নির্বাচন কমিশনার)। এই প্রতিবেদককে তিনি বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪৯ ধারা এবং ১৯৭০ সালের মিলিটারি অফেন্ডার্স রুলস মতে, পুলিশের তরফে মঞ্জুরকে সরাসরি সেনা কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে দেওয়া ছিল বেআইনি। পুলিশের উচিত ছিল মঞ্জুরকে সাব ডিভিশনাল ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করা। তখন তিনি তাঁকে জেলখানায় রাখতেন। এই জেল থেকে তাঁকে নিতে হলে সেনাপ্রধানের অনুমোদিত চিঠির দরকার পড়ত। সবকিছু রেকর্ডে এসে যেত। তাই মঞ্জুরের বেআইনি হস্তান্তরের সঙ্গে যাঁরা জড়িত, তাঁরা মঞ্জুর হত্যায় সহায়তা দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালের ৩ জুন জাতীয় সংসদের অধিবেশনে আওয়ামী লীগ ও জাসদের সাংসদদের উপস্থিতিতে মঞ্জুর হত্যা আলোচিত হয়েছিল। এদিন বেশ কয়েকজন সাংসদ জেনারেল মঞ্জুর হত্যার তদন্ত দাবি করে বক্তব্য দেন। মঞ্জুর হত্যাসহ সামগ্রিক ঘটনাবলি খতিয়ে দেখতে সামরিক ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত হিসেবে একটি পার্লামেন্টারি কমিশন গঠনেরও দাবি জানানো হয়। কিন্তু বিএনপি কখনো তা করেনি।
১৯৯৫ থেকে দুই ডজনবার মঞ্জুর হত্যা মামলার বিচারক বদলের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর মামলাটির গতি হঠাৎ রুদ্ধ হয়ে যায়।
লিফশুলজ লিখেছেন, জিয়াউদ্দীন চৌধুরী তাঁর নিজের বইয়ে এবং পরে আমার সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন যে সেনাপ্রধান এরশাদ ও অন্য ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা মঞ্জুরকে ফাঁসিয়ে দিয়ে একটি মিথ্যা আখ্যান বাজারে ছড়িয়ে দেন। ১ জুন ১৯৮১ হাটহাজারী থানা থেকে নিয়ে আসার পর মঞ্জুর নাকি ‘ক্ষুব্ধ’ সৈনিকদের হাতে মারা পড়েন। মঞ্জুর যে ঘরে বন্দী ছিলেন, কীভাবে সেই কর্মকর্তা সেখানে প্রবেশ করেন, জিয়াউদ্দীন সেটি তাঁর বইয়ে দেখিয়েছেন। জিয়াউদ্দীন বলেন, ‘তিনি (ঢাকা থেকে আগত) মঞ্জুরের ঘরে প্রবেশ করেন। মঞ্জুরের দিকে পিস্তল তাক করে গুলি করেন ও এরপর বেরিয়ে যান। সবকিছু ঘটে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে।’
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক ৷
No comments