লাখ লাখ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে by মমতাজ বিলকিস
শিক্ষা
ছাড়া জাতীয় উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই প্রতিবারের মতো এবারো প্রাথমিক ও
ইবতেদায়ি সমাপনী, জুনিয়র স্কুল ও দাখিল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় ঝরে পড়া
শিক্ষার্থীর সংখ্যা সবাইকে উদ্বিগ্ন করেছে। প্রাথমিক ও ইবতেদায়িতে নিবন্ধিত
হয়েও সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেয়নি এক লাখ ৪৫ হাজার ৫৬৬ জন শিক্ষার্থী। এদের
মধ্যে প্রাথমিকে এক লাখ পাঁচ হাজার ৪৮২ জন এবং ইবতেদায়িতে ৪০ হাজার ৮৪ জন।
পরীক্ষায় অংশ নিয়ে উত্তীর্ণ হতে পারেনি ৭৬ হাজার ৬৫৭ জন পরীক্ষার্থী
(প্রাথমিক ৬৫ হাজার ৭৭৮ জন এবং ইবতেদায়ি ১০ হাজার ৮৭৯ জন)। জুনিয়র স্কুল ও
দাখিলের ক্ষেত্রেও একই চিত্র। এবার আটটি শিক্ষা বোর্ড ও মাদরাসা বোর্ডে
জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষায় তালিকাভুক্ত হয়েছিল ২০ লাখ ৮৮ হাজার ১৫২ জন। কিন্তু
অংশ নেয়ার আগেই ঝরে পড়ে ৪৬ হাজার ৬৮১ জন শিক্ষার্থী। আর অকৃতকার্য হয়েছে
এক লাখ ৯৫ হাজার ৭৩৯ জন। অর্থাৎ, মোট দুই লাখ ৪২ হাজার ৪২০ জন। এসব
শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রায় শতভাগই ঝরে পড়াদের অন্তর্ভুক্ত বলে ধরে নেয়া যায়।
এভাবে প্রতি বছর প্রায় এক লাখ শিশু শিক্ষাঙ্গন থেকে ঝরে পড়ছে। অদ্ভুত
ব্যাপার হলো, এর দায় কেউ নিতে রাজি নয়। নীতিনির্ধারকেরা দারিদ্র্যকেই মূল
কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। আর অভিভাবকেরা বলেন নীতিনির্ধারকদের
অসতর্কতা আর অবহেলায় এই সমস্যার সমাধান হচ্ছে না এবং তারা নিচ্ছেন না ঝরে
পড়া শিক্ষার্থীদের স্কুলে ফিরিয়ে আনার যথাযথ উদ্যোগ। এ দেশে শহর ও গ্রামের
শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বিরাট ব্যবধান আজো লক্ষণীয়। জেএসসি ও প্রাথমিক
সমাপনীতে যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শীর্ষ স্থানে রয়েছে, তার সবগুলোই রাজধানী
কিংবা বড় শহরকেন্দ্রিক। গ্রামগঞ্জের কোনো প্রতিষ্ঠান এই তালিকায় স্থান
পায়নি। এর কারণ, শহর ও গ্রামগঞ্জের শিক্ষাব্যবস্থাপনায় এবং শিক্ষাদানের
ক্ষেত্রে বিরাট ফারাক রয়ে গেছে। শহরের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার ক্ষেত্রে অধিক
সুবিধা যে পেয়ে থাকে তা বলাই বাহুল্য। শহরের স্কুলগুলোতে যেমন ভালো শিক্ষক
রয়েছেন, তেমনি বেশির ভাগ অভিভাবকই শিক্ষিত ও সচেতন। রয়েছে জ্ঞান আহরণের
নানা উপকরণ এবং উন্নতমানের কোচিংসহ অন্যান্য সুব্যবস্থা। অন্য দিকে,
গ্রামাঞ্চলে অভিভাবকদের এত দিনে কেবল বোঝানো সম্ভব হয়েছে যে, ন্যূনতম
শিক্ষা অর্থাৎ নাম সই করা, একটু-আধটু লিখতে বা পড়তে এবং হিসাব-নিকাশ করতে
পারার গুরুত্ব। ফলে দরিদ্র বাবা-মা সন্তানদের উপার্জনে লাগানোর আগে অন্তত
প্রাথমিক শিক্ষা নিতে স্কুলে পাঠাচ্ছেন। এই পর্যায়ে শিক্ষাব্যয় নেই বললেই
চলে। বিনামূল্যে শিক্ষাদান এবং পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, খাদ্য কিংবা বস্ত্রের
বিনিময়ে শিক্ষা, এমনকি কোথাও কোথাও অভিভাবক সমিতি গঠন ইত্যাদি গ্রামগঞ্জের
মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছে অনেকাংশে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তা সত্ত্বেও
ড্রপআউট ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এসব পদক্ষেপ এই সমস্যা সমাধানের জন্য
অপ্রতুল বলে প্রমাণিত হয়েছে। প্রতি বছর এক কোটি ৬৪ লাখ ছেলেমেয়ের স্কুলে
যাওয়ার কথা বাংলাদেশে, তা বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, দরিদ্র
বাবা-মায়ের কাছে দুই পাতা মুখস্থ করার চেয়ে দুই পয়সা রোজগার অনেক বেশি
জরুরি। সন্তান একটু বড় হলে তারা চান, সে উপার্জনে সহায়তা করুক। তাই তারা
ছেলেসন্তানদের সাংসারিক প্রয়োজন মেটাতে কাজে লাগিয়ে দেন। আর যেখানে
ছেলেদেরই পড়াতে পারছেন না, সেখানে মেয়েদের তো প্রশ্নই ওঠে না। ফলে এত
প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যেতে বসেছে। এ পরিস্থিতিতে ছাত্রীদের পাশাপাশি
ছাত্রদের উপবৃত্তি উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত চালুর ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে জাতীয়করণ ও অবৈতনিক করা বাঞ্ছনীয় বলে
অনেকের অভিমত। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বিভিন্ন স্তরে যেসব দুর্বলতা রয়েছে
সেগুলো অবিলম্বে দূর করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের সামনে শিক্ষাশেষে
কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা অবশ্যই থাকতে হবে। তা হলে এই ঝরে পড়া অনেকটা ঠেকানো
সম্ভব হবে। এজন্য চাই বৃত্তিমূলক শিক্ষা। শিক্ষাব্যবস্থাকে গড়ে তুলতে হবে
জীবনঘনিষ্ঠ ও কর্মসংস্থানমুখী হিসেবে, যাতে অভিভাবকেরা আশ্বস্ত হতে পারেন
এই ভেবে যে, পড়া শেষ হলে সন্তান কাজ পাবে, বেকার থাকতে হবে না। এছাড়া
গ্রামগঞ্জের বেশির ভাগ অভিভাবকই অশিক্ষিত ও অল্পশিক্ষিত। ফলে মাধ্যমিক
পর্যায়ে ছেলেমেয়েকে পড়াশোনায় সাহায্য করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। দরিদ্রতার
কারণে প্রাইভেট পড়ানোও কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এটাও ড্রপআউটের অন্যতম কারণ।
মাধ্যমিক পর্যায়ে পড়াশোনা যাতে স্কুলেই সম্পন্ন করা যায়, তেমন ব্যবস্থা
স্কুলগুলোতে থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রাইভেট পড়ার প্রয়োজন যেন না পড়ে, এ দিকটি
বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। স্কুলগুলোতে লেখাপড়া ভালো না হলে পড়ার ভীতি
শিক্ষার্থীদের পেয়ে বসে। ফলে স্কুলে যেতে আগ্রহ বোধ করে না এবং রোজগারের
দিকে তারা ঝুঁকে পড়ে। এ দিকে সৃজনশীল পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের অধিক
কোচিং-নির্ভর করে তুলছে। বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা উচিত।
শিক্ষাব্যবস্থাপনায় যেসব সমস্যা বাসা বেঁধেছে, সেগুলোর যেকোনো মূল্যে
মূলোৎপাটন করতে হবে। খাতা দেখার কথিত উদার নীতি পরীক্ষা পাসের হার ও জিপিএ ৫
পাওয়ার ক্ষেত্রে অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে; কিন্তু শিক্ষার মানোন্নয়ন
এভাবে সম্ভব নয়। তাই ঢালাওভাবে জিপিএ ৫ পেলেও শিক্ষার মানের অবনতি লক্ষণীয়।
সব সম্ভবের এ দেশে সরকারি প্রাইমারি স্কুলের এমনও শিক্ষার্থী পাওয়া গেছে,
জিপিএ ৫ পেয়ে সমাপনী পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে অথচ পরীক্ষা দেয়নি। এমন
একাধিক ঘটনার খবর পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া, বিনামূল্যে বই
বিতরণ টাকার বিনিময়ে হয়েছে, এমন বিদ্যালয়ের সংখ্যাও কম নয়। আমাদের দেশে
বিভিন্ন সময়ে পাঁচটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, ৪৩
বছরেও মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থা আমরা পেলাম না। তা হলে এত কমিটি, কমিশন,
সিদ্ধান্ত, ঘোষণার ফল কী দাঁড়াল? শিক্ষাব্যবস্থায় বাস্তবসম্মত পরিবর্তন এনে
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীদের স্কুল ছেড়ে যাওয়ার
উদ্বেগজনক হার রোধ করে দেশকে শিক্ষা ক্ষেত্রে এগিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা
অবিলম্বে করা চাই।
No comments