প্রকৃতি- গোলাপ, গাঁদা, কুয়াশার দিন by আশীষ-উর-রহমান
(কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে দিগন্ত। ভোরে খেজুরের রস নিয়ে পথে নেমেছেন বিক্রেতা। শীতকালে গ্রামাঞ্চলের চেনা দৃশ্য। যশোরের মনিরামপুরের হাজরাইল গ্রাম থেকে সম্প্রতি ছবিটি তুলেছেন এহসান-উদ-দৌলা) শীত
বিদায় নিচ্ছে। তবে মাঘের শীত সত্যি এবার কাঁপিয়ে দিয়েছে। রাজধানীতে গত
কয়েক বছরই শীত এমন দাপুটে মেজাজে দেখা দেয়নি। সচরাচর ঢাকায় শীতের আগমন
ঘটে যেমন বিলম্বে, তেমিন মেজাজ-মর্জিতেও থাকে খানিকটা কুণ্ঠিত। এ বছর সেই
কুণ্ঠার খোলস ছেড়ে স্বরূপে আবির্ভূত। তার এ দাপটই বুঝিয়ে দিচ্ছে দেশের
অন্যত্র অবস্থা কতটা কম্পমান। গরম আবহাওয়ার এই দেশে শীত ক্ষণিকের অতিথির
মতো। দেশের উত্তরাঞ্চলেই সাধারণত এর প্রভাব তুলনামূলক প্রবল ও প্রলম্বিত।
কোনো কোনো বছর প্রাণহানির মতো বেদনাদায়ক ঘটনাও ঘটে। এখন অবশ্য ফি বছর
শীতার্ত মানুষের জন্য শীতবস্ত্র বিতরণ করে থাকেন সামর্থ্যবান লোকেরা ও
বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া গড়পড়তা সারা দেশে শীতে উৎসবের
আমেজই প্রধান। কার্তিকের পর থেকেই উষ্ণতা কমতে থাকে। ছোট হয়ে আসে দিন।
আকাশে কুয়াশার মলিন আঁচল ভাসতে চোখে পড়ে সকাল-সন্ধ্যায়। পৌষে সেই
কুয়াশার হালকা স্তর গভীর ও ধূমায়িত হয়ে আচ্ছন্ন করে তোলে দিকচক্রবাল।
শুরু হয় গায়ে কাঁটা দেওয়া কনকনে উত্তুরে হাওয়ার প্রবাহ। রাতভর ঝরে পড়া
শিশিরে ভিজে ওঠে ঘাস, লতাপাতা, ঘরবাড়ির টিনের ছাউিন। ঘাসের ডগায়, পাতার
কিনারে জমে থাকা স্বচ্ছ শিশিরবিন্দুতে ভোরের সোনািল রোদের স্পর্শ ছড়িয়ে
দেয় বড়ই মনোহর দ্যুতি। মুক্তোদানা বা হীরার কুচির সঙ্গে লোকে তার শোভার
তুলনা করে আসছে বহুকাল থেকে। আর শীতের এই রোদ কতই না আদরণীয়—‘মিঠে রোদ’,
‘সোনা রোদ’ ভালোবেসে দেওয়া এমন সব তার নাম। লেপ-কাঁথার ওম থেকে বেরিয়ে
এসে সকালে সেই মিঠে রোদে পিঠ দিয়ে বসার যে আরাম, শীত ছাড়া তা আর মেলে না
কখনো। মেলে না কিছুতে।
শীতের সঙ্গে উৎসবের সংযোগ অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে। কৃষিনির্ভর এ জনপদে ধান ও রকমারি সবজি উঠতে থাকে এ মৌসুমে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে পান কৃষকেরা। পিঠাপুলি, অতিথি আপ্যায়ন, যাত্রাপালায় গ্রামীণ জনপদে নির্ভার আনন্দের তরঙ্গ বয়ে যায়। অঢেল শাক-সবজি। মাঠের পর মাঠ ভরা শিম, কপি, গাজর, টমেটো, মটরশুঁটি, বরবটি, বেগুন, টমেটো প্রভৃতির আবাদ। আর সরিষার কথা বলতে হবে আলাদা করেই। আঁকাবাঁকা নদীর তীর বরাবর কুয়াশায় আবছা হয়ে থাকা দিগন্তের কাছাকাছি গ্রামের আভাস অবধি, কাঁচা হলুদে ভরিতে তোলা সরিষাখেতের যে চোখজুড়ানো সৌন্দর্য, তা একবার যার চোখে পড়ছে, তার স্মৃতির অ্যালবামে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে সেই ছবি। ঝলমলে সকাল বা পড়ন্ত বিকেলের কবোষ্ণ রোদ গায়ে মেখে ওই সরিষাখেতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে রাশিরাশি ফুলের ঝাঁজালো মধুর ঘ্রাণমাখা হিমেল হাওয়া ঝাপটা দিয়ে যায় নাকে। একটু কান পাতলেই ভেসে আসে মৌমাছির গুঞ্জন। আলপথে চলতে চলতে শিশিরে ভিজে যায় পায়ের পাতা। হয়তো চোখে পড়ে পোকামাকড় খুঁজতে থাকা লম্বা গলার সাদা বক। খেজুরগাছের মাথা থেকে রসের হাঁড়ি পেড়ে আনা বা হাঁড়ি বাঁধার দৃশ্য। বাড়ি উঠান বা ধান কেটে নেওয়া রিক্ত মাঠে গোল হয়ে বসে রোদ পোহানোর দৃশ্য। খুবই আটপৌরে, খুবই চেনা সবকিছু। তবুও কোথায় যেন তার মধ্যেই মিশে আছে গভীর আনন্দে মন পুলকিত করে তোলার মতো অনির্বচনীয় কিছু।
আমাদের দেশে তুষার পড়ে না। তবু শীতের শুষ্ক রুক্ষতা মৃত্যুর সঙ্গে তুলনীয়। গাছে গাছে মলিন, বিবর্ণ হয়ে আসে পাতা। ফেটে ঝরে পড়ে বাকল। অথচ এই রুক্ষ প্রকৃতিই ফুটিয়ে তোলে রক্তলাল গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া, মল্লিকাদের। এত রঙিন ফুলে ভরা মালঞ্চ শীত ছাড়া কার আছে আর! শহরে শীতের শোভা গজ-ফুটে মাপা ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে, এক চিলতে ঝুলবারান্দার টবে যত্নে ফোটানো এই ফুলগুলোই। চারপাশে এত ফুল ফোটাল শীত, তবু এ বছর শেষটা ভালো যাচ্ছে না তার। বোমায়, আগুনে ঝলসে যাচ্ছে মানুষের মুখ। কে আর না জানেন—মানুষের মুখের হাসির চেয়ে সুন্দরতম আর কিছু নেই। যাওয়ার আগে মানুষের মন থেকে হিংসা-ক্রুদ্ধতা মুছে ফেলে তার হৃদয়কুসুমকে আবার ফুটিয়ে তুলতে পারবে কি এই শীত? আহ্, কতই না মধুর হতো, যদি তা পারত সে!
শীতের সঙ্গে উৎসবের সংযোগ অর্থনৈতিক সচ্ছলতার কারণে। কৃষিনির্ভর এ জনপদে ধান ও রকমারি সবজি উঠতে থাকে এ মৌসুমে। হাড়ভাঙা পরিশ্রমের ফসল বিক্রি করে নগদ টাকা হাতে পান কৃষকেরা। পিঠাপুলি, অতিথি আপ্যায়ন, যাত্রাপালায় গ্রামীণ জনপদে নির্ভার আনন্দের তরঙ্গ বয়ে যায়। অঢেল শাক-সবজি। মাঠের পর মাঠ ভরা শিম, কপি, গাজর, টমেটো, মটরশুঁটি, বরবটি, বেগুন, টমেটো প্রভৃতির আবাদ। আর সরিষার কথা বলতে হবে আলাদা করেই। আঁকাবাঁকা নদীর তীর বরাবর কুয়াশায় আবছা হয়ে থাকা দিগন্তের কাছাকাছি গ্রামের আভাস অবধি, কাঁচা হলুদে ভরিতে তোলা সরিষাখেতের যে চোখজুড়ানো সৌন্দর্য, তা একবার যার চোখে পড়ছে, তার স্মৃতির অ্যালবামে চিরকাল অমলিন হয়ে থাকবে সেই ছবি। ঝলমলে সকাল বা পড়ন্ত বিকেলের কবোষ্ণ রোদ গায়ে মেখে ওই সরিষাখেতের পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে রাশিরাশি ফুলের ঝাঁজালো মধুর ঘ্রাণমাখা হিমেল হাওয়া ঝাপটা দিয়ে যায় নাকে। একটু কান পাতলেই ভেসে আসে মৌমাছির গুঞ্জন। আলপথে চলতে চলতে শিশিরে ভিজে যায় পায়ের পাতা। হয়তো চোখে পড়ে পোকামাকড় খুঁজতে থাকা লম্বা গলার সাদা বক। খেজুরগাছের মাথা থেকে রসের হাঁড়ি পেড়ে আনা বা হাঁড়ি বাঁধার দৃশ্য। বাড়ি উঠান বা ধান কেটে নেওয়া রিক্ত মাঠে গোল হয়ে বসে রোদ পোহানোর দৃশ্য। খুবই আটপৌরে, খুবই চেনা সবকিছু। তবুও কোথায় যেন তার মধ্যেই মিশে আছে গভীর আনন্দে মন পুলকিত করে তোলার মতো অনির্বচনীয় কিছু।
আমাদের দেশে তুষার পড়ে না। তবু শীতের শুষ্ক রুক্ষতা মৃত্যুর সঙ্গে তুলনীয়। গাছে গাছে মলিন, বিবর্ণ হয়ে আসে পাতা। ফেটে ঝরে পড়ে বাকল। অথচ এই রুক্ষ প্রকৃতিই ফুটিয়ে তোলে রক্তলাল গোলাপ, গাঁদা, ডালিয়া, মল্লিকাদের। এত রঙিন ফুলে ভরা মালঞ্চ শীত ছাড়া কার আছে আর! শহরে শীতের শোভা গজ-ফুটে মাপা ফ্ল্যাট বাড়ির ছাদে, এক চিলতে ঝুলবারান্দার টবে যত্নে ফোটানো এই ফুলগুলোই। চারপাশে এত ফুল ফোটাল শীত, তবু এ বছর শেষটা ভালো যাচ্ছে না তার। বোমায়, আগুনে ঝলসে যাচ্ছে মানুষের মুখ। কে আর না জানেন—মানুষের মুখের হাসির চেয়ে সুন্দরতম আর কিছু নেই। যাওয়ার আগে মানুষের মন থেকে হিংসা-ক্রুদ্ধতা মুছে ফেলে তার হৃদয়কুসুমকে আবার ফুটিয়ে তুলতে পারবে কি এই শীত? আহ্, কতই না মধুর হতো, যদি তা পারত সে!
No comments