জনগণ কী বার্তা দিচ্ছে by মাসুদ মজুমদার
প্রধানমন্ত্রী
তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিলেনÑ শোকাহত খালেদা জিয়াকে সান্ত্বনা দিতে যাবেন।
এক পক্ষ প্রস্তুত ছিলÑ রাজনৈতিক ফায়দা তুলবেন। তাৎক্ষণিক শুরু হলো ফায়দা
তোলার অনৈতিক ফন্দিফিকির। অন্য পক্ষ রাজনীতি বোঝার চেষ্টাও করল না। প্রশ্ন,
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বিএনপির একজন সিনিয়র নেতাকেও বিষয়টি আগাম জানানো
হলো না কেন! কার্যত গৃহবন্দী একজন মানুষকে এভাবে সান্ত্বনা দিতে যাওয়ার
চিন্তা কোন ধরনের প্রটোকলের মধ্যে পড়ে? তা ছাড়া আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে
দুর্যোগের ঘনঘটা। যেকোনো সময় কিছু একটা ঘটে যেতে পারে। রটে যেতে পারে নতুন
কিছু ঘটে যাওয়ার গুজব। ঘোষণা না দিয়েই আবার বাকশালে প্রত্যাবর্তনের আয়োজন
সম্পন্ন হলো। তাই বিনা ঘোষণায় ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে যাওয়াও বিচিত্র
কিছু নয়। মানুষ কিছু ভাবতে পারছে না। কাল-পরশু কী ঘটবে সে সম্পর্কে আগাম
অনুমান করাও কঠিন। এ ধরনের অনিশ্চিত কিন্তু গুমোট পরিস্থিতিতে সব কিছু ঘটে
যাওয়া সম্ভব। এমন পরিস্থিতিতে সব অতীত-বর্তমান ভুলে সান্ত্বনার সৌজন্যবোধ
কতটা রক্তমূল্যে শোধ হবে সেটাও তো ছোট প্রশ্ন নয়। কোকোর লাশ আসা থেকে কবর
দেয়া পর্যন্ত কোনো কাজে সরকারের বাড়তি সহমর্মিতা দেখা গেল না। সেনাবাহিনীর
পরিবারের জন্য রীতিসিদ্ধ কবরস্থানে সাড়ে তিন হাত জায়গা কোকোর জন্য বরাদ্দ
হলো না। অথচ জনতা তার জানাজায় জানিয়ে দিলো ‘নিরপরাধ’ কোকোর নামাজে জায়গা
তাদের হৃদয়জুড়ে। সরকারকে শুধু জনভীতি তাড়া করছে। সামাজিক যোগাযোগ থেকে
মিডিয়াÑ সর্বত্র অঘোষিত নিয়ন্ত্রণই প্রত্যক্ষ করা গেল। তবু সাধুবাদ এ জন্য
যে, তারা জনস্রোত রুদ্ধ করতে বালুর ট্রাক ও জলকামানের ব্যবস্থা করেনি। এ
নামাজে জানাজায় জনগণ একটি নীরব বার্তা দিলো। শাসকদের উচিত এ বার্তা বুঝতে
চেষ্টা করা। তাই রাজনীতির পাঠ বন্ধ রেখে আজ হিন্দি ছবির জায়গা করে দেয়া
নিয়ে কথা হোক।
হিন্দি চলচ্চিত্রের আগ্রাসন ঠেকাতে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পী এবং কলাকুশলীরা মাঠে নামলেন। এর আগে তারা কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে প্রতিবাদ করেছেন। তাদের প্রতিবাদের ভাষা যৌক্তিক। ভাষাও ঋজু। প্রতিবাদের ধরনও পরিমিতিবোধসম্পন্ন। তবে তারা সোচ্চার হলেন উদোম হওয়ার পর। যদিও তাদের প্রতিবাদের কারণেই এত দিন ভারতীয় ছবি আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। অবশ্য এর আগে আমাদের ইজ্জত-আব্রু সবই খুলে নিয়েছে। লেংটিটা ধরে টান দিতেই তাদের বোধোদয় ঘটল। তা-ও নীতিগত কারণে নয়, বাণিজ্যিক কারণে। হিন্দি ছবি বাংলা ছবির বাজার নষ্ট করবে, তাই সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও কলাকুশলীরা রিজিকের ওপর হামলা ঠেকাতে মাঠে নামলেন। যখন আমাদের গায়ের চাদর, শার্ট-লুঙ্গি খুলে নিয়ে গেছে তখন তারা টুঁ শব্দটিও করলেন না। আগ্রাসন তো শুধু ছবি দিয়ে হয় না, আগ্রাসন হয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। যার পরিণতিতে আমাদের কপাল পুড়ল। তাই মানসিক দাসত্ব লালনকারীরা এই বাঙ্গাল জাতিকে হিন্দি ছবি দেখিয়েই ছাড়বে। ইতোমধ্যে চারটি ছবির অনুমোদন দিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, শিল্পী ও কলাকুশলীদের প্রতিপক্ষ ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রদর্শক সমিতি জানিয়ে দিলো, হিন্দি ছবি প্রদর্শনে বাধা দিলে যারা বাধা দিচ্ছে তাদের ছবি তারা দেখাবে না। এখানেও গাদ্দার, মীরজাফর ও লেন্দুপ দর্জির ভূমিকা স্পষ্ট। নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে জবাব পাই নাÑ আসলে আমরা সামগ্রিক অর্থে স্বাধীন থাকতে চাই কি না! হিন্দি ছবির বাজার অনেক বড়। ভারত দুনিয়াজুড়ে বিনোদন ও সেক্স বাণিজ্য করে। তাদের বাজার মধ্যপ্রাচ্য-দূরপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা মেনে নিয়েই আমাদের অবস্থান ঠিক করা উচিত। আমাদের আলু-পটোল থেকে স্বর্ণবাজার সবটা কার্যত ভারতের দখলে। গরু থেকে মুরগির বাচ্চা, ডিম থেকে ভিম কোনোটাই ভারতীয় না হয়ে উপায় নেই। ভারতীয়দের এখানে কাজ করতে ওয়ার্ক পারমিট লাগে না। কনসালটেন্সি ফি নিতে কৈফিয়ত দিতে হয় না। বাংলাদেশ এখন ভারতীয় অর্থলগ্নির লাভজনক ক্ষেত্র। ভারতীয় বণিকেরা নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আমাদের নাব্য নদী ভরাট করে রাস্তা বানিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় যাতায়াত করতেও তাদের কোনো পারমিশন লাগে না। ট্রানজিট ফি চাইতেও নাকি আমাদের ছোটলোকি ঠাওর করা উচিত। সরকারের উপদেষ্টারা এমনই মনে করেন। বাংলাদেশ এখন ভারতের পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রবাহের জোগানদার। দেশের একটা অঞ্চলের বিদ্যুতের চাবি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সীমান্তরক্ষীরা অসহায়, ফোলানীর লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারের ওপর। পাখি শিকারের মতো গুলি ছুড়ে ভারতের সীমান্ত রক্ষীরা বাংলাদেশী হত্যা করে। মাদক পাচার হয় তারা দেখে না। বাংলাদেশ ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা মাদকে ভাসছে। চোরাই পথে আসা অস্ত্রে সন্ত্রাসীরা দেশের ও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সব স্বর্ণ চোরাচালানির গন্তব্য ভারত। জনগণ দর্শক। সরকার নতজানু। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী পানি দেয় না ভারত। ছিটমহল সমস্যা ঝুলিয়ে রাখে দিনের পর দিন। সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে না ঠাণ্ডা মাথায়। ফারাক্কার কারণে আমাদের উত্তর জনপদ আজ মরুভূমি। ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ পড়লে মেঘনা ও পদ্মা অববাহিকায়ও মরুভূমি দেখা যাবে। আমরা সমুদ্র জয়ে উৎফুল্ল, হাঁড়িয়াভাঙ্গা দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে কোনো দুঃখবোধও নেই। আমরা কোনোকালে ভারতবিদ্বেষী কিংবা বিরোধী ছিলাম না। আজো নই। তা ছাড়া মানুষ নিজে পাল্টে যেতে পারে কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টাতে পারে না। তাই প্রতিবেশীর সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সহাবস্থানই শান্তিতে বাস করার এক মাত্র উপায়। প্রতিবেশী যত ক্ষমতাধরই হোক দাদাগিরি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, অর্থনৈতিক শোষণের প্রক্রিয়া অবলম্বন কোনোভাবে মানা যায় না। তাতে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। সার্বভৌমত্বের অহম বলে অবশিষ্ট কিছু থাকে না। একটি স্বাধীন ও সভ্য দেশের মানুষ হিসেবে আমরা ট্রানজিট নিয়ে নেপাল যেতে চাই, ভুটানের সাথে বাণিজ্য করতে চাই, চীনের সাথে কানেকশন চাই, ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান হয়ে ইরান, তুরস্ক যেতে চাই। ভারতের সাফ জবাব ‘না’ বলে না, কিন্তু পাত্তাও দেয় না। অথচ তারা আমাদের আকাশ-বাতাস, জল-স্থল সবটা তাদের মতো করে ‘উপভোগ’ করতে চায়। সার্কের পরিসর বড় হোক, ভারত চায় না। আমাদের সমস্যা সার্কে আলোচনার সুযোগ দেয় না, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ললিপপ দেখিয়ে কালক্ষেপণ করে চলেছে। চলচ্চিত্র শিল্পীরা আজ মাঠে নামার দায় বোধ করলেন। অথচ ভারতের জন্য আমাদের আকাশ অনেক আগেই উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ঘরে ঘরে ভারতীয় চ্যানেলের উপস্থিতি। আমাদের একটা চ্যানেলও তারা জায়গা করে দেয় না। তাই আমাদের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য আজ হুমকির মুখে। উর্দু তাড়াতে আমরা রক্ত ঢাললামÑ আর হিন্দিকে অভ্যর্থনা করে আনলাম। কলকাতার ককটেল বাংলা এখন নতুন প্রজন্মের মুখে। ডি জুইস ভাষার সাথে ওপারের ভাষার মিশ্রণে এবং হিন্দির কুপ্রভাবে অনেকেই ধরাশায়ী। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো, কোনো ভাষাই খারাপ বা মন্দ নয়। কোনো ভাষার প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়াও সমীচীন মনে করি না। সব ভাষা আল্লাহর দান। বেদ-বেদান্তনির্ভর সংস্কৃতিঘেঁষা বাংলার চেয়ে হিন্দির কূপমণ্ডূকতা কম বরং ধ্বনিতত্ত্বের কারণে উর্দু-হিন্দি অনেকটা যমজ। যদিও হিন্দি মূলত উত্তর ভারতের ভাষা। দেবনাগরি অক্ষরে হিন্দি লেখার রেওয়াজ চালু না করলে উর্দু-আরবি-ফারসির মতো হিন্দিও আরবি বর্ণমালায় লেখা হতো। ধ্বনিও হতো প্রায় উর্দুর মতো। হিন্দি এখন ভারতের রাষ্ট্রভাষা। কোনোভাবেই ভারতের সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা নয়। ভারতের বাঙালিরা নাকি আসল বাঙালি। আমরা মুসলমানি বাঙাল। আজব ব্যাপার যে, আমরা করলাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঢাকা বাংলা ভাষার রাজধানী হলো। মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ বানালাম। মুক্তিযুদ্ধে তারা আমাদের সাহায্যও করল। অথচ তারা করল হিন্দির কাছে আত্মসমর্পণ।
এখনো উর্দু-হিন্দির উচ্চারণগত কোনো সমস্যা নেই। যা আছে তা কিছু শব্দগত ও ব্যাকরণগত। অনেকেই হিন্দির ভেতর মুসলিম সংস্কৃতির গন্ধ পান। প্রচুর উর্দু-ফারসি ও আরবি শব্দ আত্মস্থ করার কারণেই এটা হয়েছে। আরো কারণ হিন্দিকে হিন্দুয়ানি করেছে কিছু সংস্কৃতি শব্দের আধিক্য। মূলত হিন্দি একধরনের সমন্বিত ভাষা। সব দেশের ভাষার মতো এটিও ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা। যেমন উর্দুকে ফৌজি ভাষা বা অবিভক্ত ভারতের ক্যান্টনমেন্টের ভাষা মনে করা হয়, এর অংশত সত্যও। কোনো ভাষাকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা আমাদের কাজ নয়। আমরা আমাদের ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলতে চাই। তাই বলে দরজা-জানালা বন্ধ করার প্রশ্ন ওঠে না। হিন্দির সাথে কিছু মুসলিম সংস্কৃতি বিধৌত শব্দ আছে। সেটা একেবারে গৌণ বিষয়। আমাদের আপত্তিটা হিন্দি সিনেমা নিয়েও নয়, আপত্তিটা তাদের যৌন, ভোগবাদী, অনৈতিক ও বৈদিক সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলে করে দেয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে। হিন্দিতে অনেক ভালো চলচ্চিত্র রয়েছে। সেসব ছবি আমাদের দেশে কম দেখা হয় না। কিন্তু অসম বাণিজ্যিক ধারায় অবাধে হিন্দি ছবি আসা শুরু হলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প হারিয়ে যাবে। সেই সাথে হারিয়ে যাবে আমাদের স্বাতন্ত্র্যটুকু। তখন আমরা সব কিছু দেখব তাদের চোখ দিয়ে। মগজ দিয়ে। অথচ আমরা তাদেরও আমাদের চোখ-মন ও মগজ দিয়ে দেখতে চাই। তাতে কারো কোনো ক্ষতি নেই। এ সরকার চলচ্চিত্র শিল্পীদের নন্দিত ও গণদাবি পূরণের ভান করবে। আশ্বাস দেবে কিন্তু দাবি মানবে না। কারণ তারা এ জাতির স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব পায়নি। তারা পেয়েছে জোরজবরদস্তি করে সরকার পরিচালনার ঠিকাদারি। তাই তাদের কাছে দাবি না জানিয়ে জনগণকে জানান। একাট্টা হয়ে সব ধরনের আগ্রাসন রুখে দিন।
হিন্দি চলচ্চিত্রের আগ্রাসন ঠেকাতে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পী এবং কলাকুশলীরা মাঠে নামলেন। এর আগে তারা কাফনের কাপড় মাথায় বেঁধে প্রতিবাদ করেছেন। তাদের প্রতিবাদের ভাষা যৌক্তিক। ভাষাও ঋজু। প্রতিবাদের ধরনও পরিমিতিবোধসম্পন্ন। তবে তারা সোচ্চার হলেন উদোম হওয়ার পর। যদিও তাদের প্রতিবাদের কারণেই এত দিন ভারতীয় ছবি আগ্রাসন ঠেকানো সম্ভব হয়েছে। অবশ্য এর আগে আমাদের ইজ্জত-আব্রু সবই খুলে নিয়েছে। লেংটিটা ধরে টান দিতেই তাদের বোধোদয় ঘটল। তা-ও নীতিগত কারণে নয়, বাণিজ্যিক কারণে। হিন্দি ছবি বাংলা ছবির বাজার নষ্ট করবে, তাই সংশ্লিষ্ট শিল্পী ও কলাকুশলীরা রিজিকের ওপর হামলা ঠেকাতে মাঠে নামলেন। যখন আমাদের গায়ের চাদর, শার্ট-লুঙ্গি খুলে নিয়ে গেছে তখন তারা টুঁ শব্দটিও করলেন না। আগ্রাসন তো শুধু ছবি দিয়ে হয় না, আগ্রাসন হয় রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। যার পরিণতিতে আমাদের কপাল পুড়ল। তাই মানসিক দাসত্ব লালনকারীরা এই বাঙ্গাল জাতিকে হিন্দি ছবি দেখিয়েই ছাড়বে। ইতোমধ্যে চারটি ছবির অনুমোদন দিয়ে দেয়া হয়েছে। একটা বিষয় লক্ষণীয়, শিল্পী ও কলাকুশলীদের প্রতিপক্ষ ইতোমধ্যে দাঁড়িয়ে গেছে। প্রদর্শক সমিতি জানিয়ে দিলো, হিন্দি ছবি প্রদর্শনে বাধা দিলে যারা বাধা দিচ্ছে তাদের ছবি তারা দেখাবে না। এখানেও গাদ্দার, মীরজাফর ও লেন্দুপ দর্জির ভূমিকা স্পষ্ট। নিজের বিবেককে প্রশ্ন করে জবাব পাই নাÑ আসলে আমরা সামগ্রিক অর্থে স্বাধীন থাকতে চাই কি না! হিন্দি ছবির বাজার অনেক বড়। ভারত দুনিয়াজুড়ে বিনোদন ও সেক্স বাণিজ্য করে। তাদের বাজার মধ্যপ্রাচ্য-দূরপ্রাচ্য ও পাশ্চাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত। এটা মেনে নিয়েই আমাদের অবস্থান ঠিক করা উচিত। আমাদের আলু-পটোল থেকে স্বর্ণবাজার সবটা কার্যত ভারতের দখলে। গরু থেকে মুরগির বাচ্চা, ডিম থেকে ভিম কোনোটাই ভারতীয় না হয়ে উপায় নেই। ভারতীয়দের এখানে কাজ করতে ওয়ার্ক পারমিট লাগে না। কনসালটেন্সি ফি নিতে কৈফিয়ত দিতে হয় না। বাংলাদেশ এখন ভারতীয় অর্থলগ্নির লাভজনক ক্ষেত্র। ভারতীয় বণিকেরা নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। আমাদের নাব্য নদী ভরাট করে রাস্তা বানিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় যাতায়াত করতেও তাদের কোনো পারমিশন লাগে না। ট্রানজিট ফি চাইতেও নাকি আমাদের ছোটলোকি ঠাওর করা উচিত। সরকারের উপদেষ্টারা এমনই মনে করেন। বাংলাদেশ এখন ভারতের পঞ্চম রেমিট্যান্স প্রবাহের জোগানদার। দেশের একটা অঞ্চলের বিদ্যুতের চাবি ভারতের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। আমাদের সীমান্তরক্ষীরা অসহায়, ফোলানীর লাশ ঝুলে থাকে কাঁটাতারের ওপর। পাখি শিকারের মতো গুলি ছুড়ে ভারতের সীমান্ত রক্ষীরা বাংলাদেশী হত্যা করে। মাদক পাচার হয় তারা দেখে না। বাংলাদেশ ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা মাদকে ভাসছে। চোরাই পথে আসা অস্ত্রে সন্ত্রাসীরা দেশের ও জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। সব স্বর্ণ চোরাচালানির গন্তব্য ভারত। জনগণ দর্শক। সরকার নতজানু। আন্তর্জাতিক রীতি অনুযায়ী পানি দেয় না ভারত। ছিটমহল সমস্যা ঝুলিয়ে রাখে দিনের পর দিন। সীমান্ত সমস্যার সমাধান করে না ঠাণ্ডা মাথায়। ফারাক্কার কারণে আমাদের উত্তর জনপদ আজ মরুভূমি। ভারতের টিপাইমুখে বাঁধ পড়লে মেঘনা ও পদ্মা অববাহিকায়ও মরুভূমি দেখা যাবে। আমরা সমুদ্র জয়ে উৎফুল্ল, হাঁড়িয়াভাঙ্গা দক্ষিণ তালপট্টি নিয়ে কোনো দুঃখবোধও নেই। আমরা কোনোকালে ভারতবিদ্বেষী কিংবা বিরোধী ছিলাম না। আজো নই। তা ছাড়া মানুষ নিজে পাল্টে যেতে পারে কিন্তু প্রতিবেশী পাল্টাতে পারে না। তাই প্রতিবেশীর সাথে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে সহাবস্থানই শান্তিতে বাস করার এক মাত্র উপায়। প্রতিবেশী যত ক্ষমতাধরই হোক দাদাগিরি, সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার, অর্থনৈতিক শোষণের প্রক্রিয়া অবলম্বন কোনোভাবে মানা যায় না। তাতে আমাদের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যায়। সার্বভৌমত্বের অহম বলে অবশিষ্ট কিছু থাকে না। একটি স্বাধীন ও সভ্য দেশের মানুষ হিসেবে আমরা ট্রানজিট নিয়ে নেপাল যেতে চাই, ভুটানের সাথে বাণিজ্য করতে চাই, চীনের সাথে কানেকশন চাই, ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান হয়ে ইরান, তুরস্ক যেতে চাই। ভারতের সাফ জবাব ‘না’ বলে না, কিন্তু পাত্তাও দেয় না। অথচ তারা আমাদের আকাশ-বাতাস, জল-স্থল সবটা তাদের মতো করে ‘উপভোগ’ করতে চায়। সার্কের পরিসর বড় হোক, ভারত চায় না। আমাদের সমস্যা সার্কে আলোচনার সুযোগ দেয় না, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার ললিপপ দেখিয়ে কালক্ষেপণ করে চলেছে। চলচ্চিত্র শিল্পীরা আজ মাঠে নামার দায় বোধ করলেন। অথচ ভারতের জন্য আমাদের আকাশ অনেক আগেই উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে। ঘরে ঘরে ভারতীয় চ্যানেলের উপস্থিতি। আমাদের একটা চ্যানেলও তারা জায়গা করে দেয় না। তাই আমাদের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্ব ও স্বাতন্ত্র্য আজ হুমকির মুখে। উর্দু তাড়াতে আমরা রক্ত ঢাললামÑ আর হিন্দিকে অভ্যর্থনা করে আনলাম। কলকাতার ককটেল বাংলা এখন নতুন প্রজন্মের মুখে। ডি জুইস ভাষার সাথে ওপারের ভাষার মিশ্রণে এবং হিন্দির কুপ্রভাবে অনেকেই ধরাশায়ী। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলে রাখা ভালো, কোনো ভাষাই খারাপ বা মন্দ নয়। কোনো ভাষার প্রতি বিদ্বিষ্ট হওয়াও সমীচীন মনে করি না। সব ভাষা আল্লাহর দান। বেদ-বেদান্তনির্ভর সংস্কৃতিঘেঁষা বাংলার চেয়ে হিন্দির কূপমণ্ডূকতা কম বরং ধ্বনিতত্ত্বের কারণে উর্দু-হিন্দি অনেকটা যমজ। যদিও হিন্দি মূলত উত্তর ভারতের ভাষা। দেবনাগরি অক্ষরে হিন্দি লেখার রেওয়াজ চালু না করলে উর্দু-আরবি-ফারসির মতো হিন্দিও আরবি বর্ণমালায় লেখা হতো। ধ্বনিও হতো প্রায় উর্দুর মতো। হিন্দি এখন ভারতের রাষ্ট্রভাষা। কোনোভাবেই ভারতের সংখ্যাগুরু মানুষের ভাষা নয়। ভারতের বাঙালিরা নাকি আসল বাঙালি। আমরা মুসলমানি বাঙাল। আজব ব্যাপার যে, আমরা করলাম রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ঢাকা বাংলা ভাষার রাজধানী হলো। মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ বানালাম। মুক্তিযুদ্ধে তারা আমাদের সাহায্যও করল। অথচ তারা করল হিন্দির কাছে আত্মসমর্পণ।
এখনো উর্দু-হিন্দির উচ্চারণগত কোনো সমস্যা নেই। যা আছে তা কিছু শব্দগত ও ব্যাকরণগত। অনেকেই হিন্দির ভেতর মুসলিম সংস্কৃতির গন্ধ পান। প্রচুর উর্দু-ফারসি ও আরবি শব্দ আত্মস্থ করার কারণেই এটা হয়েছে। আরো কারণ হিন্দিকে হিন্দুয়ানি করেছে কিছু সংস্কৃতি শব্দের আধিক্য। মূলত হিন্দি একধরনের সমন্বিত ভাষা। সব দেশের ভাষার মতো এটিও ধর্মনিরপেক্ষ ভাষা। যেমন উর্দুকে ফৌজি ভাষা বা অবিভক্ত ভারতের ক্যান্টনমেন্টের ভাষা মনে করা হয়, এর অংশত সত্যও। কোনো ভাষাকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করা আমাদের কাজ নয়। আমরা আমাদের ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জাতিগত স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করে চলতে চাই। তাই বলে দরজা-জানালা বন্ধ করার প্রশ্ন ওঠে না। হিন্দির সাথে কিছু মুসলিম সংস্কৃতি বিধৌত শব্দ আছে। সেটা একেবারে গৌণ বিষয়। আমাদের আপত্তিটা হিন্দি সিনেমা নিয়েও নয়, আপত্তিটা তাদের যৌন, ভোগবাদী, অনৈতিক ও বৈদিক সংস্কৃতির মাধ্যমে আমাদের নৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে দেউলে করে দেয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে। হিন্দিতে অনেক ভালো চলচ্চিত্র রয়েছে। সেসব ছবি আমাদের দেশে কম দেখা হয় না। কিন্তু অসম বাণিজ্যিক ধারায় অবাধে হিন্দি ছবি আসা শুরু হলে আমাদের চলচ্চিত্র শিল্প হারিয়ে যাবে। সেই সাথে হারিয়ে যাবে আমাদের স্বাতন্ত্র্যটুকু। তখন আমরা সব কিছু দেখব তাদের চোখ দিয়ে। মগজ দিয়ে। অথচ আমরা তাদেরও আমাদের চোখ-মন ও মগজ দিয়ে দেখতে চাই। তাতে কারো কোনো ক্ষতি নেই। এ সরকার চলচ্চিত্র শিল্পীদের নন্দিত ও গণদাবি পূরণের ভান করবে। আশ্বাস দেবে কিন্তু দাবি মানবে না। কারণ তারা এ জাতির স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব পায়নি। তারা পেয়েছে জোরজবরদস্তি করে সরকার পরিচালনার ঠিকাদারি। তাই তাদের কাছে দাবি না জানিয়ে জনগণকে জানান। একাট্টা হয়ে সব ধরনের আগ্রাসন রুখে দিন।
No comments