অবরুদ্ধ গণতন্ত্র, অসহায় মানুষ by ড. আবদুল লতিফ মাসুম
নির্বিঘ্নে
তিনি মতামত দিতে পারছেন এ কারণে যে, বিদেশে অবস্থান করেন। তথ্যপ্রযুক্তি-
ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার তাকে এ সুযোগ দিলেও বাংলাদেশে এটি বিপজ্জনক হতে
পারে। অনেককে সামান্যতম সমালোচনার জন্যও জেলে যেতে হচ্ছে। সম্প্রচার
নীতিমালার সুবাদে প্রতিটি শব্দের জন্য যে কেউ অভিযুক্ত হতে পারেন। তার পরও
মানুষ ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’। তার কারণ তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে।
গণতন্ত্রের বিপরীতে আইয়ুব, ইয়াহিয়া আর এরশাদের আমলে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট
হয়েছে মানুষ। পিষ্ট হয়েছে গণতন্ত্র। একটি কথিত গণতান্ত্রিক শাসনামলে আবার
ট্রাক ফিরে আসতে দেখে বিচলিত সাধারণ মানুষ।
১. স্থান বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়। বাড়ি-৬, সড়ক-৮৬, গুলশান-২। তারিখ : ৩ জানুয়ারি ২০১৫। সময় রাত পৌনে ১২টা। দেখা যাচ্ছে, অনেক ট্রাক এনে রেখে দেয়া হচ্ছে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে। কোনো কোনো ট্রাকে ইট ও বালু ভর্তি। টিভি চ্যানেলগুলো বলছে, বেগম জিয়ার অফিসের সামনের রাস্তার পুরোটিই এ ধরনের যানবাহনে ভর্তি। এ ছাড়াও রাস্তার দু’ধারে পুলিশের চারটি লরি আড়াআড়িভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। রয়েছে ১৯ প্লাটুন পুলিশ। মোতায়েন করা হয়েছে জলকামান ও রায়টকার। যেন এক অঘোষিত যুদ্ধক্ষেত্র। কার্যালয়ের ভেতরে কাউকে প্রবেশ কিংবা বের হতে দিচ্ছে না পুলিশ। তারা সব গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
২. রাত পৌনে ১২টার দিকে বেগম খালেদা জিয়া অফিস থেকে বের হওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তালাবদ্ধ গেট খুলে দেয়নি পুলিশ। বেগম জিয়া গাড়িতে উঠলেও বের হতে দেয়া হয়নি। অনন্যোপায় হয়ে নিজ অফিসে ফিরে যান বেগম জিয়া। ৫ জানুয়ারি বিকেলে তিনি আবারো গেটে আসেন। উদ্দেশ্য, ২০ দলীয় জোট আহূত জনসমাবেশে যোগদান। অবরুদ্ধ নেতাকর্মীরা বের হওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করলে পুলিশ তাদের ওপর পেপার ¯স্প্রে নিক্ষেপ করে। এতে বেগম জিয়াসহ উপস্থিত সাংবাদিক ও নেতাকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেগম জিয়ার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ডাকা হয়। উল্লেখ্য, এই মরিচের গুঁড়া বিষাক্ত হওয়ায় ব্যবহারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত রয়েছে। এ ধরনের অমানবিক দৃশ্য ৩ জানুয়ারি থেকে এ লেখার দিন পর্যন্ত (২১.০১.১৫) দেখা গেছে। বিগত পনের দিন ধরে অবরুদ্ধ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন এখনো।
৩. বেগম খালেদা জিয়াকে এভাবে দৃশ্যত ‘গৃহবন্দী’ করার কারণ, তাকে ২০ দলীয় জোট আহূত জনসভায় যেতে না দেয়া। সবারই জানা কথা, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘অবৈধ’ নির্বাচনের প্রতিবাদে এবার ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোট এক প্রতিবাদ সমাবেশ এবং ৫ জানুয়ারিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অপর দিকে শাসক আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের বিজয় দিবস পালনের কর্মসূচি দেয়। কথিত সঙ্ঘাতের অভিযোগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ওই সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। এভাবে বিএনপির জনসভা বেআইনি ঘোষণা করলেও পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ।
৪. ৫ জানুয়ারি ঘোষিত কর্মসূচির অনুমতি না পেয়ে বিএনপি নয়া পল্টনের কার্যালয়ের সামনে জনসভার ঘোষণা দেয়। পুলিশ সেখানেও হানা দেয়। গোটা এলাকায় যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ পরিলক্ষিত হয়। বিএনপি অফিস তালাবদ্ধ করা হয়। ওই রাস্তায় শত শত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
১. স্থান বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়। বাড়ি-৬, সড়ক-৮৬, গুলশান-২। তারিখ : ৩ জানুয়ারি ২০১৫। সময় রাত পৌনে ১২টা। দেখা যাচ্ছে, অনেক ট্রাক এনে রেখে দেয়া হচ্ছে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে। কোনো কোনো ট্রাকে ইট ও বালু ভর্তি। টিভি চ্যানেলগুলো বলছে, বেগম জিয়ার অফিসের সামনের রাস্তার পুরোটিই এ ধরনের যানবাহনে ভর্তি। এ ছাড়াও রাস্তার দু’ধারে পুলিশের চারটি লরি আড়াআড়িভাবে রেখে দেয়া হয়েছে। রয়েছে ১৯ প্লাটুন পুলিশ। মোতায়েন করা হয়েছে জলকামান ও রায়টকার। যেন এক অঘোষিত যুদ্ধক্ষেত্র। কার্যালয়ের ভেতরে কাউকে প্রবেশ কিংবা বের হতে দিচ্ছে না পুলিশ। তারা সব গেটে তালা লাগিয়ে দিয়েছে।
২. রাত পৌনে ১২টার দিকে বেগম খালেদা জিয়া অফিস থেকে বের হওয়ার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তালাবদ্ধ গেট খুলে দেয়নি পুলিশ। বেগম জিয়া গাড়িতে উঠলেও বের হতে দেয়া হয়নি। অনন্যোপায় হয়ে নিজ অফিসে ফিরে যান বেগম জিয়া। ৫ জানুয়ারি বিকেলে তিনি আবারো গেটে আসেন। উদ্দেশ্য, ২০ দলীয় জোট আহূত জনসমাবেশে যোগদান। অবরুদ্ধ নেতাকর্মীরা বের হওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করলে পুলিশ তাদের ওপর পেপার ¯স্প্রে নিক্ষেপ করে। এতে বেগম জিয়াসহ উপস্থিত সাংবাদিক ও নেতাকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। বেগম জিয়ার চিকিৎসার জন্য ডাক্তার ডাকা হয়। উল্লেখ্য, এই মরিচের গুঁড়া বিষাক্ত হওয়ায় ব্যবহারে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত রয়েছে। এ ধরনের অমানবিক দৃশ্য ৩ জানুয়ারি থেকে এ লেখার দিন পর্যন্ত (২১.০১.১৫) দেখা গেছে। বিগত পনের দিন ধরে অবরুদ্ধ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া। তিনি মানবেতর জীবনযাপন করছেন এখনো।
৩. বেগম খালেদা জিয়াকে এভাবে দৃশ্যত ‘গৃহবন্দী’ করার কারণ, তাকে ২০ দলীয় জোট আহূত জনসভায় যেতে না দেয়া। সবারই জানা কথা, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ‘অবৈধ’ নির্বাচনের প্রতিবাদে এবার ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোট এক প্রতিবাদ সমাবেশ এবং ৫ জানুয়ারিকে গণতন্ত্র হত্যা দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। অপর দিকে শাসক আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের বিজয় দিবস পালনের কর্মসূচি দেয়। কথিত সঙ্ঘাতের অভিযোগে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ ওই সময়ের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে। এভাবে বিএনপির জনসভা বেআইনি ঘোষণা করলেও পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে আওয়ামী লীগ।
৪. ৫ জানুয়ারি ঘোষিত কর্মসূচির অনুমতি না পেয়ে বিএনপি নয়া পল্টনের কার্যালয়ের সামনে জনসভার ঘোষণা দেয়। পুলিশ সেখানেও হানা দেয়। গোটা এলাকায় যুদ্ধ যুদ্ধ সাজ পরিলক্ষিত হয়। বিএনপি অফিস তালাবদ্ধ করা হয়। ওই রাস্তায় শত শত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।
৫. জানুয়ারির ৩ তারিখে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে নাটকীয়ভাবে আটক করে পুলিশ। নির্বাচনপূর্ব এরশাদীয় স্টাইলে জোরপূর্বক তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেয়। পরে তিনি কৌশলে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। একই সময়ে পিএনপির বৈদেশিক সম্পর্কের দায়িত্বশীল নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা শমসের মবিন চৌধুরী বীর বিক্রমকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদুকে গ্রেফতার করা হয়। আরো গ্রেফতার করা হয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাহজাহানকে। সারা দেশ থেকে হাজার হাজার বিএনপি-জামায়াত কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
৬. ইতোমধ্যে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও গ্রেফতার করা হয়েছে। ৫ জানুয়ারি একটি অনুষ্ঠানে যোগদান করার জন্য তিনি প্রেস কাবে যান। সভা শেষে দৃশ্যত আওয়ামী সাংবাদিকদের প্ররোচনায় প্রজন্ম লীগ নামে ছাত্রলীগের একটি অপভ্রংশ মহাসচিবকে লক্ষ্য করে প্রেস কাবে হামলা চালায়। আলমগীর বের হতে না পেরে প্রেস কাবে ফিরে যান। রাতে নিরাপত্তার কারণে তিনি প্রেস কাব থেকে বের হতে পারেননি। পরদিন বিকেলে বের হওয়ার সময় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে।
৭. এ সময় আরেকটি ঘটনা ঘটে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল ইটিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে পুলিশ গ্রেফতার করে। কায়দা করে ইটিভির প্রচারণাও বন্ধ করে দেয়া হয় অনেক স্থানে। গ্রেফতারের সময় একটি পর্নোগ্রাফি মামলার কথা বলা হয়েছে। অথচ ওই মামলায় দায়ের করা এজাহারে সালামের নাম পর্যন্ত ছিল না। প্রকাশিত খবরে জানা যায়, লন্ডনে দেয়া তারেক রহমানের বক্তব্য সরাসরি প্রচার করার দায়েই তাকে গ্রেফতার করা হলো। এর পরদিন ৭ জানুয়ারি তারেকের বক্তব্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন হাইকোর্ট। ৮ জানুয়ারি লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান এবং ইটিভি চেয়ারম্যান আবদুস সালামের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করা হয়।
৮. ১৩ জানুয়ারি একটি হামলার ঘটনা ঘটে। এ দিন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব রিয়াজ রহমানের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়। আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার শরীরে চারটি স্থানে গুলির ক্ষত পাওয়া যায়। গুলিবর্ষণ প্রাক্কালে তার গাড়িতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে লোকজন তাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেন।
৯. সরকারি ষড়যন্ত্র এবং গ্রেফতারের পাশাপাশি বিএনপির শীর্ষ নেতাদের ভয় দেখানোর জন্য তাদের বাসাবাড়িতে ককটেল ও গুলিবর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ড. আবদুল মঈন খান, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের বাসায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
১০. মধ্য জানুয়ারিতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন প্রধানের রাজনৈতিক বক্তব্য সবাইকে হকচকিত করেছে। বাংলাদেশ বর্ডার গার্ড প্রধান মেজর জেনারেল আজিজ আহম্মেদ ১৫ জানুয়ারি পিলখানার দরবার হলে বিজিবি কর্তৃক সরাসরি গুলিবর্ষণের কথা বলেন। পরদিনই রংপুর জেলার মিঠাপুকুরে পুলিশের নতুন আইজি শহিদুল হক ও র্যাবের ডিজি বেনজীর আহমেদ এক জনসভায় ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের অভিন্ন ভাষায় কথা বলেন। তারা বিরোধী দল ও জনগণকে কঠোর ভাষায় হুমকি দিয়েছেন। দেশে জাতীয় নির্বাচন কখন হবে কি হবে না সে ব্যাপারেও তারা মন্তব্য করেন। বিরোধী দলের শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের সম্পর্কেও তারা কটূক্তি করেছেন।
১১. পক্ষকালের এ রাজনৈতিক ঘনঘটার আগে বছরের প্রথম দিনে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরেছিল আইন ও সালিশকেন্দ্র (আসক)। ২০১৪ সালের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মন্তব্য করা হয় যে, দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উদ্বেগজনক অবস্থায় রয়েছে। প্রদত্ত তথ্যে জানা যায়, গত বছর (২০১৪) বন্দুকযুদ্ধের নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ১২৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এ সময় ৭৪ জনকে গুপ্তহত্যা বা গুম করা হয়েছে।
১২. বেগম খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারি দেশে অবরোধের ঘোষণা দেন। এ সময় তিনি বের হতে চেয়েও যখন বের হতে পারলেন না, তখন উপস্থিত সাংবাদিকদের মাধ্যমে এ ঘোষণা দেন। অনির্দিষ্টকালের জন্য ঘোষিত রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথ অবরোধের কার্যক্রমে সারা দেশ দৃশ্যত অচল হয়ে পড়েছে।
১৩. ঘোষিত অবরোধের পর সারা দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটাচ্ছে। নানাভাবে প্রাণহানি ঘটেছে। পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে কথিত কম্বিং অপারেশন তথা যৌথবাহিনীর আক্রমণ। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের কয়েকজন নেতাকর্মীকে কথিত বন্দুকযুদ্ধে হত্যা করা হয়েছে। অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। গ্রেফতার করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। হামলা ও মামলায় বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীরা দিশেহারা। অযাচিতভাবে বেশ কিছু সাধারণ মানুষ ভায়োলেন্সের শিকার হয়েছেন। বিরোধী দল বলছে, সরকারি কারসাজি। আর সরকার বলছে, বিরোধীদলীয় নীলনকশা। মরছে মানুষ। বাঘে-মহিষের লড়াইয়ে উলুখাগড়ার মতো জনগণ পিষ্ট হচ্ছে।
এসব বর্ণনার মাধ্যমে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের দেশ পরিচালনার একটি স্বচ্ছ চিত্র পাওয়া যাবে। ঘটনাবলির মাধ্যমে নিয়মতান্ত্রিকতা বা আইনের শাসনের বদলে কূটকৌশল, শঠতা, মিথ্যাচার, প্রতারণা এবং নগ্ন শক্তি প্রয়োগের ইতিবৃত্ত উদ্ভাসিত হয়েছে। প্রচলিত সাধারণ ভদ্রতা-সভ্যতা, সৌজন্য-সংস্কৃতি, রীতি-রেওয়াজ ও আইনকানুনের যে তোয়াক্কা তারা করেন না, তা তাদের আচরণের মাধ্যমে দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। সবাই অবহিত আছেন, বিএনপি ৫ জানুয়ারি ঢাকায় জনসভা করার অনুমতি চায়। কিন্তু সরকার অনুমতি দিতে অস্বীকার করে। বিএনপি যখন নিজ উদ্যোগে অফিস প্রাঙ্গণে জনসভা করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন সরকার দুটো ন্যক্কারজনক সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমত, তারা ইতঃপূর্বে অনুসৃত বেআইনি ধারায় বিএনপি আহূত জনসভাকে ভণ্ডুল করতে সর্বাত্মক ‘সরকারি হরতাল’ নিশ্চিত করে। তারা আগের মতোই সব ধরনের যানবহন বন্ধ করে দেয়। রাজধানীর সব প্রবেশপথে ব্যাপক তল্লাশি চালায়। জনগণকে হয়রানি করে। দ্বিতীয় কাজটি খালেদা জিয়াকে অবরুদ্ধ করা। বাংলাদেশের বিগত ৪৪ বছরের ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা। নির্বাচনের আগে তারা একই ঘটনার অবতরণা করেছিল। বরাবরের মতো তারা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মৌলিক অধিকার তারা কেড়ে নিয়েছে। তাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে আটকে রাখে; মতামত প্রকাশ এবং স্বচ্ছন্দে যাতায়াতের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। শুধু তাই নয়, ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব মিথ্যাচার ও প্রতারণার আশ্রয় নেয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, উনি তো বন্দী নন। ইচ্ছা করলে এখনই যেতে পারেন। ত্রাণমন্ত্রী বলছেন, খালেদা জিয়া স্বেচ্ছায় অবরুদ্ধ। তথ্যমন্ত্রী বলছেন, উনাকে উসকানি থেকে বিরত করেছি। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সদর্পে বলেন, যত দিন প্রয়োজন, খালেদা জিয়া বেষ্টনীতে থাকবেন। পেপার স্প্রেতে অসুস্থতা প্রসঙ্গে স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাক্তার না হয়েও বলেন, তিনি অসুস্থতার ভান করছেন। গত কয়েক দিনে আওয়ামী লীগের নেতা-পাতিনেতা, মন্ত্রী-হাফমন্ত্রী মিলে যেসব নোংরা, কটুবাক্য বর্ষণ করেছেন তা কেবল ভদ্রদের মানায় না। এসব আচরণের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীনতা প্রমাণিত হয়েছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হচ্ছে, আওয়ামী লীগের এই নৈতিক দেউলিয়াত্বের সুযোগে আমলাতন্ত্র তথা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীপ্রধানদের অবাঞ্ছিত অবস্থান গ্রহণ। কয়েক বছর আগে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, রাজনীতি আর রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। তিন বাহিনীপ্রধানের মন্তব্যে কি তারই প্রমাণ মিলছে না? বিরোধীদলীয় নেতারা খুব জোর দিয়েই বলে আসছিলেন, সরকার সম্মতির বদলে শক্তি প্রয়োগের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এখন তিন বাহিনীপ্রধানের আচরণে প্রমাণ হলো রাজনৈতিকভাবে রাজনৈতিক ইস্যুগুলোর জবাব দেয়ার সক্ষমতা ও জনসম্পৃক্ততা আওয়ামী লীগের নেই। দেশকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করা হচ্ছে। কার্যত জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার নেই। একজন পর্যবেক্ষক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে বলেছেন : সারা দেশে ভীতির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং ফাদার ফিগার জেফারসনের একটি মন্তব্য উল্লেখ করা যায় : হোয়েন গভর্নমেন্ট ফিয়ার্স দ্য পিপল, দেয়ার ইজ ডেমোক্র্যাসি। বাট হোয়েন পিপল ফিয়ার্স দ্য গভর্নমেন্ট, দেন দেয়ার ইজ টিরানি। অর্থাৎ যখন সরকার জনগণকে ভয় করে চলে, তখন বুঝতে হবে দেশে গণতন্ত্র রয়েছে। আবার যখন দেখা যাবেÑ জনগণ সরকারকে ভয় করছে, তখন বুঝতে হবে, দেশে স্বৈরতন্ত্র কায়েম হয়েছে। বাংলাদেশে কোন তন্ত্র কায়েম রয়েছে, প্রত্যেক নাগরিক বুকে হাত দিলেই তা বুঝতে পারবেন। বাংলাদেশের মানুষ সতত এবং সাধারণভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন প্রমাণ করে তারা গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিতেও কুণ্ঠিত নয়। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বৈরতন্ত্রের যেকোনো ট্রাক তা হোক আইয়ুব, ইয়াহিয়া, এরশাদ অথবা অন্য কারো, তা রুখে দিতে বাংলাদেশের মানুষ আজো প্রতিজ্ঞ। ট্রাক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ’৬৯-এর গণ-আন্দোলনে কবি আল মাহমুদের সেই সাহসী উচ্চারণ মানুষ ভোলেনি : ‘ট্রাক ট্রাক ট্রাক/মতিউরকে ডাক/ শুয়োরমুখো গোঁয়ার এলো/ দুয়ার বেঁধে রাখ।’
লেখক : প্রফেসর, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments