পৃথিবীর সম্পদ ও এর ভোগব্যবস্থা by এবনে গোলাম সামাদ
পত্রিকায়
অক্সফাম প্রদত্ত বর্তমান বিশ্বের সম্পত্তির হিসাবসংক্রান্ত বিবরণ পড়ছিলাম।
অক্সফামের হিসাব অনুসারে বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ শতকরা ১ ভাগ মানুষের হাতে
গিয়ে পড়েছে। অন্য দিকে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের কাছে আছে মাত্র ৫.৫ শতাংশ
সম্পদ। অক্সফাম সম্পদ বলতে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছে তা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়।
সাধারণ অর্থনীতির বইতে প্রাকৃতিক সম্পদ আর সম্পদকে (Wealth) এক করে দেখা
হয় না। সম্পদ বলতে বোঝায়, প্রাকৃতিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যা তৈরি করে
তাকে; যেমন- কলকারখানা। বিশ্বের অর্ধেক সম্পদ শতকরা ১ ভাগ লোকের হাতে, এ
কথায় ঠিক কী বুঝতে হবে সেটা স্বচ্ছ নয় অনেকেরই কাছে। পত্রিকার খবর পড়ে এ
বিষয়ে কিছু অনুমান করা যাচ্ছে না। আমাদের হাতে এর বিস্তারিত প্রতিবেদন এসে
পৌঁছায়নি। এই সীমাবদ্ধতাকে বিবেচনায় রেখেই বর্তমান আলোচনার অবতারণা।
মানুষের ভোগের সীমাবদ্ধতা আছে। কারণ হলো, মানুষের শরীর এমনভাবে তৈরি যে, সে
মানতে বাধ্য হয় তার দেহের ভোগ করার সীমানাকে। আমার ঘরে যথেষ্ট চাল থাকার
অর্থ এই নয় যে, প্রতিদিন ১০ থালা ভাত খেতে পারব। আমার খাদ্য গ্রহণের একটা
বাস্তব সীমাবদ্ধতা আছে। বেশি ভোগ করতে গেলে ভোগ দুর্ভোগে পরিণত হতে পারে।
কথায় বলে ‘গরিব মরে না খেয়ে, আর বড়লোক মরে বেশি খেয়ে’। সব মানুষই মরে।
মানুষ মরণশীল। মৃত্যুর সীমানা দিয়ে ঘেরা মানুষের জীবন। এর বাইরে সে যেতে
পারে না। প্রশ্ন উঠছে, শতকরা এই ১ ভাগ লোক আসলে কতটা ভোগ করছেন। তারা যদি
বিশ্বের অর্ধেক সম্পদের সবটুকুই ভোগ করতে চান এবং অন্যদের কিছুই না দিতে
চান, তবে বিশ্বে এত লোক বাঁচছে কী করে। তাদের জন্য স্বাভাবিক ছিল না খেয়ে
মরে যাওয়া। তাই বলা চলে না যে, বিশ্বের শতকরা ১ ভাগ মানুষের হাতে অর্ধেক
সম্পদ চলে যাওয়ার মানে হচ্ছে, এই সম্পদের আয় থেকে আর সবাই হচ্ছে বঞ্চিত।
এটা কখনোই হতে পারে না। কিন্তু অক্সফামের হিসাব থেকে এই রকম বিভ্রান্তি
সৃষ্টি হতে পারছে। কোনো ব্যক্তি যখন তার ব্যক্তিমালিকানায় একটি কারখানা
স্থাপন করেন, তখন তাকে নিয়োগ করতে হয় শ্রমিক। নিয়োগ করতে হয় নানা পর্যায়ে
কর্মকর্তা যারা কারখানার প্রশাসন পরিচালনা করে। কোনো ব্যক্তি একা কোনো
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে না। তাই একটি কারখানার আয় কেবল যে
একজন ভোগ করেন, তা নয়। তিনি যখন কোনো কারখানা স্থাপন করেন, তখন হতে পারে
বহু লোকের কর্মসংস্থান। কিন্তু পত্রিকায় প্রকাশিত, অক্সফামের প্রতিবেদন পড়ে
মনে হচ্ছেÑ ‘বিশ্বের শতকরা ১ ভাগ লোকই কেবল ভোগ করছেন বিশ্বের শতকরা ৫০
ভাগ সম্পদের আয়। আর এ জন্যই ঘুচছে না বিশ্বের অভাব অনটন।’ গরিবেরা গরিব,
কারণ তাদের হাতে কোনো সম্পদ নেই। পৃথিবীর শতকরা ৫০ ভাগ সম্পদ নাকি চলে গেছে
শতকরা মাত্র ১ ভাগ মানুষের হাতে। অক্সফামের প্রতিবেদন পড়ে বোঝা যাচ্ছে না,
বিশ্বের আর শতকরা ৫০ ভাগ সম্পদ কাদের হাতে কী পরিমাণ আছে। প্রতিবেদন
অনুসারে এই সম্পদের শতকরা ৫ দশমিক ৫ ভাগ আছে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষের হাতে।
অক্সফাম বলছে, দারিদ্র্য বিমোচন করতে হলে ধনিক শ্রেণীর ওপর বাড়াতে হবে
আয়কর। বন্ধ করতে হবে আয়কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা। কিন্তু সব দেশেই দেখা যায়,
আয়কর বাড়ালে বাড়ে কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা। সাদা টাকা পরিণত হয় কালো টাকায়।
‘কালো’ টাকা বলতে বোঝায় কর ফাঁকি দেয়া টাকা। তা দিয়ে ব্যবসাবাণিজ্য চলে
সরকারি হিসাবের বাইরে। আয়কর অতিরিক্ত বাড়ালে ব্যবসাবাণিজ্য বন্ধ হতে চায়।
আর তাই হতে দেখা যায় বেকারত্বের বৃদ্ধি। বেকার বাড়ার অর্থ দাঁড়ায়, ক্রেতার
সংখ্যা কমা। ক্রেতার সংখ্যা কমার অর্থ দাঁড়ায় উৎপাদিত পণ্যের বাজার
সঙ্কুচিত হয়ে পড়া। আর বাজার সঙ্কোচনের ফলে দেখা দেয় বাণিজ্যের মন্দা।
অর্থনৈতিক সমস্যা তাই হয়ে উঠতে পারে খুবই জটিল।
এক সময় সমাজতন্ত্রীরা বলতেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটাতে হবে। রাষ্ট্রকে নিতে হবে অর্থনীতি পরিচালনার ভার। রাষ্ট্রিক পরিকল্পনা অনুসারে চলবে একটা দেশের অর্থনৈতিক জীবন।’ কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর সমাজতন্ত্রের যুক্তিটা আর জোরালো শোনাচ্ছে না। রাষ্ট্রকে পরিণত করা যায় না একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। অন্য দিকে চীন সমাজতন্ত্রের পথ ছেড়ে গ্রহণ করেছে বাজার অর্থনীতির পথ। চীন বলছে না সমাজতান্ত্রিক সমাজ জীবন গড়ার কথা। বলছে না, সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। তাই আজ নতুন করে দেখা দিয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনার উপযোগিতা। কেউ বলছে না, ব্যক্তিগত মালিকানায় ব্যবসাবাণিজ্য করা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল ল্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ আমাদের সংবিধানে যখন সমাজতন্ত্রের প নিয়ে এই কথাগুলো লিখিত হয়, তখন কেউ ভাবতে পারেনি, সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়বে। আর চীন মাও জে দং-এর নীতি পরিত্যাগ করে গ্রহণ করবে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ। বিশ্বের পরিস্থিতি এখন ব্যাপকভাবেই বদলে গেছে। আমাদের সংবিধানের ওই অংশটি তাই পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। কেননা সমাজতন্ত্রে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। সমাজতন্ত্র বাস্তব েেত্র হয়ে দাঁড়ায় বিশেষভাবেই আমলাতন্ত্র। মানুষ হয়ে পড়ে আমলাতন্ত্রের শাসন ও শোষণের অধীন। সম্পত্তি জাতীয়করণ মানুষকে করে তোলে বিশেষভাবে রাষ্ট্রনির্ভর। সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক উৎপাদন কমে যায়, মানুষ হারায় তার স্বাবলম্বিতা।
অক্সফাম যেভাবে অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে চাচ্ছে, তা কিছুটা হলো সমাজতন্ত্রেরই অনুরূপ। এর ফলে অর্থনীতি হয়ে উঠবে আমলাতান্ত্রিক। কমে যাবে ব্যক্তিউদ্যোগের সুযোগ; আর সেই সাথে অর্থনৈতিক বিকাশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ব্যক্তির উদ্যোগে। এটা বন্ধ করলে অর্থনীতির হবে সমূহ তি, যেটা আমরা করতে পারি না। আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করেছিল এক ব্যাপক জাতীয়করণ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচি। এই নীতি অনুসারে সব চটকল, বস্ত্র ও সুতাকল, চিনিকল, বিমান ও জাহাজ চলাচল জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি মালিকানায় আসে। এগুলো আর ব্যক্তিমালিকানায় থাকেনি। সরকারি মালিকানায় আসে অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌযান। বহির্বাণিজ্যের বৃহদংশও জাতীয়করণের ফলে সরকারি প্রচেষ্টার অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ছাড়া ১৫ লাখ টাকা ও তার বেশি মূল্যের সব পরিত্যক্ত এবং অনুপস্থিত মালিকের সম্পত্তিও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। বিদেশী ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি ছাড়া সব দেশী ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি আনা হয় সরকারি নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে অর্থনীতিতে নেমে আসে বিরাট বিপর্যয়। দেখা দেয় পরিচালনার সঙ্কট। আমাদের পাটশিল্প হয়ে যায় ধ্বংস। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হয় এক বিরাট দুর্ভি। এতে কম করে হলেও মারা যায় ৬৫ হাজার লোক। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এ রকম ভায়বহ দুর্ভি ইতঃপূর্বে হয়েছে বলে জানা নেই। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন অর্থনীতিকে ব্যক্তিমালিকানায় ফিরিয়ে আনতে। তার সময় ব্যক্তিমালিকানায় শুরু হয় তৈরী পোশাক শিল্প, যা আজ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের েেত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এতে কাজ করছে প্রায় ১৬ লাখ শ্রমজীবী। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আরম্ভ হয় বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি। শুরু হয় ব্যক্তিমালিকানায় চিংড়ি ঘের তৈরি, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলে। আওয়ামী লীগ এখনো বলেছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা। বলছে আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরে গণতন্ত্রের কথা। কিন্তু বিএনপি তা বলছে না। বিএনপি বলছে না, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একে অপরের পরিপন্থী। কেননা, গণতন্ত্র উন্নয়নের পরিপন্থী হলে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধি পেতে পারত না। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের লড়াই কেবল মতার লড়াই নয়; এর গোড়ায় আছে আদর্শিক পার্থক্য। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে সমাজতন্ত্র কিন্তু বিএনপি চাচ্ছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি, যা পরিচালিত হবে দাম, লাভ ও উৎপাদনের খরচ নির্ভর করে; সরকারি আমলাদের পরিকল্পনা অনুসারে নয়। আমাদের অর্থনীতি এখনো হয়ে আছে মূলত কৃষি অর্থনীতি। এ অর্থনীতি হয়ে আছে দণি-পশ্চিম মওসুমি বায়ুনির্ভর। যে বছর কোনো কারণে দেখা দেয় খরার সমস্যা, অর্থাৎ বৃষ্টি হয় কম অথবা হলেও ঠিক সময় হয় না, সে বছর ফসল মার খায়। আবার যে বছর মওসুমি বায়ুর কারণে অতিবৃষ্টি হয় (বাতাসে আসে সমুদ্র থেকে অধিক পরিমাণে জলীয়বাষ্প), সে বছর সৃষ্টি হয় বন্যার সঙ্কট। বন্যার ফলেও ঘটে ফসলের বিরাট তি। আমাদের দেশের কৃষি এমন যে, শতকরা ১০ ভাগ ফসল কম হলেই দেখা দিতে পারে দুর্ভিরে পরিস্থিতি। মানুষ মরতে পারে অনাহারে। আমাদের দারিদ্র্যের কারণ কেবলই ধনিক শ্রেণীর শোষণের ফল নয়। এর মূলে আছে প্রাকৃতিক কারণও। তবে দুর্ভিরে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য কিনে মজুদ করে পরে বেশি দামে বেচে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে দুর্ভি নিতে চায় ভয়াবহ রূপ। এটা যাতে না হতে পারে, তার জন্য সরকারি প্রচেষ্টার অবশ্যই প্রয়োজন।
আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা এখনো হয়ে আছে, দুর্ভি প্রতিরোধের সমস্যা। কিন্তু কৃষি অর্থনীতিতে উন্নতি ঘটছে। আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ধান উৎপাদন করতে পারছি। আমাদের কৃষিক্ষেত্রে তেমজুরের অবস্থার ঘটেছে বিরাট উন্নতি। তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আয় করছে। এটাকে উপো করা চলে না আমাদের দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে। এসবই ঘটতে পারছে ব্যক্তিগত মালিকানায়; সরকারি মালিকানায় নয়। আমরা আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলছি না সরকারি যৌথ খামার। সেটা যদি করতে চাই, তবে আমাদের কৃষি অর্থনীতিতেও আসবে বিরাট বিপর্যয়। এ বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। রাশিয়ায় যত কারণে কৃষি উৎপাদন কমেছিল, তার একটি বড় কারণ হলো সরকারি যৌথ খামার গড়া। এ েেত্র আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি পৌঁছেছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। অক্সফাম বলছে, দরিদ্র মানুষকে দিতে হবে আর্থিক সহায়তা। কিন্তু এ েেত্র মনে রাখতে হবে, অক্সফাম যেভাবে দরিদ্র মানুষকে রাষ্ট্রিক সহায়তা দিতে বলছে, এতে সৃষ্টি হতে পারে একদল পেশাদার ভিখারি। যারা রাষ্ট্রের ওপর হয়ে উঠতে চাইবে একটা বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা; যেটা কাম্য নয়। এসব কথা বলছি, কেননা সমাজতন্ত্র গড়ার হুজুগে আমাদের দেশের অর্থনীতি হয়েছিল ভয়ঙ্করভাবে তিগ্রস্ত। আবার যদি সেই হুজুগ ওঠে, তবে অর্থনীতি অচল হয়েই পড়বে। পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ শতকরা ১ ভাগ মানুষের হাতে গিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সম্পদ এখন শতকরা কত ভাগ মানুষের হাতে আছে, তার হিসাব আমরা জ্ঞাত নই। কিন্তু আমাদের দেশে ছোট ছোট কৃষিজীবী অনেক। তারা যেভাবে কৃষিকাজ করছেন, তা না করে যদি সমবায় কৃষি পদ্ধতিতে নিজেরা স্বেচ্ছায় চাষাবাদ করেন, তবে ফসলের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া মানেই মানুষ খেতে পাওয়া নয়। কারণ বেকাররা খাদ্য কিনতে পারে না। তাই থাকতে হবে কর্মসংস্থান। আমাদের রাজশাহী অঞ্চলে আলুর ফলন যথেষ্ট হচ্ছে। আলু রাখা হচ্ছে হিমঘরে। কিন্তু অনেক সময় ক্রেতার অভাবে আলু থেকে যাচ্ছে হিমঘরেই। আর পচে নষ্ট হচ্ছে সেখানেই। একইসাথে আমরা কিনছি বিদেশ থেকে আমদানি করা পটেটো চিপ্স। অথচ এটা আমরা আমাদের দেশে উৎপাদিত আলুকে ভেজেও অবাধে করতে পারি। এ েেত্র কেউ অর্থ যদি বিনিয়োগ করেন, আমার মনে হয়, তিনি লাভবান হবেন। কারণ, দেশে পটেটো চিপ্স কেনার মতো যথেষ্ট ক্রেতা আছে। অভাব মানুষের নিত্যদিনের সাথী। অভাব ছিল এবং আছে। অভাবের সমস্যা সর্বতোভাবে বোধহয় মানুষ কখনোই সমাধান করতে পারবে না। আমরা যা করতে পারি, তা হলো অভাবের সমস্যাকে সহনশীল সীমানার মধ্যে বজায় রাখা।
পাদটিকা : প্রকাশ থাকে যে, ১৯৪২ সালে বিলাতে অক্সফাম নামের সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর হলো অক্সফোর্ড। অক্সফামের লক্ষ্য হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গরিবদের আর্থিক সাহায্য দেয়া, বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আর্থিক সাহায্য প্রদান এবং আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধানে নীতি নির্ধারণের জন্য গবেষণা করা। এবার পত্রপত্রিকায় যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, তা অক্সফামের গবেষণার ফল। তবে এক সময় অক্সফামের গবেষণার যে কদর ছিল, বর্তমানে তা আর নেই। এর একটা কারণ হলো, বিলাত বা ব্রিটেন আর এখন বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রস্থল নয় এবং বর্তমানে আর পারছে না অন্য দেশকে আগের মতো আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
এক সময় সমাজতন্ত্রীরা বলতেন, ‘ব্যক্তিগত মালিকানার অবসান ঘটাতে হবে। রাষ্ট্রকে নিতে হবে অর্থনীতি পরিচালনার ভার। রাষ্ট্রিক পরিকল্পনা অনুসারে চলবে একটা দেশের অর্থনৈতিক জীবন।’ কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর সমাজতন্ত্রের যুক্তিটা আর জোরালো শোনাচ্ছে না। রাষ্ট্রকে পরিণত করা যায় না একটা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। অন্য দিকে চীন সমাজতন্ত্রের পথ ছেড়ে গ্রহণ করেছে বাজার অর্থনীতির পথ। চীন বলছে না সমাজতান্ত্রিক সমাজ জীবন গড়ার কথা। বলছে না, সমাজতন্ত্রের মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন সম্ভব। তাই আজ নতুন করে দেখা দিয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে ব্যবসাবাণিজ্য পরিচালনার উপযোগিতা। কেউ বলছে না, ব্যক্তিগত মালিকানায় ব্যবসাবাণিজ্য করা বন্ধ করতে হবে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা আরো অঙ্গীকার করছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল ল্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’ আমাদের সংবিধানে যখন সমাজতন্ত্রের প নিয়ে এই কথাগুলো লিখিত হয়, তখন কেউ ভাবতে পারেনি, সমাজতন্ত্রের ধ্বজাধারী সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়বে। আর চীন মাও জে দং-এর নীতি পরিত্যাগ করে গ্রহণ করবে মুক্তবাজার অর্থনীতির পথ। বিশ্বের পরিস্থিতি এখন ব্যাপকভাবেই বদলে গেছে। আমাদের সংবিধানের ওই অংশটি তাই পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। কেননা সমাজতন্ত্রে মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে কিছু থাকে না। সমাজতন্ত্র বাস্তব েেত্র হয়ে দাঁড়ায় বিশেষভাবেই আমলাতন্ত্র। মানুষ হয়ে পড়ে আমলাতন্ত্রের শাসন ও শোষণের অধীন। সম্পত্তি জাতীয়করণ মানুষকে করে তোলে বিশেষভাবে রাষ্ট্রনির্ভর। সমাজতন্ত্রে অর্থনৈতিক উৎপাদন কমে যায়, মানুষ হারায় তার স্বাবলম্বিতা।
অক্সফাম যেভাবে অর্থনীতিকে গড়ে তুলতে চাচ্ছে, তা কিছুটা হলো সমাজতন্ত্রেরই অনুরূপ। এর ফলে অর্থনীতি হয়ে উঠবে আমলাতান্ত্রিক। কমে যাবে ব্যক্তিউদ্যোগের সুযোগ; আর সেই সাথে অর্থনৈতিক বিকাশ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটছে ব্যক্তির উদ্যোগে। এটা বন্ধ করলে অর্থনীতির হবে সমূহ তি, যেটা আমরা করতে পারি না। আমরা আমাদের দেশের ইতিহাসের পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ আওয়ামী লীগ সরকার গ্রহণ করেছিল এক ব্যাপক জাতীয়করণ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয়করণ কর্মসূচি। এই নীতি অনুসারে সব চটকল, বস্ত্র ও সুতাকল, চিনিকল, বিমান ও জাহাজ চলাচল জাতীয়করণের মাধ্যমে সরকারি মালিকানায় আসে। এগুলো আর ব্যক্তিমালিকানায় থাকেনি। সরকারি মালিকানায় আসে অভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌযান। বহির্বাণিজ্যের বৃহদংশও জাতীয়করণের ফলে সরকারি প্রচেষ্টার অন্তর্ভুক্ত হয়। এ ছাড়া ১৫ লাখ টাকা ও তার বেশি মূল্যের সব পরিত্যক্ত এবং অনুপস্থিত মালিকের সম্পত্তিও রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। বিদেশী ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি ছাড়া সব দেশী ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি আনা হয় সরকারি নিয়ন্ত্রণে। এর ফলে অর্থনীতিতে নেমে আসে বিরাট বিপর্যয়। দেখা দেয় পরিচালনার সঙ্কট। আমাদের পাটশিল্প হয়ে যায় ধ্বংস। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলজুড়ে সৃষ্টি হয় এক বিরাট দুর্ভি। এতে কম করে হলেও মারা যায় ৬৫ হাজার লোক। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে এ রকম ভায়বহ দুর্ভি ইতঃপূর্বে হয়েছে বলে জানা নেই। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চেয়েছিলেন অর্থনীতিকে ব্যক্তিমালিকানায় ফিরিয়ে আনতে। তার সময় ব্যক্তিমালিকানায় শুরু হয় তৈরী পোশাক শিল্প, যা আজ বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের েেত্র বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। এতে কাজ করছে প্রায় ১৬ লাখ শ্রমজীবী। জিয়াউর রহমানের শাসনামলে আরম্ভ হয় বিদেশে শ্রমশক্তি রফতানি। শুরু হয় ব্যক্তিমালিকানায় চিংড়ি ঘের তৈরি, যা বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল করে তোলে। আওয়ামী লীগ এখনো বলেছে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির কথা। বলছে আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরে গণতন্ত্রের কথা। কিন্তু বিএনপি তা বলছে না। বিএনপি বলছে না, গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একে অপরের পরিপন্থী। কেননা, গণতন্ত্র উন্নয়নের পরিপন্থী হলে ইউরোপের বেশির ভাগ দেশ, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড অর্থনৈতিক দিক থেকে সমৃদ্ধি পেতে পারত না। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের লড়াই কেবল মতার লড়াই নয়; এর গোড়ায় আছে আদর্শিক পার্থক্য। আওয়ামী লীগ চাচ্ছে সমাজতন্ত্র কিন্তু বিএনপি চাচ্ছে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বাজার অর্থনীতি, যা পরিচালিত হবে দাম, লাভ ও উৎপাদনের খরচ নির্ভর করে; সরকারি আমলাদের পরিকল্পনা অনুসারে নয়। আমাদের অর্থনীতি এখনো হয়ে আছে মূলত কৃষি অর্থনীতি। এ অর্থনীতি হয়ে আছে দণি-পশ্চিম মওসুমি বায়ুনির্ভর। যে বছর কোনো কারণে দেখা দেয় খরার সমস্যা, অর্থাৎ বৃষ্টি হয় কম অথবা হলেও ঠিক সময় হয় না, সে বছর ফসল মার খায়। আবার যে বছর মওসুমি বায়ুর কারণে অতিবৃষ্টি হয় (বাতাসে আসে সমুদ্র থেকে অধিক পরিমাণে জলীয়বাষ্প), সে বছর সৃষ্টি হয় বন্যার সঙ্কট। বন্যার ফলেও ঘটে ফসলের বিরাট তি। আমাদের দেশের কৃষি এমন যে, শতকরা ১০ ভাগ ফসল কম হলেই দেখা দিতে পারে দুর্ভিরে পরিস্থিতি। মানুষ মরতে পারে অনাহারে। আমাদের দারিদ্র্যের কারণ কেবলই ধনিক শ্রেণীর শোষণের ফল নয়। এর মূলে আছে প্রাকৃতিক কারণও। তবে দুর্ভিরে পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে ব্যবসায়ীরা খাদ্যশস্য কিনে মজুদ করে পরে বেশি দামে বেচে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করেন। ফলে দুর্ভি নিতে চায় ভয়াবহ রূপ। এটা যাতে না হতে পারে, তার জন্য সরকারি প্রচেষ্টার অবশ্যই প্রয়োজন।
আমাদের অর্থনীতির মূল সমস্যা এখনো হয়ে আছে, দুর্ভি প্রতিরোধের সমস্যা। কিন্তু কৃষি অর্থনীতিতে উন্নতি ঘটছে। আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি ধান উৎপাদন করতে পারছি। আমাদের কৃষিক্ষেত্রে তেমজুরের অবস্থার ঘটেছে বিরাট উন্নতি। তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি আয় করছে। এটাকে উপো করা চলে না আমাদের দেশের অর্থনীতির অগ্রগতির ক্ষেত্রে। এসবই ঘটতে পারছে ব্যক্তিগত মালিকানায়; সরকারি মালিকানায় নয়। আমরা আমাদের দেশে সমাজতান্ত্রিক ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গড়ে তুলছি না সরকারি যৌথ খামার। সেটা যদি করতে চাই, তবে আমাদের কৃষি অর্থনীতিতেও আসবে বিরাট বিপর্যয়। এ বিষয়ে সন্দেহ করার কোনো কারণ নেই। রাশিয়ায় যত কারণে কৃষি উৎপাদন কমেছিল, তার একটি বড় কারণ হলো সরকারি যৌথ খামার গড়া। এ েেত্র আমলাতান্ত্রিক গাফিলতি পৌঁছেছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে। অক্সফাম বলছে, দরিদ্র মানুষকে দিতে হবে আর্থিক সহায়তা। কিন্তু এ েেত্র মনে রাখতে হবে, অক্সফাম যেভাবে দরিদ্র মানুষকে রাষ্ট্রিক সহায়তা দিতে বলছে, এতে সৃষ্টি হতে পারে একদল পেশাদার ভিখারি। যারা রাষ্ট্রের ওপর হয়ে উঠতে চাইবে একটা বিরাট অর্থনৈতিক বোঝা; যেটা কাম্য নয়। এসব কথা বলছি, কেননা সমাজতন্ত্র গড়ার হুজুগে আমাদের দেশের অর্থনীতি হয়েছিল ভয়ঙ্করভাবে তিগ্রস্ত। আবার যদি সেই হুজুগ ওঠে, তবে অর্থনীতি অচল হয়েই পড়বে। পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদ শতকরা ১ ভাগ মানুষের হাতে গিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের সম্পদ এখন শতকরা কত ভাগ মানুষের হাতে আছে, তার হিসাব আমরা জ্ঞাত নই। কিন্তু আমাদের দেশে ছোট ছোট কৃষিজীবী অনেক। তারা যেভাবে কৃষিকাজ করছেন, তা না করে যদি সমবায় কৃষি পদ্ধতিতে নিজেরা স্বেচ্ছায় চাষাবাদ করেন, তবে ফসলের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি পাবে। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া মানেই মানুষ খেতে পাওয়া নয়। কারণ বেকাররা খাদ্য কিনতে পারে না। তাই থাকতে হবে কর্মসংস্থান। আমাদের রাজশাহী অঞ্চলে আলুর ফলন যথেষ্ট হচ্ছে। আলু রাখা হচ্ছে হিমঘরে। কিন্তু অনেক সময় ক্রেতার অভাবে আলু থেকে যাচ্ছে হিমঘরেই। আর পচে নষ্ট হচ্ছে সেখানেই। একইসাথে আমরা কিনছি বিদেশ থেকে আমদানি করা পটেটো চিপ্স। অথচ এটা আমরা আমাদের দেশে উৎপাদিত আলুকে ভেজেও অবাধে করতে পারি। এ েেত্র কেউ অর্থ যদি বিনিয়োগ করেন, আমার মনে হয়, তিনি লাভবান হবেন। কারণ, দেশে পটেটো চিপ্স কেনার মতো যথেষ্ট ক্রেতা আছে। অভাব মানুষের নিত্যদিনের সাথী। অভাব ছিল এবং আছে। অভাবের সমস্যা সর্বতোভাবে বোধহয় মানুষ কখনোই সমাধান করতে পারবে না। আমরা যা করতে পারি, তা হলো অভাবের সমস্যাকে সহনশীল সীমানার মধ্যে বজায় রাখা।
পাদটিকা : প্রকাশ থাকে যে, ১৯৪২ সালে বিলাতে অক্সফাম নামের সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর সদর দফতর হলো অক্সফোর্ড। অক্সফামের লক্ষ্য হলো, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গরিবদের আর্থিক সাহায্য দেয়া, বিভিন্ন দেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আর্থিক সাহায্য প্রদান এবং আর্থসামাজিক সমস্যার সমাধানে নীতি নির্ধারণের জন্য গবেষণা করা। এবার পত্রপত্রিকায় যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছে, তা অক্সফামের গবেষণার ফল। তবে এক সময় অক্সফামের গবেষণার যে কদর ছিল, বর্তমানে তা আর নেই। এর একটা কারণ হলো, বিলাত বা ব্রিটেন আর এখন বিশ্বরাজনীতির কেন্দ্রস্থল নয় এবং বর্তমানে আর পারছে না অন্য দেশকে আগের মতো আর্থিক সাহায্য প্রদান করতে।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
No comments