পাখি- কয়েকটি অসহায় ছানার কথা by শরীফ খান
(বাগেরহাটের বাদোখালী বিলে অসহায় তিনটি কালিমছানা l ছবি: লেখক) দুর্ভাগা
পাখি দম্পতির সৌভাগ্য এইটুকু যে, বিলের মাঝের এক টুকরা হোগলা বনের পাশের
একচিলতে নলখাগড়া বনে বাসা বানিয়ে, ছয়টি ডিম পেড়ে চারটি ছানা ফোটাতে
পেরেছিল। কিন্তু সৌভাগ্যটুকু চরম দুর্ভাগ্যে পরিণত হলো তখন—যখন ছানারা
একটু বড় হয়ে মায়ের পেছনে পেছনে চরতে শুরু করল। এক দুপুরে গরুর জন্য ঘাস
কাটতে তালের ডোঙ্গায় চড়ে এক বালক এল, নজরে পড়ে গেল মা-বাবা পাখিসহ চারটি
কুচকুচে কালো ছানা—যেন বা মুরগির ছানা। ডোঙ্গা ঘোরাল সে। কেননা, ধাওয়া
করে এই ছানাদের বা মা-বাবা পাখিকে ধরা সম্ভব নয় মোটেও, ধুরন্ধর-চতুর ও
বুদ্ধিমান পাখি এরা। বিলপাড়ের এক এয়ারগানধারী শিকারিকে ডোঙ্গায় বসিয়ে
আবার ফিরে এল, ধানবনে ডোঙ্গা ঢুকিয়ে মাথা নামিয়ে বসে অল্পক্ষণের অপেক্ষায়
এয়ারগানের গুলিতে মা পাখিটিকে পেড়ে ফেলল তরুণ শিকারি, বাবা পাখি ভয়ে উড়াল
দিয়ে কোন দিকে যে গেল—ঘাবড়ে গেছে ওটা বউয়ের ছটফটানি দেখে। একটি ছানাও
লুটিয়ে পড়েছে। অসহায় ছানা তিনটিকে হাঁটুজলে নেমে ধাওয়া করল
দুজনই—হোগলা-নলখাগড়া ও ছিটকা গাছের ঝোপঝাড় তছনছ করার সময় ছানা তিনটি
ভয়ে জল ছেড়ে শুকনো জায়গায় দৌড়ে পাড়ি দিয়ে নেমে পড়ল ওপাশের ধানবনে।
ওপরে শঙ্খচিলের চক্কর ছিল—ছিল তার ডাইভের প্রস্তুতিও, কিন্তু সুযোগ সে
পায়নি। বিলটির নাম বাদোখালীর বিল। ভেতরে বহু মাছের ঘের। ধানের আবাদ হয় বহু
বিঘা জায়গাজুড়ে। বাগেরহাট সদর থানায় এটির অবস্থান। অর্ধশতাব্দীর বেশি সময়
ধরে এই বিখ্যাত বিলটির পর্যায়ক্রমিক বদলে যাওয়া দেখেছি। এ বছরও দেখলাম।
নামার মতো জায়গা নেই—তবু পাখিরা নামে! খাবার নেই-ই বলতে গেলে—পাখিরা নামে
কেন তবু? নিরাপত্তার বালাই নেই, তবু কেন ওরা সুখের নীড় গড়ে ছানা
ফোটানোর আশায়! গুলি খায়—তবু কেন ওরা গুলির সামনে বুক পেতে দেয় বাদোখালীর
বিলে নেমে? এসব প্রশ্নের একটাই উত্তর—নামার মতো জায়গা নেই কোথাও—কোথাও
নেই নিরাপত্তা, খাদ্যসম্ভার। যেমন ওই কুচকুচে কালো ছানা তিনটি যদি বাবাকে
খুঁজে না পায়— কিংবা বাবা খুঁজে না পায় ছানাদের, তাহলে বাঁচবে না ছানা
তিনটি। কেননা, মা-বাবার প্রশিক্ষণ ছাড়া কোনো পাখির ছানাই শিখতে পারে না
নির্মম প্রকৃতির পাঠ, খাবার চেনে না, শত্রু-মিত্র চেনে না। ওদের বাবাও যে
বন্দুকের গুলি এড়িয়ে বেঁচে থাকবে, সে নিশ্চয়তাও নেই। হাওর-বাঁওড়-বিল-মাঠের
হোগলা-নলখাগড়াসহ অন্যান্য ঝোপের বাসিন্দা এই পাখিটির নাম কালিম। কায়েম
নামেও পরিচিত। খুলনা-গোপালগঞ্জ-বাগেরহাটে এটিকে বলা হয় ‘বুরি’। এটির
ইংরেজি নাম Purple Swamphen. বৈজ্ঞানিক নাম Porphyrio Porphyrio। ওজন ৬৫০
গ্রাম। একনজরে নীলচে-বেগুনি রঙের পাখি এটি। লেজের তলা সাদা। অনেকটাই
উটপাখির মতো দৌড়াতে পারে এরা শুকনো জায়গা দিয়ে। ঠোঁটে যেন এদের হীরার
ধার! কামড় দিয়ে মানুষের হাত-পায়ের চামড়া ফুটো করে দিতে পারে। আজও
বাগেরহাটসহ গোপালগঞ্জ এলাকার হাটবাজারে গোপনে-সদরে বিক্রি হতে দেখা যায়
এদের, বিক্রেতারা ওদেরই শরীরের একটা বড় পালক টেনে তুলে নাকের ভেতরে ঢুকিয়ে
দিয়ে নিচের ঠোঁটের তলা দিয়ে ঘুরিয়ে এনে আবারও ঢুকিয়ে দেয় নাকের ছিদ্রের
ভেতর। এতে এরা ঠোঁট ফাঁক করে কামড় দিতে পারে না আর। মূল খাদ্য এদের জলজ
ঝোপঝাড়ের বিভিন্ন পোকাপতঙ্গ, কচি পাতাসহ মাছ-ব্যাঙ ইত্যাদি। এদের
কণ্ঠস্বরটা সুরেলা—ধানের ফাঁপা নাড়া দিয়ে বাঁশি বানিয়ে সেই বাঁশিতে ফুঁ
দিলে যে রকম শব্দ হয়, অনেকটাই মিলে যায় বুরির কণ্ঠের সঙ্গে। জলজ ঝোপঝাড়ে
বাসা করে। ডিম পাড়ে তিন-সাতটি। ডিম ফোটে ১৮-২৩ দিনে। দেশের হাওরাঞ্চলে
আজও কিছু পোষা বুরি দেখা যায়। অথচ বন্য প্রাণী আইনে এদের ধরা-মারা-পোষা
দণ্ডনীয় অপরাধ। বাগেরহাটের বাদোখালী বিলের দিকে যদি নজর দেয় যথাযথ
কর্তৃপক্ষ, তাহলে ওই বিলের পাখিবৈচিত্র্য হয়তোবা টিকে থাকতে পারবে আরও
কিছুকাল।
No comments