‘পাপ করিনি সোহেলকে ভালবেসে বিয়ে করেছি’ by ওয়েছ খছরু
‘কোন
পাপ করিনি। সোহেলকে ভালবেসে বিয়ে করেছি। এক বউয়ের দুই স্বামী হতে পারে না।
সোহেলই আমার বৈধ স্বামী। সবকিছু জানার পরও আব্বু অন্যের সঙ্গে বিয়ে দিতে
চেয়েছিলেন। এটা পাপ। আমি আব্বুর এ সিদ্ধান্ত মেনে নেই নি। রাতের আঁধারে
চুপিসারে নিজের ইচ্ছায় স্বামী সোহেলের বাড়িতে চলে এসেছি।’ সিলেটের
বিয়ানীবাজারের আলোচিত আমেরিকান কইন্যা আফরোজা খানম মুন্নী গতকাল মানবজমিনকে
এ কথা জানান। এ সময় তিনি বলেন, ‘সোহেলকে বিয়ে করেছি ছয় বছর আগে। সোহেলও
সুদূর লন্ডন থেকে আমার টানে বাড়ি এসেছে। আমরা স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস
করছি। কিন্তু আব্বু আমার পেছনে লেলিয়ে দিয়েছেন গোয়েন্দা পুলিশ। এলাকার
গুণ্ডারা রাতে বাড়িতে চলে আসে। তাদের চোখ রাঙানিতে ভয় লাগে। এই দেশে কি আইন
নেই?’ বিয়ানীবাজারের আমেরিকান কইন্যা আফরোজা খানম মুন্নীর ঘটনা এখন আর
কারও অজানা নয়। সিলেটের গোয়েন্দা পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে উঠিয়ে আনার পর এই
ঘটনাটি নিয়ে পুরো সিলেটজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিষয়টি নজরে এসে আমেরিকান
এম্বেসিরও। তারাও গতকাল ফোন করে ঘটনার খোঁজখবর নিয়েছেন। আফরোজা খানম
মুন্নীর (২৬) বাড়ি সিলেটের বিয়ানীবাজারের পূর্ব খাসির নামগড় গ্রামে। তার
পিতা আজির উদ্দিন আমেরিকান প্রবাসী। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় বসবাস
করছেন। সোহেল আহমদের (৩০) বাড়ি একই এলাকার আঙ্গারজুর গ্রামে। তার পিতার
নামও আজির উদ্দিন। ঘটনার শুরু ২০০৮ সালে। ওই সময় সোহেল পেশায় ছিলেন একজন
ব্যবসায়ী। আর মুন্নী ছিলেন ছাত্রী। একই এলাকায় বাড়ি হওয়ায় দুজনের মধ্যে
প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন দুজনই ছিলেন বাংলাদেশের নাগরিক। এমন সময়
লন্ডনে ওয়ার্কপারমিটের সুযোগ আসে সোহেলের সামনে। সোহেল লন্ডনে যাওয়ার
প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন। সোহেল লন্ডনে চলে গেলে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের
ছেদ হবে- এমনটি অনুভব করেন তারা। এই অনুভব থেকে গোপনে দুজনই বিয়ে করার
সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা দুজন ২০০৮ সালের ২৬শে
সেপ্টেম্বর পার্শ্ববর্তী নিনদপুরের কাজী অফিসে গিয়ে শরিয়া মতো বিয়ে করেন।
কাজী অফিসে গিয়ে তারা বিয়ে করলেও দুটি পরিবারের অমতের কথা চিন্তা করে তারা
গোপন রাখেন। এরপর ওই বছরের ৪ঠা অক্টোবর লন্ডনে চলে যান সোহেল। আর মুন্নী
রয়ে যান বাংলাদেশে। লন্ডনে গেলেও মুন্নীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল
সোহেলের। এরপর দেশে আসেন মুন্নীর পিতা আজির উদ্দিন। তিনি দেশে এসে মুন্নীসহ
পরিবারের লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে চলে যান আমেরিকায়। ওদিকে, সোহেল চলে যান
লন্ডনে আর মুন্নী আমেরিকায়। কিন্তু তাদের মধ্যে সম্পর্কে ফাটল ধরেনি। বরং
দুজনই দুজনের প্রতি দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এদিকে, মুন্নী আমেরিকায়
যাওয়ার পর ধীরে ধীরে তাদের দুজনের বিয়ের বিষয়টি প্রকাশ হতে থাকে। মুন্নী ও
সোহেলের পরিবার এ বিষয়টি জানার পর ক্ষেপে যান মুন্নীর পিতা আজির উদ্দিন।
তিনি সোহেলের সঙ্গে মুন্নীর সম্পর্কের বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। এমনকি
বিয়ের বিষয়টিও তিনি মানেননি। এ কারণে আমেরিকায় থাকাকালেই প্রায় এক বছর
মুন্নীর সঙ্গে তার পিতার কথাবার্তা বলাও বন্ধ ছিল। ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল। এ
সময়ের মধ্যে কয়েকবার দেশে আসেন মুন্নীর পিতা আজির উদ্দিন। মাঝে একবার দেশে
এসে ঘুরে যান মুন্নীও। এ সময় সোহেলের পরিবারের পক্ষ থেকে একাধিকবার মুন্নীর
পিতার কাছে আনুষ্ঠানিক বিয়ের প্রস্তাব পাঠানো হয়। সোহেলের দুই ভাই, পিতাসহ
গ্রামের লোকজন তাদের বিয়ের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে এলে বারবার তাদের ফিরিয়ে
দেয়া হয়। এ ব্যাপারে মুন্নীর পিতা আজির উদ্দিন সোহেলের পরিবারকে তেমন
পাত্তা দেননি। এ অবস্থা চলার ফাঁকেই গত নভেম্বরে মুন্নীকে আমেরিকা থেকে
দেশে নিয়ে আসেন আজির উদ্দিন। ওঠেন নিজ বাড়ি বিয়ানীবাজারের পূর্ব খাসিরনামগড়
গ্রামে। তিনি দেশে এসে মুন্নীকে বিয়ে দেয়ার জন্য বর দেখা শুরু করেন।
একপর্যায়ে জকিগঞ্জের এক পাত্রের সঙ্গে তিনি মুন্নীর বিয়ে ঠিক করেন। এ সময়
মুন্নী নিজেও জানিয়ে দেন সোহেল তার স্বামী। তারা দুজন প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ায়
কাবিন করে বিয়ে করেছেন। কিন্তু মুন্নীর কথায় কান দেননি আজির উদ্দিন। তিনি
বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে ফেললে ২৬শে ডিসেম্বর সন্ধ্যা রাতে মুন্নী পিতার বাড়ি
থেকে স্বামী সোহেলের বাড়িতে চলে যান। ওদিকে, ২৮শে ডিসেম্বর রাতে সোহেলও
মুন্নীর টানে চলে আসেন দেশে। এদিকে, মুন্নী স্বামী সোহেলের বাড়ি চলে যাওয়ার
পর রাতেই করা হয় বাড়িতে হামলা। এ নিয়ে বিয়ানীবাজার থানায় জিডি পাল্টা জিডি
হয়েছে। ওদিকে, রোববার সকালে সিলেটের ডিবি পুলিশের এসআই গাজী মিজান
মুন্নীকে তার স্বামীর বাড়ি থেকে উঠিয়ে নিয়ে আসেন। ডিবি পুলিশ জানিয়েছে,
মুন্নীর পিতা আদালতে মামলা করেন। আর এ মামলা তদন্তের জন্য সিলেটের গোয়েন্দা
পুলিশকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তদন্তের অংশ হিসেবে রোববার মামলার তদন্তকারী
কর্মকর্তা মুন্নীর স্বামীর বাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি মুন্নীকে উদ্ধারের পর
সিলেট নিয়ে আসছিলেন। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি জেনে গেলে তাদের
নির্দেশে ডিবি কর্মকর্তা গাজী মিজান শ্বশুর ও ননদসহ মুন্নীকে শ্যাওলা
ব্রিজের কাছে রেখে আসেন। পুলিশ জানিয়েছে, গাজী মিজান অভিযোগের তদন্ত করতে
গিয়েছিলেন। কেন মুন্নীকে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা চালালেন- সে বিষয়টি নিয়ে
তদন্ত হচ্ছে। এদিকে, আমেরিকান কইন্যা আফরোজা খানম মুন্নীর খোঁজখবর নিয়েছে
আমেরিকান হাইকমিশন। গতকাল সকালে বিয়ানীবাজার থানার ওসি জুবের আহমদের সঙ্গে
আমেরিকান হাইকমিশনের একজন কর্মকর্তা ফোনে কথা বলেন। পরে ওসির কাছ থেকে
মোবাইল নাম্বার সংগ্রহ করে আমেরিকান কইন্যার সঙ্গে কথা বলেন ওই কর্মকর্তা।
দীর্ঘ সময় আলাপকালে আমেরিকান কইন্যা ওই কর্মকর্তাকে তার বাবা ও পরিবারের
লোকজনের নানা রকম নির্যাতনের কথা জানান। এ সময় তার বৈধ স্বামী থাকার পরও
তাকে ফোর্স ম্যারেজ দিতে দেয়ার চূড়ান্ত পরিকল্পনার কথাও জানান, ওই
কর্মকর্তাকে। আমেরিকান কইন্যা আফরোজা খানম মুন্নী জানান, সোমবার দুপুরে
আমেরিকান হাইকমিশনের সিটিজেন সার্ভিসের কর্মকর্তা মো. বখতিয়ার তার সঙ্গে
ফোনে কথা বলেন। দীর্ঘ আলাপকালে তার কাছে নির্যাতন ও হয়রানীর সব ঘটনা জানতে
চান। এ সময় তিনি সব ঘটনা ওই কর্মকর্তাকে খুলে বলেন এবং জানান, তাকে নিয়ে
তার বাবা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করেছেন। বাবার পক্ষের একের পর এক নির্যাতনে
তিনি ও তার স্বামীর পরিবার দিশেহারা। মুন্নী ওই কর্মকর্তাকে তিনি
জানিয়েছেন, তারা একে অপরকে ভালবেসে বিয়ে করেছেন। তিনি প্রাপ্ত বয়স্ক।
কিন্তু তার পিতা অন্যস্থানে তার বিয়ে ঠিক করেন। পাত্র পক্ষের কাছ থেকে তার
পিতা ২০ লাখ টাকা গ্রহণের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। পিতা ও তার পক্ষের
লোকজনের হাত থেকে মুন্নী ও তার স্বামীর বাড়ির লোকজনকে রক্ষা করার জন্য তিনি
আমেরিকান হাইকমিশনের সহায়তা চান। এ সময় ওই কর্মকর্তা মুন্নীকে কতিপয়
পরামর্শ দেন বলে মুন্নী জানান। এদিকে, মুন্নীর স্বামী সোহেল জানিয়েছেন,
তিনিও লন্ডন প্রবাসী। মুন্নীকে ভালবেসে বিয়ে করেছেন। তারা স্বামী-স্ত্রী।
সুতরাং অন্যের কাছে বিয়ে দেয়া বাংলাদেশের আইন, কিংবা ধর্মে নেই।
No comments