১৪ বছর ধরে অনশনরত শর্মিলাকে মুক্তির নির্দেশ by অমিতাভ ভট্টশালী
উত্তর পূর্ব ভারতের মনিপুর রাজ্য থেকে
সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহারের জন্য গত চোদ্দো বছর ধরে অনশন
করছেন যিনি, সেই ইরম শর্মিলাকে মুক্তি দিতে নির্দেশ দিয়েছে সেখানকার একটি
আদালত। আত্মহত্যার চেষ্টার অভিযোগে তিনি দীর্ঘদিন ধরেই গৃহবন্দী। দু হাজার
সালের নভেম্বর মাসে রাজধানী ইম্ফলে সেনাসদস্যরা ৬২ বছরের এক মহিলা সহ ১০
জনকে গুলি করে হত্যা করে, তার পর থেকেই শর্মিলা অনশন করছেন।
ইম্ফলের
আদালত আজ তাদের নির্দেশে জানিয়েছে যে ইরম শর্মিলার বিরুদ্ধে আত্মহত্যার
চেষ্টার যে অভিযোগ এনেছিল পুলিশ, তা তারা প্রমাণ করতে পারে নি। তাই
অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে ১৪ বছর ধরে অনশনরত ইরম শর্মিলাকে। মনিপুরের লৌহ
মানবী বা আয়রণ লেডি বলে খ্যাত ইরম শর্মিলা বর্তমানে একটি সরকারী হাসপাতালে
নজরবন্দী রয়েছেন ও তাঁকে নিয়মিত নাকে ঢোকানো নল দিয়ে তরল খাবার
খাওয়ানো হয়।
আদালতের নির্দেশের পরে মিজ. শর্মিলার
ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও মানবাধিকার আন্দোলনের সহকর্মী বাবলু লইতাংবাম বিবিসি
বাংলাকে জানিয়েছেন, “সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন
একটা সম্পূর্ণভাবে রাজনৈতিক দাবী।“
তবে মি. লইতাংবামের আশংকা পুলিশী
নজরদারী থেকে ছাড়া পেলে ইরম শর্মিলাকে নাক দিয়ে যে তরল খাবার দেওয়া হত,
সেটা হয়ত বন্ধ হয়ে যাবে, আর তাতে এই লৌহ মানবীর জীবনের আশঙ্কা দেখা দেবে।
তবে এ নিয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয় নি মানবাধিকার সংগঠনগুলো।
যে
সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন বা আফ্সপার বিরুদ্ধে আন্দোলন করছেন ইরম
শর্মিলা, সেটা সেনাবাহিনীর কাজের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বলে মন্তব্য
ভারতের প্রাক্তন সেনা প্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরীর।
জেনারেল
রায়চৌধুরী বলছিলেন, “ কোনও রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার যে অঞ্চলটাকে
অশান্ত এলাকা বলে চিহ্নিত করে সেখানে সেনা নামানোর সিদ্ধান্ত নেয়, তখনই এই
আইন বলবৎ করা হয়। সেনাবাহিনী নিজের থেকে কোনও জায়গায় যায় না, তাদের
ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু তাদের কাজ করার জন্য বিশেষ ক্ষমতার প্রয়োজন
আছে।“
এই বিশেষ আইন প্রত্যাহার যদি করতে হয় – যেটা শর্মিলা দীর্ঘদিন ধরে দাবী করে আসছেন, তার সবথেকে সহজ উপায় হল ওই রাজ্য সরকার সেনাবাহিনীকে সরিয়ে দিক। তাহলেই আর আইনের প্রয়োজন থাকবে না।
জেনারেল রায়চৌধুরীর আরও মন্তব্য, “এই
বিশেষ আইন প্রত্যাহার যদি করতে হয় – যেটা শর্মিলা দীর্ঘদিন ধরে দাবী করে
আসছেন, তার সবথেকে সহজ উপায় হল ওই রাজ্য সরকার সেনাবাহিনীকে সরিয়ে দিক।
তাহলেই আর আইনের প্রয়োজন থাকবে না।“
শুধু মনিপুর বা উত্তরপূর্ব ভারত
নয়, ভারত শাসিত কাশ্মিরেও এই আইন বলবৎ রয়েছে আর বিভিন্ন সময়েই এই আইনের
অপপ্রয়োগের অভিযোগ ওঠে। অনেক সময়েই সেনা সদস্যদের অনেক অন্যায় বা
কুকীর্তি এই আইনবলে চাপা দেওয়া হয়। প্রাক্তন সেনা প্রধান স্বীকারও করলেন
যে এই আইনের অপপ্রয়োগ হয়।
জেনারেল রায়চৌধুরীর কথায়, “বেশ কিছু
ক্ষেত্রে যে এই অভিযোগ সঙ্গত। তবে এটাও ঘটনা, যখনই অভিযোগ উঠেছে, তখনই
তদন্ত হয় – অনেককে কোর্ট মার্শালও করা হয়। সঠিক সংখ্যাটা বলতে পারব না,
কিন্তু দোষী প্রমাণিত হওয়ায় সেনাবাহিনীর অনেক সদস্যকে জেলে পাঠানো
হয়েছে।“
ইরম শর্মিলা সম্প্রতি ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র
মোদীকে চিঠি দিয়ে সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রত্যাহারের দাবী
জানিয়েছেন। মানবাধিকার কর্মী বাবলু লইতাংবাম বলছিলেন তাঁরা আশা করেন সুদিন
নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, তিনি হয়ত
উত্তরপূর্ব ভারতের সুদিন আনার জন্য এই কথিত কালাকানুন প্রত্যাহার করবেন।
বাবলু
লইতাংবামের কথায়, “ভারতে এখন দুটো দেশ রয়েছে – একটা সেনাবাহিনীর বিশেষ
ক্ষমতা আইনের অধীনে আর অন্যটা তার বাইরে। যে নরেন্দ্র মোদী সারা দেশে
ইউনিফর্ম সিভিল কোডের কথা বলেন, তাঁর তো এখন উচিত উত্তরপূর্বাঞ্চলের প্রতি
এই বৈষম্য দূর করার। এই অঞ্চলের মানুষের যে সমান অধিকার রয়েছে, সেটা সরকার
প্রমাণ করুক। একটা নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছন উচিত ভারত সরকারের।“
বিশেষ
আইন প্রত্যাহার করার ঘোষণা করে মি. মোদীই ইম্ফলে এসে শর্মিলার অনশন যদি
ভাঙ্গেন, তাহলে তা উত্তরপূর্ব ভারতের মানুষের কাছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে
থাকবে বলে মনে করেন বাবলু লইতাংবাম।
নিজের বাড়ীর কাছে ১০ জনকে আসাম
রাইফেলসের গুলিতে মারা যেতে দেখে ২০০০ সালের নভেম্বরে অনশন আন্দোলন শুরু
করেছিলেন ইরম শর্মিলা। গত ১৪ বছরে একাধিকবার পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেছে,
চলেছে জোর করে নল দিয়ে খাবার দেওয়া। এর আগেও একাধিকবার পুলিশ তাঁকে
মুক্তি দিয়েও পরমুহুর্তেই আবার গ্রেপ্তার করেছে এমনকি জাতীয় রাজধানী
দিল্লিতে তিনি যখন প্রতিবাদ জানাতে গিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা
আইনের বিরুদ্ধে, সেখানেও তাঁকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল।
রাজনৈতিক
দলগুলো বা সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরও এই আইনে পরিবর্তন আনার ইচ্ছা প্রকাশ
করেছে আগে, তবে আইন পরিবর্তনের ক্ষেত্রে সবথেকে বড় বাধা এসেছে সেনাবাহিনীর
তরফ থেকে।
No comments