আনন্দমেলা! একটি কল্পকাহিনি! by আসিফ নজরুল
বেগম খালেদা জিয়ার আজও ঘুম এল না। তিনি
ঘুমান অনেক রাত করে। যত রাত হয়, তাঁর মনে পড়ে পুরোনো দিনের শানশওকতের
কথা। মনে পড়ে ছেলেদের কথা, তাঁদের সন্তানদের কথা। মক্কা থেকে ঘুরে আসার পর
তাঁর মন আরও উতলা হয়ে উঠেছে তাঁদের জন্য।
দেশে ফেরার পর তাঁর দুর্ভাবনাও বেড়েছে। তিনি শুনছেন, অরফানেজের মামলায় তাঁকে জেলে দেওয়া হবে। জেলে যেতে তাঁর ভয় ছিল না কখনো। কিন্তু এবার তিনি কেন যেন বিচলিত বোধ করেন। তাঁর বয়স হয়েছে, দীর্ঘদিন তিনি একা টানছেন বিএনপির রাজনীতি। তিনি জানেন, তাঁর ছেলেরা দেশে ফিরতে পারবেন না। তিনি জেলে গেলে এই দলের হাল ধরার কেউ থাকবে না। নানা দুশ্চিন্তায় তাঁর মন অস্থির হয়ে ওঠে। সত্যি কি জেলে যেতে হবে তাঁকে, জিয়ার মাজার সরিয়ে ফেলা হবে, তাঁর দল ভেঙে টুকরা টুকরা করে ফেলা হবে?
শেখ হাসিনার ওপর তাঁর রাগ হয় খুব। তাঁকে ৪০ বছরের বাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলা হয়েছে, সংসদ থেকে হটিয়ে দেওয়া হয়েছে, তার লাল পাসপোর্ট সবুজ হয়ে গেছে। তাঁর প্রটোকল নেই, পরিবার নেই, অর্থ-প্রতিপত্তি-ক্ষমতা সবই প্রায় নিঃশেষিত। তবু কি শেখ হাসিনা থামবেন? থামবেন না।
তিনি উঠে গিয়ে জানালা খোলেন। বাইরে অঝোর বৃষ্টি। অনেক দূর পর্যন্ত ঢাকা শহরের আলোয় উদ্ভাসিত আকাশ। তাঁকে যদি কাশিমপুর জেলে পোরা হয়, এই আলো দেখবেন না তিনি বহু বছর। অথচ এবার নির্বাচনে জিতে এলে তিনিই শেখ হাসিনাকে কাশিমপুর পাঠাতেন। তাঁর আশপাশে ক্ষিপ্ত মানুষজন আছে। তারা আরও ভয়ংকর বিভিন্ন শাস্তি চিন্তা করে রেখেছিল। তিনি জানেন তা। তখন কেমন লাগত শেখ হাসিনার!
বৃষ্টির ঝাপটা এসে তাঁর মুখে লাগছে। তিনি হঠাৎ শেখ হাসিনা সেজে ভাবতে থাকেন তাঁর কথা। শেখ হাসিনাকে বগুড়ার মহিলা পুলিশ দিয়ে গ্রেপ্তার করানো হয়েছে, টিভিতে প্রচার হচ্ছে কত খারাপ আর কত ভয়ংকর ছিলেন তিনি, তাঁর সন্তানদের গ্রেপ্তারের জন্য ইন্টারপোলের সাহায্য চাওয়া হয়েছে, তাঁর বাবার নাম মুছে ফেলা হয়েছে সবকিছু থেকে। কেমন লাগত শেখ হাসিনার তখন!
বেগম জিয়া আশ্চর্য হয়ে দেখেন, শেখ হাসিনার জন্য মায়া লাগছে তাঁর। তিনি ভাবতে শুরু করলেন, শেখ হাসিনাকে সত্যি সত্যি কী কী কষ্ট দিয়েছেন তিনি। ১৫ অগাস্ট, ২১ অগাস্ট, এমনকি গত বছর অক্টোবরের টেলিফোন সংলাপের কথা মনে পড়ল তাঁর। তিনি টের পান না, কখন যেন ভোরের বৃষ্টির হিমেল স্পর্শ এসে লাগল তার মনে। গভীর দুঃখবোধ ফিকে হয়ে গেল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়ার আগে অদ্ভুত কিছু সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি।
২.
শেখ হাসিনা কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে গেলেন খবর শুনে। খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি আর কখনো ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করবেন না। শেখ হাসিনা আরও অবাক হলেন এটি ভেবে যে এই ঘোষণার কথা তাঁর গোয়েন্দারা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারল না!
শেখ হাসিনা জানেন, বেগম জিয়ার বক্তব্যে কিছু চালাকি আছে। পত্রিকায় পাঠানো বিবৃতিতে তিনি বলেননি যে ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন নয়। তিনি শুধু বলেছেন, ১৫ আগস্ট তাঁর জন্মদিন তিনি আর কখনো পালন করবেন না, বিএনপির সকল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদেরও তিনি একই নির্দেশ দিয়েছেন। রাজনৈতিক সহনশীলতা ও সহাবস্থান নিশ্চিত করার স্বার্থে তিনি একতরফাভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে দেশবাসীকে জানিয়েছেন।
বেগম জিয়ার এই ঘোষণা সব পত্রিকা বড় করে ছাপিয়েছে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশের মানুষকে চেনেন। তিনি জানেন, দেশের মানুষও এটি খুব ভালোভাবে নেবে; এমনকি বিদেশিরাও।
শেখ হাসিনা তাঁর খুব বিশ্বস্ত কিছু লোকের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন। তিনি বেগম জিয়ার ভরং দেখে অভ্যস্ত। এর জবাব দিতে হলে তাঁর কারও সঙ্গে বুদ্ধি করার প্রয়োজন হয় না। কিন্তু বেগম জিয়ার এই বক্তব্যে কোনো ভরং নেই। আছে চমক! এই স্ট্যান্টবাজি বেগম জিয়া শিখলেন কীভাবে!
পরামর্শকেরা তাঁকে উত্তেজিত করার চেষ্টা করলেন। বেগম জিয়ার মিথ্যাচার এত দিনে প্রমাণিত হলো—এ ধরনের বিবৃতি দেওয়ার কথাও উঠল। কিন্তু তিনি কেন যেন আজ উত্তেজিত হলেন না। ১৫ আগস্ট শুধু তাঁর বাবার মৃত্যুবার্ষিকী নয়; এদিন তাঁর সন্তানসম ছোট ভাই রাসেল, তার অন্য ভাইদের এবং তার স্নেহময়ী মায়েরও মৃত্যুবার্ষিকী। ১৫ আগস্টে বেগম জিয়ার কেক কাটার উৎসবমুখর ছবি তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারেন না। তাঁর খুব ভালো লাগল ভেবে যে এমন ছবি আর কোনো দিন দেখতে হবে না।
তিনি বেডরুমে এসে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবির দিকে অপলক তাকিয়ে রইলেন। প্রায় প্রতিদিন এসব ছবি দেখে কাঁদেন তিনি। আজও কাঁদলেন। কিন্তু এই কান্নার ভেতর অদ্ভুত এক শান্তির স্পর্শ পেলেন তিনি। তাঁর হঠাৎ মনে হলো, বেগম জিয়া কি জানেন, কত বড় এক মানসিক যন্ত্রণার কিছুটা হলেও অবসান ঘটেছে আজ তার!
৩.
বেগম জিয়া ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালন করবেন না ঘোষণা দিয়েছিলেন কারও সঙ্গে পরামর্শ না করে। বিএনপির নেতারা অবাক হয়েছিলেন, কেউ কেউ তাঁর মুখের ওপর ভিন্নমতও জানিয়েছিলেন। আজ তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, এটি কতটা ভালো সিদ্ধান্ত ছিল। তাঁর বিরুদ্ধে কড়া কথা যিনি বলেছিলেন, সেই নেতার মুখে প্রশংসা শুনে তিনি অবশেষে হেসেই ফেললেন।
বেগম জিয়ার সিদ্ধান্তকে দেশের মানুষ অভিনন্দিত করেছে। সরকারও হঠাৎ নরম আচরণ করা শুরু করেছে। বিএনপির নেতাদের ওপর পুলিশ আর গোয়েন্দাদের নজরদারি কমে গেছে। বিএনপিকে এ বছরে প্রথমবারের মতো ঢাকা শহরে জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। তিনি বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছেন, জিয়ার মাজার সরিয়ে ফেলার চিন্তাও বাদ দেওয়া হয়েছে। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে মামলা নিয়েও সরকারের আগ্রহ কমে গেছে।
২০ আগস্ট রাতে তিনি আরেকটি অচিন্তনীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার ওপর নৃশংস গ্রেনেড হামলার নিন্দা জানিয়ে তিনি একটি বিবৃতি তৈরি করেন। বিবৃতিতে তিনি এমনকি এই ঘটনার তদন্তে তাঁর তৎকালীন সরকারের গাফিলতি স্বীকার করে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তাঁর এই বিবৃতি আবারও পত্রপত্রিকায় ঝড় তোলে। কিন্তু এবার কেন জানি বিএনপির কিছু নেতা খেপে যান। ২১ আগস্ট ঘটনায় বিএনপির অনেকের বিরুদ্ধেও মামলা হয়েছে। মামলা হয়েছে তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে। কাজেই তাঁর বিবৃতিতে ক্ষুব্ধ হন দলের অনেকে।
২১ আগস্ট থেকে তাঁর বাড়ির সামনে সাংবাদিকদের ভিড় জমে। তিনি কারও সঙ্গে দেখা করেন না। তাঁর শরীর খারাপ, সত্যি তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। একরাতে মাথা ঘুরে পড়ে যান তিনি। চোখ খুলে দেখেন হাসপাতালে। তাঁর ছোট ভাই আর তাঁর স্ত্রী বসে আছেন পাশে। ডাক্তার এসে হাসিমুখে জানালেন, চিন্তার কিছু নেই। এক সপ্তাহের মধ্যে বাসায় ফিরবেন তিনি।
বেগম জিয়ার কেবিনে টিভি চালু করা হলো। তিনি দেখলেন, তাঁর হাসপাতালের সামনে মানুষের ভিড়। বিভিন্ন জায়গায় দোয়া হচ্ছে তাঁর সুস্থতার জন্য। তিনি ছেলেদের সঙ্গে কথা বললেন ফোনে। পরদিন দুপুরে ঘুম ভাঙতেই আনন্দে তাঁর চোখে পানি চলে এল। তাঁর রুম আলো করে বসে আছে জোবাইদা আর জায়মা!
বেগম জিয়ার জন্য আরও বড় বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বিকেল চারটায় তাঁর কেবিনের দরজা খুলে গেল। ফুলের তোড়া হাতে নিয়ে ঢুকলেন শেখ হাসিনা। তার সারা মুখে দুষ্টু-মধুর হাসি। বেগম জিয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে তিনি ভুরু নাচালেন: কী আপা, হাসপাতালে শুয়ে থাকলে হবে? আমার বিরুদ্ধে তাহলে আন্দোলন করবে কে!
বেগম জিয়া বেডে উঠে বসলেন। শেখ হাসিনা তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইটে তাঁর চোখ প্রায় অন্ধ হয়ে গেল। তবু তিনি বিশ্বাস করতে পারলেন না এ দৃশ্য!
রাতে তিনি টিভিতে দেখলেন আরেক অকল্পনীয় দৃশ্য। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মিছিল হচ্ছে। সেই মিছিলে স্লোগান দেওয়া হচ্ছে: জয় শেখ হাসিনা, জয় খালেদা জিয়া! খালেদা জিয়া জিন্দাবাদ, শেখ হাসিনা জিন্দাবাদ!
৪.
দুই নেত্রী বৈঠকে বসেছেন। তৃতীয়বারের বৈঠকে বসলেন তাঁরা শুধু দুজন। সেই বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে তাঁরা হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি ভুলে একসঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। স্বৈরাচারী, জঙ্গি, সাম্প্রদায়িক ও যুদ্ধাপরাধী—সব গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত জানিয়েছেন। স্থানীয় সরকার, বিচার বিভাগ, বিভিন্ন কমিশন এবং সংসদকে আরও শক্তিশালী ও স্বাধীন করার কর্মসূচি প্রণয়নের জন্য জাতীয় কনভেনশন ডেকেছেন। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে এখন থেকে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছেন। পর্যায়ক্রমে জনগণের অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা আর স্বাস্থ্যসেবাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছেন।
সবচেয়ে যা উল্লেখযোগ্য, তাঁরা অচিরে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য একটি নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে নির্বাচনকালীন সরকার ও নির্বাচন কমিশনের আমূল সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। এই সংস্কারের রূপরেখা প্রণয়নের জন্য নাগরিক সমাজের সঙ্গে একসঙ্গে আলোচনায় বসা হবে বলে জানিয়েছেন।
সারা দেশে সারা দিন আনন্দ মিছিল হলো, মিষ্টি বিতরণ হলো, মসজিদ-মন্দির-গির্জায় দুই নেত্রীর জন্য প্রার্থনা হলো। সারা রাতের টক শো মধুর হয়ে গেল। অপু উকিল আর নিলোফার রহমান মনি টক শোর মাঝখানে একে অপরকে জড়িয়ে ধরলেন। উপস্থাপক মতিউর রহমান চৌধুরী ‘সমাধানটা কী’—এই প্রশ্ন করা ভুলে গেলেন প্রথমবারের মতো।
পরদিন ভোরে সবচেয়ে সুন্দর এক সূর্যোদয় হলো বাংলাদেশের বুকে!
৫.
কথা ছিল বিএনপির আন্দোলনের হুমকি নিয়ে লিখব আমি। তা-ই হয়তো লিখতাম! কিন্তু সংঘাত, সন্ত্রাস, ক্রসফায়ার ও হানাহানি নিয়ে ক্লান্তিকর লেখা সত্যিই লিখতে ইচ্ছে করে না আর। লিখতে ইচ্ছে করে আনন্দ, আশাবাদ আর ভালোবাসার গল্প।
মাননীয় দুই নেত্রী, এমন একটি ভালোবাসাময় ভুবন সত্যি তৈরি করতে পারেন আপনারা। কখনো ইচ্ছে হয় না আপনাদের তা?
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments