উপনিবেশকে আমরা ছাড়িনি by কুলদীপ নায়ার
মাদ্রাজ হাইকোর্টের একজন বিচারককে ধুতি পরে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে বেশ শোরগোল তৈরি হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা এ ঘটনাকে ‘তামিল’ সংস্কৃতির প্রতি অবজ্ঞা হিসেবে চিত্রিত করেছেন। এআইএডিএমকে-প্রধান দ্রুত একটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে এই প্রথা বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী তামিলনাড়ু ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের (টিএনসিএ) বিরুদ্ধেও দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এই সংস্থার ক্লাবেই বিচারপতি ড. হরিপরানথমন ও আরও দুই অতিথিকে পোশাক-বিধান মান্য না করায় ঢুকতে দেওয়া হয়নি।
একবার ভাবুন তো, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা ক্লাবে গিয়েছেন আর পোশাকের কারণে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও লাহোরের পাঞ্জাব ক্লাবে ও নজর-উল-ইসলামও ঢাকা ক্লাবে যদি একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতেন, তাহলে কী হতো? এসব ক্ষেত্রে জনরোষের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে উঠত।
সাদা শাসকেরা তাঁদের দেশের প্রধান ক্লাবগুলোকে অভিজাত মানুষের আড্ডাখানা হিসেবেই দেখতেন। সেখানে অসাদাদের ঢুকতে না দেওয়া বর্ণবৈষম্য টিকিয়ে রাখারই একটি কৌশল ছিল। অভিজাতদের ক্লাবের মুখে একটি বিলবোর্ডে লেখা থাকত: ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। শুনতে খারাপ লাগলেও সাদা শাসকেরা কালো ভারতীয়দের অবমাননা করে সুখ পেতেন, তাঁদের অসম্মানের অন্যান্য তরিকার সঙ্গে এটাও তাঁরা একইভাবে করতেন।
সমাজের উঁচুতলার মানুষ যাঁরা সাদাদের সঙ্গে তাল দিয়ে চলতেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এসব ক্লাবের প্রবেশাধিকার অবাধ ছিল। সে কারণে ইউরোপীয় সাদাদের বদলে দেশীয় সাদারাই এখন সে স্থান দখল করেছেন, সেখানে অন্য তরিকার মানুষের প্রবেশ নিষেধ। ক্লাব কর্তৃপক্ষ সেখানে ঢোকার জন্য বিশেষ পোশাক পরিধানের বিধান করেছে, সেটা নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় ঘরানার। ক্লাবের ভেতরে স্থানীয় পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ।
সেখানে যাঁরা ঢুকবেন, তাঁদের পরিপাটি পোশাক পরে আসতে হবে। মাদ্রাজ ক্লাবের একজন সদস্য বলেন, ‘তামিলনাড়ুর স্টাইলে ধুতি পরিধান করলে শরীরের একটি বড় অংশ দৃশ্যমান হতে পারে। সে কারণে অনেক ক্লাবই অতিথিদের ধুতি পরিধান নিষিদ্ধ করেছে।’ যে দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ পশ্চিমা পোশাকের চেয়ে ধুতি ও সাদা শার্ট পছন্দ করেন, সেখানে ধুতি পরলে অশোভনভাবে শরীরের অংশ বেরিয়ে থাকে—এ কথা বলা সাজে না। ৭৭ বছর বয়স্ক প্রবীণ আইনজীবী আর. গান্ধী সে সময় বিচারপতি ড. হরিপরানথমনের সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ক্লাব কর্তৃপক্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বেচ্ছাচার করেছে, সে সময় তাঁরা তাঁদের নিয়মিত পোশাকেই ছিলেন।’
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ মেজাজে যতই গণতান্ত্রিক হোন না কেন, ক্ষমতার প্রতি তাঁদের একধরনের মোহ আছে। ক্লাব হয়তো ব্রিটিশরাজের ধ্বজা বহন করছে, এগুলো একই সঙ্গে ক্ষমতার প্রতীকও বটে। সে কারণেই এসব ক্লাব এখনো আছে, ভারতের সমাজের সঙ্গে সেগুলো খাপ না খেলেও কিছু আসে-যায় না।
হ্যাঁ, বিজেপিরই জয় হয়েছে। বামপন্থীরাও যখন নমনীয় হিন্দুত্ববাদের খপ্পরে পড়ে, তখন তারা একটু উদার হতেই পারে। মুসলমানরা কংগ্রেসকে ভোট দিলেও কংগ্রেস বিগত কয়েক বছরে তার সেক্যুলার আবেদন হারিয়ে বসেছে। মুসলমানদের সামনে এখন সমস্যা হচ্ছে একটি প্রকৃত উদারনীতিক দল খুঁজে বের করা। মুসলমান সম্প্রদায় মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে এর কোনো সুরাহা করতে পারবে না, এখন যেটা ঘটছে। এতে তাদের পুরো সমাজই কলঙ্কিত হবে। আর সংখ্যাগত দিক দিয়ে হিন্দু মৌলবাদের সামনে মুসলিম মৌলবাদ টিকতেই পারবে না।
ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি জে সি ভার্মার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে ধর্ষণ আইনে ও এর বিচারের মাত্রা সম্পর্কিত পরিবর্তন আনা। ধর্ষণের বিচার হিসেবে ছাত্ররা ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড বা নপুংসকরণের দাবি তুলেছে। তার পরও সরকার কেন চাপের মধ্যে কাজ করছে, তা সত্যি বিস্ময়কর! কর্তৃপক্ষ ভীতি সঞ্চারের চেষ্টায় ইন্ডিয়া গেট অভিমুখে সব রাস্তা বন্ধ করে দেয় এবং বিক্ষোভরত ছাত্রদের ব্যারিকেডের বাইরে রাখতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। এটা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, এর সমালোচনাও কম হয়নি।
রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে বড় সহায় হচ্ছে পুলিশ, এই বাহিনীই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করে। এই বাহিনী থেকে চাটুকার ও ঢিলাদের বের করে দিতে হবে। তার আগে পুলিশকে স্বাধীন করে দিতে হবে, যাতে তারা রাজনীতিবিদদের চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। তা না হলে বিপদ। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের পুলিশ সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি এ জায়গায় গেলে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার—এসব কিছুই আর থাকে না, তখন এগুলো নিছক শব্দে পরিণত হয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক।
একবার ভাবুন তো, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতা ক্লাবে গিয়েছেন আর পোশাকের কারণে তাঁকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। প্রখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজও লাহোরের পাঞ্জাব ক্লাবে ও নজর-উল-ইসলামও ঢাকা ক্লাবে যদি একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতেন, তাহলে কী হতো? এসব ক্ষেত্রে জনরোষের মোকাবিলা করা কঠিন হয়ে উঠত।
সাদা শাসকেরা তাঁদের দেশের প্রধান ক্লাবগুলোকে অভিজাত মানুষের আড্ডাখানা হিসেবেই দেখতেন। সেখানে অসাদাদের ঢুকতে না দেওয়া বর্ণবৈষম্য টিকিয়ে রাখারই একটি কৌশল ছিল। অভিজাতদের ক্লাবের মুখে একটি বিলবোর্ডে লেখা থাকত: ‘কুকুর ও ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ’। শুনতে খারাপ লাগলেও সাদা শাসকেরা কালো ভারতীয়দের অবমাননা করে সুখ পেতেন, তাঁদের অসম্মানের অন্যান্য তরিকার সঙ্গে এটাও তাঁরা একইভাবে করতেন।
সমাজের উঁচুতলার মানুষ যাঁরা সাদাদের সঙ্গে তাল দিয়ে চলতেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এসব ক্লাবের প্রবেশাধিকার অবাধ ছিল। সে কারণে ইউরোপীয় সাদাদের বদলে দেশীয় সাদারাই এখন সে স্থান দখল করেছেন, সেখানে অন্য তরিকার মানুষের প্রবেশ নিষেধ। ক্লাব কর্তৃপক্ষ সেখানে ঢোকার জন্য বিশেষ পোশাক পরিধানের বিধান করেছে, সেটা নিঃসন্দেহে ইউরোপীয় ঘরানার। ক্লাবের ভেতরে স্থানীয় পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ।
সেখানে যাঁরা ঢুকবেন, তাঁদের পরিপাটি পোশাক পরে আসতে হবে। মাদ্রাজ ক্লাবের একজন সদস্য বলেন, ‘তামিলনাড়ুর স্টাইলে ধুতি পরিধান করলে শরীরের একটি বড় অংশ দৃশ্যমান হতে পারে। সে কারণে অনেক ক্লাবই অতিথিদের ধুতি পরিধান নিষিদ্ধ করেছে।’ যে দেশের অধিকাংশ রাজনীতিবিদ পশ্চিমা পোশাকের চেয়ে ধুতি ও সাদা শার্ট পছন্দ করেন, সেখানে ধুতি পরলে অশোভনভাবে শরীরের অংশ বেরিয়ে থাকে—এ কথা বলা সাজে না। ৭৭ বছর বয়স্ক প্রবীণ আইনজীবী আর. গান্ধী সে সময় বিচারপতি ড. হরিপরানথমনের সঙ্গে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘ক্লাব কর্তৃপক্ষ বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে স্বেচ্ছাচার করেছে, সে সময় তাঁরা তাঁদের নিয়মিত পোশাকেই ছিলেন।’
দক্ষিণ এশিয়ার মানুষ মেজাজে যতই গণতান্ত্রিক হোন না কেন, ক্ষমতার প্রতি তাঁদের একধরনের মোহ আছে। ক্লাব হয়তো ব্রিটিশরাজের ধ্বজা বহন করছে, এগুলো একই সঙ্গে ক্ষমতার প্রতীকও বটে। সে কারণেই এসব ক্লাব এখনো আছে, ভারতের সমাজের সঙ্গে সেগুলো খাপ না খেলেও কিছু আসে-যায় না।
হ্যাঁ, বিজেপিরই জয় হয়েছে। বামপন্থীরাও যখন নমনীয় হিন্দুত্ববাদের খপ্পরে পড়ে, তখন তারা একটু উদার হতেই পারে। মুসলমানরা কংগ্রেসকে ভোট দিলেও কংগ্রেস বিগত কয়েক বছরে তার সেক্যুলার আবেদন হারিয়ে বসেছে। মুসলমানদের সামনে এখন সমস্যা হচ্ছে একটি প্রকৃত উদারনীতিক দল খুঁজে বের করা। মুসলমান সম্প্রদায় মৌলবাদের দিকে ঝুঁকে এর কোনো সুরাহা করতে পারবে না, এখন যেটা ঘটছে। এতে তাদের পুরো সমাজই কলঙ্কিত হবে। আর সংখ্যাগত দিক দিয়ে হিন্দু মৌলবাদের সামনে মুসলিম মৌলবাদ টিকতেই পারবে না।
ভারতের সাবেক প্রধান বিচারপতি জে সি ভার্মার নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করা হয়েছে। তাদের কাজ হচ্ছে ধর্ষণ আইনে ও এর বিচারের মাত্রা সম্পর্কিত পরিবর্তন আনা। ধর্ষণের বিচার হিসেবে ছাত্ররা ধর্ষকদের মৃত্যুদণ্ড বা নপুংসকরণের দাবি তুলেছে। তার পরও সরকার কেন চাপের মধ্যে কাজ করছে, তা সত্যি বিস্ময়কর! কর্তৃপক্ষ ভীতি সঞ্চারের চেষ্টায় ইন্ডিয়া গেট অভিমুখে সব রাস্তা বন্ধ করে দেয় এবং বিক্ষোভরত ছাত্রদের ব্যারিকেডের বাইরে রাখতে পুলিশ লাঠিপেটা করে। এটা ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত, এর সমালোচনাও কম হয়নি।
রাজনীতিবিদদের সবচেয়ে বড় সহায় হচ্ছে পুলিশ, এই বাহিনীই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখভাল করে। এই বাহিনী থেকে চাটুকার ও ঢিলাদের বের করে দিতে হবে। তার আগে পুলিশকে স্বাধীন করে দিতে হবে, যাতে তারা রাজনীতিবিদদের চাপমুক্ত হয়ে কাজ করতে পারে। তা না হলে বিপদ। পাঞ্জাব ও হরিয়ানা রাজ্যের পুলিশ সেখানকার মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। পরিস্থিতি এ জায়গায় গেলে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার—এসব কিছুই আর থাকে না, তখন এগুলো নিছক শব্দে পরিণত হয়।
ইংরেজি থেকে অনূদিত
কুলদীপ নায়ার: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক।
No comments