জলাবদ্ধতা থেকে চট্টগ্রামকে মুক্ত করুন
চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা দূর করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য প্রধানত সিটি মেয়রই দায়ী |
পর পর দুই দিন বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম শহরের এক বিরাট অংশ পানিতে তলিয়ে যায় এবং এই জলাবদ্ধতা চার থেকে পাঁচ দিন থাকে। কোনো কোনো এলাকায় সপ্তাহও পার হয়ে যায়, পানি আর নামে না। বাদুরতলা, কাপাসগোলাসহ শহরের কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা তাদের বাসার (নিচতলা) খাট, পালং, টেবিল, আলমারি ছয় ইঞ্চি থেকে এক ফুট উঁচু অতিরিক্ত কাঠ দিয়ে উঁচু করে নিয়েছে। যারা এসব এলাকার বাসিন্দা, পৈতৃক সূত্রে আবাসিক, তাদের পক্ষে বাসা পাল্টিয়ে অন্যত্র চলে যাওয়াও সম্ভব নয়। বর্ষাকালে অতিবৃষ্টির কালে তাদের প্রায় দুই দশক ধরে এ রকম বিড়ম্বনার মধ্যেই দিন যাপন করতে হচ্ছে।
এই দুর্ভাগ্য তাদের মেনে নিতে হয়েছে। গত ২২ জুন প্রথম আলো পত্রিকা এক প্রতিবেদনে প্রশ্ন তুলেছে: ‘যে শহরে উন্নয়নের জোয়ার বইছে, সেই শহরে মানুষ পানিবন্দী কেন?’ আশা করি চট্টগ্রামের মেয়র, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান, স্থানীয় সাংসদেরা, চট্টগ্রামের মন্ত্রীরা জনগণের কাছে, বিশেষ করে তাঁদের ভোটারদের কাছে এই প্রশ্নের জবাব দেবেন। আওয়ামী লীগের বহু নেতা, মন্ত্রী, সাংসদ সুযোগ পেলেই বক্তৃতায় বলে থাকেন: ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়নের দায়িত্ব নিজের হাতে নিয়েছেন।’ আমরা তাঁদের প্রশ্ন করতে চাই, এটা কি তার নমুনা? প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ‘এই শহরের উন্নয়নে চার হাজার ৪০০ কোটি টাকার ৩৫টি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে ১ নম্বর সমস্যা ‘জলাবদ্ধতা’ নিয়ে কোনো প্রকল্প নেই।’ (২২ জুন) এতে বোঝা যায়, সরকারি নানা বিভাগের কর্মকর্তারা জনগণের স্বার্থে প্রকল্প গ্রহণ করেন না। করেন তাঁদের স্বার্থসিদ্ধি কোথায় ভালোভাবে হবে, তা বিবেচনা করে। অথবা ‘উন্নয়ন’ সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের পরিষ্কার ধারণা নেই। চট্টগ্রামের সবাই একবাক্যে বলেছেন, খাল ভরাট হয়ে যাওয়া, নগরের পানিনিষ্কাশনের ব্যবস্থা (ড্রেনেজ) অনেকাংশে বন্ধ হয়ে যাওয়াই জলাবদ্ধতার মূল কারণ। সিটি মেয়র যে তা জানেন না, এমন নয়। নগরের ড্রেনেজ মহাপরিকল্পনাবিষয়ক একটি প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। ১৯৯৫ সালে ২০ বছর মেয়াদি এই মহাপরিকল্পনা নেওয়া হয়। এর জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল এক হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়ন দূরে থাক, মহাপরিকল্পনাটি আজও ফাইলবন্দী। (সূত্র: প্রথম আলো, ১৪ মে ২০১৪)
চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা দূর করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য প্রধানত সিটি মেয়রই দায়ী। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, একনেক ইত্যাদি বিভাগের কর্মকর্তারাও কম দায়ী নন। তাঁরা চট্টগ্রামের এত বড় একটি সমস্যাকে আমলে নেননি অথবা রাজনৈতিক কারণে উপেক্ষা করেছেন। এটাও অত্যন্ত জঘন্য মনোবৃত্তি বলা যায়। আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এগুলো সম্ভব। চট্টগ্রামের বর্তমান ও সাবেক সাংসদ ও মন্ত্রীরাও কম দায়ী নন। বিএনপি আমলের সাংসদ ও মন্ত্রীরাও এর জন্য দায়ী। তাঁরা আজ আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা করেন। অথচ নিজেরা ক্ষমতায় থাকতে এর সমাধান করেননি। একটি প্রকল্প প্রস্তাব সরকারের কাছে জমা দিয়ে বসে থাকলে হয় না। তা মন্ত্রণালয় ও একনেক থেকে পাস করিয়ে টাকা ছাড় করা পর্যন্ত লেগে থাকতে হয়। মেয়র মন্জুর আলম সরকারি কাজের এসব নিয়মকানুন জানেন না মনে হয়। তিনি না জানতে পারেন, তাঁর অফিসের বড় কর্মকর্তারাও কি জানেন না? এত বড় একটি প্রকল্প পাস করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার ছিল। বাংলাদেশে তো প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা ছাড়া কোনো বড় কাজ করা সম্ভব হয় না। মেয়র মন্জুর আলমের বোঝা উচিত, তিনি বিএনপি-সমর্থিত মেয়র। বর্তমান ও বিগত সরকার তাঁকে বেশি সহযোগিতা করবে না। কাজেই তাঁর ভিন্ন কৌশল গ্রহণ করা উচিত ছিল। যেমন সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ইত্যাদি নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করে প্রকল্পটি বিকেন্দ্রীকরণ করতে পারতেন।
এই সমস্যা শুধু সিটি করপোরেশনের অন্তর্গত নয়। এটা সিডিএ, ওয়াসা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডেরও। কাজেই তাদের সঙ্গে নিয়ে এই সমস্যা মোকাবিলা করা উচিত ছিল। মন্ত্রণালয় ও একনেক এই প্রকল্প বাস্তবায়নে যে অসহযোগিতা করেছে, তা তথ্য-প্রমাণসহ বিভিন্ন নাগরিক ফোরাম ও মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চট্টগ্রামের উন্নয়ন যে ব্যক্তিগতভাবে তদারক করছেন, তা দেশবাসী জানতে পারতেন। যেহেতু চট্টগ্রামের সবাই মনে করেন, জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধান না হওয়ার জন্য প্রধানত মেয়রই দায়ী, সে জন্য মন্জুর আলমের উচিত একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ব্যর্থতার কারণগুলো জনগণকে জানানো। বর্তমান মেয়রের মেয়াদ আর এক বছর। এই এক বছরে তিনি এই সমস্যার সমাধান করে ফেলবেন, এটা কেউ বিশ্বাস করেন না। অথচ এটা ছিল তাঁর প্রধান নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। অন্যান্য রুটিন কাজ তদারক করার ভার অন্যদের (নির্বাচিত কাউন্সিলর) দিয়ে তিনি যদি গত চার বছর শুধু জলাবদ্ধতা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে নিজেকে নিয়োজিত রাখতেন, তাহলে দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁর মেয়র নির্বাচিত হওয়া কেউ ঠেকাতে পারত না। এখন এত বড় ব্যর্থতা ও প্রধান নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণ না করে তাঁর পক্ষে আবার ভোট চাওয়া কি সম্ভব হবে? চট্টগ্রামে জলাবদ্ধতা সমস্যার সমাধান না হওয়ার পেছনে ‘চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ’ও (সিডিএ) কিছুটা দায়ী। বর্তমানে সিডিএর চেয়ারম্যান হলেন মহানগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ। শোনা যায়, তিনি প্রধানমন্ত্রীর খুব কাছের মানুষ। বর্তমানে সিডিএ চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে চট্টগ্রামে ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, যা খুবই প্রশংসনীয়। সিডিএর ৩৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্য ৩১টির কাজ শেষ পর্যায়ে। এর মধ্যে জলাবদ্ধতার মতো প্রকল্প নেই। কেন নেই? কারণ সিডিএ, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ও একনেক চট্টগ্রামের উন্নয়ন প্রকল্পের অগ্রাধিকার নির্ণয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগে সিডিএর চেয়ারম্যান তাঁর সব প্রকল্প পাস করিয়ে আনতে পেরেছেন।
এর অনেক প্রকল্প খুব জরুরিও ছিল না, জলাবদ্ধতার তুলনায়। অন্যদিকে, সিটি মেয়র বিএনপি নেতা হওয়ার কারণে অতি প্রয়োজনীয় প্রকল্পও মন্ত্রণালয় ও একনেক পাস করেনি। সে জন্য চট্টগ্রামে ৭২৮ কোটি টাকার উড়ালসড়ক (সিডিএ) হয়ে যায়, ৩০০ কোটি টাকার বহদ্দারহাট খাল খনন প্রকল্প (সিটি করপোরেশন) পড়ে থাকে। এগুলো আমাদের দূষিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির কুফল। এ থেকে আরেকটি কথা প্রমাণিত হয়, চট্টগ্রামে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয় নেই। সিটি মেয়র হলেন মহানগরে একমাত্র নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। সিডিএর চেয়ারম্যান একজন সরকারি কর্মকর্তা। কারও কাছে তাঁর জবাবদিহি নেই। আদর্শ ব্যবস্থা হতে পারত নির্বাচিত মেয়রের সভাপতিত্বে সিডিএ, ওয়াসা, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রাসঙ্গিক অন্যান্য সরকারি সংস্থার প্রধানদের নিয়ে একটি ‘উন্নয়ন সমন্বয় কমিটি’ থাকা। নগরের সব উন্নয়ন প্রকল্প এই কমিটি অনুমোদন করবে এবং এ কমিটির পক্ষে সিটি মেয়র তা কেন্দ্রে পাঠাবেন। কেন্দ্র অর্থ বরাদ্দ করলে যার জন্য যা প্রাসঙ্গিক, সেই দপ্তর সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। সমগ্র বিষয়টা তদারক করবে সিটি মেয়র। অন্য প্রতিষ্ঠানের প্রধানেরও মেয়রের তত্ত্বাবধানে কাজ করতে আপত্তি করার কথা নয়। চট্টগ্রামে এ রকম সমন্বয় কমিটি না থাকায় জলাবদ্ধতার মতো এত বড় সমস্যা সমাধানের মুখ দেখছে না। আমাদের প্রস্তাব: শুধু চট্টগ্রামেই নয়, যেসব স্থানে সিটি করপোরেশন রয়েছে, সেখানে নির্বাচিত মেয়রের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধানদের নিয়ে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হোক। শুধু সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে কোনো জেলাতেই বড় কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সরকারের প্রধান এজেন্ডা উন্নয়ন। কাজেই অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নই সরকারের লক্ষ্য হওয়া উচিত। চট্টগ্রামের নির্বাচিত মেয়র বিএনপি নেতা হওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার চট্টগ্রাম শহরের অধিবাসীদের বর্ষাকালে এভাবে পানির নিচে ডুবিয়ে রাখবে, তা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। আর প্রধানমন্ত্রী যে ব্যক্তিগতভাবে চট্টগ্রামের উন্নয়ন তদারক করেন, তা প্রমাণ করারও সময় এসেছে।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী৷
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী৷
No comments