বিহারি ক্যাম্পে হামলা- সমঝোতার প্রস্তাব মোল্লার by রুদ্র মিজান
কুর্মিটোলা বিহারি ক্যাম্পে হামলা ও ১০
জনকে হত্যার ঘটনায় সরকারদলীয় সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা সমঝোতা করতে
চাইছেন ক্ষতিগ্রস্ত বিহারিদের সঙ্গে। তাদের মামলা না করতে চাপ দেয়া হচ্ছে
তার পক্ষে। চেষ্টা চলছে বিহারি নেতাদের বশে আনার। এ জন্য বেশ কয়েক দফা বৈঠক
হয়েছে তাদের সঙ্গে। ওই বৈঠকে ক্ষতিগ্রস্ত বিহারিদের আর্থিক সুবিধা দেয়ার
প্রলোভন দেখানো হয়েছে। তবে তারা তা প্রত্যাখ্যান করে হত্যাকা-ের বিচার দাবি
করেছেন। সমঝোতার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নতুন শঙ্কা ভর করেছে এসব
পরিবারে। হত্যাকা-ের পর নেপথ্যে ইন্ধনদাতা হিসেবে নাম আসে স্থানীয় এমপি
ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লার। যদিও শুরু থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন তিনি।
সমঝোতার প্রস্তাবের বিষয় অস্বীকার করে এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা
জানিয়েছেন, বিহারিরাই তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা তার কাছে ক্ষমা চাইতে
আসবে।
তবে গত কয়েকদিন অনুসন্ধান চালিয়ে জানা যায় নিহতদের স্বজনদের সঙ্গে মোল্লার পক্ষে বৈঠক করেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিহারি নেতারা। নিজ নেতাদের এই তৎপরতায় আতঙ্কিত বিহারিরা। অথচ এই নেতারাই কিছু দিন আগে এমপি ইলিয়াস মোল্লার ফাঁসি চেয়ে মিছিল করেছেন। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার রাতে স্ট্যান্ডার্ড পাকিস্তানিজ জেনারেল রিপার্টিশন কমিটি (এসপিজিআরসি)-এর মুরাপাড়া ক্যাম্পে একটি বৈঠক করেছেন ওই সংগঠনের নেতারা। বৈঠকে আগুনে পুড়ে নিহত ৯ জনের পরিবারের ইয়াসিন আলী ও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত আজাদের ভাই ভুলুকে খবর দিয়ে নেয়া হয়। সেখানে এসপিজিআরসি’র নেতারা এমপি ইলিয়াস মোল্লার পক্ষে সমঝোতার প্রস্তাব দেন। নিহতদের স্বজনদের তারা জানান, এমপি ইলিয়াস মোল্লা প্রভাবশালী লোক। তার সঙ্গে ঝামেলা করে লাভ হবে না। বরং ক্ষতি হবে। তার সঙ্গে তোমরা পারবে না। তাই যা হওয়ার হয়েছে এখন তার সঙ্গে সমঝোতা করাই ভাল।
বৈঠকের বিষয়ে নিহত আজাদের ভাই মুহাম্মদ ভুলু জানান, এসপিজিআরসি’র মোস্তাক তাকে লোক মাধ্যমে বৈঠকে ডেকে নিয়েছেন। তাকে এমপি’র সঙ্গে সমঝোতার জন্য চাপ দিয়েছেন। এ নিয়ে তার সঙ্গে নেতাদের বাকবিত-া হয়েছে। তিনি রাজি হননি। বিহারি নেতাদের এই উদ্যোগের কারণ সম্পর্কে ভুলু বলেন, এসপিজিআরসি’র এসব নেতা এমপি’র কাছে বিক্রি হয়ে গেছেন। একই ভাবে বৈঠকের বিষয়ে ইয়াসিন আলী বলেন, নেতারা বলেছেন এমপি’র বিরুদ্ধে কোন ঝামেলা করো না। তার সঙ্গে মিলে যাও। সমঝোতার প্রস্তাব দিলেও ইয়াসিন তাদের কিছুই বলেননি বলে জানান। ইয়াসিন বলেন, আমি ভয়ে আছি। আমি কার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেবো। আমার পরিবারের সবাইকে পুড়িয়ে মেরেছে। পরে আমাকেও মারার চেষ্টা করবে।
বৈঠকে এসপিজিআরসি’র মিরপুর-১১ নম্বর শাখার সভাপতি আবদুল জলিল, সাধারণ সম্পাদক মাল্লু, বাদল, সাব্বির, ইদু বাবু, ক্যান্টনমেন্ট ক্যাম্পের সভাপতি মুহাম্মদ পাছু, খুরশিদ, রাশেদ, মোস্তাক উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের আগে এসপিজিআরসি’র কুর্মিটোলা ক্যাম্প অফিসেও বৈঠকে করেন এই সংগঠনের নেতারা। কিন্তু সেখানকার স্থানীয় কিছু বিহারি নেতারা এমপি’র সঙ্গে সমঝোতার বিষয় জানতে পেরে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলে বৈঠকের স্থান পরিবর্তন করা হয়। পরে মুরাপাড়া ক্যাম্পের অফিসে ওই বৈঠক হয়।
সূত্র জানায়, সমঝোতার জন্য ইতিমধ্যে অর্থও ছড়িয়েছেন এমপি ইলিয়াস মোল্লা। আয়ত্তে নিয়েছেন বিহারিদের সংগঠন এসপিজিআরসি’র নেতাদের। সূত্রমতে, এমপি ইলিয়াস মোল্লা ওই চক্রকে বলেছেন, যত টাকা লাগে দেবো। আমাকে এই অভিযোগ থেকে রক্ষা করো। সমঝোতার জন্য এসপিজিআরসি’র সাবেক নেতা ইরানি বস্তির ইদু বাবু ও সাব্বিরকে কাজে লাগান ইলিয়াস মোল্লা ও তার ঘনিষ্ঠরা। এলাকাবাসী জানিয়েছেন, ইদু মোল্লার সঙ্গে এমপি ইলিয়াস মোল্লার ভাই মনু মোল্লার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ইদু বাবুর ইরানি ক্যাম্পের বাসায় নিয়মিত আসা-যাওয়া করেন মনু মোল্লা। সাব্বির ও ইদু বাবুর মাধ্যমেই সমঝোতার ছক তৈরি করেন ইলিয়াস মোল্লা। বিহারি নেতাদের এই চক্রকে সোমবার রাতে এবং তার আগের দিন অর্থও দেয়া হয়।
সমঝোতা ও অর্থ দেয়ার অভিযোগ মোটেও সত্য নয় বলে দাবি করেছেন ঢাকা-১৬ আসনের এমপি ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লা। তবে শিগগিরই বিহারিরা তার কাছে ক্ষমা চাইবে জানিয়ে তিনি বলেন, কারা কোথায় সমঝোতা বৈঠক করেছে আমি জানি না। এজন্য আমি কাউকে টাকাও দেইনি। এসব অপপ্রচার। বরং বিহারিরা যারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা এ নিয়ে একটি বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে। এ রকম খবর তিনি পেয়েছেন বলে জানান।
কুর্মিটোলা ক্যাম্পের বাসিন্দা মুহাম্মদ শাহীদ জানান, ১০ জনকে খুনের দায়ে যারা ইলিয়াস মোল্লার ফাঁসি চেয়ে মিছিল করেছে তারাই এখন তার ভক্ত হয়ে গেছে। ক্যাম্পের বাসিন্দা রাজু সহ কিছু লোক ইলিয়াস মোল্লাকে ক্যাম্পে এনে মঞ্চ তৈরি করে সভা করতে চাইছেন। সমঝোতার মূল হোতাদের অন্যতম এসপিজিআরসি’র আবদুল জলিলের কাছে সমঝোতা বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করেন। মানবজমিন-র কাছে থাকা তথ্য-প্রমাণের কথা জানালে তিনি তা স্বীকার করে বলেন, এলাকাবাসীর স্বার্থেই আমরা সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছি। এমপি ইলিয়াস মোল্লার কাছ থেকে টাকা নেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই তথ্য সত্য না। পরে এই প্রতিবেদককে তিনি তার অফিসে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়ে বলেন, অফিসে আসেন আপনাকে বিস্তারিত বলবো। জানা গেছে, বিহারিদের রয়েছে দু’টি বড় সংগঠন। এর মধ্যে এসপিজিআরসি একটি। এছাড়াও রয়েছে উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট। গত ১৪ই জুন সকালে রাজধানীর মিরপুরের কুর্মিটোলা ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। ক্যাম্পবাসী অভিযোগ করেন পার্শ্ববর্তী বাউনিয়াবাদ এলাকার যুবলীগ নেতাকর্মীরা এ হামলা চালায়। তাদের দেয়া আগুনে পুড়ে মারা যায় ইয়াসিনের পরিবারের শিশু, নারীসহ ৯ জন। এসময় আগুন নেভাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আজাদ। ক্যাম্পবাসীর অভিযোগ, ঘটনার আগে ১০ই জুন নতুন ক্যাম্পের ট্রান্সফরমার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ চেয়েছিলেন ইলিয়াস মোল্লা। তিনি নিজে সংযোগ নিতে এসে লাঞ্ছিত হন। এ ঘটনার জের ধরেই কুর্মিটোলা ক্যাম্পে সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে বলে দাবি বিহারিদের। ঘটনার পর থেকে এসপিজিআরসি ও উর্দু স্পিকিং পিপলস ইউথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্ট দোষীদের বিচার চেয়ে মিছিল-সমাবেশ করে। তারা ওই আসনের এমপি ইলিয়াস মোল্লা ও তার ক্যাডার যুবলীগের পল্লবী থানার সাধারণ সম্পাদক জুয়েল রানার ফাঁসি দাবি করেন। এসপিজিআরসি’র এ রকম দাবি সংবলিত ব্যানার এখনও কুর্মিটোলা ক্যাম্পে টাঙানো রয়েছে।
No comments