নেপাল পারলে আমরা পারব না কেন? by কামাল আহমেদ
জাতিসংঘের
মহাসচিব বান কি মুন অভিবাসনের জন্য নিরাপদ, সুশৃঙ্খল এবং নিয়মিত পথ তৈরির
জন্য বিশ্বের সব দেশের সরকারগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গেল সপ্তাহে
সুইডেনের স্টকহোমে গ্লোবাল ফোরাম অন মাইগ্রেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের এক
সভায় তিনি সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে অভিবাসীরা যেসব দেশে যান, সেসব
দেশের অর্থনীতিতেও তাঁরা অবদান রাখেন (সূত্র: জাতিসংঘ রেডিও, ১৮ মে, ২০১৪)।
আর সে কারণেই বান কি মুন অভিবাসনব্যবস্থায় নিরাপত্তা আনয়ন ও নিয়মনীতির ওপর
জোর দিয়েছেন। ওই
সপ্তাহেই নেপালের একজন পদস্থ কর্মকর্তা কৃষ্ণহরি পুষ্কর বলেছেন যে বিদেশে
কাজ করতে গিয়ে মারা যাওয়া নেপালিদের শতকরা ৯০ ভাগকেই হত্যা হিসেবে বিবেচনা
করা উচিত (গার্ডিয়ান, ২০ মে, ২০১৪)। প্রবাসী শ্রমবিষয়ক দপ্তরের সাবেক
মহাপরিচালক ও বর্তমানে সরকারের যুগ্ম সচিব পুষ্কর বলেছেন, যতজন নেপালি
শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে গিয়ে মারা যাচ্ছেন, তার অতি ক্ষুদ্র একটি অংশের
মৃত্যু হচ্ছে স্বাভাবিক। নেপাল সরকারের একটি প্রতিনিধিদল বিদেশে নেপালি
শ্রমিকদের বিষয়ে সরেজমিনে তদন্ত অনুষ্ঠানের পর পুষ্কর প্রবাসে প্রতিটি
শ্রমিকের মৃত্যুর পর ময়নাতদন্ত, প্রয়াত শ্রমিকের সহকর্মীদের সাক্ষাৎকার
গ্রহণ এবং নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় ক্ষতিপূরণের
ব্যবস্থা করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে, বিশ্বকাপ ফুটবল ২০২২-এর আয়োজন
নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার মুখে কাতার সরকার অভিবাসী শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ
এবং অস্বাভাবিক মৃত্যুহার বিষয়ে অনুসন্ধানের উদ্যোগ নিয়ে তার দায়িত্ব
দিয়েছিল ডিএলএ পাইপার নামের একটি বৈশ্বিক আইনি সেবা প্রতিষ্ঠানকে, যার সদর
দপ্তর লন্ডনে। গত ১৪ মে তারা তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল প্রকাশ করে প্রায় ৬০
দফারও বেশি সুপারিশ পেশ করেছে। এই তদন্তে নিশ্চিত করা হয় যে গত দুই বছরে
কাতারে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালের শত শত শ্রমিকের
আকস্মিক অসুস্থতাজনিত মৃত্যুর কোনো ব্যাখ্যা নেই। কাতার সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে ওই রিপোর্টে বলা হয়, ২০১২ ও ২০১৩—এই দুই বছরে কাতারে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মোট ৯৬৪ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে কাজ করার সময় পড়ে গিয়ে। শুধু ২০১২ সালেই ২৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে এবং কথিত হৃদ্রোগ৷ শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, বাড়তি কাজের চাপই এসব আকস্মিক হদ্রোগের কারণ। কাতারে নির্মাণশ্রমিকদের মধ্যে জাতিগতভাবে নেপালি ও ভারতীয়রা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কাজ করছেন বলে তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও বাংলাদেশিদের সংখ্যাগত তথ্য সেখানে প্রকাশ করা হয়নি।
২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাগতিক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কাতারকে নতুন করে গড়ে তোলার যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, সেটাই দেশটিতে বিপুল সংখ্যায় অভিবাসী শ্রমিকের কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু, এমনিতেই কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার পটভূমিতে দেশটির প্রস্তুতির দিকে নজর পড়েছে বিশ্বের অনেকেরই। তারই অংশ হিসেবে গার্ডিয়ান পত্রিকার অনুসন্ধানে প্রথম বেরিয়ে আসে এই অস্বাভাবিক হারে মৃত্যুর পরিসংখ্যান। পত্রিকাটি এসব অভিবাসী শ্রমিকদের ‘বিশ্বকাপের দাস’ অভিহিত করে হুঁশিয়ারি দেয় যে ফিফা যদি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ২০২২ বিশ্বকাপের জন্য মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো শুধু কাতার নয়, এমনকি ফিফার সমালোচনায়ও সরব হয়ে ওঠে। তারই পরিণতি কাতার সরকারের এই তদন্ত।
সুপারিশগুলোর মধ্যে যেসব প্রথা বা পদ্ধতি বিলোপ বা সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই পুরো উপসাগরীয় বা আরব দেশগুলোয় চালু আছে। যেমন, কাফালা বা স্পনসরশিপ-ব্যবস্থা। যে নিয়োগকর্তার কাজ নিয়ে একজন শ্রমিক সে দেশে যাচ্ছেন, সেই নিয়োগকর্তার কাছে চুক্তির বন্ধনে আটকে থাকার এই ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে অবসানের মাধ্যমে অভিবাসীর চলাচলের স্বাধীনতা এবং শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে। অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধে রিক্রুটিং এজেন্সির ফি আদায় বন্ধেরও সুপারিশ রয়েছে এতে। অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, কোনো নিয়োগকর্তা ন্যূনতম মজুরি না দিলে তাঁর স্পনসর হওয়ার অধিকার বাতিল, কাজের সময়ে স্বাস্থ্যগত ও নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবিলার দায়িত্ব এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় ঠিকাদার ও উপঠিকাদার উভয়ের ওপর যৌথভাবে আরোপ, আবাসনব্যবস্থার তদারকি, ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান এবং অভিযোগকারীর বিচার প্রার্থনার জন্য কোনো ধরনের ফি প্রদান থেকে অব্যাহতির কথাও রয়েছে এই সুপারিশমালায়।
এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ছয় বছরে ১৪ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে: এমন মৃত্যু মানা যায় না’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৩ সালে মারা যাওয়া যে দুই হাজার ৪৯৬ জনের লাশ দেশে ফিরেছে, তার মধ্যে মাত্র ১৫৯ জনের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। যার অর্থ হচ্ছে, ৯৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক, হৃদ্রোগ ও দুর্ঘটনা। ২০১২ সালেও মারা যাওয়া দুই হাজার ৩৭৭ জনের মধ্যে ৯৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ অস্বাভাবিক। প্রবাসে যাঁরা কাজ করতে যান, তাঁদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। অথচ, এসব অকালমৃত্যুর বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সংসদে বলেন, ‘প্রবাসে শ্রমিকদের মৃত্যুর হার জাতীয় মৃত্যুর হারের চেয়ে কম।’ (১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, প্রথম আলো)। বাংলাদেশের জাতীয় মৃত্যুর হারের সঙ্গে প্রবাসীদের মৃত্যুর হারের তুলনা দেওয়ার সময় মন্ত্রীর মাথায় আসেনি যে বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন বেড়ে ৬৫-তে উঠেছে, আর প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটছে তার অর্ধেক বয়সে। জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরের বিবরণী পড়ে মনে হয় তাঁর বিবেচনায় প্রবাসীদের সেবা ও সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা বিদেশের দূতাবাসগুলোয় জনবলের সংকট। কিন্তু, জনবল বাড়ালেই যে সমস্যার সমাধান হবে না, তার আলামত মন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গিতেই স্পষ্ট। প্রবাসে প্রতিটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ময়নাতদন্ত দাবি করা কি এতটাই দুঃসাধ্য? নেপাল যেটা পারে, আমরা সেটা কেন পারব না? মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে শ্রমিক সরবরাহের প্রধান উৎস যেসব দেশ, তার একটা বড় অংশই দক্ষিণ এশিয়ার জোট সার্কভুক্ত—ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। সুতরাং, এই দেশগুলোর সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগ অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় যতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, একক কোনো উদ্যোগে তার ভগ্নাংশ পরিমাণও অর্জন সম্ভব নয়।
৭ মে একই ধরনের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘ইনটু দি আননোন’ প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা অ্যান্টি-স্লেভারি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের এই রিপোর্টটি নেপালি অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়ে, তবে নারী শ্রমিকদের বিষয়ে যাঁরা গৃহকর্মী বা পরিচারিকা হিসেবে কাজ করছেন। যে দেশটির কাজের পরিবেশ নিয়ে এই প্রতিবেদন, সেটি হচ্ছে লেবানন। সেখানে প্রায় ১২ হাজার নেপালি নারী শ্রমিক কাজ করছেন, যাঁদের অনেককেই দাসত্বের জীবন যাপন করতে হচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এখানেও দাসত্বের শৃঙ্খলের কারণ ওই কাফালা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকেও হাজার হাজার নারী শ্রমিক লেবাননের ‘অজানা জীবনে’ পাড়ি জমিয়েছেন। মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে তাঁদের দুর্ভোগের খবরও প্রকাশিত হয়। তাতে সর্বসম্প্রতি পরিহাসের যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছে, তা হলো বৈরুতে বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের নিযুক্তি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সে রকমই এক অভিযোগ আলোচিত হচ্ছে। অভিবাসী বাংলাদেশিদের একটি সংগঠনের অভিযোগ, লেবাননে বাংলাদেশিদের স্বার্থ দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে যে কূটনীতিককে, গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগেই তাঁকে সুইডেন থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
আগামী বছরের বাজেট দেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে অঙ্ক কষতে গিয়ে আমাদের মন্ত্রী ও আমলারা হিসাব পেয়েছেন যে মাথাপ্রতি জাতীয় আয় বেড়ে এখন এক হাজার ১৯০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে দলীয় নেতা-কর্মীদের খুনখারাবি, অপহরণ-বাণিজ্য, দখলদারি, চাঁদাবাজি, তদবিরবাজির দুঃসংবাদের মধ্যে অন্তত এই একটি খবর প্রধানমন্ত্রীকে উৎফুল্ল করেছে বলে সংবাদপত্রের খবর। এ-জাতীয় আয় বৃদ্ধির সুফল সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘরে পৌঁছাচ্ছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও যে সত্যকে এড়ানো যাবে না, তা হলো এতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক আয়ের উৎস হচ্ছে এই প্রবাসীদের শ্রম, যাঁরা পেছনে রেখে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য বাড়তি পরিশ্রম করে আলিঙ্গন করছেন অকালমৃত্যু। জাতীয় আয় বৃদ্ধির সাফল্য উদ্যাপনের সময় ভবিষ্যতের এমন অকালমৃত্যু ঠেকানোর কথা কি আমরা একটুও ভাবব না?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷
আকস্মিক অসুস্থতাজনিত মৃত্যুর কোনো ব্যাখ্যা নেই। কাতার সরকারের নিজস্ব পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে ওই রিপোর্টে বলা হয়, ২০১২ ও ২০১৩—এই দুই বছরে কাতারে দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশের মোট ৯৬৪ জন অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ২৮ জন আত্মহত্যা করেছেন। ৩৫ জনের মৃত্যু হয়েছে কাজ করার সময় পড়ে গিয়ে। শুধু ২০১২ সালেই ২৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে আকস্মিকভাবে এবং কথিত হৃদ্রোগ৷ শ্রমিক সংগঠনগুলোর দাবি, বাড়তি কাজের চাপই এসব আকস্মিক হদ্রোগের কারণ। কাতারে নির্মাণশ্রমিকদের মধ্যে জাতিগতভাবে নেপালি ও ভারতীয়রা সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় কাজ করছেন বলে তাঁদের সম্পর্কে বিস্তারিত পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও বাংলাদেশিদের সংখ্যাগত তথ্য সেখানে প্রকাশ করা হয়নি।
২০২২ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলের স্বাগতিক হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর কাতারকে নতুন করে গড়ে তোলার যে কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে, সেটাই দেশটিতে বিপুল সংখ্যায় অভিবাসী শ্রমিকের কাজের সুযোগ করে দিয়েছে। কিন্তু, এমনিতেই কাতারে বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়ে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তার পটভূমিতে দেশটির প্রস্তুতির দিকে নজর পড়েছে বিশ্বের অনেকেরই। তারই অংশ হিসেবে গার্ডিয়ান পত্রিকার অনুসন্ধানে প্রথম বেরিয়ে আসে এই অস্বাভাবিক হারে মৃত্যুর পরিসংখ্যান। পত্রিকাটি এসব অভিবাসী শ্রমিকদের ‘বিশ্বকাপের দাস’ অভিহিত করে হুঁশিয়ারি দেয় যে ফিফা যদি পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে ২০২২ বিশ্বকাপের জন্য মৃত্যুর সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়ে যাবে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো শুধু কাতার নয়, এমনকি ফিফার সমালোচনায়ও সরব হয়ে ওঠে। তারই পরিণতি কাতার সরকারের এই তদন্ত।
সুপারিশগুলোর মধ্যে যেসব প্রথা বা পদ্ধতি বিলোপ বা সংস্কারের আহ্বান জানানো হয়েছে, সেগুলোর অধিকাংশই পুরো উপসাগরীয় বা আরব দেশগুলোয় চালু আছে। যেমন, কাফালা বা স্পনসরশিপ-ব্যবস্থা। যে নিয়োগকর্তার কাজ নিয়ে একজন শ্রমিক সে দেশে যাচ্ছেন, সেই নিয়োগকর্তার কাছে চুক্তির বন্ধনে আটকে থাকার এই ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে অবসানের মাধ্যমে অভিবাসীর চলাচলের স্বাধীনতা এবং শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব হতে পারে। অভিবাসী শ্রমিকদের নিয়োগ-প্রক্রিয়ায় দালালদের দৌরাত্ম্য বন্ধে রিক্রুটিং এজেন্সির ফি আদায় বন্ধেরও সুপারিশ রয়েছে এতে। অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, কোনো নিয়োগকর্তা ন্যূনতম মজুরি না দিলে তাঁর স্পনসর হওয়ার অধিকার বাতিল, কাজের সময়ে স্বাস্থ্যগত ও নিরাপত্তাঝুঁকি মোকাবিলার দায়িত্ব এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দায় ঠিকাদার ও উপঠিকাদার উভয়ের ওপর যৌথভাবে আরোপ, আবাসনব্যবস্থার তদারকি, ইউনিয়ন করার অধিকার প্রদান এবং অভিযোগকারীর বিচার প্রার্থনার জন্য কোনো ধরনের ফি প্রদান থেকে অব্যাহতির কথাও রয়েছে এই সুপারিশমালায়।
এ বছরের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘ছয় বছরে ১৪ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে: এমন মৃত্যু মানা যায় না’ শীর্ষক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৩ সালে মারা যাওয়া যে দুই হাজার ৪৯৬ জনের লাশ দেশে ফিরেছে, তার মধ্যে মাত্র ১৫৯ জনের মৃত্যু ছিল স্বাভাবিক। যার অর্থ হচ্ছে, ৯৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ স্ট্রোক, হৃদ্রোগ ও দুর্ঘটনা। ২০১২ সালেও মারা যাওয়া দুই হাজার ৩৭৭ জনের মধ্যে ৯৪ শতাংশের মৃত্যুর কারণ অস্বাভাবিক। প্রবাসে যাঁরা কাজ করতে যান, তাঁদের অধিকাংশই বয়সে তরুণ। অথচ, এসব অকালমৃত্যুর বিষয়ে প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী সংসদে বলেন, ‘প্রবাসে শ্রমিকদের মৃত্যুর হার জাতীয় মৃত্যুর হারের চেয়ে কম।’ (১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, প্রথম আলো)। বাংলাদেশের জাতীয় মৃত্যুর হারের সঙ্গে প্রবাসীদের মৃত্যুর হারের তুলনা দেওয়ার সময় মন্ত্রীর মাথায় আসেনি যে বাংলাদেশের গড় আয়ু এখন বেড়ে ৬৫-তে উঠেছে, আর প্রবাসী শ্রমিকদের মৃত্যু ঘটছে তার অর্ধেক বয়সে। জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরের বিবরণী পড়ে মনে হয় তাঁর বিবেচনায় প্রবাসীদের সেবা ও সুরক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল সমস্যা বিদেশের দূতাবাসগুলোয় জনবলের সংকট। কিন্তু, জনবল বাড়ালেই যে সমস্যার সমাধান হবে না, তার আলামত মন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গিতেই স্পষ্ট। প্রবাসে প্রতিটি অস্বাভাবিক মৃত্যুর নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ ময়নাতদন্ত দাবি করা কি এতটাই দুঃসাধ্য? নেপাল যেটা পারে, আমরা সেটা কেন পারব না? মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যে শ্রমিক সরবরাহের প্রধান উৎস যেসব দেশ, তার একটা বড় অংশই দক্ষিণ এশিয়ার জোট সার্কভুক্ত—ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপাল। সুতরাং, এই দেশগুলোর সমন্বিত কূটনৈতিক উদ্যোগ অভিবাসী শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্বার্থ রক্ষায় যতটা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, একক কোনো উদ্যোগে তার ভগ্নাংশ পরিমাণও অর্জন সম্ভব নয়।
৭ মে একই ধরনের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ‘ইনটু দি আননোন’ প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংস্থা অ্যান্টি-স্লেভারি ইন্টারন্যাশনাল। তাদের এই রিপোর্টটি নেপালি অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়ে, তবে নারী শ্রমিকদের বিষয়ে যাঁরা গৃহকর্মী বা পরিচারিকা হিসেবে কাজ করছেন। যে দেশটির কাজের পরিবেশ নিয়ে এই প্রতিবেদন, সেটি হচ্ছে লেবানন। সেখানে প্রায় ১২ হাজার নেপালি নারী শ্রমিক কাজ করছেন, যাঁদের অনেককেই দাসত্বের জীবন যাপন করতে হচ্ছে বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়। এখানেও দাসত্বের শৃঙ্খলের কারণ ওই কাফালা। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ থেকেও হাজার হাজার নারী শ্রমিক লেবাননের ‘অজানা জীবনে’ পাড়ি জমিয়েছেন। মাঝেমধ্যে সংবাদপত্রে তাঁদের দুর্ভোগের খবরও প্রকাশিত হয়। তাতে সর্বসম্প্রতি পরিহাসের যে বিষয়টি যুক্ত হয়েছে, তা হলো বৈরুতে বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের নিযুক্তি। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে সে রকমই এক অভিযোগ আলোচিত হচ্ছে। অভিবাসী বাংলাদেশিদের একটি সংগঠনের অভিযোগ, লেবাননে বাংলাদেশিদের স্বার্থ দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়েছে যে কূটনীতিককে, গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগেই তাঁকে সুইডেন থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল।
আগামী বছরের বাজেট দেওয়ার প্রস্তুতি হিসেবে অঙ্ক কষতে গিয়ে আমাদের মন্ত্রী ও আমলারা হিসাব পেয়েছেন যে মাথাপ্রতি জাতীয় আয় বেড়ে এখন এক হাজার ১৯০ ডলারে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে দলীয় নেতা-কর্মীদের খুনখারাবি, অপহরণ-বাণিজ্য, দখলদারি, চাঁদাবাজি, তদবিরবাজির দুঃসংবাদের মধ্যে অন্তত এই একটি খবর প্রধানমন্ত্রীকে উৎফুল্ল করেছে বলে সংবাদপত্রের খবর। এ-জাতীয় আয় বৃদ্ধির সুফল সংখ্যাগরিষ্ঠের ঘরে পৌঁছাচ্ছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও যে সত্যকে এড়ানো যাবে না, তা হলো এতে প্রবাসী শ্রমিকদের অবদান। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রধান বৈদেশিক আয়ের উৎস হচ্ছে এই প্রবাসীদের শ্রম, যাঁরা পেছনে রেখে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য বাড়তি পরিশ্রম করে আলিঙ্গন করছেন অকালমৃত্যু। জাতীয় আয় বৃদ্ধির সাফল্য উদ্যাপনের সময় ভবিষ্যতের এমন অকালমৃত্যু ঠেকানোর কথা কি আমরা একটুও ভাবব না?
কামাল আহমেদ: প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি, লন্ডন৷
No comments