বিএনপিকে মাঠে নামাতে মন্ত্রীদের উসকানি!

কূটনীতিকেরা বিএনপিকে দুই বছরের মধ্যে আন্দোলন না করার পরামর্শ দিয়েছেন বলে গতকাল একটি পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ খবরের সত্যাসত্য সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত নই। তবে বিএনপির নেতাদের হাবভাব দেখে মনে হয়, তাঁরা দুই বছর না হলেও আন্দোলনের জন্য সরকারকে কিছুটা সময় দিতে চান। এর আগে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনের আগে দল গোছানোর কথা বলেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি এ কথাও জানিয়ে দেন যে তাঁরা খুব বেশি দিন অপেক্ষা করবেন না। বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৯-দলীয় জোটের ভেতরেও যে আন্দোলনে নামা না-নামা নিয়ে চাপান-উতোর চলছে, নানা সূত্রে তারও আভাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু এক মাস বয়সী সরকারের কতিপয় মন্ত্রী যে ভাষায় কথা বলছেন, তাতে মনে হচ্ছে, ক্ষমতাসীন দলটিই চাইছে না বিএনপি বেশি দিন আন্দোলনের বাইরে থাকুক। মাঠ গরম না হলে এই শেষ শীতের দিনে তাঁদের ভালো লাগে না। গত বৃহস্পতিবার শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু একটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ কেন নিচ্ছে, সে জন্য বিএনপির কাছে কৈফিয়ত তলব করেছেন। এ নিয়ে মন্ত্রীর আত্মশ্লাঘার কিছু নেই। বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কারণেই তো আমির হোসেনের মতো আরও অনেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হয়ে শেখ হাসিনার তৃতীয় সরকারের মন্ত্রী হয়েছেন। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারে যিনি প্রথমে মন্ত্রীই হতে পারেননি।
কেননা, তিনি বিএনপির একজন নবীন নেতার কাছে হেরে গিয়েছিলেন। পরে টেকনোক্র্যাট কোটায় খাদ্যমন্ত্রী হন এবং উপনির্বাচনে ইলেন ভুট্টোকে হারিয়ে সাংসদ হন। ২০০১ সালের নির্বাচনে আবার ইলেন ভুট্টোই নির্বাচিত হন। হেরে যান আমির হোসেন আমু। সে ক্ষেত্রে বিএনপি নির্বাচনে না আসায় তাঁর অন্তত সুবিধাই হয়েছে। বিএনপির কাছে কৈফিয়ত না চেয়ে তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারতেন। আর নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বিএনপি ভুল করে থাকলে সে জন্য জনগণ তাদের কাছে কৈফিয়ত চাইবে। এখন যদি বিএনপি ভুল বুঝতে পেরে উপজেলা নির্বাচনে শরিক হয়েও থাকে, সে জন্য কৈফিয়ত দিতে হবে কেন? আমির হোসেন আমুরা যেহেতু নিজেদের নির্বাচিত প্রতিনিধি মনে করেন, তাঁদেরই উচিত জনগণের কাছে কৈফিয়ত দেওয়া। এক মাসের বেশি সময় হলো, তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আছেন। এই সময়ে তাঁর মন্ত্রণালয়ে কী কাজ হয়েছে, সেটি জানার অধিকার দেশবাসীর আছে। এত দিন সব দুর্গতির জন্য তাঁরা বিরোধী দলের সংঘাত-সংঘর্ষ, হরতাল-অবরোধের অজুহাত দিতেন। এখন তো সেসব নই। তাহলে কেন শিল্পকারখানায় উৎপাদন বাড়ছে না? কেন কারখানাগুলোতে প্রয়োজনীয় গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে না? কেন রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকারখানাগুলোর লোকসান বাড়ছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার পর আমির হোসেন আমু শিল্পবহির্ভূত বিষয় নিয়ে কথাবার্তাই বেশি বলছেন। আরেক মন্ত্রী, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন একই দিন ফরিদপুরে ছাত্রলীগের কর্মী সম্মেলনে বিএনপির উদ্দেশে বলেছেন, তাদের আন্দোলন ঠেকাতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট। তাঁর এ কথাটি পত্রিকায় পড়ে দুই দশক আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার একটি বক্তব্য মনে পড়ে।
সে সময় বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন চলছিল। সেই প্রেক্ষাপটে তিনি বলেছিলেন, বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করতে ছাত্রদলই যথেষ্ট। আমাদের দেশে ক্ষমতা বদলায়, দল বদলায়, ক্ষমতাবানদের চরিত্র বদল হয় না। কঠিন সত্য হলো, খালেদা জিয়ার ছাত্রদল বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবিলা করতে পারেনি। তাঁকে শেষ পর্যন্ত বিরোধী দলের দাবি মেনে নিতে হয়েছিল। আর এখন তো বিরোধী দল আন্দোলনই করছে না। সংসদের ভেতরে যাঁরা বিরোধী দলের আসনে বসেছেন, তাঁরা নিষ্ক্রিয়, নির্জীব। একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলেও আছেন। দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন না করেও সাংসদ হয়েছেন, বিশেষ দূত হয়েছেন। রওশন এরশাদ নির্বাচন করে সংসদে বিরোধী দলের নেতা হয়েছেন। তাঁদের স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ এখন সংসদেও গড়িয়েছে। রঙ্গভরা বঙ্গদেশে আরও কত কিছু দেখতে হবে। আর সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি ভোটে পরাজিত না হলেও রাজনৈতিক কৌশলে পরাজিত হয়ে এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্ব লক্ষ করা যাচ্ছে। কর্মীদের অভিযোগ, নেতাদের কারণে আন্দোলন সফল হয়নি। এই অবস্থায় বিএনপির নেতারা যখন শিগগিরই আন্দোলনের চিন্তা করছেন না, তখন মন্ত্রীদের উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতির কী যুক্তি থাকতে পারে? বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। সুখে থাকতে ভূতে কিলায়। দেশে আন্দোলন নেই, হরতাল-অবরোধ নেই এটি সম্ভবত মন্ত্রীদের ভালো লাগছে না। এ কারণেই কি মন্ত্রীরা উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন? তবে গত মন্ত্রিসভার সদস্য যাঁরা ছিলেন, তাঁদের কাছ থেকে নব্য মন্ত্রীদের শিক্ষা নেওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। সেই মন্ত্রিসভায় যাঁরা বড় বড় কথা বলতেন, তাঁদের অনেকেই এখন মন্ত্রিসভার বাইরে। পাঁচ বছর তাঁরা বিএনপি তথা বিরোধী দলকে গালমন্দ করে নিজেদের সফল মন্ত্রী হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। দিনের শেষে মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন। কেননা, শেষ বিচারে সরকারের সাফল্য ও ব্যর্থতার দায় শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।
বর্তমানে বিএনপি নাজুক অবস্থায় আছে, মানি। এর অর্থ এই নয় যে আওয়ামী লীগ খুব ভালো অবস্থায় আছে। বিএনপি নির্বাচন করেনি, তাই সংসদে বা সরকারে তার কোনো ভূমিকা নেই। কিন্তু যেহেতু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে, ভালোমন্দের দায়ও তাদের নিতে হবে। কে কীভাবে নেন সেটাই দেখার বিষয়। ইতিমধ্যে মন্ত্রী পদমর্যাদার চিফ হুইফ সাহেব এক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। দলের নেতা-কর্মীদের কাছে ক্রেস্ট না দিয়ে ক্যাশ নিয়ে আসার জন্য হুকুম দিয়েছেন। বিগত সরকারের ক্যাশ আদায়কারীরা এখন দুদকের সন্দেহ ও তদন্তের আওতায়। আমরা জানি না, উসকানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে মন্ত্রীরা বিরোধী দলকে মাঠে নামাতে চাইছেন কেন? দেশে শান্তি আছে, এটি তাঁদের পছন্দ নয়? আবার কি মন্ত্রীরা ৫ জানুয়ারির আগের অবস্থায় দেশকে ফিরিয়ে নিতে চান? শেখ হাসিনার তৃতীয় সরকারের মেয়াদ মাত্র এক মাস কয়েক দিন। এই কয়েক দিনে নিশ্চয়ই সরকার টের পেয়েছে, বিরোধী দলকে রাজনৈতিক কৌশলে হারানো যত সহজ, দেশ চালানো তত সহজ নয়। এই এক মাস সময়ের মধ্যেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে গেছে, এই এক মাস সময়ের মধ্যেই দাম না পেয়ে কৃষকেরা আলু রাস্তায় ফেলে দিচ্ছেন। এই সময়ের মধ্যেই জানা গেল, যুক্তরাষ্ট্র জিএসপি-সুবিধা সহজে ফিরিয়ে দিচ্ছে না। প্রায় প্রতিদিনই সরকারপ্রধানকে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। তিনি সাধ্যমতো সেগুলো সমাধানেরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু তাঁর অধিকাংশ মন্ত্রীই সম্ভবত সেই বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পারছেন না। আর সে কারণেই বিরোধী দলকে রাজপথে নিয়ে আসার জন্য উসকানি দিয়ে যাচ্ছেন। এটি থামানো প্রয়োজন।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net

No comments

Powered by Blogger.