নাগরিক সুবিধাবিহীন নগর রংপুর

রংপুরের একজন নাগরিকের জীবন যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখা যাবে—রংপুর বিভাগ এবং সিটি করপোরেশন হওয়ার পর তিনি বাসাভাড়া দেন আগের তুলনায় অনেক বেশি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করেন বেশি দামে, সন্তানকে স্কুলে দেবেন তার পর্যাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই, শিশুকে বিনোদনকেন্দ্রে পাঠাবেন তার কোনো ব্যবস্থা নেই, শহরে সড়কপথের ভোগান্তিতে পড়তেই হবে। রাতের শহরে একটু নিরিবিলি পথে একলা চললে ছিনতাইকারীর কবলে পড়ার আশঙ্কা। হেডলাইট না জ্বালানো অটোরিকশায় চলতে হবে। মূল শহর ছেড়ে নগরের উপকণ্ঠে গেলেই পল্লী বিদ্যুৎ। ঘন ঘন লোডশেডিং। অসুস্থ হলেও সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্রে অপ্রতুল সেবা। এ রকম অযুত সমস্যা জীবনকে তিক্ত করে তোলে। যাঁরা রংপুরকে নিজেদের স্বপ্নের শহর বলে দাবি করতেন, তাঁদের হতাশ হওয়া ছাড়া আপাতত আর কোনো উপায় নেই। রংপুর এমন একটি নগর, যেখানে গ্রামীণ জীবনের সরল-সুন্দর আবহ নেই, নাগরিক জীবনের সুবিধাও নেই। নাগরিক জীবনের সুবিধা একেবারেই না থাকার কারণে রংপুরের জনজীবনের সুখশান্তি সুদূরপরাহত। প্রায় তিন বছর ধরে রংপুরের চার লেন সড়কের কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার। যেটুকু অংশে চার লেনের কাজ শেষ করেছে, সেটুকু অংশের দখলদারি ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের হাতে। শহরের প্রাণকেন্দ্র প্রেসক্লাব থেকে টাউন হল পর্যন্ত দুর্বিষহ যানজট লেগে থাকে। ঘনবসতিপূর্ণ নগরে নাগরিক জীবনে যে যোগাযোগব্যবস্থা থাকার কথা ছিল, তা হয়ে ওঠেনি।
রংপুর সিটি করপোরেশনের আয়তন ২০৩ বর্গকিলোমিটার। নতুন-পুরোনো মিলে ৩৩টি ওয়ার্ড। পুরোনো ওয়ার্ডের অনেকগুলো রাস্তা পাকা করা হয়নি। পাকা রাস্তাগুলোর অনেকগুলো চলাচল-অযোগ্য। সড়কবাতি নেই অধিকাংশ সড়কে। সড়ক চার লেনে উন্নীত করার নামে প্রাচীন বৃক্ষগুলো কেটে ফেলা হয়েছে, কিন্তু আর রোপণ করা হয়নি। ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজে বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় ২৭ হাজার। সেই কলেজে প্রবেশমুখের সড়ক এতটাই অপরিচ্ছন্ন এবং ঘিঞ্জি যে বোঝার উপায় নেই এখানে শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী কারমাইকেল কলেজ রয়েছে। অথচ, ওই স্থানে মুক্তিযুদ্ধের একটি দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য হতে পারে। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, কারমাইকেল কলেজ, সরকারি বালিকা বিদ্যালয়, জিলা স্কুল, পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজ—সবখানেই একটি করে ফুটওভার পাসের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। অনেক আন্দোলন, হরতাল শেষে রংপুরকে সিটি করপোরেশনে উন্নীত করা হয়। সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, সাবেক পৌর মেয়র, সাবেক সাংসদ শরফুদ্দীন আহমেদ নির্বাচিত হন রংপুরের প্রথম নগরপিতা। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা তিনি কাজে লাগাবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাঁর পদমর্যাদাই সুনির্দিষ্ট হয়নি। তার ওপর রাষ্ট্রীয় কাজে ঢাকা যাওয়ার পথে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি কিছুদিন ছিলেন অসুস্থ। রংপুর বিভাগীয় শহরে উন্নীত হওয়া এবং সিটি করপোরেশন বাস্তবায়নের পর থেকে জনসংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত বেড়েছে।
বিভাগীয় কার্যালয়ে কাজের জন্য প্রচুর মানুষ এখন প্রতিদিন আসছে। জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি হলেও তাদের জন্য পর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকার কারণে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে ছিনতাই হচ্ছে, তুচ্ছ কারণকে কেন্দ্র করেও খুন হচ্ছে মানুষ। নগরায়ণের ফলে বৃদ্ধি পাওয়া জনসংখ্যার জন্য আলাদা করে থানা স্থাপনও হয়নি। রংপুরে বিনোদনের ব্যবস্থাই নেই। শিশুদের জন্যও বিনোদনকেন্দ্রের যথেষ্ট অভাব। একটি চিড়িয়াখানা, তা-ও শিশুদের জন্য অনুপযোগী। সুরভি উদ্যানটি কেবলই উপযোগী করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। রংপুরে একটি আধুনিক মিলনায়তন হওয়ার কথা ছিল। তা-ও বর্তমানে অনিশ্চিত। শিশু একাডেমী এবং শিল্পকলা একাডেমীতে যে পরিমাণে শিক্ষার্থীদের সংগীত-আবৃত্তি-চিত্রাঙ্কন শেখানো হয়, তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। খেলাধুলার পরিবেশও অনেক সীমিত পর্যায়ের। রংপুর বিভাগ এবং সিটি করপোরেশন হওয়ার পর থেকে রংপুরের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে অনেক। রংপুর সিটি করপোরেশনের মধ্যে অবস্থিত সব বাড়ির মালিক কিংবা যেকোনো ব্যবসায়ীদের আগের তুলনায় অনেক বেশি কর দিতে হয়। তাঁরা সেই করের টাকা আদায় করার চেষ্টা করেন ভাড়াটে কিংবা ক্রেতাদের কাছ থেকে। যেহেতু বাড়িভাড়া আইন কার্যকর নয় এবং আগের তুলনায় আয়কর দিতে হয় অনেক বেশি, তাই তাঁরা বাড়িভাড়া বৃদ্ধি করেছেন অনেক। ব্যবসায়ীরাও নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি করেছেন। সিটি করপোরেশনের নীরবতার সুযোগ নিয়ে কোনো কারণ ছাড়াই অটোরিকশার ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে।
নগরজীবনে ব্যয় অধিক হেতু নগরে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁদের নগরভাতা পাওয়ার কথা। কিন্তু সেই নগরভাতা না থাকার কারণে স্বল্প আয়ের মানুষের জীবনযাপনে অনেকটাই নাভিশ্বাস উঠেছে। বিভাগীয় কার্যালয়সহ অনেক সরকারি, আধা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যালয় গড়ে উঠছে রংপুরে। প্রতিদিন তাই বাড়ছে বসতি। কিন্তু, ছোট্ট জেলা শহর রংপুরের জন্য যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তা দিয়েই চলছে শিক্ষা দেওয়ার কাজ। সব বিভাগীয় শহরে রয়েছে মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ। কিন্তু রংপুর শহরে সেই মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ নেই। সরকারি-বেসরকারি যে প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তা এখানকার শিক্ষার্থীদের চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত কম। সরকারি উদ্যোগে আরও স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। রংপুরের নাগরিকদের নাগরিক সুবিধা প্রদান করতে চাইলে সবার আগে প্রয়োজন সরকারি সহযোগিতা। নতুন সিটি করপোরেশনকে সেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রাথমিক অবস্থায় যে পরিমাণ অর্থ প্রয়োজন হয়, সেই পরিমাণ অর্থ সরকারকে প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে প্রাথমিক অবস্থায় ১০ বছর মেয়াদি প্রকল্প হিসেবে এ নগরকে গণ্য করে এখানে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ-পয়োনিষ্কাশন-শিক্ষা-চিকিৎসা, বিনোদনকেন্দ্র-খেলার মাঠ-নিরাপত্তা-শপিং কমপ্লেক্স-উপযুক্ত সড়ক-জিমনেসিয়ামের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকল্পটি এক কিংবা দুই ধাপে শেষ হতে পারে। তা নাহলে যখন নিজস্ব আয়ে সিটি করপোরেশন চলতে পারবে, তখনই রংপুরের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা যাবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলে রংপুরকে একটি মডেল নগরে পরিণত করা সম্ভব। ঢাকা শহরের মতো তিক্ত অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও আমরা যদি পরিকল্পিত রংপুর নগর গড়ে তুলতে না পারি, সেটা হবে খুবই দুঃখজনক।
তুহিন ওয়াদুদ: শিক্ষক, বাংলা বিভাগ, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
wadudtuhin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.