মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ by রাজু আলাউদ্দীন
প্রত্যেক
লেখকই তার লেখার মধ্যে জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে বহন করেন তার কালের চিহ্নগুলো আর
এ চিহ্নগুলোর নজন্মদাতা যে-মানুষ তারও এক কোলাজ চিত্র তাতে প্রস্ফুটিত হয়ে
থাকে। কিন্তু লেখক যেমন দৃশ্যমান ঘটনার চিত্রকর, তেমনি এ চিত্রের সব রঙের
মাঝে নিজের কণ্ঠস্বরটিও অজান্তে চিত্রিত হয়ে ওঠে। শৈল্পিক উৎকর্ষতার
পাশাপাশি সেই কণ্ঠ মানবিকতায় কতটা সুগভীর হয়ে ওঠে সেটাও আমাদের মনযোগকে
আকর্ষণ না করে পারে না। আর্হেন্তিনার কবি ও চিত্রকর, কথাসাহিত্যক ও
প্রাবন্ধিক অসবাল্দো স্বানাসিনি রবীন্দ্ররচনা পাঠ করতে গিয়ে মানবতাবাদী
রবীন্দ্রনাথের সার্বজনীন আবেদনকে বুঝার চেষ্টা করেছেন। অসবাল্দো আমাদের
কাছে প্রায় অজ্ঞাত এক নাম। ভাষিক বাধা পেরিয়ে তার খ্যাতি বা কর্মের উত্তাপ
আমরা না পেলেও আর্হেন্তিনার (প্রচলিত উচ্চারণ আর্জেন্টিনা) গত শতাব্দীর
পঞ্চাশ বা ষাটের দশকের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তিনি বিশেষ ব্যক্তিত্ব হিসেবে নজর
কেড়ে নিয়েছিলেন তার নানামুখী সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য। জন্মেছিলেন ১৯২৮
সালের ৮ ডিসেম্বর। লেখা আর আঁকার মধ্যে তার সৃষ্টিশীল সত্তার স্ফূরণ ঘটেছে।
দেশে-বিদেশে প্রায় ৪৫টি প্রদর্শনী হয়েছিল তার চিত্রকলার। চিত্র সমালোচক
হিসেবেও তার খ্যাতি ছিল স্পানঞলভাষী দেশগুলোয়। কথাসাহিত্য, কবিতা ও
প্রবন্ধের বইয়ের সংখ্যা ষাটের ওপরে। দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কার ও সম্মাননায়
অভিষিক্ত অসবাল্দো স্বানাসিনি মৃত্যুবরণ করেন।
অসবাল্দো কীভাবে রবীন্দ্রনাথে আগ্রহী হয়েছিলেন তার কোনো স্পষ্ট ইতিহাস আমাদের জানা নেই। তথ্য আকারে শুধু এটুকু জানা যায়, তিনি দুবার দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। একবার ১৯৫১ সালে আর্হেন্তিক অনুবাদক এরিবের্তো চার্লসের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথেরstray Birds-এর স্পানঞল অনুবাদ Aves Errantes গ্রন্থের জন্য একটি ভূমিকা হিসেবে আর এর ১০ বছর পর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে SUR পত্রিকার প্রকাশিত রবীন্দ্র সংখ্যায়। SUR-এর লেখাটির শিরোনাম ছিল মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ (Tagore Humanista) তবে কোন লেখককে যত সহজে মানবতাবাদী হিসেবে প্রতিপন্ন করা সম্ভব ততটা সহজ নয় শিল্পের জটিল দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে অনিষ্ট পরিচয়টিকে উদ্ধার করা। জটিলতার কারণ শিল্পের স্বভাবজাত নানা আভাসে, বিরোধাভাসে তা এমন সব সুক্ষ্ম রেখায় উৎকীর্ণ হয়ে থাকে যে, খুব সতর্কতা নিয়ে না তাকালে ভুল বুঝার অবকাশ তাতে থেকে যায়।
অসবাল্দো ‘মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধের শুরুতে এ সতর্কতা নিয়ে তাকাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গীতাজ্ঞলির ২৬নং কবিতার দ্বৈততাকে লক্ষ্য করেছিলেন এবং কবি যে এ দ্বৈততাকে ত্যাগ করছেন না সেটাকেও তিনি আমলে নিয়ে বুঝেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা কবীর কিংবা রুমীর সর্বেশ্বরবাদী প্রতীকবাদের ভাবনা থেকে অনেক দূরে। তবে দূরত্ব যাই-ই হোক না কেন, মানবতাবিষয়ক ভাবনা আর শিল্পের মধ্যেকার দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্কটি রবীন্দ্রনাথ কীভাবে রচনা করছেন তাই অসবাল্দোর মনযোগের বিষয়। নিজের শৈল্পিক অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো বুঝার চেষ্টা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে-
‘মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানের প্রতিফলনকে প্রত্যাখ্যান করেন না, তবে মানবরূপে অবস্থিত ঐক্যগুলোতে ফিরে যেতে তিনি পছন্দ করেন, হয়তো একটি পথের সন্ধানে এই ফিরে যাওয়া কিংবা শুধুই কবিতা-প্রসূত যন্ত্রণার কারণেই এই ফিরে যাওয়া যে যন্ত্রণার কথা তু ফু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন লি তাই পো’কে (আবারও কবিতার যন্ত্রণায় ভুগছ?)’
একদিকে কবিতার যন্ত্রণা অন্যদিকে মানবতার আকুতি... এ দুয়ের মাঝখানে শিল্পীর দ্বন্দ্বকে অসবাল্দো দেখতে চেয়েছিলেন সংবেদনশীল মনের সহযোগিতায়। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে এর নিষ্পত্তি করছেন তা অসবাল্দোর কাছে ছিল খুবই কৌতূহলের বিষয়। নিষ্পত্তির সূত্রগুলোর সন্ধানে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর নাটকের মধ্যে পেন্ডুলামের মতো যাতায়াত করেছেন কৌতূহলের সুতায় ঝুলে থেকে। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে তিনি রবীন্দ্রনাথের নাটকের মধ্যে কয়েকটি ধ্র“বসত্যের মুখোমুখি হলেন যা শৈল্পিক নির্মাণে বিরোধাভাসের সৌন্দর্যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অসবাল্দো পর্যবেক্ষণে আমরা দেখব, সন্ন্যাসী ভালোবাসার মধ্যে খুঁজে পায় যথার্থতা।
সন্ন্যাসী নাটকের চতুর্থ অংক থেকে তিনি সন্ন্যাসীর উদ্ধৃতি দিয়ে এ যথার্থতাকে নিশিত করে তোলেন : ‘কারণ সত্যিকারের অসীমতা রয়েছে সীমার মধ্যে আর প্রেমই কেবল সত্যকে চিনতে পারে...’
রবীন্দ্রনাথের এ সত্যের সঙ্গে তিনি তুলনা করতে গিয়ে স্মরণ করেছেন মধ্যযুগীয় জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক মেইস্টার একহার্টকে (Eckhart)। একহার্ট বলেছিলেন, মানুষ আসলে ইশ্বর আর ইশ্বর আসলে মানুষ। তবে তুলনা করতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্যকে ভুলে যাননি। বলেছেন, এই সত্যে পৌঁছার ধরন ভিন্ন।
জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক অবস্থান বুঝার জন্য তিনি এরপর আরও একবার তুলনার প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের সঙ্গে স্যামুয়েল বেকেটের waiting for Godot কে পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছেন কীভাবে তারা ভিন্ন পথে ভিন্ন বার্তার ঘোষক হয়ে উঠেছে। অসবাল্দোকে অনুসরণ করে আমরা দেখতে পারি তিনি কীভাবে এ তুলনার পথে অগ্রসর হচ্ছেন-
‘অমলের (El Cartero del Rey) কোমলতা... সারল্যের মতোই তীব্রভাবে আকর্ষণীয় আর রাজার (ইশ্বরের প্রতীক) আগমনকে বাস্তবতার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা এবং নিজের কৈশরিক স্বপ্নের প্রতিদান স্বরূপ একটা ক্ষতিপূরণ ও শিশুর বেদনার উপশমের লক্ষে একটা উদ্যোগ হিসেবেই দেখা উচিত। রাজা আর গডোট (বেকেট)... উভয়ে এক অভিন্ন প্রতীক, দুজনই দৃশ্যে অনুপস্থিত। কিন্তু এই চরিত্র দুটি পুরোপুরি আলাদা। পোজ্জোর উদাসীন নিষ্ঠুরতা বা লাকির মৃত্যুতে বেঁচে থাকার মতোই স্বচ্ছভাবে বেকেট যা তুলে ধরেন তা এস্ট্রাগন ও ভাদিমিরের যন্ত্রণা নয়, বরং এক বিচার। বিপরীতে, অমল বিচার ছাড়াই কোনো কিছু তৈরিতে সক্ষম এবং তাকে ঘিরে যে চরিত্রগুলো আবর্তিত তারাও; বাস্তবতা যখন তীব্র যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে, তখন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে তারা। প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের ভাবনা ও অনুভূতির ক্ষেত্রে যে পার্থক্য বর্তমান, বেকেট এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও একই পার্থক্য নির্ধারণ করা সম্ভব।’
অসবাল্দোর রবীন্দ্র-বিচারের একটা বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি রবীন্দ্রনাথকে তার নানা ধরনের প্রেক্ষিতে তো বটেই, এমনকি সেসব রচনাকে অন্য লেখকদের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। এটা ক্রমশ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ যে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় গৃহীত হয়েছিলেন তা অটুট রয়েছে এক দীর্ঘ সময় ধরে। অটুট থাকার পেছনে যেটাকে প্রধান কারণ হিসেবে আমার মনে হয় তা হল রবীন্দ্রনাথকে তারা ইউরোপীয়দের মতো হুজুগের বশে নয় বরং তার রচনার বৈশ্বিক আবেদনকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নিজেদের বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার কারণে।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অসবাল্দো তার প্রবন্ধের শেষ স্তবকে যা বলেছেন তাতে এ বিশ্বাস আমাদের আরও নিশ্চিত হয়ে ওঠে-
‘পশ্চিমের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে তার রচনাকর্মে এমন এক প্রশান্তিকে খুঁজে পান যা পরে ভুলে যান তারা, ভুলে যাওয়ার কারণ হয়তো এই যে তাতে প্রবলভাবে দৃশ্যমান বৈপরীত্যহীন এক ধারাবাহিকতা কিংবা হয়তো এতে রয়েছে চূড়ান্ত সারল্যের মুখোশে সত্যের উপস্থিতি।’
অসবাল্দো কীভাবে রবীন্দ্রনাথে আগ্রহী হয়েছিলেন তার কোনো স্পষ্ট ইতিহাস আমাদের জানা নেই। তথ্য আকারে শুধু এটুকু জানা যায়, তিনি দুবার দুটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে। একবার ১৯৫১ সালে আর্হেন্তিক অনুবাদক এরিবের্তো চার্লসের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথেরstray Birds-এর স্পানঞল অনুবাদ Aves Errantes গ্রন্থের জন্য একটি ভূমিকা হিসেবে আর এর ১০ বছর পর ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে SUR পত্রিকার প্রকাশিত রবীন্দ্র সংখ্যায়। SUR-এর লেখাটির শিরোনাম ছিল মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ (Tagore Humanista) তবে কোন লেখককে যত সহজে মানবতাবাদী হিসেবে প্রতিপন্ন করা সম্ভব ততটা সহজ নয় শিল্পের জটিল দ্বন্দ্বের মধ্য থেকে অনিষ্ট পরিচয়টিকে উদ্ধার করা। জটিলতার কারণ শিল্পের স্বভাবজাত নানা আভাসে, বিরোধাভাসে তা এমন সব সুক্ষ্ম রেখায় উৎকীর্ণ হয়ে থাকে যে, খুব সতর্কতা নিয়ে না তাকালে ভুল বুঝার অবকাশ তাতে থেকে যায়।
অসবাল্দো ‘মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধের শুরুতে এ সতর্কতা নিয়ে তাকাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের গীতাজ্ঞলির ২৬নং কবিতার দ্বৈততাকে লক্ষ্য করেছিলেন এবং কবি যে এ দ্বৈততাকে ত্যাগ করছেন না সেটাকেও তিনি আমলে নিয়ে বুঝেছিলেন যে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা কবীর কিংবা রুমীর সর্বেশ্বরবাদী প্রতীকবাদের ভাবনা থেকে অনেক দূরে। তবে দূরত্ব যাই-ই হোক না কেন, মানবতাবিষয়ক ভাবনা আর শিল্পের মধ্যেকার দ্বন্দ্বমধুর সম্পর্কটি রবীন্দ্রনাথ কীভাবে রচনা করছেন তাই অসবাল্দোর মনযোগের বিষয়। নিজের শৈল্পিক অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো বুঝার চেষ্টা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে-
‘মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথ জ্ঞানের প্রতিফলনকে প্রত্যাখ্যান করেন না, তবে মানবরূপে অবস্থিত ঐক্যগুলোতে ফিরে যেতে তিনি পছন্দ করেন, হয়তো একটি পথের সন্ধানে এই ফিরে যাওয়া কিংবা শুধুই কবিতা-প্রসূত যন্ত্রণার কারণেই এই ফিরে যাওয়া যে যন্ত্রণার কথা তু ফু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন লি তাই পো’কে (আবারও কবিতার যন্ত্রণায় ভুগছ?)’
একদিকে কবিতার যন্ত্রণা অন্যদিকে মানবতার আকুতি... এ দুয়ের মাঝখানে শিল্পীর দ্বন্দ্বকে অসবাল্দো দেখতে চেয়েছিলেন সংবেদনশীল মনের সহযোগিতায়। রবীন্দ্রনাথ কীভাবে এর নিষ্পত্তি করছেন তা অসবাল্দোর কাছে ছিল খুবই কৌতূহলের বিষয়। নিষ্পত্তির সূত্রগুলোর সন্ধানে তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর নাটকের মধ্যে পেন্ডুলামের মতো যাতায়াত করেছেন কৌতূহলের সুতায় ঝুলে থেকে। মানবতাবাদী রবীন্দ্রনাথের সন্ধানে তিনি রবীন্দ্রনাথের নাটকের মধ্যে কয়েকটি ধ্র“বসত্যের মুখোমুখি হলেন যা শৈল্পিক নির্মাণে বিরোধাভাসের সৌন্দর্যে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। অসবাল্দো পর্যবেক্ষণে আমরা দেখব, সন্ন্যাসী ভালোবাসার মধ্যে খুঁজে পায় যথার্থতা।
সন্ন্যাসী নাটকের চতুর্থ অংক থেকে তিনি সন্ন্যাসীর উদ্ধৃতি দিয়ে এ যথার্থতাকে নিশিত করে তোলেন : ‘কারণ সত্যিকারের অসীমতা রয়েছে সীমার মধ্যে আর প্রেমই কেবল সত্যকে চিনতে পারে...’
রবীন্দ্রনাথের এ সত্যের সঙ্গে তিনি তুলনা করতে গিয়ে স্মরণ করেছেন মধ্যযুগীয় জার্মান ধর্মতাত্ত্বিক মেইস্টার একহার্টকে (Eckhart)। একহার্ট বলেছিলেন, মানুষ আসলে ইশ্বর আর ইশ্বর আসলে মানুষ। তবে তুলনা করতে গিয়ে তিনি রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্যকে ভুলে যাননি। বলেছেন, এই সত্যে পৌঁছার ধরন ভিন্ন।
জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক অবস্থান বুঝার জন্য তিনি এরপর আরও একবার তুলনার প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের সঙ্গে স্যামুয়েল বেকেটের waiting for Godot কে পাশাপাশি রেখে দেখিয়েছেন কীভাবে তারা ভিন্ন পথে ভিন্ন বার্তার ঘোষক হয়ে উঠেছে। অসবাল্দোকে অনুসরণ করে আমরা দেখতে পারি তিনি কীভাবে এ তুলনার পথে অগ্রসর হচ্ছেন-
‘অমলের (El Cartero del Rey) কোমলতা... সারল্যের মতোই তীব্রভাবে আকর্ষণীয় আর রাজার (ইশ্বরের প্রতীক) আগমনকে বাস্তবতার জন্য তীব্র ব্যাকুলতা এবং নিজের কৈশরিক স্বপ্নের প্রতিদান স্বরূপ একটা ক্ষতিপূরণ ও শিশুর বেদনার উপশমের লক্ষে একটা উদ্যোগ হিসেবেই দেখা উচিত। রাজা আর গডোট (বেকেট)... উভয়ে এক অভিন্ন প্রতীক, দুজনই দৃশ্যে অনুপস্থিত। কিন্তু এই চরিত্র দুটি পুরোপুরি আলাদা। পোজ্জোর উদাসীন নিষ্ঠুরতা বা লাকির মৃত্যুতে বেঁচে থাকার মতোই স্বচ্ছভাবে বেকেট যা তুলে ধরেন তা এস্ট্রাগন ও ভাদিমিরের যন্ত্রণা নয়, বরং এক বিচার। বিপরীতে, অমল বিচার ছাড়াই কোনো কিছু তৈরিতে সক্ষম এবং তাকে ঘিরে যে চরিত্রগুলো আবর্তিত তারাও; বাস্তবতা যখন তীব্র যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে, তখন বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করে তারা। প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের ভাবনা ও অনুভূতির ক্ষেত্রে যে পার্থক্য বর্তমান, বেকেট এবং রবীন্দ্রনাথের মধ্যেও একই পার্থক্য নির্ধারণ করা সম্ভব।’
অসবাল্দোর রবীন্দ্র-বিচারের একটা বড় বৈশিষ্ট্য এই যে, তিনি রবীন্দ্রনাথকে তার নানা ধরনের প্রেক্ষিতে তো বটেই, এমনকি সেসব রচনাকে অন্য লেখকদের সঙ্গে মিলিয়ে পাঠ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের স্বাতন্ত্র্যকে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। এটা ক্রমশ আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, লাতিন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ যে উৎসাহ ও উদ্দীপনায় গৃহীত হয়েছিলেন তা অটুট রয়েছে এক দীর্ঘ সময় ধরে। অটুট থাকার পেছনে যেটাকে প্রধান কারণ হিসেবে আমার মনে হয় তা হল রবীন্দ্রনাথকে তারা ইউরোপীয়দের মতো হুজুগের বশে নয় বরং তার রচনার বৈশ্বিক আবেদনকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন নিজেদের বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখার কারণে।
রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অসবাল্দো তার প্রবন্ধের শেষ স্তবকে যা বলেছেন তাতে এ বিশ্বাস আমাদের আরও নিশ্চিত হয়ে ওঠে-
‘পশ্চিমের অনেকেই রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে তার রচনাকর্মে এমন এক প্রশান্তিকে খুঁজে পান যা পরে ভুলে যান তারা, ভুলে যাওয়ার কারণ হয়তো এই যে তাতে প্রবলভাবে দৃশ্যমান বৈপরীত্যহীন এক ধারাবাহিকতা কিংবা হয়তো এতে রয়েছে চূড়ান্ত সারল্যের মুখোশে সত্যের উপস্থিতি।’
No comments