আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান by কবিয়াল নুরুল হুদা
আমি মোঃ নুরুল হুদা বাঁশখালী, দক্ষিন পুইছড়ি গ্রামের সুলতানিয়া প্রাইমারী স্কুল থেকে ১৯৬৭ইং ৫ম শ্রেণী পাশ করার পর তখন আমার বয়স আনুমানিক ১৪ বছর। আমাদের গ্রামের পাশে হাই স্কুল না থাকায়, আমাকে আমার চাচার মফস্বলের শহর টেকনাফে নিয়ে যায়। চাচা জনাব বোজুরুজ মেহের ফরেষ্ট গার্ড হিসেবে কর্মরত ছিলেন টেকনাফ। আমার বাবাও কক্সবাজার আদালতে মহুরীর চাকুরী করতেন। চাচা বেশি ভালবাসত বলেই সেই সুবাদে টেকনাফ রেষ্ট হাউসের পাশে ফরেষ্ট কোয়াটারে থেকে টেকনাফ হাইস্কুলে ফেব্রুয়ারীর শেষের দিকে ভর্তি করিয়ে দেন। নতুন স্কুল, নতুন বন্ধু ও নতুন জায়গায় গিয়ে কিশোর মনে তখন আনন্দে ভরপুর ছিলাম। রীতিমত সপ্তাহ খানেক স্কুলে যাওয়া আসার পর হঠাৎ এক রাতে কোয়াটারের পাশে রেষ্ট হাউসের সামনে গাড়ির হরণ ও শব্দ শুনা যাচ্ছে।
চাচা বোজুরুজ মেহের এক লাফে উঠে রেষ্ট হাউসের চাবি নিয়ে গাড়ির সামনে গেলেন, আমি ও পেছনে গিয়ে দেখলাম গাড়ী থেকে দুইজন ভদ্র সাহেব বের হয়ে আসলেন এবং অস্ত্র সহ আরও দুইজন ফরেষ্ট গার্ড। চাচা সালাম দেওয়ার পর ফরেষ্ট অফিসার বললেন, আমাদের ফরেষ্টের তদন্ত কাজের জন্য একজন অতিথি এসেছেন, উনি এখানে কয়েকদিন থাকবেন। অতিথি ভদ্র লোকটি তেমন কোন কথা বললেন না। চাচা তাড়াতাড়ি রেষ্ট হাউস খোলে দিয়ে অতিথিদের জন্য হালকা চা নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। তখন রাত আনুমানিক ১২.০০-১.০০টা পর্যন্ত হবে। স্যার বলেন অতিথির দেখাশোনা করবে ও ওনার নির্দেশ মোতাবেক যা যা লাগে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে অতিথির সাথে আর ও কিছুক্ষন সময় দিয়ে গাড়ী নিয়ে কক্সবাজার চলে গেলেন।
অতিথি রাত্রি যাপন করে পরদিন সকালের নাস্তা শেষে গোসলের জন্য গরম পানি দিতে বলেন। চা-নাস্তা, গরম পানি, পত্রিকা ও চিটিপত্র নিয়ে যাওয়া ছিল আমার কাজ। তখনো চিনতে পারিনি এই গভীর গোর গম্ভির লোকটি কে? সকালে গোসলের শেষে পরের দিনের পত্রিকা গুলো নিয়ে চোখ বোলাচ্ছেন এবং চাচাকে ডেকে বললেন এখানে বন পরিদর্শন করার মত কোন নৌকা আছে? চাচামিয়া বললেন একটা আছে স্যার তবে মেরামত করিতে হবে। স্যার বললেন তাড়াতাড়ি মেরামত করে নাও। দুইদিনের মধ্যে উপরে কাঠের ছাউনি দিয়ে খুব সুন্দর একটা নৌকা তৈরী হয়ে গেল। তারপর একরাতে বের হয়ে গেলেন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে ২টি অস্ত্র দুইজন ফরেষ্ট গার্ড সহ রেরিয়ে পড়েন গহীন জঙ্গলে গভীর রাত পর্যন্ত নিঝুম প্রকৃতির সাথে কিছু সময় জোৎস্না, আর কিছু সময় অন্ধকার বনের পশু পাখিদের ডাক আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দের সাথে মিশে নৌকার ভেতর সারারাত কাটান, আর কিছু সময় ঘুমান। সকালে আবার রেষ্ট হাউসে এসে গরম পানিতে গোসল ও নাস্তা করার পর পত্রিকার দিকে মনোযোগ দেন। প্রতিদিন অনেক গুলো পত্রিকা পাঠিয়ে দেওয়া হত কক্সবাজার থেকে, দৈনিক পত্রিকা গুলো আসতে আসতে তার পরের দিন এসে পৌছে। একদিন আমাকে অতিথি সাহেব একটি চিটি দিয়ে বলেন এই চিঠিটা ফরেষ্ট অফিসার রওশন আলী সাহেবের কাছে দিয়ে আস।
পরে আমি টেকনাফ থেকে কক্সবাজার বন কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে উঠলাম, আমি ছোট বলে কেউ আমাকে স্যারের রুমে ঢুকার অনুমতি দেয়নি। দরজায় দেখলাম নেম প্লেটে লেখা রয়েছে রওশন আলী, তখন নিশ্চিৎ হলাম যে, এই রুমেই রওশন আলী স্যার আছেন। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করার পর যখন দেখলাম কেউ নেই, তখন হঠাৎ করেই স্যারের রুমে ঢুকে গেলাম। স্যার প্রথমেই একটু বিস্ময় চোখে তাকালে এত ছোট ছেলে আমার রুমে ঢুকে পড়েছে, সালাম দিয়ে বললাম স্যার আমি টেকনাফ রেষ্ট হাউসের অতিথি স্যারের চিঠি নিয়ে আসছি। স্যার আতংকিত অবস্থায় চেয়ার থেকে উঠে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করেন। পরে দরজা খোলে কলিং বেল দিয়ে পিয়ন ডেকে আমাকে আপ্যায়ন করার কথা বলেন এবং আমার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করেন তুমি আজ রাত কোথায় থাকবে। তখন আমি বললাম আমার বাবা কক্সবাজার আদালতে মুহুরী এখানে আমাদের বাসা আছে। স্যার বলেন তাহলে তুমি কাল সকালে আমার সাথে দেখা করার পর টেকনাফ যাবে, পরে আমাকে দুপুরের ভাত খাওয়ান। ঐ দিন বাবার সাথে থেকে পরদিন স্যারের অফিসে গিয়ে দেখা করলাম, স্যার আমাকে বেশ কিছু পত্রিকা আর মোড়ানো একটা পেকেট দিলেন। আমি টেকনাফ রেষ্ট হাউসে গিয়ে অতিথির হাতে যখন পেকেট টাকা দিলাম, উনি খোলে দেখার পর একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলেন। পেকেটের ভেতর ছিল ক্যাপেষ্টেন সিগারেটের ছুগা এবং সেবন করার চোরট (কাল রংয়ের পাইপ)। আমি খুশি মনে বের হয়ে গেলাম, ভাবলাম এত বড় অফিসার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন শুধু তাই নয় তিনি হিন্দু, মুসলিম, মামা যাকেই পান শুধু বুকে জড়িয়ে ধরতেন। সবার মনে ভাবনা হয় এমন অফিসারতো আর কোন দিন পাইনি।
একদিন পত্রিকা পড়ার পর খুব বিষন্ন অবস্থায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর চাচা বুজুরুজ মেহের (কালামিয়া) কে ডেকে বলেন এখানে বার্মার কোন লোক আছে? চাচা বললেন আছে স্যার আমাদের পরিচিত এক বার্মার হুজুর আছে উনি এখন কক্সবাজারে বাহারছড়া মসজিদের ইমামতি করেন ও আরবী পড়ান। স্যার বললেন তাড়াতাড়ি ওকে খবর দাও। তখন চাচা টেকনাফ টি এন্ড টি অফিস থেকে আমার বাবার কাছে টেলিফোন করে বলেন, ইমাম মৌলবী নুরুজ্জামান হুজুরকে অতিসত্ত্বর টেকনাফ ফরেষ্ট রেষ্ট হাউসে আসতে বলেন। তার পরদিন বাবা উমরমিয়া সহ হুজুর নুরুজ্জামান উপস্থিত। তখন বাবা চাচা হুজুর ও অতিথি সহ কিছুক্ষণ বৈঠক করেন, অতিথির বার্মার কোন গ্রাম দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং নুরুজ্জামান হুজুরের বাড়ীতে থাকবেন। উক্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, তারপর দিন মাগরিবের আযানের পর টেকনাফ থেকে বার্মা যাওয়ার ব্যবস্থা করা হউক।
অতিথির নির্দেশ মত পরের দিন সব মালামাল খাবার দাবার নিয়ে সবাই উপস্থিত। ঠিক মাগেিরবের নামাজের পর প্রথমে অতিথি নৌকায় উঠেন পরে আমার বাবা চাচা ও বার্মার হুজুর, মাঝি ২জন সহ পাল তোলা নৌকায় উঠে পড়েন।
তথন আমি আর কান্না থামাতে পারছিনা আমাকে ফেলে বাবা, চাচা চলে যাচ্ছে মনটা বড় খারাপ হয়ে আবেগকে ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। তখন বাবা নৌকা থেকে নেমে এসে আমাকে ধমক দেন আমাকে বাসায় চলে যেতে বলেন। অতিথি নৌকার ভেতর থেকে বড়গলায় বলেন ওকেও নৌকায় তুলে নাও। আমি খুশিতে আত্মহারা অতিথির বার্মা সফর সঙ্গী হিসেবে থাকতে পেরে আমার কান্না তখন বন্ধ হয়ে গেল। তারপর তাহাদের সাথে আমিও রওনা হলাম। পালতোলা নৌকা সাগরের মাঝখানে চলে গেছে প্রায়, পরে বড়খাল থেকে ছোট খালে হুজুর নুরুজ্জামানের দেখানো পথে চলতে লাগল।
সারা রাত বার্মার পুলিশের কঠিন পাহারার চোখ ফাঁকি দিয়ে সারারাত নৌকা চলছেই, ফজরের আযানের পরপরই পৌছে গেছি নুরুজ্জামার হুজুরের বাড়ী হাইদছুরাতা গ্রামে।,ভোরের পাখির ডাকে আমরা নৌকা থেকে পা নামালাম বার্মার মাটিতে, পরে নৌকা আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে যায় টেকনাফে। সামান্য কিছু পথ পায়ে হেটে নুরুজ্জামান হুজুরের বাড়ীতে পৌছে গরম জল দিয়ে গোসল করেন অতিথি। বিনি চালের ভাত দিয়ে সকালের নাস্তা করেন অতিথি ও আমারা সবাই। যতদিন বার্মায় ছিলাম ততদিন অতিথি ও সবার মন মানসিকতা খুব ভাল ছিল। হুজুরের বাড়ীতে আমরা চার দিন পর্যন্ত অবস্থান করি সেখানেও কিভাবে যে অতিথির জন্য বাংলা পত্রিকা পৌছে যেত কিছুই বোঝতে পারতাম না। বার্মার ঘরগুলো খুব সুন্দর মাটির তৈরী ও লোকজন প্রায় আমাদের দেশের মতো লাগে দেখতে এবং খুব অতিথি পরায়ন ও মিশুক প্রকৃতির। ভালই কেটেছে সেই দিন গুলো সবার মনে ছিল খুব আনন্দ। ৪-৫ দিন পর অতিথি আবার নৌকা আনার জন্য নির্দেশ দেন। চাচা টেকনাফ গিয়ে আবার মাঝি মাল্লা সহ সেই পালতোলা নৌকা নিয়ে হাজির। একদিন মাগরিব নামাজের পর আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আসার সময় অতিথি বলেন “ইহা আমার জীবন মরন তরী”। গভীর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে পালতোলা নৌকা সারা রাত যুদ্ধ করে ফজরের আযানের আগে বাংলাদেশে পৌছি এবং টেকনাফ ফরেষ্ট রেষ্ট হাউসে আসি। আবার গরম পানিতে গোসল শেষে রেষ্ট হাউজে জমাকৃত পত্রিকায় চোখ ভোলান।
এমনি করে আরও দুইদিন কেটে গেল। রাত নয়টার দিকে ড্রাইভার আবুল বশর ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি নিয়ে এসে অতিথি ও আমাদের সহ ইনানী রেষ্ট হাউসে নিয়ে যায়। অতিথির জন্য সেলাই করা নতুন জামা ও নতুন লুঙ্গি পাঠিয়ে দেন জনাব রওশন আলী সাহেব। ইনানী ফরেষ্ট রেষ্ট হাউজে প্রায় ১০-১২ দিনের মত অবস্থান করে। আমিও তাহাদের সাথে থাকতে থাকতে আমার আর স্কুলে যাওয়া হচ্ছেনা। সেখানে অতিথির সেবা করা আর সাথে সাথে সব সময় কাছে থাকা হচ্ছে আমার ডিউটি, আর ছকিনা নামে এক মহিলা অতিথির জন্য রেষ্ট হাউজের রান্না-বান্না করতেন, কাপড় চোপড় ধুয়া ও অন্যান্য সব ধরনের কাজ ও অতিথির গরম জল দেওয়া আর মাঝে মাঝে চা বানানো ছিল ছকিনার প্রধান কাজ । অতিথি ডাবের পানি বেশি পছন্দ করতেন, অন্যান্য পানি কম খেতেন, বেশির ভাগ ডাবের পানিই খেতেন। অতিথি প্রতিদিন প্রায় স্থানীয় মার্মাদের সাথে তাদের ঘরে যাওয়া আসা করতেন। সালেং প্র“ ও অংছেং প্র“ নামে দুইজন মার্মা এসে অতিথিকে তাদের পাড়ায় নিয়ে যেত। সেখানে মাঝেমধ্যে তাদের বাড়ীতে দুপুরের খাবার ও খেয়ে আসতেন। তাদের সাথে এভাবে মিশে গেছিল যে ওদেরকেও বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং প্রায় দুই কিলোমিটার হেটে তাদের বাড়ীতে যেতেন। একদিন অতিথি চাচা বোজুরুজ মেহের কে বলেন রজু খালে একটা বড় সাম্পান আছে তার মাঝিকে খবর দাও। চাচা আমাকে ডেকে বলেন রজু খালের ভেতর যে সাম্পান দেখা যাবে সেই সাম্পানের মাঝিকে ডাক, নাম ইসলাম মাঝি এবং বন্দুক কাশেম ও শুক্কুর আলী নামে আরও দুইজন উপস্থিত ছিল। তখন অতিথি তাদের পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং আনন্দ উৎসবের মধ্যে সবার জন্য ভাল খাবারের ব্যবস্থা করেন। আমার চাচাকেও তাহাদের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক অতিথির সাথে সাথে থাকার জন্য টেকনাফ থেকে ইনানীতে বদলি করেন। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী এবং কুস্তি ও ক্যারাত খেলায় ছিল বাংলাদেশের সেরা। পরে চাচাকে বডি গার্ড হিসেবে সবসময় সাথে রাখতেন এবং ফরিদপুর থেকে কৃষ্ণা নামে এক হিন্দু মেয়েকে বিবাহ পড়িয়ে দেন বর্তমানে তার নাম মোস্তাফা খানম। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন গ্রামের বাড়ী ফরিদপুরে তখন হয়তো ঢাকায় থাকলে তিনিও মারা যেত।
আমি গ্রামের বাড়ী বাঁশখালীতে চলে আসি। চাচা যখন টেকনাফ থেকে বদলি হয়ে আসে ইনানিতে তখন আমাকে গ্রামের বাড়ী বাঁশখালীতে চলে আসতে হয়েছে। ১৯৬৮/এপ্রিল মাসের দিকে টৈইটং হাই স্কুলে ভর্তি হই। সেখানেও রীতিমত স্কুলে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন আমি স্কুল থেকে এসে দেখি কক্সবাজার হইতে আমার বাবা ও চাচা বোজুরুজ মেহের গ্রামের বাড়ীতে এসে তড়িঘড়ি করে ভাল রান্নাবান্নার আয়োজনের ব্যস্ত আছেন। আমাদের কাচারী ঘরে দেখি, অতিথি আমাদের ঘরে এসেছেন। দেখে আমার মনে খুব আনন্দ লাগল, এমন মহান মহানুবতার স্যার যার মনে কোন হিংসা বা গৌরব কোন কিছুই পাইনি। কি জানি যদি সেই বার্মার মত আবার কোথাও বেড়াতে যেতে পারি মনে অনেক ইচ্ছে জমা হতে শুরু করেছে। উনাকে কাছ থেকে আরও ভাল করে কাছে গিয়ে দেখতে শুরু করলাম। অতিথির কথা গুলি ছিল খুব মিষ্ট ভাষায় আর অনুকরন করার মত। ইসলাম মাঝি, বন্দুক কাসেম সহ আমাদের ঘরে রাতের খাওয়া দাওয়া করে অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ আলোচনা করে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ভোর হল গ্রামের বাড়ীতে পুকুর দেখে অতিথি পুকুরে নেমে গোসল করেন মনের আনন্দে এবং বলেন “আজ অনেক দিন পর মনের তৃপ্তি মত গোসল করলাম”। অথচ উনি গরম জল ছাড়া একদিনও গোসল করেননি। গোসল শেষে সকালের নাস্তা করার পর বাবা আমাকে বলেন, এই পত্রটা মৌলভী সৈয়দের বাড়ীতে পৌছে দিয়ে আস। আমি সোজা পত্রটা নিয়ে তাহার বাড়ীতে গিয়ে দেখি উনি নেই পরে উনার ভাইকে দিয়ে আসলাম। বাড়ীতে এসে জনাব আতাউর রহমান কাউছার সাহেবকে দেখতে পেলাম। পরে সন্ধ্যা আবার আমাদের বাড়ীতে খাওয়া দাওয়া করার পর স্থান পরিবর্তন করেন। ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করেন অতিথি সাহেব। পরদিন মৌলভী সৈয়দ ও আতাউর রহমান কাউছার সহ টৈটং ফরেষ্ট অফিসের সন্নিকটে আতাউর রহমান খানের বাংলোয় আসলাম। মাঝি সহ উপস্থিত থাকেন ঐ বাংলোত কিছুদিন অপেক্ষা করেন। সেখানে বুজুরুজ মেহের আমার চাচা কাসেম গার্ডকে নির্দেশ দেন আতাউর রহমান ভাই এর বাংলোতে একজন অফিসার আসিয়াছেন আপনি আপনাদের সরকারী বন্দুক নিয়ে উনার নিরাপত্তা দিবেন যেন কোন প্রকার অসুবিধা না হয়। ভাই হিসেবে এটা আমার অনুরোধ। পরে ওখানেও ৫/৬ দিন ছিলেন এবং মৌলভী সৈয়দ সাহেবের এর ব্যবস্থাপনায় সেখানে আতিতিয়তার ব্যবস্থা করা হয়। সব ষ্টাফরা অতিথির সুবিধা অসুবিধার দিক খেয়াল রাখেন এবং আঃ মজিদ নামে একজন বাংলো চৌকিদার ছিলেন সে অতিথির রান্না বান্না কাপড় চোপড় ধোয়াসহ সব ধরনের কাজ করতেন। বাংলোর পাশে একটা ছোট ঘরে থাকতেন।
পরে জানিতে পারি যে, অতিথি একদিন টৈটং থাকা অবস্থায় পত্রিকা পড়ে খুব খুশি মনে সবাইকে ডাকতে বললেন। জনাব আতাউর রহমান কাউছার সাহবে, ফরেষ্ট গার্ড বোজুরুজ মেহের, নূরুল হুদা, ওমর আলী, ইসলাম মাঝি, বন্দুক কাসেম, শুক্কুর আলী, মৌলভী হাসান শরিফ, জহুরুল আলম সওদাগর, কেরানী ছালে আহম্মদ, মাষ্টার মৌলভী সৈয়দ সবাই খুশি মনে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে সেই মুহূর্তে অতিথি সবাইকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন এতদিন এত খাল নদী পাহাড় পাড়ি দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার পর অতিথি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন- “আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, আমাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার নামও মামলায় জড়িত করেন। তাই আমি মান সম্মানের কারনে আতাউর রহমান খান এর সহযোগিতায় হাতিয়া তমুরুদ্দিন বাজার হইতে বড় লবনের সাম্পানে করে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে রাজাখালীর ভোলা গ্রামে আতাউর এর বাংলোয় উঠি তারপর এই জেলার বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করিয়া থাকি। বর্তমানে আমি মামলা হইতে নির্দোষ খালাস পেয়েছি। এখন আমি মুক্ত আমার আর কোন অসুবিধা নেই। আমি আবার আমার গন্তব্য স্থান ঢাকায় চলিয়া যাইতেছি”।
এই বলিয়া সবার নিকট হইতে বিদায় নিলেন। তখন ও জানতামনা যে আমাদের মাঝে এতদিন এতবড় একজন দেশ প্রেমিক বড় নেতা ছিল এবং বিদায় নিচ্ছেন। যাবার সময় আবারও সবাইকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন “আমি তোমাদের সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়েছি মনে কোন কষ্ট বা দুখঃ নিওনা ” এই বলে সবার সাথে এক এক করে হাত মিলিয়ে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান জনাব আতাউর রহমান কাউছার সাহেব সহ সাম্পানে উঠিয়া পড়েন। ইসলাম মাঝির সাম্পানে উঠিয়া হাল ছাড়ার পর আবারও সবার উদ্দেশ্যে সাম্পানের উপর হতে হাত নেড়ে বিদায় জানান।
এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমি তখন ইলিশিয়া জমিলা বেগম হাই স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। কিছুদিন পর বাড়িতে এসে জানিতে পারিলাম যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বাংলাদেশে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে কক্সবাজার পরিদর্শনে আসেন। জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার কে নির্দেশ দেন আমি আত্মগোপন থাকা কালিন যারা আমার সেবা সাহায্য সহযোগিতা করেছিল তাহাদে সবাইকে কক্সবাজার রেষ্ট হাউজে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হউক। আমরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের নির্দেশ মত সবাই রেষ্ট হাউজে উপস্থিত হলাম। এবং এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইল। আমাদের সবাইকে মাইকের মাধ্যমে নাম ডেকে মঞ্চে উঠানো হইল।
১। আবুল কাশেম, ২। বশার ডাইভার, কক্সবাজার বন বিভাগ। ৩। রওশন আলী চৌধুরী (অনুপস্থিত) ৩। বোরুজ মেহের, বন প্রহরী (আমার চাচা) ৪। ওমর মিয়া, মুহুরী (আমার বাবা) ৫। সালেং প্র“ মার্মা ৬। অংসেং প্র“ মার্মা ৭। ছকিনা বেগম ৮। নূরুল হুদা ৯। ইসলাম মাঝি ১০। বন্দুক কাসেম ১১। মৌলভী নুরুজ্জামান (বার্মার)
আমরা সকলে এক এক করে মঞ্চে উঠলাম তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন তোমরা আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধা, বীরউত্তম বীর পুরুষ এরকম উপাধি দিলেও হবেনা। তোমরা আমার কাছে তার চেয়েও বড়, মাইকে বীর বাহাদুর ঘোষনা করে আমাদের সবাইকে। আমি আমার কঠিন সময়ে তোমাদের সহযোগিতা পেয়েছি যা আমি জীবনেও ভুলতে পারিবনা। আমাদের সবাইকে এক হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দিয়ে এক এক করে সবার কাছ থেকে জিজ্ঞেষ করেন তোমাদের কারো কোন সমস্যা আছে কিনা বল আমি তা পুরন করব, বল আমি তোমাদের কি সাহায্য করিতে পারি।
আবুল বশর, ড্রাইভার দাঁড়াইয়া বলিলেন হুজুর আমার কক্সবাজারে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকার কোন জায়গা নেই। আমাকে দয়া করিয়া কিছু জায়গা দিলে ভাল হয়। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলা প্রশাসক কক্সবাজারকে নির্দেশ দিলেন, সরকারী পরিতক্ত জায়গা কোথায় আছে দেখে আমার কাছে প্রতিবেদন দাখিল কর। বার্মার মৌলভী নুরুজ্জামান দাাঁড়িয়ে বলেন হুজুর আমার সৌদি আরব যাওয়ার ইচ্ছা, তখন জেলা প্রশাসক কে নির্দেশ দিলেন মৌলভী নুরুজ্জামানকে সৌদিআরব যাওয়ার ব্যবস্থা করে আমাকে অবহিত করবে। পরে অন্যান্য সবাইকে আশ্বাস দিলেন আপনাদের কোন সমস্যা হলে আপনাদের সূখে দুঃখে আমি সব সময় পাশে থাকব। এই বলে আমন্ত্রিত অতিথি আমাদের সবার সাথে হাত মিলিয়ে উক্ত সভা ও পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান শেষ করে আমাদের সবাইকে রেষ্ট হাউসে একসাথে খাওয়ার কথা বলে মঞ্চ ত্যাগ করেন। পরে আমরা সবাই রেষ্ট হাউসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে খাবার খাওয়ার পর সবাই বিদায় নিলাম।
কিছু দিন পর বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করার জন্য রাঙ্গামাটি গমন করেন। খবর পেয়ে আমি ও বাবা উমর আলী সহ বেতবুনিয়া যাই। সেখানে বন বিভাগের কর্মকর্তা জনাব রওশন আলী সাহেবের বাংলোতে এক রাত থেকে পরদিন জনাব রওশন আলী স্যার সহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করি এবং আমার বাবা বলেন হুজুর আমার ছেলে নুরুল হুদাকে যদি একটা সরকারী চাকুরী দেন ভাল হয়। তখন তিনি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জনাব রওশন আলী স্যারকে নির্দেশ দেন আমাকে যেন ফরেষ্ট গার্ড হিসাবে চাকুরী দেন। তার পরদিন আমাকে রাঙ্গামাটি দুধছড়ি রেঞ্জের অধীন কচুছড়ি বিটে ফরেষ্ট গার্ড় হিসাবে চাকুরী দেন । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মারা যাওয়ার পর আমার ম্যালেরিয়া রোগ হয়ে রাঙ্গামাটি সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হই এবং ডাক্তারের পরামর্শে বাড়ীতে এসে বিশ্রামে থাকি পরে রাঙ্গামাটি গিয়ে দেখি আমার চাকুরী চলে যায় এবং গ্রামে ও আমি রাজনীতি প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে পড়ি এবং গোপনে ড্রাইভারি শিখতে থাকি। পরে যখন জানিতে পারিলাম যে, বন বিভাগে ড্রাইভার পদে লোক নিয়োগ করিতেছে। অনেক খুজাখুজি করে জনাব রওসন আলী স্যারের সাথে ঢাকায় যোগাযোগ করি এবং উনার সুপারিশে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক জনাব আব্দুল বাতেন সাহেব আমাকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গাড়ী চালক পদে চাকুরী দেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে নিয়োজিত আছি। আমাদের সহ কর্মচারী জনাব আজিজুল হক আলম এর উৎসাহ ও সহযোগীতায় আমি আমার শৈশব লেখার আগ্রহ প্রকাশ করি।
লেখক : কবিয়াল নুরুল হুদা
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ কবিয়াল সমিত।
চাচা বোজুরুজ মেহের এক লাফে উঠে রেষ্ট হাউসের চাবি নিয়ে গাড়ির সামনে গেলেন, আমি ও পেছনে গিয়ে দেখলাম গাড়ী থেকে দুইজন ভদ্র সাহেব বের হয়ে আসলেন এবং অস্ত্র সহ আরও দুইজন ফরেষ্ট গার্ড। চাচা সালাম দেওয়ার পর ফরেষ্ট অফিসার বললেন, আমাদের ফরেষ্টের তদন্ত কাজের জন্য একজন অতিথি এসেছেন, উনি এখানে কয়েকদিন থাকবেন। অতিথি ভদ্র লোকটি তেমন কোন কথা বললেন না। চাচা তাড়াতাড়ি রেষ্ট হাউস খোলে দিয়ে অতিথিদের জন্য হালকা চা নাস্তার ব্যবস্থা করলেন। তখন রাত আনুমানিক ১২.০০-১.০০টা পর্যন্ত হবে। স্যার বলেন অতিথির দেখাশোনা করবে ও ওনার নির্দেশ মোতাবেক যা যা লাগে সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়ার কথা বলে অতিথির সাথে আর ও কিছুক্ষন সময় দিয়ে গাড়ী নিয়ে কক্সবাজার চলে গেলেন।
অতিথি রাত্রি যাপন করে পরদিন সকালের নাস্তা শেষে গোসলের জন্য গরম পানি দিতে বলেন। চা-নাস্তা, গরম পানি, পত্রিকা ও চিটিপত্র নিয়ে যাওয়া ছিল আমার কাজ। তখনো চিনতে পারিনি এই গভীর গোর গম্ভির লোকটি কে? সকালে গোসলের শেষে পরের দিনের পত্রিকা গুলো নিয়ে চোখ বোলাচ্ছেন এবং চাচাকে ডেকে বললেন এখানে বন পরিদর্শন করার মত কোন নৌকা আছে? চাচামিয়া বললেন একটা আছে স্যার তবে মেরামত করিতে হবে। স্যার বললেন তাড়াতাড়ি মেরামত করে নাও। দুইদিনের মধ্যে উপরে কাঠের ছাউনি দিয়ে খুব সুন্দর একটা নৌকা তৈরী হয়ে গেল। তারপর একরাতে বের হয়ে গেলেন অস্ত্র ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে ২টি অস্ত্র দুইজন ফরেষ্ট গার্ড সহ রেরিয়ে পড়েন গহীন জঙ্গলে গভীর রাত পর্যন্ত নিঝুম প্রকৃতির সাথে কিছু সময় জোৎস্না, আর কিছু সময় অন্ধকার বনের পশু পাখিদের ডাক আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দের সাথে মিশে নৌকার ভেতর সারারাত কাটান, আর কিছু সময় ঘুমান। সকালে আবার রেষ্ট হাউসে এসে গরম পানিতে গোসল ও নাস্তা করার পর পত্রিকার দিকে মনোযোগ দেন। প্রতিদিন অনেক গুলো পত্রিকা পাঠিয়ে দেওয়া হত কক্সবাজার থেকে, দৈনিক পত্রিকা গুলো আসতে আসতে তার পরের দিন এসে পৌছে। একদিন আমাকে অতিথি সাহেব একটি চিটি দিয়ে বলেন এই চিঠিটা ফরেষ্ট অফিসার রওশন আলী সাহেবের কাছে দিয়ে আস।
পরে আমি টেকনাফ থেকে কক্সবাজার বন কর্মকর্তার অফিসে গিয়ে উঠলাম, আমি ছোট বলে কেউ আমাকে স্যারের রুমে ঢুকার অনুমতি দেয়নি। দরজায় দেখলাম নেম প্লেটে লেখা রয়েছে রওশন আলী, তখন নিশ্চিৎ হলাম যে, এই রুমেই রওশন আলী স্যার আছেন। কিছুক্ষন ঘুরাঘুরি করার পর যখন দেখলাম কেউ নেই, তখন হঠাৎ করেই স্যারের রুমে ঢুকে গেলাম। স্যার প্রথমেই একটু বিস্ময় চোখে তাকালে এত ছোট ছেলে আমার রুমে ঢুকে পড়েছে, সালাম দিয়ে বললাম স্যার আমি টেকনাফ রেষ্ট হাউসের অতিথি স্যারের চিঠি নিয়ে আসছি। স্যার আতংকিত অবস্থায় চেয়ার থেকে উঠে এসে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং আমার হাত থেকে চিঠিটা নিয়ে পড়া শুরু করেন। পরে দরজা খোলে কলিং বেল দিয়ে পিয়ন ডেকে আমাকে আপ্যায়ন করার কথা বলেন এবং আমার কাছ থেকে জিজ্ঞেস করেন তুমি আজ রাত কোথায় থাকবে। তখন আমি বললাম আমার বাবা কক্সবাজার আদালতে মুহুরী এখানে আমাদের বাসা আছে। স্যার বলেন তাহলে তুমি কাল সকালে আমার সাথে দেখা করার পর টেকনাফ যাবে, পরে আমাকে দুপুরের ভাত খাওয়ান। ঐ দিন বাবার সাথে থেকে পরদিন স্যারের অফিসে গিয়ে দেখা করলাম, স্যার আমাকে বেশ কিছু পত্রিকা আর মোড়ানো একটা পেকেট দিলেন। আমি টেকনাফ রেষ্ট হাউসে গিয়ে অতিথির হাতে যখন পেকেট টাকা দিলাম, উনি খোলে দেখার পর একহাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলেন। পেকেটের ভেতর ছিল ক্যাপেষ্টেন সিগারেটের ছুগা এবং সেবন করার চোরট (কাল রংয়ের পাইপ)। আমি খুশি মনে বের হয়ে গেলাম, ভাবলাম এত বড় অফিসার আমাকে জড়িয়ে ধরলেন শুধু তাই নয় তিনি হিন্দু, মুসলিম, মামা যাকেই পান শুধু বুকে জড়িয়ে ধরতেন। সবার মনে ভাবনা হয় এমন অফিসারতো আর কোন দিন পাইনি।
একদিন পত্রিকা পড়ার পর খুব বিষন্ন অবস্থায় গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারপর চাচা বুজুরুজ মেহের (কালামিয়া) কে ডেকে বলেন এখানে বার্মার কোন লোক আছে? চাচা বললেন আছে স্যার আমাদের পরিচিত এক বার্মার হুজুর আছে উনি এখন কক্সবাজারে বাহারছড়া মসজিদের ইমামতি করেন ও আরবী পড়ান। স্যার বললেন তাড়াতাড়ি ওকে খবর দাও। তখন চাচা টেকনাফ টি এন্ড টি অফিস থেকে আমার বাবার কাছে টেলিফোন করে বলেন, ইমাম মৌলবী নুরুজ্জামান হুজুরকে অতিসত্ত্বর টেকনাফ ফরেষ্ট রেষ্ট হাউসে আসতে বলেন। তার পরদিন বাবা উমরমিয়া সহ হুজুর নুরুজ্জামান উপস্থিত। তখন বাবা চাচা হুজুর ও অতিথি সহ কিছুক্ষণ বৈঠক করেন, অতিথির বার্মার কোন গ্রাম দেখার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং নুরুজ্জামান হুজুরের বাড়ীতে থাকবেন। উক্ত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে, তারপর দিন মাগরিবের আযানের পর টেকনাফ থেকে বার্মা যাওয়ার ব্যবস্থা করা হউক।
অতিথির নির্দেশ মত পরের দিন সব মালামাল খাবার দাবার নিয়ে সবাই উপস্থিত। ঠিক মাগেিরবের নামাজের পর প্রথমে অতিথি নৌকায় উঠেন পরে আমার বাবা চাচা ও বার্মার হুজুর, মাঝি ২জন সহ পাল তোলা নৌকায় উঠে পড়েন।
তথন আমি আর কান্না থামাতে পারছিনা আমাকে ফেলে বাবা, চাচা চলে যাচ্ছে মনটা বড় খারাপ হয়ে আবেগকে ধরে রাখতে না পেরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। তখন বাবা নৌকা থেকে নেমে এসে আমাকে ধমক দেন আমাকে বাসায় চলে যেতে বলেন। অতিথি নৌকার ভেতর থেকে বড়গলায় বলেন ওকেও নৌকায় তুলে নাও। আমি খুশিতে আত্মহারা অতিথির বার্মা সফর সঙ্গী হিসেবে থাকতে পেরে আমার কান্না তখন বন্ধ হয়ে গেল। তারপর তাহাদের সাথে আমিও রওনা হলাম। পালতোলা নৌকা সাগরের মাঝখানে চলে গেছে প্রায়, পরে বড়খাল থেকে ছোট খালে হুজুর নুরুজ্জামানের দেখানো পথে চলতে লাগল।
সারা রাত বার্মার পুলিশের কঠিন পাহারার চোখ ফাঁকি দিয়ে সারারাত নৌকা চলছেই, ফজরের আযানের পরপরই পৌছে গেছি নুরুজ্জামার হুজুরের বাড়ী হাইদছুরাতা গ্রামে।,ভোরের পাখির ডাকে আমরা নৌকা থেকে পা নামালাম বার্মার মাটিতে, পরে নৌকা আমাদেরকে নামিয়ে দিয়ে আবার ফিরে যায় টেকনাফে। সামান্য কিছু পথ পায়ে হেটে নুরুজ্জামান হুজুরের বাড়ীতে পৌছে গরম জল দিয়ে গোসল করেন অতিথি। বিনি চালের ভাত দিয়ে সকালের নাস্তা করেন অতিথি ও আমারা সবাই। যতদিন বার্মায় ছিলাম ততদিন অতিথি ও সবার মন মানসিকতা খুব ভাল ছিল। হুজুরের বাড়ীতে আমরা চার দিন পর্যন্ত অবস্থান করি সেখানেও কিভাবে যে অতিথির জন্য বাংলা পত্রিকা পৌছে যেত কিছুই বোঝতে পারতাম না। বার্মার ঘরগুলো খুব সুন্দর মাটির তৈরী ও লোকজন প্রায় আমাদের দেশের মতো লাগে দেখতে এবং খুব অতিথি পরায়ন ও মিশুক প্রকৃতির। ভালই কেটেছে সেই দিন গুলো সবার মনে ছিল খুব আনন্দ। ৪-৫ দিন পর অতিথি আবার নৌকা আনার জন্য নির্দেশ দেন। চাচা টেকনাফ গিয়ে আবার মাঝি মাল্লা সহ সেই পালতোলা নৌকা নিয়ে হাজির। একদিন মাগরিব নামাজের পর আমরা সবাই মিলে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। আসার সময় অতিথি বলেন “ইহা আমার জীবন মরন তরী”। গভীর সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের সাথে পালতোলা নৌকা সারা রাত যুদ্ধ করে ফজরের আযানের আগে বাংলাদেশে পৌছি এবং টেকনাফ ফরেষ্ট রেষ্ট হাউসে আসি। আবার গরম পানিতে গোসল শেষে রেষ্ট হাউজে জমাকৃত পত্রিকায় চোখ ভোলান।
এমনি করে আরও দুইদিন কেটে গেল। রাত নয়টার দিকে ড্রাইভার আবুল বশর ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্টের গাড়ি নিয়ে এসে অতিথি ও আমাদের সহ ইনানী রেষ্ট হাউসে নিয়ে যায়। অতিথির জন্য সেলাই করা নতুন জামা ও নতুন লুঙ্গি পাঠিয়ে দেন জনাব রওশন আলী সাহেব। ইনানী ফরেষ্ট রেষ্ট হাউজে প্রায় ১০-১২ দিনের মত অবস্থান করে। আমিও তাহাদের সাথে থাকতে থাকতে আমার আর স্কুলে যাওয়া হচ্ছেনা। সেখানে অতিথির সেবা করা আর সাথে সাথে সব সময় কাছে থাকা হচ্ছে আমার ডিউটি, আর ছকিনা নামে এক মহিলা অতিথির জন্য রেষ্ট হাউজের রান্না-বান্না করতেন, কাপড় চোপড় ধুয়া ও অন্যান্য সব ধরনের কাজ ও অতিথির গরম জল দেওয়া আর মাঝে মাঝে চা বানানো ছিল ছকিনার প্রধান কাজ । অতিথি ডাবের পানি বেশি পছন্দ করতেন, অন্যান্য পানি কম খেতেন, বেশির ভাগ ডাবের পানিই খেতেন। অতিথি প্রতিদিন প্রায় স্থানীয় মার্মাদের সাথে তাদের ঘরে যাওয়া আসা করতেন। সালেং প্র“ ও অংছেং প্র“ নামে দুইজন মার্মা এসে অতিথিকে তাদের পাড়ায় নিয়ে যেত। সেখানে মাঝেমধ্যে তাদের বাড়ীতে দুপুরের খাবার ও খেয়ে আসতেন। তাদের সাথে এভাবে মিশে গেছিল যে ওদেরকেও বুকে জড়িয়ে ধরতেন এবং প্রায় দুই কিলোমিটার হেটে তাদের বাড়ীতে যেতেন। একদিন অতিথি চাচা বোজুরুজ মেহের কে বলেন রজু খালে একটা বড় সাম্পান আছে তার মাঝিকে খবর দাও। চাচা আমাকে ডেকে বলেন রজু খালের ভেতর যে সাম্পান দেখা যাবে সেই সাম্পানের মাঝিকে ডাক, নাম ইসলাম মাঝি এবং বন্দুক কাশেম ও শুক্কুর আলী নামে আরও দুইজন উপস্থিত ছিল। তখন অতিথি তাদের পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরেন এবং আনন্দ উৎসবের মধ্যে সবার জন্য ভাল খাবারের ব্যবস্থা করেন। আমার চাচাকেও তাহাদের পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক অতিথির সাথে সাথে থাকার জন্য টেকনাফ থেকে ইনানীতে বদলি করেন। তিনি ছিলেন সুঠাম দেহের অধিকারী এবং কুস্তি ও ক্যারাত খেলায় ছিল বাংলাদেশের সেরা। পরে চাচাকে বডি গার্ড হিসেবে সবসময় সাথে রাখতেন এবং ফরিদপুর থেকে কৃষ্ণা নামে এক হিন্দু মেয়েকে বিবাহ পড়িয়ে দেন বর্তমানে তার নাম মোস্তাফা খানম। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সময় তিনি ছিলেন গ্রামের বাড়ী ফরিদপুরে তখন হয়তো ঢাকায় থাকলে তিনিও মারা যেত।
আমি গ্রামের বাড়ী বাঁশখালীতে চলে আসি। চাচা যখন টেকনাফ থেকে বদলি হয়ে আসে ইনানিতে তখন আমাকে গ্রামের বাড়ী বাঁশখালীতে চলে আসতে হয়েছে। ১৯৬৮/এপ্রিল মাসের দিকে টৈইটং হাই স্কুলে ভর্তি হই। সেখানেও রীতিমত স্কুলে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন আমি স্কুল থেকে এসে দেখি কক্সবাজার হইতে আমার বাবা ও চাচা বোজুরুজ মেহের গ্রামের বাড়ীতে এসে তড়িঘড়ি করে ভাল রান্নাবান্নার আয়োজনের ব্যস্ত আছেন। আমাদের কাচারী ঘরে দেখি, অতিথি আমাদের ঘরে এসেছেন। দেখে আমার মনে খুব আনন্দ লাগল, এমন মহান মহানুবতার স্যার যার মনে কোন হিংসা বা গৌরব কোন কিছুই পাইনি। কি জানি যদি সেই বার্মার মত আবার কোথাও বেড়াতে যেতে পারি মনে অনেক ইচ্ছে জমা হতে শুরু করেছে। উনাকে কাছ থেকে আরও ভাল করে কাছে গিয়ে দেখতে শুরু করলাম। অতিথির কথা গুলি ছিল খুব মিষ্ট ভাষায় আর অনুকরন করার মত। ইসলাম মাঝি, বন্দুক কাসেম সহ আমাদের ঘরে রাতের খাওয়া দাওয়া করে অনেক রাত পর্যন্ত আলাপ আলোচনা করে রাতে ঘুমিয়ে পড়েন। পরদিন ভোর হল গ্রামের বাড়ীতে পুকুর দেখে অতিথি পুকুরে নেমে গোসল করেন মনের আনন্দে এবং বলেন “আজ অনেক দিন পর মনের তৃপ্তি মত গোসল করলাম”। অথচ উনি গরম জল ছাড়া একদিনও গোসল করেননি। গোসল শেষে সকালের নাস্তা করার পর বাবা আমাকে বলেন, এই পত্রটা মৌলভী সৈয়দের বাড়ীতে পৌছে দিয়ে আস। আমি সোজা পত্রটা নিয়ে তাহার বাড়ীতে গিয়ে দেখি উনি নেই পরে উনার ভাইকে দিয়ে আসলাম। বাড়ীতে এসে জনাব আতাউর রহমান কাউছার সাহেবকে দেখতে পেলাম। পরে সন্ধ্যা আবার আমাদের বাড়ীতে খাওয়া দাওয়া করার পর স্থান পরিবর্তন করেন। ঘনঘন স্থান পরিবর্তন করেন অতিথি সাহেব। পরদিন মৌলভী সৈয়দ ও আতাউর রহমান কাউছার সহ টৈটং ফরেষ্ট অফিসের সন্নিকটে আতাউর রহমান খানের বাংলোয় আসলাম। মাঝি সহ উপস্থিত থাকেন ঐ বাংলোত কিছুদিন অপেক্ষা করেন। সেখানে বুজুরুজ মেহের আমার চাচা কাসেম গার্ডকে নির্দেশ দেন আতাউর রহমান ভাই এর বাংলোতে একজন অফিসার আসিয়াছেন আপনি আপনাদের সরকারী বন্দুক নিয়ে উনার নিরাপত্তা দিবেন যেন কোন প্রকার অসুবিধা না হয়। ভাই হিসেবে এটা আমার অনুরোধ। পরে ওখানেও ৫/৬ দিন ছিলেন এবং মৌলভী সৈয়দ সাহেবের এর ব্যবস্থাপনায় সেখানে আতিতিয়তার ব্যবস্থা করা হয়। সব ষ্টাফরা অতিথির সুবিধা অসুবিধার দিক খেয়াল রাখেন এবং আঃ মজিদ নামে একজন বাংলো চৌকিদার ছিলেন সে অতিথির রান্না বান্না কাপড় চোপড় ধোয়াসহ সব ধরনের কাজ করতেন। বাংলোর পাশে একটা ছোট ঘরে থাকতেন।
পরে জানিতে পারি যে, অতিথি একদিন টৈটং থাকা অবস্থায় পত্রিকা পড়ে খুব খুশি মনে সবাইকে ডাকতে বললেন। জনাব আতাউর রহমান কাউছার সাহবে, ফরেষ্ট গার্ড বোজুরুজ মেহের, নূরুল হুদা, ওমর আলী, ইসলাম মাঝি, বন্দুক কাসেম, শুক্কুর আলী, মৌলভী হাসান শরিফ, জহুরুল আলম সওদাগর, কেরানী ছালে আহম্মদ, মাষ্টার মৌলভী সৈয়দ সবাই খুশি মনে আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে সেই মুহূর্তে অতিথি সবাইকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন এতদিন এত খাল নদী পাহাড় পাড়ি দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার পর অতিথি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন- “আমার নাম শেখ মুজিবুর রহমান, আমাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমার নামও মামলায় জড়িত করেন। তাই আমি মান সম্মানের কারনে আতাউর রহমান খান এর সহযোগিতায় হাতিয়া তমুরুদ্দিন বাজার হইতে বড় লবনের সাম্পানে করে কুতুবদিয়া চ্যানেল হয়ে রাজাখালীর ভোলা গ্রামে আতাউর এর বাংলোয় উঠি তারপর এই জেলার বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করিয়া থাকি। বর্তমানে আমি মামলা হইতে নির্দোষ খালাস পেয়েছি। এখন আমি মুক্ত আমার আর কোন অসুবিধা নেই। আমি আবার আমার গন্তব্য স্থান ঢাকায় চলিয়া যাইতেছি”।
এই বলিয়া সবার নিকট হইতে বিদায় নিলেন। তখন ও জানতামনা যে আমাদের মাঝে এতদিন এতবড় একজন দেশ প্রেমিক বড় নেতা ছিল এবং বিদায় নিচ্ছেন। যাবার সময় আবারও সবাইকে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন “আমি তোমাদের সবাইকে অনেক কষ্ট দিয়েছি মনে কোন কষ্ট বা দুখঃ নিওনা ” এই বলে সবার সাথে এক এক করে হাত মিলিয়ে জনাব শেখ মুজিবুর রহমান জনাব আতাউর রহমান কাউছার সাহেব সহ সাম্পানে উঠিয়া পড়েন। ইসলাম মাঝির সাম্পানে উঠিয়া হাল ছাড়ার পর আবারও সবার উদ্দেশ্যে সাম্পানের উপর হতে হাত নেড়ে বিদায় জানান।
এরপর দেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আমি তখন ইলিশিয়া জমিলা বেগম হাই স্কুলে ৮ম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। কিছুদিন পর বাড়িতে এসে জানিতে পারিলাম যে, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বাংলাদেশে দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথমে কক্সবাজার পরিদর্শনে আসেন। জেলা প্রশাসক, কক্সবাজার কে নির্দেশ দেন আমি আত্মগোপন থাকা কালিন যারা আমার সেবা সাহায্য সহযোগিতা করেছিল তাহাদে সবাইকে কক্সবাজার রেষ্ট হাউজে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হউক। আমরা কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের নির্দেশ মত সবাই রেষ্ট হাউজে উপস্থিত হলাম। এবং এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হইল। আমাদের সবাইকে মাইকের মাধ্যমে নাম ডেকে মঞ্চে উঠানো হইল।
১। আবুল কাশেম, ২। বশার ডাইভার, কক্সবাজার বন বিভাগ। ৩। রওশন আলী চৌধুরী (অনুপস্থিত) ৩। বোরুজ মেহের, বন প্রহরী (আমার চাচা) ৪। ওমর মিয়া, মুহুরী (আমার বাবা) ৫। সালেং প্র“ মার্মা ৬। অংসেং প্র“ মার্মা ৭। ছকিনা বেগম ৮। নূরুল হুদা ৯। ইসলাম মাঝি ১০। বন্দুক কাসেম ১১। মৌলভী নুরুজ্জামান (বার্মার)
আমরা সকলে এক এক করে মঞ্চে উঠলাম তারপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন তোমরা আমার কাছে মুক্তিযুদ্ধা, বীরউত্তম বীর পুরুষ এরকম উপাধি দিলেও হবেনা। তোমরা আমার কাছে তার চেয়েও বড়, মাইকে বীর বাহাদুর ঘোষনা করে আমাদের সবাইকে। আমি আমার কঠিন সময়ে তোমাদের সহযোগিতা পেয়েছি যা আমি জীবনেও ভুলতে পারিবনা। আমাদের সবাইকে এক হাজার টাকা করে সম্মানী ভাতা দিয়ে এক এক করে সবার কাছ থেকে জিজ্ঞেষ করেন তোমাদের কারো কোন সমস্যা আছে কিনা বল আমি তা পুরন করব, বল আমি তোমাদের কি সাহায্য করিতে পারি।
আবুল বশর, ড্রাইভার দাঁড়াইয়া বলিলেন হুজুর আমার কক্সবাজারে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকার কোন জায়গা নেই। আমাকে দয়া করিয়া কিছু জায়গা দিলে ভাল হয়। তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলা প্রশাসক কক্সবাজারকে নির্দেশ দিলেন, সরকারী পরিতক্ত জায়গা কোথায় আছে দেখে আমার কাছে প্রতিবেদন দাখিল কর। বার্মার মৌলভী নুরুজ্জামান দাাঁড়িয়ে বলেন হুজুর আমার সৌদি আরব যাওয়ার ইচ্ছা, তখন জেলা প্রশাসক কে নির্দেশ দিলেন মৌলভী নুরুজ্জামানকে সৌদিআরব যাওয়ার ব্যবস্থা করে আমাকে অবহিত করবে। পরে অন্যান্য সবাইকে আশ্বাস দিলেন আপনাদের কোন সমস্যা হলে আপনাদের সূখে দুঃখে আমি সব সময় পাশে থাকব। এই বলে আমন্ত্রিত অতিথি আমাদের সবার সাথে হাত মিলিয়ে উক্ত সভা ও পুরস্কার বিতরনী অনুষ্ঠান শেষ করে আমাদের সবাইকে রেষ্ট হাউসে একসাথে খাওয়ার কথা বলে মঞ্চ ত্যাগ করেন। পরে আমরা সবাই রেষ্ট হাউসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে খাবার খাওয়ার পর সবাই বিদায় নিলাম।
কিছু দিন পর বেতবুনিয়া ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র উদ্বোধন করার জন্য রাঙ্গামাটি গমন করেন। খবর পেয়ে আমি ও বাবা উমর আলী সহ বেতবুনিয়া যাই। সেখানে বন বিভাগের কর্মকর্তা জনাব রওশন আলী সাহেবের বাংলোতে এক রাত থেকে পরদিন জনাব রওশন আলী স্যার সহ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সাথে যোগাযোগ করি এবং আমার বাবা বলেন হুজুর আমার ছেলে নুরুল হুদাকে যদি একটা সরকারী চাকুরী দেন ভাল হয়। তখন তিনি বিভাগীয় বন কর্মকর্তা জনাব রওশন আলী স্যারকে নির্দেশ দেন আমাকে যেন ফরেষ্ট গার্ড হিসাবে চাকুরী দেন। তার পরদিন আমাকে রাঙ্গামাটি দুধছড়ি রেঞ্জের অধীন কচুছড়ি বিটে ফরেষ্ট গার্ড় হিসাবে চাকুরী দেন । জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মারা যাওয়ার পর আমার ম্যালেরিয়া রোগ হয়ে রাঙ্গামাটি সরকারী হাসপাতালে ভর্তি হই এবং ডাক্তারের পরামর্শে বাড়ীতে এসে বিশ্রামে থাকি পরে রাঙ্গামাটি গিয়ে দেখি আমার চাকুরী চলে যায় এবং গ্রামে ও আমি রাজনীতি প্রতিহিংসার শিকার হয়ে বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে পড়ি এবং গোপনে ড্রাইভারি শিখতে থাকি। পরে যখন জানিতে পারিলাম যে, বন বিভাগে ড্রাইভার পদে লোক নিয়োগ করিতেছে। অনেক খুজাখুজি করে জনাব রওসন আলী স্যারের সাথে ঢাকায় যোগাযোগ করি এবং উনার সুপারিশে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক জনাব আব্দুল বাতেন সাহেব আমাকে চট্টগ্রাম অঞ্চলে গাড়ী চালক পদে চাকুরী দেন। বর্তমানে চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগে নিয়োজিত আছি। আমাদের সহ কর্মচারী জনাব আজিজুল হক আলম এর উৎসাহ ও সহযোগীতায় আমি আমার শৈশব লেখার আগ্রহ প্রকাশ করি।
লেখক : কবিয়াল নুরুল হুদা
সাধারণ সম্পাদক
বাংলাদেশ কবিয়াল সমিত।
No comments