সহজিয়া কড়চা- হাতির দাঁত ও বাংলাদেশ by সৈয়দ আবুল মকসুদ
হাতি যে দাঁতগুলো দিয়ে খায়, সেগুলো আমরা
দেখতে পাই না। যে দাঁত দুটি আমরা দেখি, ও-দুটি তার শোভাবর্ধনকারী দাঁত।
শুঁড়ে ঢাকা ভেতরের দাঁতগুলো অতি ধারালো ও তীক্ষ। তা ছাড়া হাতিরও মাহুত
থাকে। সেই হস্তীচালক যেভাবে নির্দেশ দেয়, হাতি সেভাবেই চলে। কারণ, তারও
পুরোপুরি স্বাধীনতা নেই যা খুশি করার।
প্রকাশ্যে কথা বলার সময় আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের মুখে যে হাসিটি দেখা যায়, সেটি তাঁর শোভা মাত্র। আন্তর্জাতিক কূটনীতিকদের অনেক কিছুই হয় অপ্রকাশ্যে। বাইরে থেকে আমরা যেটুকু দেখি তা তার অংশ মাত্র। জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূতের যে নির্বিশেষ তৎপরতা আমরা বাইরে থেকে দেখেছি মিডিয়ার মাধ্যমে, তা তাঁর কর্মসূচির অংশ মাত্র। বেশির ভাগই শুধু তিনি নিজে জানেন। তাঁর ধর্মপত্নীও নন, গার্লফ্রেন্ডও নন আর জানেন তাঁর অন্তর্যামী। পুরোটা জানেন তাঁর মাহুতরা। জাতিসংঘের মহাসচিবের পেছনে থাকা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্তারা।
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর মিশনের মূল সুর সম্পর্কে মোটামুটি জানেন বাংলাদেশের দুই বিবদমান পক্ষের দুই শীর্ষ নেতা। পল্লিবন্ধু কতটা জানেন, তা আমরা বলতে পারব না। দুই পক্ষের যে নেতাদের তিনি পিঠে হাত বুলিয়ে (তাঁদের নেত্রীদের অনুমতি নিয়ে) বৈঠকে বসিয়েছিলেন, তাঁরাও তাঁর মিশনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে কতটা জানেন, তাতে আমার ঘোর সন্দেহ রয়েছে। তাঁরা নাটকের পার্শ্বচরিত্র মাত্র। প্রধান চরিত্র হয়ে বড় ভূমিকা পালনের সুযোগ তাঁদের দেওয়া হয় না। বরং পরলোকগত আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আব্দুল জলিলের যে নিয়তি, তাঁদের উত্তরসূরিদের নিয়তি তার চেয়ে এক পোয়া পরিমাণ কম।
আমরা বরং খুশি হয়েছি এ কারণে যে বাংলাদেশের ঝগড়াটেরা তারানকোর অন্তিম ইচ্ছা পূরণ করার সুযোগটা করে দিয়েছেন। তাঁতের মাকুর মতো কয়েক দিন ছোটাছুটি করে তিনি যদি হোটেল থেকে সোজা প্লেনে গিয়ে উঠতেন, তা হতো তাঁর জীবনের বড় ব্যর্থতা শুধু নয়, অপমানও। তিনি যে দুই পক্ষকে বসানোর ব্যবস্থাটা করলেন, তাতে তাঁর কৃত্রিম সাফল্যের দৃষ্টান্ত স্থাপিত হলো। তাঁর মুখেও ফুটে উঠল হাসি। ওই হাসিটা ১৬ কোটি মানুষের উপভোগ করার প্রয়োজন ছিল।
কী সুন্দর সাফল্য! অমন সাফল্য বাংলার মানুষের চৌদ্দপুরুষ দেখেনি। তাঁর দূতিয়ালির পক্ষগুলোর মধ্যে ছিল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও জামায়াতে ইসলামী। এই চার পক্ষের কারও সঙ্গেই ভাব নেই তেমন কয়েকজন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধির কথাও তিনি শোনেন।
তাঁর যাওয়ার সময় যখন ঘনিয়ে এল, তখন দুই পক্ষের হাত দুটি ধরে তিনি বললেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র বাঁচানোর দায়িত্ব বিধাতা আমাকে দেননি, চাকরি রক্ষার্থে আমি এখানে এসেছি, আর্জেন্টিনায় অন্য চাকরি করলে আমি এখানে কস্মিনকালেও আসতাম না, তোমরা আমাকে বাঁচাও। শারীরিকভাবে নয়, বেইজ্জতির হাত থেকে বাঁচাও। বাঁচানোর উপায়টা কী? উপায় হলো, কোনোরকমে তোমরা বসো। তোমাদের টিভির দর্শকেরা দেখুক আর আমার বস বান সাহেবও জানুন।
তাঁর অনুরোধকে অসম্মান করা হয়নি। তাঁর মিশনে সফলতা এল। দুই নেতাকে হ্যান্ডশেক করাতে দুটি হাতের দরকার। হাত একটি ছিল প্রকাশ্যে আরেকটি ছিল আত্মগোপনে। আত্মগোপনের হাতটি তিনি বাইরে আনতে পারলেন। সেটা কম সফলতা নয়। কিন্তু তাঁরা মোলাকাতও করলেন, ওদিকে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের জোর আয়োজনও চলল, রাজপথে যানবাহনে জ্বলতে থাকল আগুন, রেললাইন হলো উৎপাটিত, গাছের গুঁড়ি দিয়ে অবরোধ করা হলো মহাসড়ক, কীটপতঙ্গের মতো মরতে লাগল মানুষ। নির্বাচন কমিশনের সঙ্গেও তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি চলে যাওয়ার ১৫০ ঘণ্টার মধ্যেই ১৫১ জন (পরে আরও তিনজন) বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ নির্বাচিত হলেন। পৃথিবীর বহু দেশের পার্লামেন্টের সদস্যসংখ্যাও ১৫১ নয়। মহাসচিবের মহাদূতের এক বিরাট সাফল্য!
আমরা অনেকে ধরে নিয়েছি জাতিসংঘের দূত এসেছিলেন আমাদের স্বার্থে। আমাদের গণতন্ত্রকে বাঁচাতে। দুই পক্ষের মান-অভিমান ভাঙাতে। আসলে তা নয়। বিষয়টা দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট। জাতিসংঘ কোনো অতিজাগতিক পরাশক্তিনিরপেক্ষ বিশ্ব সংস্থা নয়। তার হেডকোয়ার্টার্সটাই আমেরিকার মাটিতে। ম্যানহাটন দ্বীপে। একমাত্র পরাশক্তি হিসেবে আমেরিকার কথা যতটা সম্ভব তাকে মানতে হয়। রয়েছে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্যদেশগুলো। তাদেরও অগ্রাহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারানকো ঢাকায় এসে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। চীন ও ভারতের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারকে উপেক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
জাতিসংঘের অর্থনৈতিক স্বার্থেও প্রয়োজন রয়েছে বাংলাদেশের। তার শান্তি মিশনে আমাদের সেনাবাহিনী ও পুলিশের সদস্যরা রয়েছেন। তাতে তাদেরও উপকার, আমাদেরও উপকার। আমরা বৈদেশিক মুদ্রা রোজগার করছি। পিস মিশন ছাড়া রয়েছে বাংলাদেশে জাতিসংঘের এজেন্সিগুলোর বহু প্রজেক্ট। তাতে বহু টাকা বিনিয়োগ তাদের। বাংলাদেশে গোলযোগ থাকলে সেই সব প্রকল্পের কাজ বিঘ্নিত হবে। ক্ষতি হবে ওই বিশ্ব সংস্থার। জাতিসংঘের শক্তিশালী সদস্যদেশগুলোরও ঋণ-অনুদানের অসংখ্য প্রকল্প রয়েছে বাংলাদেশে। তাদের স্বার্থও তাকে রক্ষা করতে হয়। সুতরাং বান কি মুন শান্তিশৃঙ্খলা চান বাংলাদেশের স্বার্থেও, তাঁদের স্বার্থেও।
আমাদের সরকারি দলের নেতাদের কথাবার্তা শুনে মনে হয় তাঁরা রোমান সম্রাটদের মতো সর্বশক্তিমান। চেঙ্গিস খাঁর মতো তাঁরা কাউকে পরোয়া করেন না। বিদেশিরা কে কী বলল, তা তাঁরা থোড়াই কেয়ার করেন। ধমক মারেন। প্রবুদ্ধ নেতাদের বলতে চাই, এই দুনিয়ায় একা চলা যায় না। রোমান সম্রাট ও চেঙ্গিস খাঁর জামানা নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংশ্লিষ্টতা আজকের দুনিয়ার কোনো রাষ্ট্রের পক্ষেই সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। তা যত বড় শক্তির অধিকারীই হোক।
নেতাদের কথা শুনে মনে হয়, তাঁদের মতো বীর দুনিয়ায় আর দুখানা নেই। তাঁদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগ বাড়িয়ে আমাদের সহায়তায় এগিয়ে না এলে, পাকিস্তানের বিপক্ষে না দাঁড়ালে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিলম্বিত হতো। কতটা বিলম্বিত ও বিঘ্নিত হতো তা ৪২ বছরের কম বয়সী বীরেরা ধারণাও করতে পারবেন না। সে জন্যই মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা দেওয়া বিদেশি বন্ধুদের আমরা সম্মাননা দিচ্ছি। সুতরাং বিদেশিদের মতামত তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দেওয়া অদূরদর্শিতা ও মূর্খতার নামান্তর। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ বরদাশত না করার মধ্যে সাহসের পরিচয় রয়েছে।
নির্বাচন নিয়ে বাংলাদেশে অচলাবস্থা, তা থেকে সাম্প্রতিক সহিংসতা ও নাশকতা, কাদের মোল্লার ফাঁসির আগে-পরে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডব প্রভৃতি নিয়ে বিদেশিদের উদ্বেগ প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। তাকে উপেক্ষা করা বা উড়িয়ে দেওয়া ঠিক নয়। বর্তমানে সংবিধানের দোহাই দিয়ে নির্বাচনের নামে যা হচ্ছে, স্বাধীন নির্বাচন কমিশনই তা করছে, তার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত বিশ্বের ইতিহাসে নেই। প্রধান দলগুলোর অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু নির্বাচনই জনগণের প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশাকে মূল্য না দিয়ে অন্য কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন দেশে ও সমাজে শান্তি আনবে না। ছোট দেশ। মানুষ বেশি। হানাহানি লেগেই থাকবে। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সাধারণ মানুষ। সব দলমতের মানুষ। বিশেষ করে সমাজের দুর্বলতর অংশ, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু।
মহাসচিবের দূতের সফরের ব্যর্থতা ও সফলতা নিয়ে যাঁরা মাথা ঘামাচ্ছেন, তাঁদের উচিত তাঁর সফরের কেন প্রয়োজন হলো সেই কারণগুলো খতিয়ে দেখা ও বিশ্লেষণ করা। তিনি যে হাসি হেসে গেছেন, তা হাতির শোভন দুই দাঁত। যে দাঁত দিয়ে হাতি খায় সে দাঁত তীক্ষ ও ধারালো। সেই দাঁতের নিচে আমরা পড়তে চাই না। ৪২ বছরে এবারই প্রথম বিজয় দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাননি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতেরা। সরকারি কর্মকর্তারা একে যতই কূটনৈতিক শিষ্টাচার লঙ্ঘন বলে উড়িয়ে দিন না কেন, আমার ভালো ঠেকেনি। অপমানিত বোধ করছি।
গত পাঁচ হাজার বছরে হঠকারিতা করে পৃথিবীর কোনো দেশেই কেউ উপকৃত হয়নি। হঠকারিতা যে করে এবং যাদের বিরুদ্ধে করে, কেউই লাভবান হয় না। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনগণ। ঢাকায় নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষ নন। তিনি দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর, বিশেষ করে বাংলাদেশের ও পাকিস্তানের রাজনীতির নাড়িনক্ষত্র খুব ভালো জানেন। তিনি একজন বিচক্ষণ কূটনীতিক। তিনি একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষকও।
এক লেখায় কয়েক দিন আগে মাইলাম বলেছেন, ‘দেশটির প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকারগ্রস্ততার কারণে, (বাংলাদেশ) এমন একটি অবস্থায় রয়েছে, যা বিরোধী দলকে বলপূর্বক দমন করে একটি একদলীয় ব্যবস্থার দিকে এগোচ্ছে। এই নির্বাচন আগে যা কিছু হয়েছে তার পরিবর্তে, উপমহাদেশে সম্পূর্ণ নতুন কিছুর ইঙ্গিত নিয়ে আসতে পারে।’ সরকার বলবে, এক দল কোথায়? তরীকত, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাপার ভগ্নাংশ তো আমাদের সঙ্গেই আছে। একদলীয় শব্দটা ‘অসত্য ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। মাইলাম কথিত ‘সম্পূর্ণ নতুন কিছুর ইঙ্গিত’ কথাটির নানা রকম অর্থ করা সম্ভব।
একটি ভালো সরকারের দায়িত্ব হলো দেশের ভেতরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও বাইরে কূটনৈতিক দক্ষতা প্রদর্শন করা। বিদেশিদের কোনো ধরনের উদ্বেগকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের বন্ধু ও উন্নয়নের সহযোগী ভারত, চীন, জাপান, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্কের ওপরই আমাদের আর্থসামাজিক উন্নতি নির্ভরশীল। তাই এই মুহূর্তে জাতীয় নেতৃত্বের কাছে জনগণ আশা করে গভীর সংযম ও দূরদৃষ্টি।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক।
No comments