সমঝোতা চাইলে ফোনগেট বাধা নয়

ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারিতে নিক্সন বিদায় নিয়েছিলেন। স্কাইপগেটে একজন বিচারপতি সরে দাঁড়িয়েছিলেন। দুই নেত্রী অবশ্য রীতিমতো দেশবাসীকে জানান দিয়ে ফোনালাপ করেছিলেন। এটি ফাঁস করে দেওয়ার আইনি ও নৈতিকতার প্রশ্ন কম জোরালো নয়। কিন্তু এটা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও এডওয়ার্ড স্নোডেনদের নায়কোচিত মর্যাদালাভের যুগ। এটা ওপেন গভর্নমেন্টের যুগ। দুই নেত্রী জানতেন, তাঁরা গোপনীয় আলোচনায় যোগ দেননি। তাঁদের একান্ত কথায় এমন কিছুই আমরা পাইনি, যা তাঁরা নতুন বলেছেন। তাদের কাজিয়ার বিষয়, ভাষা, ভঙ্গি, রুচি—সবই আমাদের অতি চেনা। তাহলে এটা আমাদের লজ্জায় ফেলেছে মানায় না। এসব তাঁরা করেন, করে আসছেন এবং করে চলবেন। এর পরও তাঁদেরই আমরা প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধী দলের নেতা করব। নাগরিক সমাজ সংলাপের সাংস্কৃতিক মান নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেনি। সর্বোচ্চ পর্যায়ে এ রকম আনুষ্ঠানিক ঝগড়াঝাঁটির বিষয়বস্তুই যে অসুখকর, গণতন্ত্রের জন্য ভয়ংকর, তার স্বীকৃতি মেলেনি। তার চেয়ে পত্রিকায় বড় শিরোনাম হয়েছে আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ। এখানেও সেই দুই নেত্রীর সুবিধা-অসুবিধার চশমায় আমাদের বিষয়টি দেখতে, স্পর্শকাতরতার তল মাপতে বাধ্য করা হচ্ছে। কেউ বলছেন, যারা এটা প্রকাশ করেছে, তারা গণতন্ত্রের জন্য ভয়ংকর কিছু করেছে। তাদের নাকচ করব না। এখন পর্যন্ত একটা মিথ্যাচার চলছে যে মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দীনকে ‘যারা’ ডেকেছে তারা রাজনীতিক নয়
 তারা ‘সুশীল সমাজ’। রাজনীতির দীনতা নয়, দায়ী ওই কুচক্রী সুশীল সমাজ। ভবিষ্যতে হয়তো শুনতে হবে, এই কুচক্রী সমাজই ভুল বুঝিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করিয়েছিল! টেপ ছাপিয়ে ‘দণ্ডনীয় ও জামিন-অযোগ্য অপরাধ’ করে এরাই দুই নেত্রীর মধ্যে কৃত্রিম দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। অথচ তিন দিনে ১৩/১৪টি লাশ মিলেছে। মানুষ আতঙ্কিত। সামনে যত বেশি কর্মসূচি তত বেশি লাশ। কত লাশের বিনিময়ে ‘সংবিধান অনুযায়ী’ নির্বাচন হবে? না, এ যে ‘শিশু গণতন্ত্র’। সে চিৎকার করে কাঁদছে। কিন্তু সে মুখে ফিডার দিতে মা-খালাদের খবর নেই। স্কাইপগেট জামায়াতের যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে বিএনপিকে প্রচারণার সুবিধা দিয়েছিল। সেটা একান্ত গোপনীয় বিষয় হলেও তার বিষয়বস্তু বিচারে জনস্বার্থে তার প্রকাশ সমর্থন করেছিলাম। ক্ষমতাসীনদের জন্য তা বিব্রতকর হলেও তা তারা তদন্ত করেনি। গণমাধ্যমে ফোনগেট যখন আংশিক ছাপা হলো, তখন বিএনপিকে ক্ষুব্ধ হতে দেখা যায়নি। পরে স্কাইপগেটকে দণ্ডনীয় বর্ণনাকারীরা বলেছেন, ‘এটা রাষ্ট্রীয় সংলাপ। এটা প্রকাশিত হওয়া উচিত।’ সরকার না করলে কারা ফাঁস করল, তার তদন্ত হবে না। সংবিধানের ৪৩ অনুচ্ছেদমতে, ফোনগেট বিচার্য। এটা বলেছে, ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা,
জনশৃঙ্খলা, জনসাধারণের নৈতিকতা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের চিঠিপত্রের, যোগাযোগের অন্যান্য উপায়ের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকার থাকবে।’ আমার প্রথম কথা হলো, দুই নেত্রী মুঠোফোনে যে ভাবভঙ্গি প্রকাশ করেছেন, তা ৩৯(২) অনুচ্ছেদের চেতনাকে আঘাত করেছে। দেশের যে পরিস্থিতিতে যে ভাব তাঁরা প্রকাশ করেছেন, সেটা করে তাঁরা সংবিধানের ব্যত্যয় ঘটিয়েছেন। সংবিধান তাঁদের এটা করার অনুমতি দেয়নি। কারণ, তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু ‘জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতা’সম্পন্ন বলে প্রতীয়মান হয় না। এই যোগ্যতা নিয়েই তাঁরা ‘আমি একবার অপজিশনে, আপনি একবার অপজিশনে, আমি একবার সরকারে এবং আপনি আরেকবার সরকারে’ যাচ্ছেন। তাঁদের একমাত্র আতঙ্ক—এই পালাবদল হাতছাড়া না হয়। সুতরাং ফোনগেট প্রচারের বৈধতা খুঁজতে গেলে শিকড়সুদ্ধ টান পড়বে। তাই বিএনপি আর যা-ই করুক, আইনের বরখেলাপের অভিযোগ বা এর কোনো তদন্ত নিয়ে বাড়াবাড়ি করবে না। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতে নাগরিকের গোপনীয়তার শিষ্টাচার কি চালু করেছিল? মুঠোফোনে আড়ি পাতা নিয়ে দেশে অব্যাহতভাবে সংবিধানের লঙ্ঘন চলছে। কিন্তু তা নিয়ে আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে পেরেশান হতে দেখিনি। ‘জায়গার অভাবে’ প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই ভবনে ‘অস্থায়ীভাবে’ স্থাপিত হয়েছিল আড়ি পাতা যন্ত্র। এর নিয়ন্ত্রণ আইনমতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।
কিন্তু চেষ্টা করেও এর নিয়ন্ত্রণ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী আজ পর্যন্ত নিতে পারেননি বলেই জানি। ২০১০ সালের এপ্রিলে কথিতমতে ক্ষমতাসীন দলের কয়েকজন নেতার মুঠোফোনে গোয়েন্দা সংস্থার দ্বারা আড়ি পাতার ঘটনা ফাঁস হলে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে হইচই পড়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার তদন্ত হয়নি। প্রায় পাঁচ হাজার মুঠোফোনে আড়ি পাতার ক্ষমতা ১৯ হাজারে উন্নীত করার সার্মথ্য বৃদ্ধি ঘটেছে কি না, জানি না। মার্কিন সিনেটের ইন্টেলিজেন্স কমিটির চেয়ারম্যান ডায়ান ফিনস্টিন ২৯ অক্টোবর আঙ্গেলা ম্যার্কেলদের দিকে তাকিয়ে বলেছেন, বন্ধু দেশের নেতাদের মুঠোফোনে আড়ি পাতা ভুল ছিল। আমাদের দুই নেত্রী গোয়েন্দাদের ওপর নজরদারি করতে কোনো কমিটি করেননি। নাগরিকের অনুকূলে আড়ি পাতা-সংক্রান্ত বিধিব্যবস্থা নিশ্চিত না করতে উভয়ের মধ্যে কোনো কাজিয়া নেই। দুই নেত্রীর বহুল আলোচিত ফোনগেট সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া মিশ্র। মির্জা ফখরুলের কথায়, ‘টেপ ফাঁস উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। যাতে সংলাপের পরিবেশ সৃষ্টি না হয়, সংলাপ যাতে না হয়, এ জন্য সরকার নাটক তৈরি করেছে।’ কিন্তু নাটক বিএনপি কি কিছু কম করেছে? শেখ হাসিনা তো যথার্থই বলেছিলেন, ‘আপনার আলটিমেটাম মেনেই আমি ফোন করলাম। এখন তাহলে হরতাল থেকে সরবেন না কেন?’ ১৮-দলীয় জোট নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করার শর্ত তিনি জনসভায় দেননি। ৩২ মিনিট কথা বলার মাথায় বরং খালেদা জিয়া নতুন শর্ত দেন। বলেন, ‘আপনি নির্দলীয় সরকার মেনে নিন। তাহলে আমি এখনই হরতাল প্রত্যাহার করব।’ টেলিফোন আলাপচারিতায় প্রথমই শেখ হাসিনা যখন বললেন, আপনি কেমন আছেন?
তার উত্তরে খালেদা জিয়া আমি ভালো আছি বলার পর বাঙালির সৌজন্য অনুযায়ী আপনি কেমন আছেন কথাটিও তিনি বলতে পারেননি। ৩৭ মিনিটের আলোচনায় পাঁচ মিনিটের কম মূল সংলাপের বিষয় ঠাঁই পেয়েছে। বিকল লাল টেলিফোন ও কেক কাটার মতো পুরোনো কাসুন্দি নিয়ে বাদানুবাদের সময় তাঁদের গলায় জোর ছিল। দুই নেত্রীর কেউই নির্বাচনকালীন সরকারের ফয়সালায় মনোযোগী ছিলেন না। এটা এসেছে বাত কি বাত। অনেক প্রসঙ্গ এসেছে যখন লাইন কেটে যেতে পারত। যেমন ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা আপনারা করিয়েছেন’। আমার একবারের জন্যও মনে হয়নি তাঁরা কেউ কাউকে নির্বাচন বিষয়ে আশ্বস্ত করতে প্রস্তুত ছিলেন। শেখ হাসিনা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন হরতাল প্রত্যাহার করাতে। সংলাপ নিয়ে তাঁর মাথাব্যথা প্রকাশ পায়নি। প্রধানমন্ত্রী এমনকি খালেদা জিয়াকে আহত করেন এই বলে যে, গণভবনে তিনি অন্যান্য দলকেও দাওয়াত দিয়েছেন। সে কারণেই প্রধানমন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেতাকে দাওয়াত দিচ্ছেন। নিজের উদারতা তুলে ধরতে তিনি জানান, সংসদে তাঁর দলের ৯০ শতাংশ আসন সত্ত্বেও সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। অথচ তাঁর স্মরণ রাখা উচিত ছিল, বিএনপি কখনো ৩৩ শতাংশের নিচে ভোট পায়নি। অন্যদিকে, ‘গ্রেনেড হামলা আপনারা করেছেন’—খালেদা জিয়া শেখ হাসিনার মুখের ওপর এতটা জোর দিয়ে বললেন কিসের জোরে? কিছুদিন আগে মির্জা ফখরুল আমাকে বললেন, ওই হামলার বিচার-প্রক্রিয়া নিয়ে বিএনপি সরকার ভুল করেছিল। তিনি এ জন্য অনুশোচনাও করলেন। তবে তিক্ততা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘দয়া করে হরতাল প্রত্যাহার করুন।’
আবার খালেদা জিয়াও ‘দুঃখিত’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। খালেদা জিয়া স্মরণ করেছেন যে ‘আমরা অনেক কথা বলেছি, এরশাদবিরোধী আন্দোলনে একসঙ্গে কাজ করেছি, আপনার বাসায় বহুবার গিয়েছি। আপনি এসেছেন। এখনো আলোচনা করতে চাই। আবার শেখ হাসিনা পরে বলেছেন, আপনি কখনো অপজিশনে, কখনো আমি। কখনো আমি সরকারে, কখনো আপনি সরকারে। আমরা যা করব, পার্লামেন্টে করব। খালেদা জিয়া তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন, আপনার সভার সময় চলে যাচ্ছে। টেলিফোনে সব বলা যায় না। আমার একটা নতুন অনুভূতি হলো, শেখ হাসিনার সর্বদলীয় সরকারের যুক্তি হলো মাইনাস টু ভীতি। তিনি খালেদাকে একবারও বলেননি তাঁর আমলের সুষ্ঠু সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কথা। ‘যারা মাইনাস টু করতে চেয়েছিল তাদেরকে আপনি সুযোগ দিতে চান কেন?’ খালেদা জিয়া বলেন, আমি দিতে চাই না, সেটা আপনি দিতে চান। শেখ হাসিনা খালেদাকে নিয়ে নিজেদের জাতীয় ঐকমত্যের অবিসংবাদিত প্রতিভূ মনে করেন। খালেদাকেও সেটা ভাবতে বলেন। আমরাও তো কার্যত তাই মানি। সমস্যা হলো ক্ষমতার লোভ। ত্রয়োদশ সংশোধনীর অপব্যবহার করে খালেদা জিয়া এক-এগারোর আগে যা চেয়েছিলেন, শেখ হাসিনা সেটা বাতিল করে চাইছেন।
এ পর্যন্ত যা কিছু ঘটেছে, তাতে কোনো পক্ষই সংলাপ থেকে পিছিয়ে আসার সু-যুক্তি দিতে পারে। খালেদা জিয়া সতর্ক ছিলেন যে, কে সরকারপ্রধান হবেন, তা তিনি শেখ হাসিনার ওপর চাপিয়ে দিতে পারেন না। ৩৪ মিনিটের মাথায় তাই তিনি বলেন, ‘আলোচনায় ঠিক হবে আমার ফর্মুলা থাকবে, না আপনার ফর্মুলা থাকবে।’ শেখ হাসিনাকে খোঁচা দিয়েই খালেদা জিয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা জামায়াতই আপনাকে দেখিয়েছিল। আমরা অনেকে ফোনগেটে হতাশ হতে পারি, দুঃখ পেতে পারি কিন্তু এটাই বাংলাদেশি বাস্তবতা। সংলাপ চাইলে ফোনগেটের লজ্জা বাধা নয়। লজ্জা ও বিড়ম্বনা হবে একতরফা নির্বাচন করলে। কথায় কথায় জেনারেল মইন উ আহমেদকে শাপান্ত করার বিপদ আছে। ব্যবসায়ী নেতাদের কথায়, সমঝোতা না হলে তৃতীয় শক্তি আসতে পারে। ষড়যন্ত্র নয়, তাঁরা হয়তো স্বাভাবিক যুক্তি দিচ্ছেন। পারভেজ মোশাররফ দেশে টিকে যেতে পারেন, কারণ, তিনি ব্যর্থ হলেও দল করেছিলেন। ভবিষ্যতের মইনউদ্দিনেরা দল করার প্রবণতা দেখাবেন।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.