নির্বাচন নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে জাতি বিভ্রান্ত by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
জাতীয়
নির্বাচনকে ঘিরে আলো-আঁধারের খেলাটা ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে
নির্বাচন নিয়ে ধূম্রজাল। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে একেক সময় একেক রকম
বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। একবার বলা হচ্ছে নির্বাচন অক্টোবরে হবে, আবার বলা
হচ্ছে জানুয়ারিতে হবে; একবার বলা হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে হবে,
আবার বলা হচ্ছে দলীয় সরকারের অধীনে হবে। একবার বলা হচ্ছে সংসদ ভেঙে দিয়ে
হবে, আবার বলা হচ্ছে পৃথিবীর যেসব দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র আছে, সেসব দেশে
যেভাবে নির্বাচন হয় বাংলাদেশেও আগামী নির্বাচন সেভাবেই হবে। সর্বশেষ গত ২
আগস্ট সচিবদের সঙ্গে এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪
জানুয়ারির মধ্যে যে কোনো একদিন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তিনি এ-ও
বলেছেন, বর্তমান সংসদ ও মন্ত্রিসভা বহাল থাকা অবস্থায় নির্বাচন হবে। অর্থাৎ
অন্তর্বর্তীও নয়, নির্দলীয়ও নয়; বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন
অনুষ্ঠিত হবে।
অন্যদিকে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে বর্তমান সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারেন। সংবিধান নাকি প্রধানমন্ত্রীকে এই অসীম ক্ষমতা দিয়েছে। এখানে নির্বাচন না হওয়ার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। একই দিনে শাসক দলের দুই নেতার দু’ধরনের বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। তাছাড়া গত ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; ২৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে ২০১২ সালের ৩০ জুলাই লন্ডনে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচনকালে বিরোধী দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দল চাইলে অংশ নিতে পারে। এর কয়েক সপ্তাহ পর ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব থেকে সরে আসেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি বহাল থাকা অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক বক্তব্যে জাতি বিভ্রান্ত। এসব বক্তব্যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অপরিহার্যতার বিষয়টি অনিবার্যভাবে জাতির সামনে পরিস্ফুটিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সরকার ফেঁসে গেছে। এ কারণেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য ব্যক্তিরা সাম্প্রতিককালে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন এবং অহেতুক রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন; যাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলা হয়, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। কারণ নির্বাচন না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে বহাল থাকার এখতিয়ার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এই সংশোধনী একটি দুরভিসন্ধিকে সামনে রেখেই করা হয়েছে, যাতে দেশে নির্বাচন না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অনন্তকাল পদে বহাল থাকতে পারেন। এমন সুবিধা সংবিধান যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে, সেখানে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে কেন তিনি নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে যাবেন?
প্রধানমন্ত্রী যখন মনে করবেন তার দল নির্বাচনে জেতার মতো পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন তিনি নির্বাচনের কথা চিন্তা করতে পারেন- ‘প্রধানমন্ত্রী সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারেন’ কথার তাৎপর্য এখানেই। এখন প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী কি দেশে নির্বাচন না দিয়ে পারবেন? তখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কি তার হাতে থাকবে? সব দল নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলে তিনি একা কী করবেন?
জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের প্রচেষ্টায় রাজনীতিতে যে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে সেই আশা নিরাশায় পর্যবসিত হবে; রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে। এমনিতেই দেশ চরম সংকটে নিপতিত। সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, দেশে একটি গৃহযৃদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছে। এমনটি হলে ধ্বংস হবে মানুষের সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। কাজেই সরকারকে অপরিণামদর্শী রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে। সহনশীল রাজনীতির আবহ তৈরি করতে হবে। সমঝোতার পথ রুদ্ধ করা সরকারের জন্য মোটেই সমীচীন হবে না। এতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তাতে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষমতাসীন দল। কারণ জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে অতীতে কোনো শাসক লাভবান হয়নি। জনগণ চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। নির্বাচন নিয়ে শংকা দূর হোক।
শান্তিতে নেই ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরাও। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ছে, উৎপাদন কমে যাচ্ছে; রফতানি বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন করে উত্তপ্ত হলে আমদানি-রফতানি খাতে দেখা দেবে বিপর্যয়। বন্ধ হবে কল-কারখানা। কর্ম হারিয়ে বেকার হবে হাজার হাজার শ্রমিক। দেখা দেবে সামাজিক বিশৃংখলা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ হবে রুদ্ধ। কাজেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়ার আগে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে; মনে রাখতে হবে, পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত করা সম্ভব। দলীয় সরকারের অধীনে এটি আশা করা অবান্তর। ওই নির্বাচনে বিরোধী দল কোনোভাবেই অংশ নেবে না।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সরকারকে পরিষ্কার জানিয়ে রেখেছেন, বিএনপিকে বাইরে রেখে দলীয় সরকারের অধীনে যে কোনো নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। এর প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তিনি তার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণা খালেদা জিয়াকে নিঃসন্দেহে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ফিরে আসা তার পক্ষে আর কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কঠোর আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া সরকার বিরোধী দলের সামনে আর কোনো পথ খোলা রাখল না।
লক্ষণীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ-সংশয়। এর প্রভাব পড়ে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয় প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন প্রতিপক্ষের কাছে। এতে প্রতীয়মান হয়, এ দেশের মানুষের মাঝে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার খুব ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে; এর প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মানুষের মুখের ভাষা উপলব্ধিতে আনাই দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচায়ক। এটিই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। গণতন্ত্রকে পরিপক্ব করতে হলে মানুষের এ ভাষার প্রতি শাসকদের অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে এবং সহানুভূতিশীল হতে হবে; সর্বোপরি দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। রাজনীতিতে পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে হবে, জয়কে সহিষ্ণুতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই জনগণের কাছে শাসক দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। মানুষ শাসক দলকে নতুন চোখে দেখবে।
শুধু শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করাও অবান্তর। ইচ্ছা থাকলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। কেননা, সারাদেশে প্রায় ৬০ হাজার ভোট কেন্দ্রের ৯ কোটির ওপর ভোটারের ভোট নিশ্চিত করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে তাদের নির্বাচনের আয়োজন করতে হয় আর দলীয় সরকারের অধীনে এসব প্রশাসনযন্ত্র কোনোভাবেই নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। সুতরাং বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এই নির্মোহ সত্যটি শাসক দল যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে, ততই তাদের ও দেশের মঙ্গল।
রাজনৈতিক সহিংসতায় গত কয়েক মাসে অনেক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে একটি নির্বাচন নিয়ে এমন আত্মঘাতী ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে জেনেশুনে কৌশলে জাতিকে ভয়ানক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে; যাতে এ জাতি বিপন্ন জাতিকে পরিণত হয়, বাইরের অপশক্তির হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে কোনো রাজনীতি হতে পারে না। রাজনীতি করতে গিয়ে রাষ্ট্রই যদি বিপন্ন হল, তাহলে রাজনীতি কার স্বার্থে? কাজেই রাজনৈতিক সহিংসতায় আর যেন কোনো প্রাণ ঝরে না যায়, কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
অন্যদিকে দফতরবিহীন মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী চাইলে বর্তমান সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারেন। সংবিধান নাকি প্রধানমন্ত্রীকে এই অসীম ক্ষমতা দিয়েছে। এখানে নির্বাচন না হওয়ার একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। একই দিনে শাসক দলের দুই নেতার দু’ধরনের বক্তব্যে নির্বাচন নিয়ে জনমনে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। তাছাড়া গত ২৩ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, সংবিধান অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়েই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে; ২৭ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় বলেছিলেন, বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এর আগে ২০১২ সালের ৩০ জুলাই লন্ডনে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে নির্বাচনকালে বিরোধী দলের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সরকারের মন্ত্রিসভায় বিরোধী দল চাইলে অংশ নিতে পারে। এর কয়েক সপ্তাহ পর ১৯ সেপ্টেম্বর সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব থেকে সরে আসেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী পদে তিনি বহাল থাকা অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, সংসদ ভেঙে দিয়ে আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আগামী নির্বাচন নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে এসব পরস্পরবিরোধী ও সাংঘর্ষিক বক্তব্যে জাতি বিভ্রান্ত। এসব বক্তব্যে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের অপরিহার্যতার বিষয়টি অনিবার্যভাবে জাতির সামনে পরিস্ফুটিত হচ্ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে সরকার ফেঁসে গেছে। এ কারণেই নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য ব্যক্তিরা সাম্প্রতিককালে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন এবং অহেতুক রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনা সৃষ্টি করছেন; যাতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলা হয়, নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়। কারণ নির্বাচন না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে স্বপদে বহাল থাকার এখতিয়ার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সুনিশ্চিত করা হয়েছে। এই সংশোধনী একটি দুরভিসন্ধিকে সামনে রেখেই করা হয়েছে, যাতে দেশে নির্বাচন না হলেও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অনন্তকাল পদে বহাল থাকতে পারেন। এমন সুবিধা সংবিধান যেখানে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছে, সেখানে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে কেন তিনি নির্বাচনের ঝুঁকি নিতে যাবেন?
প্রধানমন্ত্রী যখন মনে করবেন তার দল নির্বাচনে জেতার মতো পর্যায়ে পৌঁছেছে, তখন তিনি নির্বাচনের কথা চিন্তা করতে পারেন- ‘প্রধানমন্ত্রী সংসদের মেয়াদ বৃদ্ধি করতে পারেন’ কথার তাৎপর্য এখানেই। এখন প্রশ্ন হল, প্রধানমন্ত্রী কি দেশে নির্বাচন না দিয়ে পারবেন? তখন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কি তার হাতে থাকবে? সব দল নির্বাচনের পক্ষে অবস্থান নিলে তিনি একা কী করবেন?
জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের প্রচেষ্টায় রাজনীতিতে যে আশার আলো জ্বলে উঠেছিল, নির্বাচন নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বক্তব্যে সেই আশা নিরাশায় পর্যবসিত হবে; রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়বে। এমনিতেই দেশ চরম সংকটে নিপতিত। সামনে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা কারও কাছেই স্পষ্ট নয়। অনেকে বলছেন, দেশে একটি গৃহযৃদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠছে। এমনটি হলে ধ্বংস হবে মানুষের সব স্বপ্ন ও সম্ভাবনা। কাজেই সরকারকে অপরিণামদর্শী রাজনীতি ত্যাগ করতে হবে। সহনশীল রাজনীতির আবহ তৈরি করতে হবে। সমঝোতার পথ রুদ্ধ করা সরকারের জন্য মোটেই সমীচীন হবে না। এতে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে, তাতে নিঃসন্দেহে ক্ষতিগ্রস্ত হবে ক্ষমতাসীন দল। কারণ জনগণের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে অতীতে কোনো শাসক লাভবান হয়নি। জনগণ চায় নির্দলীয় সরকারের অধীনে সব দলের অংশগ্রহণে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। নির্বাচন নিয়ে শংকা দূর হোক।
শান্তিতে নেই ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীরাও। দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ছে, উৎপাদন কমে যাচ্ছে; রফতানি বাণিজ্যে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন করে উত্তপ্ত হলে আমদানি-রফতানি খাতে দেখা দেবে বিপর্যয়। বন্ধ হবে কল-কারখানা। কর্ম হারিয়ে বেকার হবে হাজার হাজার শ্রমিক। দেখা দেবে সামাজিক বিশৃংখলা। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ হবে রুদ্ধ। কাজেই রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনিশ্চয়তার মধ্যে ঠেলে দেয়ার আগে এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মাথায় রাখতে হবে; মনে রাখতে হবে, পক্ষপাতহীন ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত করা সম্ভব। দলীয় সরকারের অধীনে এটি আশা করা অবান্তর। ওই নির্বাচনে বিরোধী দল কোনোভাবেই অংশ নেবে না।
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া সরকারকে পরিষ্কার জানিয়ে রেখেছেন, বিএনপিকে বাইরে রেখে দলীয় সরকারের অধীনে যে কোনো নির্বাচন প্রতিহত করা হবে। এর প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তিনি তার দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের নির্দেশও দিয়ে রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণা খালেদা জিয়াকে নিঃসন্দেহে পয়েন্ট অব নো রিটার্নে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ফিরে আসা তার পক্ষে আর কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। কঠোর আন্দোলনে যাওয়া ছাড়া সরকার বিরোধী দলের সামনে আর কোনো পথ খোলা রাখল না।
লক্ষণীয়, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিলের পর থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকে। মানুষের ভোটাধিকার নিয়ে তৈরি হয় সন্দেহ-সংশয়। এর প্রভাব পড়ে পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে। অপ্রত্যাশিতভাবে ক্ষমতাসীন দলের জনপ্রিয় প্রার্থীরা শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন প্রতিপক্ষের কাছে। এতে প্রতীয়মান হয়, এ দেশের মানুষের মাঝে নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার খুব ভালোভাবেই জায়গা করে নিয়েছে; এর প্রয়োজনীয়তা এখনও ফুরিয়ে যায়নি।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মানুষের মুখের ভাষা উপলব্ধিতে আনাই দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচায়ক। এটিই গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। গণতন্ত্রকে পরিপক্ব করতে হলে মানুষের এ ভাষার প্রতি শাসকদের অবশ্যই সম্মান দেখাতে হবে এবং সহানুভূতিশীল হতে হবে; সর্বোপরি দেশের স্বার্থকে বড় করে দেখতে হবে। রাজনীতিতে পরাজয়কে সহজভাবে মেনে নিতে হবে, জয়কে সহিষ্ণুতার সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে। তাহলেই জনগণের কাছে শাসক দলের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাবে। হারানো জনপ্রিয়তা পুনরুদ্ধার সম্ভব হবে। মানুষ শাসক দলকে নতুন চোখে দেখবে।
শুধু শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন দিয়ে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আশা করাও অবান্তর। ইচ্ছা থাকলেও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। কেননা, সারাদেশে প্রায় ৬০ হাজার ভোট কেন্দ্রের ৯ কোটির ওপর ভোটারের ভোট নিশ্চিত করার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। সিভিল প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর ওপর নির্ভর করে তাদের নির্বাচনের আয়োজন করতে হয় আর দলীয় সরকারের অধীনে এসব প্রশাসনযন্ত্র কোনোভাবেই নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। সুতরাং বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত রাখতে ও গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। এই নির্মোহ সত্যটি শাসক দল যত তাড়াতাড়ি উপলব্ধি করবে, ততই তাদের ও দেশের মঙ্গল।
রাজনৈতিক সহিংসতায় গত কয়েক মাসে অনেক সম্পদ ধ্বংস হয়েছে, অনেক প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই জাতি ও ধর্মের মানুষের মধ্যে একটি নির্বাচন নিয়ে এমন আত্মঘাতী ঘটনা অত্যন্ত দুঃখজনক। সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, ক্ষমতার পালাবদলকে কেন্দ্র করে জেনেশুনে কৌশলে জাতিকে ভয়ানক বিভক্তির দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে; যাতে এ জাতি বিপন্ন জাতিকে পরিণত হয়, বাইরের অপশক্তির হস্তক্ষেপ অনিবার্য হয়। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রকে বিপন্ন করে কোনো রাজনীতি হতে পারে না। রাজনীতি করতে গিয়ে রাষ্ট্রই যদি বিপন্ন হল, তাহলে রাজনীতি কার স্বার্থে? কাজেই রাজনৈতিক সহিংসতায় আর যেন কোনো প্রাণ ঝরে না যায়, কোনো মায়ের বুক খালি না হয়।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments