ক্ষমতার পালাবদল, না রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন? by বিভুরঞ্জন সরকার
নবম
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে অনেকেই এ কথা বলেছিলেন যে,
দেশের তরুণ সমাজ বা নতুন ভোটাররা ব্যাপকভাবে পরিবর্তনের পক্ষে ভোট দিয়েছেন
বলেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বড় ধরনের বিজয় অর্জন করেছে।
অপরাধমুক্ত, ন্যায়ভিত্তিক একটি সমাজ প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা তরুণদের মধ্যে
প্রবল বলেই ধারণা করা যায়। পুরো ধারার রাজনীতি তাদের কাম্য নয়। তাছাড়া
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তরুণ সমাজের অনেকেই বলিষ্ঠ অবস্থান নিয়েছে।
দেশের রাজনীতির ব্যাপারে তরুণদের একেবারেই আগ্রহ নেই বলে এতদিন যা বলা
হয়েছে তা হয়তো যথার্থ নয়। বিদ্যমান রাজনীতি নিয়ে, দেশ পরিচালনার পদ্ধতি
নিয়ে, প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনৈতিক মানসিকতা নিয়ে তরুণদের মধ্যে নিশ্চয়ই
প্রশ্ন আছে, আছে দ্বিধা-সংশয়। তবে সব ব্যাপারে যে তারা একেবারে উদাসীন নয়,
দেশ ও সমাজ নিয়ে তাদের কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই তেমনটি ভাবার কারণ নেই।
২০০৮-এর নির্বাচনে তরুণদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থেকে বোঝা গেছে, তারা যথেষ্ট
সমাজমনস্ক। তাদের এ সমাজমনস্কতার সবচেয়ে বড় বহিঃপ্রকাশ দেখা গেছে এ বছর
শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চে। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ যারা সংঘটিত
করেছিলেন, তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে রাস্তায় নেমে তরুণরা প্রমাণ
করেছেন, তারা দেশভাবনায় কতটা আন্তরিক ও অগ্রসর।
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশের রাজনীতিতে সুস্থ ধারা বিকশিত হচ্ছে না, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বিকাশের পরিবর্তনে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, ইচ্ছাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উৎকট প্রতিযোগিতা চলছে। কালো টাকা, পেশিশক্তির দাপটে সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদরা ক্রমেই পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছেন। হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি-রেষারেষি এবং আধিপত্য বিস্তারের কদর্য প্রতিযোগিতা রাজনীতিকে গ্রাস করে নেয়ায় কেবল তরুণ সমাজ কেন, অনেকেই রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়েছেন। ভোগলিপ্সার চরম বিস্তার, বিত্তবান হওয়ার রাক্ষুসে প্রবণতা ব্যাপক জনগোষ্ঠীকেই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উচ্চ আশা পোষণ থেকে বিরত রেখেছে। ‘এই দেশের কিচ্ছু হবে না, দেশে থেকে কিচ্ছু করা যাবে না’ এমন মানসিকতা তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবেই পেয়ে বসেছে। দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ মন থেকে বিতাড়িত হওয়ায় যে কোনো উপায়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছে অনেকেই। তবে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা এবং জঙ্গিবাদের বিস্তারের পর পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি সম্ভবত এদেশের তরুণদের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাতে এবং কিছুটা দেশমুখী হতে সহায়তা করেছে। বিদেশ মানেই উন্নত জীবনের হাতছানি, নিশ্চিত ভালো থাকা- এ বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য দেশকেই প্রথমে আপন করে নিতে হবে- এ ভাবনা থেকেই তরুণরা আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়ে শেকড়ের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এজন্যই হয়তো বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তারা অনুসন্ধিৎসু হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সম্পর্কে তাদের মনের মধ্যে ঘৃণাবোধ জন্মেছে।
মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছে, যারা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে, রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী গঠন করে বাঙালি নিধনে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে, তাদের বিচারের দাবি উঠলে অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘এত বছর পরে এসে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে জাতিকে বিভক্ত করা ঠিক না। এখন পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ এসব কথা এক ধরনের চালাকি। এভাবে সব ক্ষেত্রে অতীতকে উপেক্ষা করার ফল ভালো হয় না। ইতিহাসের একটি বড় সত্য ভুলে থেকে, এদেশের কিছু কুলাঙ্গারের দেশদ্রোহী ভূমিকাকে অস্বীকার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ হতে পারে না। জাতির বিভক্তিও এভাবে দূর হয় না। কঠিন হলেও সত্যের মুখোমুখি না হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না।
এটা ঠিক যে, ক্ষমতায় গিয়ে কথা না রাখার ঐতিহ্য তৈরি করার জন্যই তরুণ সমাজসহ অনেকেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্যই তরুণরা গত নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছে। তারা রাজনীতিতে পালাবদল দেখতে চেয়েছে। যারা নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন, তারাও গত নির্বাচনের পর কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়, তারপর নব্বইয়ের পরিবর্তনের সময় মানুষের মধ্যে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, সক্রিয়তা দেখা দিয়েছিল, তা স্থায়ী হয়নি নেতৃত্বের ভুলের কারণেই। মানুষের শক্তির ওপর নির্ভর না করে রাজনীতি কালো টাকা, পেশিশক্তি, আমলাতন্ত্র, ধর্মব্যবসায়ীসহ নানা রকম অপশক্তিনির্ভর হওয়ায় মানুষের হতাশা দূর হচ্ছে না। শেখ হাসিনার এবারের সরকারও রাজনীতিতে নতুন হাওয়া যোগ করতে পারলেন না। তিনিও নিজেকে পুরনো ধারায়ই শামিল করলেন।
প্রতিহিংসার রাজনীতি, ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে দেশের রাজনীতি যে বেরিয়ে আসতে পারল না, সেটা এক গভীর বেদনার বিষয়। দিনবদলের অঙ্গীকার করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন খুব একটা আনতে পারেনি। মানুষের সৃজনশীলতা ও সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সম্প্রসারিত না করে এক ধরনের মূঢ়তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার প্রচলিত ব্যবস্থাকে বর্তমান সরকারও অনুসরণ করেছে। এ সরকার উন্নয়নমূলক কাজকর্ম যথেষ্ট করেছে, কিন্তু সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়েনি। একদিকে ভালো কাজ, অন্যদিকে খারাপ মানুষদের প্রশ্রয় দেয়া- এ বিপরীত দুই ঘটনা মানুষকে আহত করেছে। তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে। সরকার কতটা ভালো করেছে, আর খারাপ কতটা- সে সম্পর্কে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক করা যেতে পারে, ধারাবাহিক গবেষণাও চলতে পারে। তবে তাতে মানুষ উৎসাহ বোধ করবে না। এ মুহূর্তে যা করণীয় তা হল, রাজনীতিকে বেশি বেশি জনসম্পৃক্ত করার উপায় খুঁজে বের করা। মানুষকে দূরে ঠেলে নয়, কাছে টেনেই পরিবর্তনের দিকে রাজনীতির মুখ ফেরাতে হবে। ভবিষ্যতে যারা জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন তারা যাতে অধিকাংশ সময় জনগণের সঙ্গেই থাকেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদ অধিবেশন চলার সময় বা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনী এলাকার বাইরে অবস্থান নিরুৎসাহিত করতে হবে। নির্বাচনী এলাকায় যারা অতিথি হয়ে যাওয়া-আসা করেন তাদের আর মনোনয়ন দেয়া চলবে না- এ অতিথি রাজনীতিবিদদের কারণেই মূলত এলাকায় পোড় খাওয়া কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়, গড়ে ওঠে বিশেষ কোটারিগোষ্ঠী। কোনো জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা থাকে না বলে এরা সাধারণত ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতেই সচেষ্ট থাকে। ব্যক্তিগতভাবে এরা লাভবান হয় ঠিকই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল ও সরকার। এ ধারা বদলানোর অঙ্গীকার এবার নির্বাচনের আগে করতে হবে।
দেশের রাজনীতির ইতিহাসটাও নতুন প্রজন্মের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা দরকার। ক্রমাগত বিকৃত প্রচার-প্রচারণার ফলে অনেকের মধ্যেই স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তি আছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রথম সরকারের কাজকর্ম নিয়ে যেমন স্বচ্ছ ধারণার অভাব আছে, তেমনি পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতি নিয়েও আছে ভ্রান্তি। বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু সে জন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ করে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে কারা উপকৃত ও লাভবান হয়েছে সে সম্পর্কে দেশবাসীর সামনে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা দরকার। কাউকে দেবতা কিংবা কাউকে দানব বানানো নয়, যিনি যেমন তাকে সেভাবেই চিত্রিত না করলে সঠিক ইমেজে দাঁড় করানো যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, জিয়াউর রহমান কোন বিবেচনায় প্রশংসিত এবং নন্দিত? কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জিয়া দেশের শাসন ক্ষমতা কব্জা করেছিলেন? জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক অসততার অভিযোগ হয়তো নেই, কিন্তু দেশে সবধরনের রাজনৈতিক অসততার জনক তো তিনিই। জিয়াউর রহমান দেশের প্রথম সামরিক শাসক। তিনি দালাল আইন প্রত্যাহার করেছেন। নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কুখ্যাত গোলাম আযমকে দেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন। রাজাকার-আলবদরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শাহ আজিজ, মাওলানা মান্নানকে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী বানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের চাকরি দিয়ে বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দিয়েছেন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে সেনাবাহিনীতে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন। হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করে ভোট দুর্নীতির সূচনা করেছেন। মেধাবী ছাত্রদের হিজবুল বাহারে চড়িয়ে বিপথগামী করেছেন। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। দল ভাঙার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছেন। আরও কত কী! এসব প্রশ্ন বাইরে রেখে রাজনীতি সুস্থ করা যাবে না।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসেও রাজনীতিতে ভালো কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। অবশ্য পুরনো ব্যবস্থা, চিন্তাধারা, মনমানসিকতা বদলে ফেলাটা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকা দরকার। সেটা শেখ হাসিনার সরকারেরও নেই। দল ক্ষমতায় এলেই একশ্রেণীর নেতাকর্মীর মধ্যে লোভ-প্রলোভন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরা সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের চেয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে অতি তৎপর হয়। এগুলো সবার চোখে লাগে। আমাদের সম্পদ সীমিত। তাছাড়া সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থাও সুষম নয়। ধনী-গরিবের উৎকট বৈষম্য কোনোভাবেই আড়াল করা যায় না। যায় না সবাইকে খুশি করা। তৈরি হয় ক্ষোভ-হতাশা। অন্যদিকে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যেও রয়েছে প্রবল মতপার্থক্য, বিভাজন। দেশের অগ্রগতি-উন্নতির প্রশ্নে ঐকমত্য গড়ে ওঠে না। এ দুই দলের মধ্যে বন্ধুসুলভ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে শত্র“তামূলক মনোভাব অত্যন্ত প্রকট। বঙ্গবন্ধু হত্যা, একুশ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা ইত্যাদি বিষয়ে বিএনপির অবস্থান দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমানোর পথে বড় অন্তরায়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জটিলতার নিরসন করা না যায়, তাহলে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে। সরকার চায় সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে। বিরোধী দল চায়- নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিরোধী দলের দাবির পক্ষে জনমতের পাল্লা ভারি বলেই মনে হয়। কী অদ্ভুত আমাদের যুক্তিবোধ! আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারবে না বা সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়- এ বক্তব্যের সমর্থনে কেউ কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারছে না। অথচ অনুমাননির্ভর একটি অভিযোগ দিয়েই রাজনীতিতে চলছে তোলপাড়। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না। এ আশংকাকে যদি সত্য বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি কি অধিক গণতন্ত্রী দল? এ ধরনের অসত্য প্রচারণা চালিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হলেও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হবে কি? অতীতে অপপ্রচার, মিথ্যাচার আমাদের রাজনীতির অনেক ক্ষতি করেছে। আগামী নির্বাচনে ভোটাররা বিশেষ করে নারী এবং তরুণ ভোটাররা আবেগ, নাকি যুক্তিবুদ্ধি দ্বারা তাড়িত হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, তার ওপর রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের অনেক কিছুই নির্ভর করবে।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
এ কথা অস্বীকার করা যাবে না যে, দেশের রাজনীতিতে সুস্থ ধারা বিকশিত হচ্ছে না, গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনার বিকাশের পরিবর্তনে স্বেচ্ছাচারী মনোভাব, ইচ্ছাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উৎকট প্রতিযোগিতা চলছে। কালো টাকা, পেশিশক্তির দাপটে সৎ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদরা ক্রমেই পর্দার আড়ালে চলে যাচ্ছেন। হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি-রেষারেষি এবং আধিপত্য বিস্তারের কদর্য প্রতিযোগিতা রাজনীতিকে গ্রাস করে নেয়ায় কেবল তরুণ সমাজ কেন, অনেকেই রাজনীতি থেকে আগ্রহ হারিয়েছেন। ভোগলিপ্সার চরম বিস্তার, বিত্তবান হওয়ার রাক্ষুসে প্রবণতা ব্যাপক জনগোষ্ঠীকেই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে উচ্চ আশা পোষণ থেকে বিরত রেখেছে। ‘এই দেশের কিচ্ছু হবে না, দেশে থেকে কিচ্ছু করা যাবে না’ এমন মানসিকতা তরুণ সমাজকে ব্যাপকভাবেই পেয়ে বসেছে। দেশপ্রেম, স্বাজাত্যবোধ মন থেকে বিতাড়িত হওয়ায় যে কোনো উপায়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর মানসিকতায় আচ্ছন্ন হয়েছে অনেকেই। তবে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলা এবং জঙ্গিবাদের বিস্তারের পর পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি সম্ভবত এদেশের তরুণদের আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাতে এবং কিছুটা দেশমুখী হতে সহায়তা করেছে। বিদেশ মানেই উন্নত জীবনের হাতছানি, নিশ্চিত ভালো থাকা- এ বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে। সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য দেশকেই প্রথমে আপন করে নিতে হবে- এ ভাবনা থেকেই তরুণরা আত্মজিজ্ঞাসার মুখোমুখি হয়ে শেকড়ের সন্ধানে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। এজন্যই হয়তো বাঙালির জাতীয় জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন মুক্তিযুদ্ধের বিষয়ে তারা অনুসন্ধিৎসু হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীদের সম্পর্কে তাদের মনের মধ্যে ঘৃণাবোধ জন্মেছে।
মুক্তিযুদ্ধের যারা বিরোধিতা করেছে, যারা পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসেবে কাজ করেছে, রাজাকার-আলবদর-আলশামস বাহিনী গঠন করে বাঙালি নিধনে সক্রিয় সহযোগিতা করেছে, তাদের বিচারের দাবি উঠলে অনেককেই বলতে শোনা যায়, ‘এত বছর পরে এসে অতীত নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে জাতিকে বিভক্ত করা ঠিক না। এখন পেছনে না তাকিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’ এসব কথা এক ধরনের চালাকি। এভাবে সব ক্ষেত্রে অতীতকে উপেক্ষা করার ফল ভালো হয় না। ইতিহাসের একটি বড় সত্য ভুলে থেকে, এদেশের কিছু কুলাঙ্গারের দেশদ্রোহী ভূমিকাকে অস্বীকার করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ মসৃণ হতে পারে না। জাতির বিভক্তিও এভাবে দূর হয় না। কঠিন হলেও সত্যের মুখোমুখি না হয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায় না।
এটা ঠিক যে, ক্ষমতায় গিয়ে কথা না রাখার ঐতিহ্য তৈরি করার জন্যই তরুণ সমাজসহ অনেকেই রাজনীতি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটানোর জন্যই তরুণরা গত নির্বাচনে ব্যাপকভাবে ভোট দিয়েছে। তারা রাজনীতিতে পালাবদল দেখতে চেয়েছে। যারা নতুন স্বপ্ন দেখার সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন, তারাও গত নির্বাচনের পর কিছুটা আশাবাদী হয়ে উঠেছিলেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময়, তারপর নব্বইয়ের পরিবর্তনের সময় মানুষের মধ্যে যে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছিল, সক্রিয়তা দেখা দিয়েছিল, তা স্থায়ী হয়নি নেতৃত্বের ভুলের কারণেই। মানুষের শক্তির ওপর নির্ভর না করে রাজনীতি কালো টাকা, পেশিশক্তি, আমলাতন্ত্র, ধর্মব্যবসায়ীসহ নানা রকম অপশক্তিনির্ভর হওয়ায় মানুষের হতাশা দূর হচ্ছে না। শেখ হাসিনার এবারের সরকারও রাজনীতিতে নতুন হাওয়া যোগ করতে পারলেন না। তিনিও নিজেকে পুরনো ধারায়ই শামিল করলেন।
প্রতিহিংসার রাজনীতি, ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে দেশের রাজনীতি যে বেরিয়ে আসতে পারল না, সেটা এক গভীর বেদনার বিষয়। দিনবদলের অঙ্গীকার করে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে গুণগত পরিবর্তন খুব একটা আনতে পারেনি। মানুষের সৃজনশীলতা ও সুকুমার বৃত্তিগুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ সম্প্রসারিত না করে এক ধরনের মূঢ়তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়ার প্রচলিত ব্যবস্থাকে বর্তমান সরকারও অনুসরণ করেছে। এ সরকার উন্নয়নমূলক কাজকর্ম যথেষ্ট করেছে, কিন্তু সুশাসন নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হওয়ায় সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা বাড়েনি। একদিকে ভালো কাজ, অন্যদিকে খারাপ মানুষদের প্রশ্রয় দেয়া- এ বিপরীত দুই ঘটনা মানুষকে আহত করেছে। তাদের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়েছে। সরকার কতটা ভালো করেছে, আর খারাপ কতটা- সে সম্পর্কে বিস্তর তর্ক-বিতর্ক করা যেতে পারে, ধারাবাহিক গবেষণাও চলতে পারে। তবে তাতে মানুষ উৎসাহ বোধ করবে না। এ মুহূর্তে যা করণীয় তা হল, রাজনীতিকে বেশি বেশি জনসম্পৃক্ত করার উপায় খুঁজে বের করা। মানুষকে দূরে ঠেলে নয়, কাছে টেনেই পরিবর্তনের দিকে রাজনীতির মুখ ফেরাতে হবে। ভবিষ্যতে যারা জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন তারা যাতে অধিকাংশ সময় জনগণের সঙ্গেই থাকেন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সংসদ অধিবেশন চলার সময় বা জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জনপ্রতিনিধিদের নির্বাচনী এলাকার বাইরে অবস্থান নিরুৎসাহিত করতে হবে। নির্বাচনী এলাকায় যারা অতিথি হয়ে যাওয়া-আসা করেন তাদের আর মনোনয়ন দেয়া চলবে না- এ অতিথি রাজনীতিবিদদের কারণেই মূলত এলাকায় পোড় খাওয়া কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়, গড়ে ওঠে বিশেষ কোটারিগোষ্ঠী। কোনো জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতা থাকে না বলে এরা সাধারণত ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতেই সচেষ্ট থাকে। ব্যক্তিগতভাবে এরা লাভবান হয় ঠিকই কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় দল ও সরকার। এ ধারা বদলানোর অঙ্গীকার এবার নির্বাচনের আগে করতে হবে।
দেশের রাজনীতির ইতিহাসটাও নতুন প্রজন্মের কাছে বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরা দরকার। ক্রমাগত বিকৃত প্রচার-প্রচারণার ফলে অনেকের মধ্যেই স্বাধীনতা-পরবর্তী রাজনীতি নিয়ে নানারকম বিভ্রান্তি আছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রথম সরকারের কাজকর্ম নিয়ে যেমন স্বচ্ছ ধারণার অভাব আছে, তেমনি পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতি নিয়েও আছে ভ্রান্তি। বঙ্গবন্ধু এবং তার সরকারের সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতা নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু সে জন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার মতো জঘন্য কাজ করে ইতিহাসের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে কারা উপকৃত ও লাভবান হয়েছে সে সম্পর্কে দেশবাসীর সামনে বিস্তারিত তথ্য উপস্থাপন করা দরকার। কাউকে দেবতা কিংবা কাউকে দানব বানানো নয়, যিনি যেমন তাকে সেভাবেই চিত্রিত না করলে সঠিক ইমেজে দাঁড় করানো যায় না। প্রশ্ন হচ্ছে, জিয়াউর রহমান কোন বিবেচনায় প্রশংসিত এবং নন্দিত? কোন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জিয়া দেশের শাসন ক্ষমতা কব্জা করেছিলেন? জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক অসততার অভিযোগ হয়তো নেই, কিন্তু দেশে সবধরনের রাজনৈতিক অসততার জনক তো তিনিই। জিয়াউর রহমান দেশের প্রথম সামরিক শাসক। তিনি দালাল আইন প্রত্যাহার করেছেন। নিজে মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী কুখ্যাত গোলাম আযমকে দেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দিয়েছেন। রাজাকার-আলবদরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী শাহ আজিজ, মাওলানা মান্নানকে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী বানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বঘোষিত খুনিদের চাকরি দিয়ে বিদেশে নিরাপদ জীবনযাপনের সুযোগ করে দিয়েছেন। মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে প্রহসনের বিচারে ফাঁসি দিয়েছেন। অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করে সেনাবাহিনীতে নিজের কর্তৃত্ব বজায় রেখেছেন। হ্যাঁ-না ভোটের আয়োজন করে ভোট দুর্নীতির সূচনা করেছেন। মেধাবী ছাত্রদের হিজবুল বাহারে চড়িয়ে বিপথগামী করেছেন। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। দল ভাঙার রাজনৈতিক সংস্কৃতি চালু করেছেন। আরও কত কী! এসব প্রশ্ন বাইরে রেখে রাজনীতি সুস্থ করা যাবে না।
আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ক্ষমতায় এসেও রাজনীতিতে ভালো কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। অবশ্য পুরনো ব্যবস্থা, চিন্তাধারা, মনমানসিকতা বদলে ফেলাটা খুব সহজ কাজ নয়। এর জন্য সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা থাকা দরকার। সেটা শেখ হাসিনার সরকারেরও নেই। দল ক্ষমতায় এলেই একশ্রেণীর নেতাকর্মীর মধ্যে লোভ-প্রলোভন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এরা সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের চেয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে অতি তৎপর হয়। এগুলো সবার চোখে লাগে। আমাদের সম্পদ সীমিত। তাছাড়া সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থাও সুষম নয়। ধনী-গরিবের উৎকট বৈষম্য কোনোভাবেই আড়াল করা যায় না। যায় না সবাইকে খুশি করা। তৈরি হয় ক্ষোভ-হতাশা। অন্যদিকে দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক শক্তির মধ্যেও রয়েছে প্রবল মতপার্থক্য, বিভাজন। দেশের অগ্রগতি-উন্নতির প্রশ্নে ঐকমত্য গড়ে ওঠে না। এ দুই দলের মধ্যে বন্ধুসুলভ প্রতিযোগিতার পরিবর্তে শত্র“তামূলক মনোভাব অত্যন্ত প্রকট। বঙ্গবন্ধু হত্যা, একুশ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা ইত্যাদি বিষয়ে বিএনপির অবস্থান দুই দলের মধ্যে দূরত্ব কমানোর পথে বড় অন্তরায়। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট থেকেই নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে জটিলতা দেখা দিয়েছে। যদি আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে জটিলতার নিরসন করা না যায়, তাহলে দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে বলেও আশংকা প্রকাশ করা হচ্ছে। সরকার চায় সাংবিধানিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন করতে। বিরোধী দল চায়- নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন। বিরোধী দলের দাবির পক্ষে জনমতের পাল্লা ভারি বলেই মনে হয়। কী অদ্ভুত আমাদের যুক্তিবোধ! আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে মানুষ অবাধে ভোট দিতে পারবে না বা সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়- এ বক্তব্যের সমর্থনে কেউ কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারছে না। অথচ অনুমাননির্ভর একটি অভিযোগ দিয়েই রাজনীতিতে চলছে তোলপাড়। বলা হচ্ছে, আওয়ামী লীগ দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না। এ আশংকাকে যদি সত্য বলে ধরে নেয়া হয়, তাহলে বলতে হবে, আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপি কি অধিক গণতন্ত্রী দল? এ ধরনের অসত্য প্রচারণা চালিয়ে ক্ষমতার পালাবদল হলেও রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হবে কি? অতীতে অপপ্রচার, মিথ্যাচার আমাদের রাজনীতির অনেক ক্ষতি করেছে। আগামী নির্বাচনে ভোটাররা বিশেষ করে নারী এবং তরুণ ভোটাররা আবেগ, নাকি যুক্তিবুদ্ধি দ্বারা তাড়িত হয়ে ভোটাধিকার প্রয়োগ করবে, তার ওপর রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের অনেক কিছুই নির্ভর করবে।
বিভুরঞ্জন সরকার : সাংবাদিক ও কলাম লেখক
No comments